এত সোজা সমাধান? তাই তো বটে! এই করেই হল জুতা আবিষ্কার। তিনকুড়ি কেন্দ্রীয় সদস্য, কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে শ-দুই চাকুরে, আরও শ-দুই তর্জুমানের উর্দু জানার প্রয়োজন [হিসেবটা অত্যন্ত দরাজ হাতে করা গেল); তার জন্য চার কোটি লোককে উর্দু কপচাতে হবে!
না হয় পাঁচশো নয়, সাতশো নয়, পাঁচ হাজার লোকেরই উর্দু বলার প্রয়োজন হবে। তবে তাদের পায়েই উর্দুর জুতা পরিয়ে দিই; এই ভলভলে কাদার দেশে চার কোটি লোককে জুতো পরাই কোন্ হস্তী-বুদ্ধির তাড়নায়?
রবীন্দ্রনাথের গল্পটি এইখানেই শেষ নয়; আমাদের কথাও এখানে ফুরোয় না। আমরা যখন এই জটিল সমস্যার সরল সমাধান বাৎলে দিই তখন
কহিলা রাজা, এত কি হবে সিধে,
ভাবিয়া মল সকল দেশসুদ্ধ।
মন্ত্রী কহে,
বেটারে শূলে বিধে
কারার মাঝে করিয়া রাখ রুদ্ধ।
চামারের মতো সরল সমাধান যারা করতে যায় তাদের জন্য শূলের হুকুম জারি হয়। তাদের তখন নামকরণ হয়এনিমিজ অব দি স্টেট, আজ প্রভোকাতর!!
ইতিহাস দিয়ে যদি-বা সপ্রমাণ করা যায় যে পূর্ব পাকিস্তানের মতো বিশাল দেশের বিপুল সংখ্যক লোককে কখনও তাদের মাতৃভাষা ভুলিয়ে অন্য ভাষা শেখানো সম্ভবপর হয়নি, ইরান-তুর্কি প্রভৃতি দেশে এ প্রকারের চেষ্টা সর্বদাই নিষ্ফল হয়েছে, তবু একরকমের লোক যারা আপন স্বাধিকার-প্রমত্ততায় দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে নাথিং ইজ ইমপসিবল বুলি কপচান, এ সম্প্রদায়ের লোক যদি দেশের দণ্ডধর না হতেন তবে আমাদের ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজই আর পাঁচজনকে সত্যনিরূপণ করাতে সমর্থ হত। তাই প্রশ্ন, এসব দণ্ডধরদের সামনে অন্য কোন যুক্তি পেশ করা যায়, কী কৌশলে বোঝানো যায় যে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে উর্দু চালানো সম্পূর্ণ অসম্ভব।
ফারসিতে বলে জান-মাল, বাংলায় বলিধন-প্রাণ মানুষ এই দুই বস্তু বড় ভালোবাসে; ইতিহাস যা বলে বলুক, এই দুই বস্তু যদি মানুষের হাত এবং দেহ ছাড়ার উপক্রম করে তবে দণ্ডধরেরা পর্যন্ত ব্যাকুল হয়ে পড়েন; হাতের পাখি এবং প্রাণপক্ষী বাঁচাবার জন্য তখন ঝোঁপের ইমপসিবল চিড়িয়ার তালাশি বন্ধ হয়ে যায়।
তাই প্রথম প্রশ্ন, ঝোঁপের উর্দু চিড়িয়া ধরতে হলে যে ফাঁদ কেনার প্রয়োজন তার খর্চার বহরটা কী?
ধরা যাক আমরা পূর্ব পাকিস্তানের পাঠশালা, স্কুল, কলেজ সর্বত্র উর্দু চালাতে চাই। পূর্ব পাকিস্তানে ক হাজার পাঠশালা, ক জন গুরুমহাশয়, দ্বিতীয় শিক্ষক, স্কুলমাস্টার, কলেজ প্রফেসার আছেন জানি না, কিন্তু একথা নিশ্চয় জানি যে কেবলমাত্র পাঠশালাতেই যদি আজ আমরা উর্দু চালাবার চেষ্টা করি তবে আমাদের হাজার হাজার উর্দু-শিক্ষকের প্রয়োজন হবে। সেসব শিক্ষকরা আসবেন বিহার এবং যুক্তপ্রদেশ থেকে। তারা আঠারো কুড়ি-টাকার মাইনেতে পূর্ব বাংলার গায়ে পরিবার পোষণ করতে পারবেন না। আমাদের পাঠশালার পণ্ডিতমশাইদের কিছু কিছু জমিজমা আছে, কেউ কেউ হালও ধরে থাকেন, এবং তৎসত্ত্বেও তারা যে কী দারিদ্র্যের ভেতর দিয়ে জীবনযাপন করেন সে নিদারুণ কাহিনী বর্ণনা করার মতো শৈলী এবং ভাষা আমার কলমে নেই। লেখাপড়া শিখেছেন বলে গ্রামের আর পাঁচজনের তুলনায় এঁদের সূক্ষ্মানুভূতি, স্পর্শকাতরতা এবং আত্মসম্মানজ্ঞান হয় বেশি। মহাজনের রূঢুবাক্য, জমিদারের রক্তচক্ষু এদের হৃদয়-মনে আঘাত দেয় বেশি এবং উচ্চশিক্ষা কী বস্তু তার সন্ধান তারা কিছুটা রাখেন বলে মেধাবী পুত্রকে অর্থাভাবে উচ্চশিক্ষা না দিতে পারাটা এঁদের জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। ইত্তেহাদ, আজাদ মাঝে মাঝে এঁদের হস্তগত হয় বলে এঁরা জানেন যে যক্ষ্মারোগী স্বাস্থ্যনিবাসে বহুস্থলে রোগমুক্ত হয়, হয়তো তার সবিস্তর বর্ণনাও কোনও রবিবাসরীয়তে তারা পড়েছেন এবং তার পর যখন পুত্র অথবা কন্যা যক্ষ্মারোগে চোখের সামনে তিলে তিলে মরে তখন তারা কী করেন, কী ভাবেন, আমাদের জানা নেই। বাইবেলি ভাষায় বলতে ইচ্ছে হয়, ধন্য যাহারা অজ্ঞ, কারণ তাহাদের দুঃখ কম। পণ্ডিতের তুলনায় গাঁয়ের আর পাঁচজন যখন জানে না স্বাস্থ্যনিবাস সাপ না ব্যাঙ না কী, তখন তারা যক্ষ্মা-রোগকে কিস্মতের গর্দিশ বলেই নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারে।
সুদূর যুক্তপ্রদেশ, বিহার থেকে যারা উর্দু শেখাবার জন্য বাংলার জলেভেজা, কাদাভরা, পানাটাকা, জ্বরেমারা পাড়াগাঁয়ে সপরিবার আসবেন তারা মাইনে চাইবেন কত? আমাদের গায়ে গায়ে ফালতত জমিজমা আর নেই যে চাকরি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের লাখেরাজ বা ব-খেরাজ ভূসম্পত্তি দিয়ে দেব আর তারা সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে চন্দ রোজের মুসাফিরি কোনও সুরতে গুজার করে নেবেন। তাই তাদের মাইনে অন্ততপক্ষে কত হওয়া উচিত, আপনারা এবং আর পাঁচজন গাঁও-বুড়ারা, মাথা মিলিয়ে ধরে দিন। আমরা মেনে নেব।
যত কমই ধরুন না কেন, তার দশমাংশ দেবার মতো তাগদও পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রীর নেই (শুধু পূর্ব পাকিস্তানের কেন, এরকম পাগলা প্ল্যান চালাতে চাইলে ইংলন্ড-ফ্রান্সেরও নেই)। জমির সার, হালের বলদ, কলকজা কেনা সবকিছুর জন্য পয়সা খরচা বন্ধ করে এই কি এডুকেশনাল এক্সপেরিমেন্ট করার মোকা!
এতক্ষণ ধনের কথা হচ্ছিল, এখন প্রাণের কথাটা তুলি।
বিহার, যুক্তপ্রদেশ থেকে শিক্ষক আনিয়ে তো আমাদের পাঠশালাগুলো ভর্তি করা হল। আটার অভাবে তাঁরা মাসোহারা পেয়েও অর্ধাহারী রইলেন। তা থাকুন, কিন্তু যেসব হাজার হাজার পাঠশালার বাংলা শিক্ষককে পদচ্যুত করে বিদেশিদের জায়গা করা হল তারা যাবেন কোথায়? কোনও দোষ করেননি, এনিমিজ অব দি স্টেট এরা নন, এঁদের বরখাস্ত করা হবে কোন্ হক্কের জোরে, কোন্ ইসলামি কায়দায়?