মার্শাল বুলগানিন, আইসেনহাওয়ার, চার্চিল, মাও-সে-তুঙ, চিয়াং-কাই-শেক যখন ঘন্টার পর ঘণ্টা আলাপ-আলোচনা করেন– আর চার্চিল তো মামুলি কথা বলতে গেলেও ওজস্বিনী বক্তৃতা ঝাড়েন তখন সকলেই আপন আপন মাতৃভাষাতেই কথা বলেন। দোভাষী তর্জুমানরা সেসব আলাপ-আলোচনার অনুবাদ করেন।
এত বড় যে ইউনাইটেড নেশনস অরগেনাইজেশন (উনো), যেখানে দুনিয়ার প্রায় তাবৎ ভাষাই শুনতে পাওয়া যায়; সে-ও চলে তর্জুমানদের মধ্যস্থতায়।
পাঠক হয়তো বলবেন অনূদিত হলে মূল বক্তৃতার ভাষার কারচুপি অলঙ্কারের ঝলমলানি, গলা ওঠানো-নাবানোর-লম্ফঝম্ফ মাঠে মারা গিয়ে বক্তৃতা রসকষহীন সাদামাটা হয়ে বেরোয়, ওজস্বিনী বক্তৃতা তখন একঘেয়ে রচনা পাঠের মতো শোনায়। সেকথা ঠিক– যদিও প্রোফেশনাল এবং বিচক্ষণ তর্জুমান মূলের প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ জৌলুস রাখতে সমর্থ হন– কিন্তু যখন সব বক্তারই বক্তৃতা অনূদিত হয়ে সাদামাটা হয়ে গেল তখন সকলেই সমান লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন।
গুণীরা বলেন, আলাপ-আলোচনা যেখানে ঝগড়া-কাজিয়ায় পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সেখানে কদাচ বিপক্ষের মাতৃভাষায় কথা বলবে না; তুমি একখানা কথা বলতে-না-বলতে সে দশখানা বলে ফেলবে। বিচক্ষণ লোক মাত্রই স্টেশনে লক্ষ করে থাকবেন যে হুঁশিয়ার বাঙালি বিহারি মুটের সঙ্গে কদাচ উর্দুতে কথা বলে না। আর মুটে যদি তেমনি ঘুঘু হয় তবে সে-ও বাংলা জানা থাকলেও আপন উর্দু চালায়। তবু তো বিহারি মুটেকে কিছুটা ভালো উর্দু জানা থাকলে ঘায়েল করা যায়, কিন্তু করাচিতে যেসব উর্দুভাষীদের মোকাবেলা করতে হবে তাদের উর্দুজ্ঞান পয়লানম্বরি হবে নিশ্চয়ই। প্রেমালাপের কথা স্বতন্ত্র, সেখানে কোনও ভাষারই প্রয়োজন হয় না, টোটিফুটি উর্দু বললেও আপত্তি নেই।
তুলসী দাস কহেন–
জো বালক কহে তোতরি বাতা
সুনত মুদিত নেন পিতু আরু মাতা—
বালক যখন আধা-আধা কথা বলে তখন পিতামাতা মুদ্রিত নয়নে (গদগদ হয়ে) সেকথা শোনেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যগণ শুধু রসালাপ করার জন্য করাচি যাবেন না। স্বার্থের দ্বন্দ্ব উপস্থিত হলে, দরকার বোধ করলে তাদের তো বাগবিতণ্ডাও করতে হবে।
কেন্দ্রের ডাঙর ডাঙর নোকরির বেলাও এই যুক্তি প্রযোজ্য। আমরা যত উত্তম উর্দুই শিখি না কেন, প্রতিযোগিতাত্মক পরীক্ষায় উর্দু-মাতৃভাষীর সঙ্গে কখনওই টক্কর দিতে পারব না। অথচ আমরা যদি আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় পরীক্ষা দিই, এবং উর্দু-মাতৃভাষীরা তাঁদের মাতৃভাষায় পরীক্ষা দেন তবে পরীক্ষায় নিরপেক্ষতা রক্ষা করা হবে। তখন প্রশ্ন উঠবে, বাঙালি ছেলেরা উর্দু না জেনে কেন্দ্রে নোকরি করবে কী করে? উত্তরে বলি, সিন্ধি বেলুচি ছেলে যে প্রকারে কেন্দ্রে কাজ করবে ঠিক সেই প্রকারে তাদের মাতৃভাষাও তো উর্দু নয়। পাঠানেরা পশতুর জন্য যেরকম নাড়াচাড়া আরম্ভ করেছেন তাঁদের ওই একই অবস্থা হবে। অথবা বলব উর্দু-মাতৃভাষীরা যে কৌশলে বাংলাদেশে নোকরি করবেন ঠিক সেই কৌশলে। এ সম্বন্ধে বাকি বক্তব্যটুকু অন্য প্রসঙ্গে বলা হবে।
উর্দুওয়ালারা এর পরও শুধাতে পারেন, আমরা যদি উর্দু না শিখি তবে কেন্দ্র থেকে যেসব হুকুম ফরমান, আইন-কানুন আসবে সেগুলো পড়ব কী করে?
উত্তরে বলি, তার জন্যে ঢাকাতে তর্জুমানদের ব্যবস্থা করতে হবে। একথা শুনে উর্দুওয়ালারা আনন্দে লাফ দিয়ে উঠবেন। বলবেন, তবেই তো হল। তর্জুমানদের যখন উর্দু শেখাতেই হবে তখন তামাম দেশকে উর্দু শেখালেই পারো।
এ বড় অদ্ভুত যুক্তি। উদাহরণ না দিলে কথাটা খোলসা হবে না বলে নিবেদন করি, আরব, ফ্রান্স, জর্মনি, স্পেন, রুশিয়া, চীন ইত্যাদি দেশে পাকিস্তানের লোক রাজদূত হয়ে যাবে। তাই কি পাকিস্তানের লোককে আমরা দুনিয়ার তাবৎ ভাষা শেখাই?
একটা গল্প মনে পড়ল। স্বয়ং কবিগুরু সেটি ছন্দে বেঁধেছেন; তাই যতদূর সম্ভব তাঁর ভাষাতেই বলি–
কহিলা হবু শুন গো গোবু রায়
কালিকে আমি ভেবেছি সারারাত্র
মলিন ধুলা লাগিবে কেন পায়
ধরণী মাঝে চরণ ফেলা মাত্র?
শীঘ্র এর করিবে প্রতিকার
নহিলে কারও রক্ষা নাহি আর।
মন্ত্রী তখন,
অশ্রুজলে ভাষায়ে পাকা দাড়ি
কহিলা গোবু হবুর পাদপদ্মে
যদি না ধুলা লাগিবে তব পায়ে
পায়ের ধুলা পাইব কী উপায়ে।
শেয়ানা উত্তর। কিন্তু রাজা মন্ত্রীর চেয়েও ঘড়েল তাই বললেন–
–কথাটা বটে সত্য,
কিন্তু আগে বিদায় করো ধূলি
ভাবিয়ো পরে পদধূলির তত্ত্ব!
তখন নানা তরকিব নানা কৌশলে রাজার পা দু খানাকে ধুলা থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হল। সাড়ে সতেরো লক্ষ বঁটা দিয়ে তামাম দুনিয়া সাফ করার প্রথম চেষ্টাতে যখন কোনও ফল হল না তখনএকুশ লাখ ভিস্তি দিয়ে জল ঢালার ব্যবস্থা করা হল। তাতেও যখন কিছু হল না তখন–
কহিল, মন্ত্রী, মাদুর দিয়া ঢাকো;
ফরাশ পাতি করিব ধুলা বন্ধ।
কহিল কেহ, রাজারে ঘরে রাখো।
কোথাও যেন না থাকে কোনও রন্ধ্র।
রাজার কপাল ভালো বলতে হবে, কেউ যে তাঁর পা দুখানা কাটার ব্যবস্থা করলেন না। শেষটায় সমস্বরে–
কহিল সবে, চামারে তবে ডাকি
চর্ম দিয়া মুড়িয়া দাও পৃথ্বী।
তখন ধীরে চামার কুলপতি
কহিল এসে ঈষৎ হেসে বৃদ্ধ,
বলিতে পারি করিলে অনুমতি
সহজে যাহে মানস হবে সিদ্ধ।
নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে
ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।