পাকিস্তান সফল করেছেন কারা? গ্রামে গ্রামে পাকিস্তানের প্রোপাগান্ডা ছড়াল কে, সিলেটের প্লেবিসিটের সময় কুর্তা বিক্রয় করে নৌকা ভাড়া করল কারা, পোলোয় করে মরণাপন্ন ভোটারকে বয়ে নিয়ে গেল কার বেটা-বাচ্চারা?
এরাই লড়েছে পাকিস্তান-বিরোধীদের সঙ্গে। এরা কুর্দিনশীন, মোটর-সওয়ার পলিটিশিয়ান নয়। এরা লড়তে জানে। দরকার হলে এরা দলে দলে ঢাকার দিকে ধাওয়া করবে, সঙ্গে যাবে তাদের বাধ্য চাষা-মজুর। তাদের সংখ্যা কী হবে অনুমান করতে পারছিনে, কিন্তু শুনেছি এক ঢাকা শহরের বাংলাভাষী মুষ্টিমেয় ছাত্রসম্প্রদায়ের হাতেই বাংলা-উর্দু বাবদে কোনও কোনও দণ্ডধর কর্তাব্যক্তি লাঞ্ছিত-অপমানিত হয়েছেন। ছাত্ররা শহরবাসী কিন্তু এরা গ্রাম্য; এরা প্রাণের ভয় দেখাতে জানে। ধন তো আগেই গিয়েছিল বিদেশ থেকে শিক্ষক আনিয়ে, তখন আরম্ভ হবে প্রাণের ওপর হামলা।
খুদা পানাহ। আমরা এ অবস্থার কল্পনাও করতে পারিনে। আমাদের বিশ্বাস, কর্তাব্যক্তিরা তার বহু পূর্বেই কিতাবুমুবিন দেখে সিরাতুল মুস্তাকিমের সন্ধান পাবেন;-ওয়া আম্মাস্সইলা ফলা তনহর, অর্থাৎ সাইল (প্রার্থী)-দের প্রত্যাখ্যান কোরো না!১ এস্থলেসাইল শব্দ আরবি অর্থে নিতে হবে, উর্দু অর্থে নয়, এবং তা হলে কথাটা আমাদের গরিব গুরুমহাশয়দের বেলাই ঠিক ঠিক খাটে।
হিটলার কুরানের এ আদেশ মানেননি। যে রোম ও তার সাঙ্গোপাঙ্গের কর্মতৎপরতার দরুন তিনি জার্মানিতে তার তৃতীয় রাষ্ট্র গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন, দেড় বৎসর যেতে-না-যেতে তিনি র্যোম এবং তার প্রধান সহকর্মীদের গুলি করে মেরেছিলেন। আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস আমাদের কর্তাব্যক্তি কুতুবমিনাররা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন এবং ইসলামে গণতন্ত্রের অর্থ হক ওসবর-এর ওপর নির্ভর করা (ওয়া তাত্তাসাও বিল হক্তি, ও তত্তাসাও বিস্-সবর)।
এ তো গেল পাঠশালার কথা। হয়তো উর্দুওয়ালারা বলবেন যে তারা পাঠশালায় বাংলাই চালাবেন কিন্তু স্কুল-কলেজে পড়াবেন উর্দু। দু রকম শিক্ষাব্যবস্থার অধর্ম ও কুফল আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি; আপাতত শুধু এইটুকু দ্রষ্টব্য যে স্কুল-কলেজে তাবৎ বিষয়বস্তু উর্দুর মাধ্যমিকে পড়াতে হলে উপস্থিত যেসব শিক্ষকরা এসব বিষয় পড়াচ্ছেন তাদের সকলকে বরখাস্ত করতে হবে এবং তাঁদের স্থলে যুক্তপ্রদেশ ও বিহার থেকে হাজার হাজার শিক্ষক আনাতে হবে।
কাজেই প্রথম প্রশ্ন, এসব মাস্টাররা কি অন্ন-হারা হওয়ার দুর্দৈবটা চোখ বুজে সয়ে নেবেন? প্রত্যেক অনুন্নত দেশের বেকার সমস্যার প্রধান অংশ সমাধান করে শিক্ষাবিভাগ, কারণ তার হাতে বিস্তর চাকরি। পূর্ব পাকিস্তান সে সমস্যার সমাধান দূরে থাক, পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালি শিক্ষকদের বরখাস্ত করে বাইরের থেকে লোক ডেকে সৃষ্টি করবেন বৃহৎ বেকার সমস্যা।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, ভূগোল, ইতিহাস, অঙ্ক এবং কলেজে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, কৃষিবিদ্যা, পূর্ত-খনিজ-বৈদ্য-শাস্ত্র পড়াবার জন্য উর্দুভাষী শিক্ষক পাওয়া যাবে তো? ভুললে চলবে না যে পূর্ব পাকিস্তান যদি উর্দু গ্রহণ করে তবে সিন্ধুপ্রদেশ এবং বেলুচিস্তানেও ঠিক আমাদের কায়দায়ই উর্দু মাস্টার, প্রফেসরের চাহিদা ভয়ঙ্কর বেড়ে যাবে। ফলে যখন আমরা ঢাকার স্কুল-কলেজে শিক্ষকদের যে মাইনো দিচ্ছি সে মাইনের চেয়ে দ্বিগুণ অথবা তিনগুণ দিতে হবে এইসব বহিরাগতদের। অত টাকা কোথায়? এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস উর্দুর মাধ্যমিকে উপরে লিখিত তাবৎ বিষয় পড়াবার মতো শিক্ষক বিহার যুক্তপ্রদেশে পাঞ্জাবে প্রয়োজনের দশমাংশও নেই।
তৃতীয় প্রশ্ন, তাবৎ পাঠ্যপুস্তক উর্দুতে লেখবার জন্য গ্রন্থাকার কোথায়? প্রয়োজনীয় শিক্ষকের দশমাংশ যখন বাজারে নেই তখন লেখকের দশমাংশও যে পাব না সে তথ্যও অবিসংবাদিত সত্য। কিছু বই লাহোর থেকে আসবে সত্য, কিন্তু বাংলার ভূগোল, ইতিহাস, কৃষিবিদ্যা তো লাহোরে লেখা হবে না এবং পূর্ব পাকিস্তানে এসব বিষয় লেখার লোক নেই। এবং যে ব্যবস্থাই গ্রহণ করি না কেন, আমাদের পাঠ্যপুস্তক-লেখকদের রুটি বহু বৎসরের জন্য নির্ঘাত মারা যাবে।
চতুর্থ প্রশ্ন, উর্দু ছাপাখানা, কম্পজিটর, প্রুফ-রিডার কোথায়? বাংলা প্রেস, প্রুফ-রিডাররা বেকার হয়ে যাবে কোথায়?
এবং সর্বশেষ দ্রষ্টব্য : পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশের স্কুল-কলেজে এখনও উর্দু শিক্ষার মাধ্যমিক হয়নি। বিবেচনা করি, আস্তে আস্তে হবে। কিন্তু পাঞ্জাবিদের পক্ষে এ কর্ম অপেক্ষাকৃত সরল হবে কারণ উর্দু তাদের মাতৃভাষা। দরকার হলে কেঁদেককিয়ে তারা উর্দুতে আপন আপন বিষয় পড়াতে পারবেন কিন্তু বাঙালি মাস্টার-প্রফেসারের পক্ষে উর্দু শিখে আপন কর্তব্য সমাধান করতে বহু বহু বৎসর লাগবে। ততদিন আমরা থ্রি-লেগেড রেস রান করি? বিশেষ করে যখন কি না পূর্ব পাকিস্তানকে শক্তিশালী রাষ্ট্রাংশ করার জন্য আমাদের কর্তব্য (ফ বললে ভালো হয়) ঊর্ধ্বশ্বাসে, ত্বরিতগতিতে সম্মুখপানে ধাবমান হওয়া।
উর্দুওয়ালারা যদি বলেন, আমরা স্কুল-কলেজে উর্দু দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে শেখাব, আজ যেরকম ফারসি, আরবি, সংস্কৃত অপশনাল সেকেন্ড ল্যান্গুইজ হিসেবে শেখাচ্ছি, তা হলে এ প্রস্তাবে যে আমাদের বিন্দুমাত্রও আপত্তি নেই শুধু তাই নয়, আমরা সর্বান্তঃকরণে সায় দিই। প্রসঙ্গান্তরে সে আলোচনা হবে।