পাকিস্তান বড়লোকের জন্য নয়, গরিবের হক পাকিস্তানে বেশি।
ইংরেজও ভদ্রলোক ওছোটলোকের ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা করে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। ইংরেজ কৃষি রিপোর্ট বের করত ইংরেজি ভাষায় এবং চাষাভুষাদের শেখাত বাংলা! বোধহয় ভাবত বাঙালি মাছিমারা কেরানি যখন ইংরেজি না জেনেও ইংরেজি দলিলপত্র নকল করতে পারে তখন ইংরেজি-অনভিজ্ঞ চাষাই-বা ইংরেজিতে লেখা কৃষি রিপোর্ট, আবহাওয়ার খবরাখবর পড়তে পারবে না কেন? এই পাগলামি নিয়ে যে আমরা কত ঠাট্টা-মশকরা করেছি সেকথা হয়তো উর্দুওয়ালারা ভুলে গিয়েছেন কিন্তু আমরা ভুলিনি। তাই শুধাই, এবার কি আমাদের পালা? এখন আমরা কৃষি রিপোর্ট, বাজারদর, আবহাওয়ার খবরাখবর বের করব উর্দুতে আর চাষিদের শেখাব বাংলা! খবর শুনে ইংরেজ লন্ডনে বসে যে অট্টহাসি ছাড়বে আমরা সিলেটে বসে তার শব্দ শুনতে পাব।
উর্দুওয়ালারা বলবেন, ক্ষেপেছ? আমরা উর্দু কৃষি রিপোর্ট বাংলাতে অনুবাদ করে চাষার বাড়িতে পাঠাব।
উত্তরে আমরা শুধাই : সে অনুবাদটি করবেন কে? কৃষি রিপোর্টের অনুবাদ করা তো পাঠশালা-পাসের বাংলা বিদ্যে দিয়ে হয় না। অতএব বাংলা শেখানোর জন্য হাইস্কুলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়াতে হবে। অর্থাৎ আমাদের সক্কলকে স্কুল-কলেজে বাংলা উর্দু দুই-ই বেশ ভালো করে শিখতে হবে (কৃষি-রিপোর্ট ছাড়া উর্দুতে লেখা অন্যান্য সাহিত্যও তো বাংলাতে তর্জমা করতে হবে); ফলে দুই কুলই যাবে, যেমন ইংরেজ আমলে গিয়েছিল—না শিখেছিলুম বাংলা লিখতে, না পেরেছিলুম ইংরেজি ঝাড়তে।
ইংলন্ড, ফ্রান্স, জার্মানিতে যে উচ্চশিক্ষার এত ছড়াছড়ি, সেখানেও দশ হাজারের মধ্যে একটি ছেলে পাওয়া যায় না যে দুটো ভাষায় সড়গড় লিখতে পারে। আরব, মিশরের আলিম-ফাজিলগণও এক আরবি ছাড়া দ্বিতীয় ভাষা জানেন না।
না হয় সবকিছুই হল কিন্তু তবু মনে হয়, এ বড় অদ্ভুত পরিস্থিতি যে রিপোর্ট পড়নেওয়ালার শতকরা ৯৯ জন জানে বাংলা, সে রিপোর্টের মূল লেখা হবে উর্দুতে! ব্যবস্থাটা কতদূর বদখত বেতালা তার একটা উপমা দিলে আমার বক্তব্য খোলসা হবে : যেহেতু পূর্ব পাকিস্তানে উপস্থিত শ-খানেক রুটি-খানেওয়ালা পাঞ্জাবি আছেন অতএব তাবৎ দেশে ধানচাষ বন্ধ করে গম ফলাও! তা সে আল-বাধা, জলে টইটম্বুর ধানক্ষেতে গম ফলুক আর না-ই ফলুক।
উর্দুওয়ালারা তবু বলবেন, সব না হয় মানলুম, কিন্তু একথা তো তোমরা অস্বীকার করতে পারবে না কেন্দ্রের ভাষা যে উর্দু সে সম্বন্ধে পাকাপাকি ফৈসালা হয়ে গিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের লোক যদি উর্দু না শেখে তবে করাচির কেন্দ্রীয় পরিষদে তাঁরা গাকগাক করে বক্তৃতা ঝাড়বেনই-বা কী প্রকারে, এবং আমাদের ছেলেছোকরারা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে ডাঙর ডাঙর নোকরিই-বা করবে কী প্রকারে?
বক্তৃতা দেওয়া সম্বন্ধে আমাদের বক্তব্য এই যে, আমরা যত ছেলেবেলা থেকে যত উত্তম উর্দুই শিখি না কেন, উর্দু যাদের মাতৃভাষা তাঁদের সঙ্গে আমরা কস্মিনকালেও পাল্লা দিয়ে পেরে উঠব না। আমাদের উচ্চারণ নিয়ে উর্দুভাষীগণ হাসিঠাট্টা করবেই এবং সকলেই জানেন উচ্চারণের মশকরা-ভেংচানি করে মানুষকে সভাস্থলে যত ঘায়েল করা যায় অন্য কিছুতেই ততটা সুবিধে হয় না। অবশ্য যাদের গুরদা-কলিজা লোহার তৈরি তাঁরা এসব নীচ ফন্দি-ফিকিরে ঘায়েল হবেন না কিন্তু বেশিরভাগ লোকই আপন উচ্চারণের কমজোরি বেশ সচেতন থাকবেন, বিশেষত যখন সকলেই জানেন যে প্রথম বহু বৎসর ধরে উত্তম উচ্চারণ শেখবার জন্য ভালো শিক্ষক আমরা জোগাড় করতে পারব না, এবং একথাও বিলক্ষণ জানি যে একবার খারাপ উচ্চারণ দিয়ে বিদ্যাভ্যাস আরম্ভ করলে অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সে সে জখমি উচ্চারণ আর মেরামত করা যায় না। দৃষ্টান্তের জন্য বেশিদূর যেতে হবে না। পূর্ববঙ্গের উর্দুভাষাভাষী মৌলবি সাহেবদের উচ্চারণের প্রতি একটু মনোযোগ দিলেই তাদের উচ্চারণের দৈন্য ধরা পড়ে। সে উচ্চারণ দিয়ে পূর্ববাংলায়ওয়াজ দেওয়া চলে কিন্তু যাদের মাতৃভাষা উর্দু তাঁদের মজলিসে মুখ খোলা যায় না। এমনকি দেওবন্দ-রামপুর ফের্তা কোনও কোনও মৌলবি সাহেবকে উচ্চারণ বাবতে শরমিন্দা হতে দেখেছি, অথচ বহুক্ষেত্রে নিশ্চয় জানি যে এঁদের শাস্ত্রজ্ঞান দেওবন্দ-রামপুরের মৌলানাদের সঙ্গে অনায়াসে পাল্লা দিতে পারে। কিন্তু এরা নিরুপায়, ছেলেবেলা ভুল উচ্চারণ শিখেছিলেন, এখনও তার খেসারতি ঢালছেন।
কিন্তু কী প্রয়োজন জান পানি করে ছেলেবেলা থেকে উর্দু-উচ্চারণে পয়লানম্বরি হওয়ায়? অন্য পন্থা কি নেই?
আছে। গণতন্ত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ ভূমি সুইজারল্যান্ডে চারটি ভাষা প্রচলিত। তাদের পার্লামেন্টে সকলেই আপন আপন মাতৃভাষায় বক্তৃতা দেন। সেসব বক্তৃতা অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করা হয়। উর্দুওয়ালারা প্রশ্ন শুধাবেন : এসব বক্তৃতা অনুবাদ করে কারা?
সেই তত্ত্বটা এইবেলা ভালো করে বুঝে নেওয়া দরকার। এই ধরুন, আপনার মাতৃভাষা বাংলা, আপনি উর্দুও জানেন। কিন্তু উর্দুতে বক্তৃতা দিতে গেলে আপনি হিমশিম খেয়ে যান। অথচ অল্প উর্দু জানা সত্ত্বেও যদি আপনাকে কোনও উর্দু বক্তৃতা বাংলায় তর্জমা করতে হয় তবে আপনি সেটা অনায়াসে করে দিতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ যখন ফ্রান্স, জর্মনি, হল্যান্ড প্রভৃতি দেশে সফর করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তখন তিনি দুনিয়ার বাহান্নটা ভাষায় বক্তৃতা দেননি? বক্তৃতা দিয়েছিলেন হামেশাই ইংরাজিতে। এবং অনুবাদকেরা আপন আপন মাতৃভাষায় সেসব বক্তৃতা অনুবাদ করেছিলেন।