এ প্রসঙ্গে উর্দুওয়ালাদের কাছে আমাদের শেষ প্রশ্ন : ত্রয়োদশ শতকে মুসলমান কর্তৃক বঙ্গবিজয় থেকে আরম্ভ করে ঊনবিংশ শতকের প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত ফারসি-উর্দু এদেশে চালু ছিল। শাহজাহানের আমল থেকে আজ পর্যন্ত বেশুমার মৌলবি-মৌলানা, আলিম-ফাজিল দেওবন্দ রামপুর থেকে উর্দু শিখে এসে এদেশে উর্দুতে ওয়াজ ঝেড়েছেন, উর্দুতেগুফতগু করেছেন; মনে পড়েছে ছেলেবেলায় দেখেছি উদ্ধত অর্বাচীন তরুণ যখনই তর্কে মোল্লাদের কাবু করেছে তখনই তারা হঠাৎ উর্দুতে কথা বলতে আরম্ভ করে (আজ জানি সে উর্দু কত ন্যক্কারজনক ভুলে পরিপূর্ণ থাকত) আপন যুক্তির অভাব অথবা দুর্বলতা ঢাকবার চেষ্টা করেছেন এবং চাষাভুষার কাছে মুখ বাঁচিয়েছেন। সেকথা থাক, কারণ এমন মৌলবি-মৌলানার সংস্পর্শেও এসেছি যাদের সঙ্গে তর্কে হেরেও আনন্দ পেয়েছি, কিন্তু আসল প্রশ্ন : এইসব আলিম-ফাজিলগণ বাংলা দেশের শিক্ষা ও কৃষ্টি নির্মাণের সম্পূর্ণ ভার হাতে পেয়েও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চেষ্টা করা সত্ত্বেও এদেশের আপামর জনসাধারণকে নাপাক বাংলা ভুলিয়ে ফারসি বা উর্দু চালাতে সক্ষম হলেন না কেন? ইংরেজি স্কুল তখন ছিল না, সংস্কৃত টোল তখন অনাদৃত, আরবি-ফারসি-উর্দু শিখলে তখন উমদা উমদা নোকরি মিলত, বাদশাহ-সুবাদারের মজলিসে শিরোপা মিলত, মনসব মিলত, আর আরবি-ফারসির জরিয়ায় বেহেস্তের দ্বার তো খুলতই। ইহলোক-পরলোক উভয় লোকের প্রলোভন সত্ত্বেও বাঙালি মুসলমান নাপাক বাংলায় কেন কথাবার্তা বলল, জারিমর্সিয়া রচনা করল, ভাটিয়ালি-পিরমুর্শিদি, আউলবাউল, সাঁইদরবেশি গান গাইল, কেচ্ছা-সাহিত্য তৈরি করল, রাধার চোখের পানি নিয়ে বিদাত কবিতা পর্যন্ত লিখল? এবং একথাও তো জানি যে মৌলবি-মৌলানারা এসব লোকসাহিত্যের প্রতি উদাসীন ছিলেন না, তাঁরা বার বার ফতোয়া দিয়েছেন যে এসব সাহিত্যবিদাত, নাজাইজ, কুফর, শিরক। তৎসত্ত্বেও এগুলো এখনও খেয়াঘাটে, বাথানে, চাষার বাড়িতে পড়া হয়, এসব বই এখনও ছাপা হয়, হাটবারে বটতলায় বিক্রয় হয়।
শুধু তাই? পাঠান বাদশাহরা পয়সা খরচ করে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের দিয়ে মহাভারত, রামায়ণ বাংলায় অনুবাদ করালেন। বাদশাহদের দরবারে বিস্তর আলিম-ফাজিল ছিলেন। তারা তখন নিশ্চয়ই এই ফুজুল, বিদাত, ওয়াহিয়াত, ইসরাফের বিরুদ্ধে তারস্বরে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন কিন্তু শেষপর্যন্ত তো তত্ত্বকথা এই যে, আজ পর্যন্ত এদেশে পরাগল খান, ছুটি খানের নাম রয়ে গিয়েছে বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে।
কিন্তু আমাদের আসল প্রশ্নটা যেন ধামাচাপা পড়ে না যায়। উর্দুওয়ালাদের কাছে আমার সবিনয় প্রশ্ন : বাংলাদেশের কৃষ্টিজগতে প্রায় ছয়শত বৎসর একাধিপত্য করেও তারা যখন উর্দু চালাতে পারেননি তখন বর্তমান যুগের নানা কৃষ্টিগত দ্বন্দ্ব, বহু নিদারুণ দারিদ্র্য, ক্রমবর্ধমান বাংলাসাহিত্য ও ভাষার সঙ্গে বিজড়িত মুসলমান-হিন্দুকে তাদের মাতৃভাষা ভুলিয়ে উর্দু চালানো কি সম্ভবপর?
আরব-ইরান পাশাপাশি দেশ, এক দেশ থেকে আরেক দেশে গমনাগমনে কোনও অসুবিধা ছিল না, উর্দুর তুলনায় আরবি বহু পূতপবিত্র ভাষা ও সে ভাষা ইসলামের তাবত দৌলত ধারণ করে; তৎসত্ত্বেও যখন ইরানে আরবি চলল না তখন যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তান বহুশত ক্রোশ দূরে– মাঝখানে আবার এমন রাষ্ট্র যার সঙ্গে এখনও পুরা সমঝাওতা হয়নি, যে পশ্চিম পাকিস্তানেও আবার পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন ভাষা প্রচলিত– সেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান একজোট হবেই-বা কী করে আর একে অন্যকে উর্দু শেখাবেই-বা কী প্রকারে? এ তো দু পাঁচজন মাস্টারের কথা নয়, আমাদের দরকার হবে হাজার হাজার লোকের। আর হাজার নবাগতকে পোষবার ক্ষমতা যদি পূর্ব পাকিস্তানের থাকতই তবে পূর্ব পাঞ্জাব থেকে বিতাড়িত হতভাগ্য মুসলমানদের কি পূর্ব পাকিস্তান এতদিনে আমন্ত্রণ করে চোখের জল মুছিয়ে দিত না, মুখে অন্ন তুলে ধরত না?
হয়তো উর্দুওয়ালারা বলবেন যে, সমস্ত দেশকে উর্দু শেখানো তাঁদের মতলব নয়; তাঁদের মতলব প্রাইমারি স্কুলে অর্থাৎ গ্রাম্য পাঠশালায় বাংলা শেখানো এবং হাইস্কুল ও কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে উর্দু চালানো।
তাই যদি হয় তবে ফল হবে এই যে, হাইস্কুল-কলেজে উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত গুণী-জ্ঞানীরা কেতাব লিখবেন উর্দুতে। তাতে ইসলামের প্রাচীন ইতিহাস থাকবে, সে ঐতিহ্যের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তানের নবীন রাষ্ট্র কী করে গড়ে তুলতে হবে তার কায়দাকানুনের বয়ান থাকবে, আল্লা-রসুলের বাণী সেসব কেতাবে নতুন করে প্রচারিত হবে এবং এসব তাবত দৌলতের ভোগী হবেন উর্দু জাননেওলারা। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৮০/৯০ জন চাষা-মজুর; তাদের শিক্ষাসমাপ্তি যে পাঠশালা পাসের সঙ্গে সঙ্গেই হয়ে যাবে সেকথাও নিশ্চয়ই জানি এবং তারা এসব কেতাব পড়তে পারবে না। এই শতকরা আশিজনের ওপর যে নবীন রাষ্ট্র নির্মিত হবে তার আদর্শ নতুন, আকাক্ষা নতুন এবং সে আদর্শে পৌঁছানোর জন্য যেসব বয়ান উর্দু ভাষাতে লেখা হবে তারা সেসব পড়তে সক্ষম হবে না। অর্থাৎ শতকরা আশিজন কোনওকিছু না জেনেশুনে আদর্শ রাষ্ট্র গড়াতে উঠেপড়ে লেগে যাবে।
এ বড় মারাত্মক ব্যবস্থা, এ বড় অনৈসলামিক কুব্যবস্থা। প্রাচীন ঐতিহ্যপন্থী মৌলবি-মৌলানাকে যত দোষ দিতে চান দিন, কিন্তু এ দোষ তাদের জানী দুশমনও দিতে পারবেন না যে তারা ধনী এবং গরিবের জন্য পৃথক পৃথক শিক্ষাব্যবস্থা করেছিলেন। ধনীর ছেলেকে তারা যেমন আরবি-ফারসি-উর্দু শিখিয়েছিলেন, গরিবের ছেলেকেও ঠিক সেই কারিকুলামের ভেতর দিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। যদি পাকচক্রে পূর্ব পাকিস্তানকে কোনওদিন উর্দু গ্রহণ করতেই হয় এবং স্বীকার করে নিতেও হয় যে আমাদের সাহিত্য এবং অন্যান্য সৃষ্টি উর্দুতেই হবে, তবে তাঁরা পাঠশালায়ও উর্দু চালাবেন। দেবভাষা ও গণভাষা বলে পৃথক পৃথক বস্তু স্বীকার করা ইসলাম-ঐতিহ্য পরিপন্থী।