উৎসাহের কারণ :
(১) তোমার মা বলেছেন,
(২) দেখলুম, তোমার বয়স যখন ১২। ১৪ হবে, তখন আমি তো এ-লোকে থাকব না; তাই তোমার জন্য তোমার ওই বয়সের উপযোগী কিছু লিখে রেখে গেলে তুমি খুশি হবে। উপস্থিত জলে ডাঙায় বসুমতীতে বেরুচ্ছে।
আজ এখানে শেষ বর্ষা যাচ্ছে। এখানে এটাকে হাতিয়া নক্ষত্রের বৃষ্টি বলে। এর পর নাকি এদেশে আর বৃষ্টি হয় না।
চওড়া বারান্দায় বসে শুনছি, ঝিল্লির ঝিলিমিলি, তার সঙ্গে ব্যাঙের কর ক কর কর। সামনের দেয়ালে বেড়ে ওঠা মধুমালতীলতা দুলছে, লাল-সাদায় মেশানো ফুলগুলো কাঁপছে– দাঁড়াও, এই লতাকে যে মধুমালতী বলা হয় তার কোনও হদিস নেই। কারণ এগুলো তো এসেছে রেঙ্গুন থেকে এখনও একশো বছর হয়নি। অথচ মধুমালতী প্রাচীন নাম। ইংরেজিতে একে বলে Rangoon Creepers (ইংরেজিতেশিউলিকে বলে Sorrow Flowers, টগরকে বলে Twister Jasmine, বেলকে বলে wood apple, সজনেভঁাটাকে বলৈ Drum sticks, ব্লাড়শকে বলে Ladys fingers. এগুলো ইংলন্ডে নেই বলে কোনও ইংরেজ এগুলো বুঝবে না, অর্থাৎ এগুলো Anglo-Indian শব্দ)। ঠিক ওই রকম মাধবী কি ফুল কেউ জানে না। গুরুদেব এক নাম-না জানা লতাকে মাধবী নাম দেন। তার পর গান রচেন, হে মাধবী দ্বিধা কেন?পারুলও তাই। কেউ জানে না ওটা কোন ফুল। শান্তিনিকেতনের কাছে যে পারুল বন আছে সেটা গুরুদেবের দেওয়া নাম। এখানকার ফুল সত্যই পারুল কি না, কেউ জানে না।
ভেবেছিলুম বর্ষার মোলায়েম বর্ণনা দিয়ে তোমাকে আজ গল্প বলব। তা আর হল না। পারুল মাধবীর শব্দতত্ত্ব নিয়ে সময় কেটে গেল।
কিন্তু আজ সত্যই মেদুর সন্ধ্যা। আজ সপ্তমী। এখন আটটা বেজেছে। সপ্তমীর চাঁদ কখন ওঠে ঠিক জানিনে। বাইরে অন্ধকারটা জমাট নয়। আকাশ যেন কোনও ঘোর রঙের চশমা পরে তাকিয়ে আছে। বাতাস যেন ভিজে কথা পরে আমার চতুর্দিকে ঘোরাফেরা করছে। দু-এক ফোঁটা জল আমার লেখাকে চুপসে দিচ্ছে। সেক্রেটারিয়েটের ঘড়ি আটটা হাঁকছে। শামাপোকা জোরালো বাতির চতুর্দিকে ঘুরছে। ডানাগুলো আস্বচ্ছ (অস্বচ্ছ নয়), ইংরেজিতে যাকে বলে ডায়েফনাস্।
সমস্ত জীবন কাটল এই রকম একা বসে বসে।
–আব্বু
.
[কনিষ্ঠ পুত্রকে লেখা পত্র]
১৭.১০.৫৫
বাবা ভজু,
তোমাকে নাকি ফিরোজ জিগ্যেস করল– আমি যখন ঢাকায় গিয়ে তোমাদের আদর করছিলুম কবীর, তোর আব্ব কই?
—আব্বু
[উপরের পত্রগুলো যখন সৈয়দ মুজতবা আলী লেখেন, তখন তাঁর পুত্রেরা নিতান্তই শিশু। এ চিঠি তারা বড় হয়ে পড়বে, সেই আশাতেই লেখক লিখেছেন। প্রতি চিঠিতেই প্রবাসী পিতার বুভুক্ষু বাৎসল্য প্রকট। ফিরোজ জ্যেষ্ঠপুত্র সৈয়দ মুশাররফ আলীর ডাকনাম, ভজু কনিষ্ঠ পুত্র সৈয়দ জগলুল আলী।]
.
শ্রীচারুচন্দ্র চক্রবর্তীকে (জরাসন্ধ) লিখিত পত্র
১.১.৭০
প্রিয়বরেষু,
নববর্ষে আপনার সহি-সালামতের জন্য আল্লার দরগায় দোওয়া মাঙছি। আপনার জরিন কলম হোক, আপনি আরও বহু বহু বৎসর ধরে বাঙালিকে আনন্দ দান করুন, এটা আসল। তৎপর যা করে আসছেন, অর্থাৎঅপরাধ কী, অপরাধী কারে কয়, সে-সম্বন্ধে বাঙালিকে চিন্তা করতে ও সহিষ্ণু হতে শেখান। আল্লার কসম, এগুলো আমার উপদেশ নয়। আমার হৃদয়ের কামনা, প্রার্থনা, আমি ভেবেছিলুম, আপনি আমার খোঁজ নেবেন। তা তো নিলেন না। অবশ্য আমার কসুর অধিকতর। আসলে ব্যাপারটা এই, আমার বয়স ৬৪ (জন্মাষ্টমীর সূর্যাস্তে জন্ম!) এবং তার চেয়ে বেশি অথর্ব। উৎসাহের তোড়ে যদি বা আপনাকে pin down করলুম, তার পর সেটা আর follow up করতে পারলুম না। … ৪।১৭০ আবার রাজশাহী যাচ্ছি, ধর্মপত্নী ও দুই সৈয়দজাদা (যথাক্রমে ১৭ এবং ১৫) সেখানে থাকেন, এটা আমার বাৎসরিকহজ।
পরশুদিন শচীনবাবুর ওখানে গিয়েছিলুম। তার অজানতে দু খানা বই চুরি করে আনি। ন্যায়দণ্ড তথাগল্প লেখা হল না। পড়ে বড় আনন্দ পেয়েছি, বড় আনন্দ পেয়েছি। সে-কথা জানাবার জন্যই এই কার্ড। শেষের বইখানা বাবাজীবনদের জন্য নিয়ে যাব, জানেন বোধহয়, আজকাল কোনও প্রকারের printed matter পাকিস্তানে নিয়ে যেতে দেয় না। ওদিকে বাবাজীবনরা আপনার, রাজশেখরবাবুর ভক্ত। ব্রিামও ওদের ভারি পছন্দ। একদা মনে করত ব্রিাম greatest writer of Bengal. সে এক মজার ব্যাপার, বড় ব্যাটা ফিরোজকে একদিন বলেছিলুম, ব্রিামকে আমি চিনি। তাচ্ছিল্যি করে ব্যাটা বললেন, রেখে দাও! তুমি আবার লেখক। দ্বিামদা তোমার সঙ্গে কথাই কইবে না। আমি মনস্তাপ জানিয়ে ব্রিামকে আদ্যন্ত জানালুম। তার পর ফিরোজ ছুটিতে কলকাতা এলে তাকে ব্রিামের ওখানে নিয়ে গেলুম। সে এক দৃশ্য। ব্রিাম ফ্যালফ্যাল করে ফিরোজের দিকে তাকিয়ে, আর ফিরোজ মুগ্ধ নয়নে। ব্রিাম বেচারি ফিরোজের জন্য ফুরি থেকে ফেদৃজিনির কেক কিনে এনেছিল। আমিও যে খুব একটা নিরেস লেখক নই সেটা ব্রিাম একবার ফিরোজকে বোঝাতে গেলে সে with one murderous sweep of hands সেটা বন্ধ করে দিলে। …এবারে বলুন, কোন্ সাহসে ফিরোজকে বলি, আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে?
গুণমুগ্ধ
সৈ, মু. আলী
.
(২)
Dec. 6/7/71
শ্ৰদ্ধাস্পদ সুহৃদবরেষু,
আপনার ৬। ৪। ৭০-এর চিঠি আমি পাই সিলেটে। দেশে ফিরে আসা মাত্রই মোকা জুটে যায় জর্মনি যাওয়ার। তারই তদ্বির-(কে যেন বলেছেন একদা বসুন্ধরা ছিলেন বীরভোগ্যা, এখন তদ্বিরভোগ্যা) তদারকির মধ্যিখানে অবশ্য বিছানায় শুয়ে শুয়েই– আপনার সঙ্গে দু দণ্ড রসালাপ করব তেমন কিস্মৎ আমার ছিল না। তড়িঘড়ি ফের বিদেশ।