এ বিষয়ে আরেকটি কথা এইবেলা বলে নেওয়া ভালো। সাধারণত ওদিকে কেউ বড় একটা নজর দেন না। আমাদের প্রশ্ন, সব বিষয় পড়াবার জন্য যদি আমরা উর্দু শিক্ষক পেয়েও যাই, উর্দু শিক্ষয়িত্রী পাব কি? না পেলে আমাদের স্ত্রীলোকদের শিক্ষার কী ব্যবস্থা হবে, উর্দুওয়ালারা ভেবে দেখবেন কি? আমাদের কাছে পাকাপাকি খবর নেই, কিন্তু শুনতে পাই বাংলা শিক্ষয়িত্রীর অভাবেই আমরা যথেষ্ট কাহিল হয়ে পড়েছি। (এস্থানে উল্লেখ করি শ্রীহট্ট শহরের মহিলা মুসলিম লীগ তথা অন্যান্য মহিলারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য গত নভেম্বর মাস থেকে একটানা আন্দোলন করে যাচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য, পাকিস্তান নবজাত শিশুর ন্যায় নবজাত রাষ্ট্র। মাতৃভাষারূপ মাতৃস্তন্য ব্যতীত অন্য যে কোনও খাদ্য তার পক্ষে গুরুপাক হবে।)।
উর্দুওয়ালারা কেউ কেউ বলে থাকেন– অতশত বুঝি না, আমরা চাই, বাংলা ভাষার আজ যে পদ পূর্ব পাকিস্তানে আছে ঠিক সেইরকমই থাক, এবং ইংরেজির আসনটি উর্দু গ্রহণ করুক। তার অর্থ এই যে উর্দু উচ্চশিক্ষার মাধ্যমিক (মিডিয়াম অব ইনস্ট্রাকশন) হোক।
মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য কোনও ভাষা শিক্ষার মাধ্যমিক করলে যে কী প্রাণঘাতী বিষময় ফল জন্মায় তার সবিস্তর আলোচনা না করে উপায় নেই।
প্রথম পৃথিবীর কোন শিক্ষিত সভ্য দেশ মাতৃভাষা ছাড়া অন্য মাধ্যমে শিক্ষা দিচ্ছে? ইংলন্ড, ফ্রান্স, জর্মনি, ইতালি, চীন, জাপান, রুশ, মিশর, ইরাক, তুর্কি, ইরান এমন কোন দেশ আছে যেখানকার লোক আপন মাতৃভাষাকে অবমাননা করে আপন দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে? আরবি পূতপবিত্র, ঐশ্বর্যশালিনী, ওজস্বিনী ভাষা; কিন্তু কই, তুর্কি, ইরান, চীন, জাভার কোটি কোটি লোকে তো আরবির মাধ্যমে শিক্ষালাভ করে না, বিদ্যাভ্যাস শাস্ত্রচর্চা করে না। তবে বাংলার বেলা এ ব্যত্যয় কেন? বাংলা ভাষাভাষী লোকসংখ্যা তো নগণ্য নয়। সংখ্যা দিয়ে যদি ভাষার গুরুত্ব নির্ণয় করি এবং সে নির্ণয়করণ কিছু অন্যায় নয়– তবে দেখতে পাই চীনা, ইংরেজি, হিন্দি-উর্দু, রুশ, জর্মন ও স্পেনিশের পরেই বাংলার স্থান। পৃথিবীতে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা ছয় কোটি (পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় সোয়া চার কোটি) এবং তার তুলনায় ভুবনবিখ্যাত ফরাসি ভাষায় কথা বলে সাড়ে চার কোটি, ইতালিয়ানে চার কোটি, ফারসিতে এক কোটি, তুর্কিতে সত্তর লক্ষ, এমনকি আরবিতেও মাত্র আড়াই কোটি। যে ভাষায় এত লোক সাহিত্যসৃষ্টি করবার জন্য সুযোগ অনুসন্ধান করছে তাদের এতদিন চেপে রেখেছিল মৌলবি-মৌলানাদের আরবি-ফারসি-উর্দু এবং পরবর্তী যুগে ইংরেজি। বাংলার সময় কি এখনও আসেনি, সুযোগ কি সে কোনওদিনই পাবে না?
মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য মাধ্যমিকে শিক্ষাদানের দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে আছে এবং তার ফল কী সেকথাও ঐতিহাসিকদের অবিদিত নয়। ক্যাথলিক জগতে কেন্দ্র অর্থাৎ পোপের সঙ্গে যোগ রাখার প্রলোভনে (আজ পূর্ব পাকিস্তান করাচির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য যেরকম প্রলুব্ধ) একদা ইয়োরোপের সর্বত্র লাতিনের মাধ্যমিকে শিক্ষাদান পদ্ধতি জনসাধারণের মাতৃভাষার উপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল। এবং সে পাথর সরাবার জন্য লুথারের মতো সংস্কারক ও প্রোটেস্টান্ট ধর্মের মতো নবীন সংস্কারপদ্ধতির প্রয়োজন হয়েছিল। পরবর্তী যুগে দেখতে পাই ফরাসি লাতিনের জায়গা দখল করেছে এবং তার চাপে দিশেহারা হয়ে ফ্রেডরিক দি গ্রেটের মতো জর্মন সম্রাট মাতৃভাষা জর্মনকে অবহেলা করে ফরাসিতে কবিতা লিখেছেন এবং সে কবিতা মেরামত করবার জন্য ফরাসি গুণী ভলতেয়ারকে পৎসদামে নিমন্ত্রণ করেছেন। ঠিক সেইরকম রাশিয়ারও অনেক বত্সর লেগেছিল ফরাসির নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে। আজ উর্দুওয়ালারা বাংলাকে যেরকম তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছেন ঠিক সেইরকম জর্মন ও রুশ আপন আপন মাতৃভাষাকে অবহেলা করে বহু বৎসর যশের মন্দিরে প্রবেশ লাভ করতে পারেননি।
এসব উদাহরণ থেকে এইটুকু স্পষ্ট বোঝা যায় যে, যতদিন পর্যন্ত মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যমিকরূপে গ্রহণ না করা হয় ততদিন শিক্ষা সমাজের উচ্চস্তরের গুটিকয়েক লোকের সংস্কৃতিবিলাসের উপকরণ মাত্র এবং যেখানে পূর্বে শুধু অর্থের পার্থক্য মানুষে মানুষে বিভেদ আনত সেখানে উচ্চশিক্ষা ও সংস্কৃতির পার্থক্য দুই শ্রেণির বিরোধ কঠোরতর করে তোলে।
এ দেশে যে ইসলামি শিক্ষা কখনও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারেনি তার প্রধান কারণ বাংলার মাধ্যমিকে কখনও শাস্ত্রচর্চা করা হয়নি। যে বস্তু মাতৃভাষায় অতি সহজ, অত্যন্ত সরল, বিদেশি ভাষায় সেই বস্তুই অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তখন আরম্ভ হয় স্কুল থেকে পালানোর পালা এবং মধ্যবিত্ত ও ধনীর গৃহের চাপের ফলেই এই দুই শ্রেণির ছেলে তখনও লেখাপড়া শেখে, কিন্তু অনুন্নত গরিব তখন ভাবে যে পরিবারে যখন কেউ কখনও লেখাপড়া শেখেনি তখন এ ছেলেই-বা পারবে কেন, বাপ-দাদার মতো এরও মাথায় গোবর ঠাসা।
মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য মাধ্যমিকে শিক্ষা দিলে যে দেশের কতদূর ক্ষতি হয় তার সামান্যতম জ্ঞান এখনও আমাদের হয়নি। সে শিক্ষাবিস্তারে যে তখন শুধু অজস্র অর্থ ব্যয় হয় তা নয়, সে শিক্ষা ছাত্রের বুদ্ধিবৃত্তিকে অবশ করে তোলে, কল্পনাশক্তিকে পঙ্গু করে দেয় এবং সর্বপ্রকার সৃজনীশক্তিকে কণ্ঠরোধ করে শিক্ষার আঁতুড়ঘরেই গোরস্তান বানিয়ে দেয়।