.
(২)
ভাই গজেনদা,
তোমার বই পড়ছিলুম। বহুকাল পূর্বে (১৯২১) দ্বিজেন্দ্রনাথ বড়বাবু আমাকে বলেন, কথাটা কষ্টে সৃষ্টে নয়; হবে কষ্টে শ্রেষ্ঠে। তিনি কী কী যুক্তি দিয়েছিলেন আজ আর মনে নেই। আমার মনে হয় কষ্টে সৃষ্ট না হয় বোঝা গেল, কিন্তু কষ্টে সৃষ্টেরএকারটা এল কোত্থেকে? তদুপরি by itselfকষ্টে সূষ্টে ঠিক মানে কী ধরে? আমরা আজকাল তো বুঝিঅতিকষ্টে। এবংঅতিকষ্টে সক্ষম হয়েছি অর্থাৎ সৃষ্টি করেছি। তা হলে তো, অতি কষ্টে সৃষ্টে কাজটা করতে পেরেছি অর্থ দাঁড়ায়, অতি কষ্টে সৃষ্ট সৃষ্টি করেছি। ডবল ডবল পুনরাবৃত্তি। অথচ কষ্টে শ্রেষ্ঠে, সুখে দুঃখে, হাসি কান্নায়, তকলিফে বেতকলিফে কাজটা সেরেছি– এটাই তো ভালো।
তাই তোমার বইয়ের (পৌষ-ফাগুনের পালা) p. 524, line4-এ গাঁইয়া উচ্চারণে কষ্টসৃষ্ট নতুন করে প্রশ্নটা মনে তুলল।
তুমি এসব শব্দ সমাস নিয়ে মাথা ঘামাও, তাই আরেকটা বলি : চুল চেরা বোধহয় আসলে ছিল চুন-চেরা –ফারসিতে আছে– ওই একার্থে। কখন? কেন (চেরা)? বলে অযথা সূক্ষ্মতর্ক করা। নটা কি ভুলেল হয়ে গিয়েছে। অবশ্য চুলচেরা by itself সুন্দর image মনের চোখে আনে– কিন্তু সংস্কৃতাদিতে এর নজির নেই!
Happy New Year
—আ ॥
পুনঃ ব্যবহারিক (না ব্যাবহারিক) শব্দকোষ সম্বন্ধে আমার সতর্কবাণী পেয়েছ? উত্তর কই?
.
[ শ্রীনারায়ণ সান্যালকে লিখিত পত্র ॥
৪ঠা ভাদ্র ১৩৭৩
প্রিয়বরেষু,
আজকের ভাষায় যাকেরসোত্তীর্ণ, আপনার সত্যকাম তাই হয়েছে কি না সে বিচার না করে প্রথমেই বলি, এই obscurantism ও revivalism-এর যুগে আপনি এ-পুস্তক লিখে বাঙালি হিন্দুর চোখে জ্ঞানাঞ্জন লাগাবার চেষ্টা করেছেন। সে যদি অঞ্জন মাখতে না চায়– আশা করি ইতোমধ্যে ভট্টপল্লি তথা নবদ্বীপে স্মার্ত সমাজ par excellence আপনাকে হুনো দেননি– তবে সে-দোষ আপনার নয়। এখনও যে দেশে বারেন্দ্র-রাঢ়ী-বৈদিকে সহজে বিয়ে হয় না; পূর্ববঙ্গের শরণাগত গুহ রাঢ়ী ঘোষ-বোস দ্বারা কুলীন বলে স্বীকৃত হয় না, কায়েত মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে বামুনবাড়ি গেলে এবং এ ব্যাটাদের তিন পুরুষের কেউ সন্ধ্যাহ্নিক করেনি, কিঞ্চিৎ এ-পুরুষ পঞ্চমকারে আকণ্ঠ নিমগ্ন– খড়মপেটা হওয়ার সম্ভাবনা, বিয়ের মরসুমে যে-সব নিমন্ত্রণপত্র আসে সেগুলো আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি, কটা অসবর্ণ বিয়ে হল তার শুমারি, % রাখার চেষ্টা করি। আমার এক অনুজপ্রতিম বারেন্দ্র (আপনারই মতো সান্ন্যাল) মুখুয্যে শাদি করেছে। সে-দেশে সত্যকামের কাহিনী স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রতি ধর্মভীরু দ্বিজের কর্তব্য। আপনি সেই কর্মটি অতি সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছেন। আপনাকে অভিনন্দন জানাই, শতংজীব; সহস্ৰজীব, শঙ্কর আপনাকে জয়যুক্ত করুন।
আপনি আদৌ ভাববেন না, আমি কৌলিক ঐতিহ্য তথা আচার-অনুষ্ঠান বাবদে চার্বাক-পন্থী। কিন্তু সে কাহিনী এখানে তুলব না।
সত্যকাম তথা অন্য বহুবিধ কারণে যেসব ব্রাহ্মণ এবং ব্রাহ্মণের উপনয়ন হয়নি, (অর্থাৎ, বিশেষ করে, যে-সব অব্রাহ্মণকে ব্রাহ্মণ পর্যায়ে তুলতে হবে। তাদের নিয়ে ব্রাত্য–সে তো আপনি আমার চেয়ে ঢের বেশি জানেন। এক জর্মন পণ্ডিত ঝাড়া বিশটি বছর খেটে (কারণ ব্রাত্যদের সম্বন্ধে তথ্য হেথা-হোথা সর্বত্র ছড়ানো) পঁচিশ পাতার কেঁদো কেতাব লেখেন, নাম স্রেফ ব্রাত্য। আমার বড়ই বাসনা ছিল, কেউ বইখানার অনুবাদ করে। হিন্দু উপকৃত হত। দেখত সে একদা কতখানি dynamic, catholic ছিল, শুধু যুক্তি দিয়ে বিচার করত না (আপনার কথায় যে সত্যের পিছনে, শিব সুন্দর নেই– সেটা বেকার) হৃদয়ের logic-ও শুনত, বলত : if tradition (স্মৃতি) help us, good! If not, without it and so much the better! আর আজ!
আপনি সত্যকামের কাহিনী বললেন (আজকাল দিনের লোক উপনিষদ মাথায় থাকুন, রবিঠাকুরও পড়ে না–তাই উঠিলা গৌতম ঋষি ছাড়িয়া আসন লাইনগুলো কেতাবের পয়লা বা আখেরে দিলে ভালো করতেন, মায় উপন্যাসটির নাম), রামমোহনও শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে সতীদাহ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন, agnostic বিদ্যেসাগরও শাস্ত্রের দোহাই দেন। তখন বঙ্কিম (for whose religious views I have little understanding, except that possa which is a mervellously written book with a very wrong thesis to prove!) তাঁকে লেখেন, আপনি শাস্ত্রের আশ্রয় নিচ্ছেন কেন? শাস্ত্র কেউ মানে না। মানে লোকাচার। আপনি তাই Humanitarian grounds-এর ওপর নির্ভর করুন। বিদ্যাসাগর খুবসম্ভব কোনও উত্তর দেননি। তিনি জানতেন, শাস্ত্রের বরাত দিলে তবু-বা কিছু হতে পারে। Rational, humanitarian consideration have precious little chance.
অর্থাৎ Voltaire-এর যুগ এই পোড়া বাঙলা দেশে এখনও আসেনি। আমার জানা মতে ১নং চৈতন্য, ২নং বিবেকানন্দ– সাহস যা দেখাবার, to rebel against শাস্ত্র, এঁরাই কিছুটা দেখিয়েছেন।
মুসলমানের ভিতর, গোড়ার দিকে, কিছুটা দেখান আকরম খাঁ। মোল্লাদের হুনো খেয়ে সে-বই আর reprint করেননি। নজরুল ইসলাম গোড়ায় বিদ্রোহী, শেষের দিকে very traditionalist!
এবারে আপনি একটু Voltaire পড়ুন। বিশেষ করে CANDID.