তার ভৃত্য বনমালী তাঁর জন্য এক গেলাস শরবত এনে দেখে বাইরের কে বসে আছেন বনমালী থেমে যাওয়াতে কবি বললেন, ওগো বনমালী দ্বিধা কেন? কবি বলেছিলেন সাধারণ ধুলো-মাটির দৈনন্দিন ভাষাকে একটু মধুরতর করার জন্যে। অথচ বাক্যটি তাঁর নিজের মনেও এমনই চাঞ্চল্য তুলল যে তিনি সেদিনই গান রচনা করলেন,
হে মাধবী, দ্বিধা কেন,
আসিবে কি ফিরিবে কি–
আঙিনাতে বাহিরেতে
মন কেন গেল ঠেকি॥
এমনকি কমলালেবুর সওগাত পেয়ে, ধূপকাঠি জ্বালিয়ে যে তাকে সেগুলো নিবেদন করেছিল, তার স্মরণে তিনি যেসব কবিতা লিখেছেন, সেগুলো অনেক পাঠকই তাকে ব্যক্তিগতভাবে না-চিনেও স্মরণ করতে পারবেন।
এতেও কিন্তু তার এদিকটার পরিচয় অতিশয় অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আমরা তাকে প্রধানত চিনেছি গুরুরূপে। সে সম্বন্ধে সুধীরঞ্জন দাশ, প্রমথনাথ বিশী প্রাঞ্জল ভাষায় সবিস্তর লিখেছেন- আমারও সংক্ষেপে লেখার সুযোগ অন্যত্র হয়েছে। কিন্তু কেমন যেন মনে হয়, আমরা যেটুকু অসম্পূর্ণভাবে দেখেছি সেটিও যেন সম্পূর্ণ প্রকাশ করতে পারিনি।
এমন গুরু হয় না। পড়াবার সময় তিনি কখনও বাক্য অসম্পূর্ণ রাখতেন না– প্যারেনথেসিসে, অর্থাৎ এক বাক্যের ভিতর অন্য বাক্য এনে কখনও ছাত্রদের মনে দ্বিধার সৃষ্টিও করতেন না, এবং প্রত্যেকটি বক্তব্য তাঁর পরিপূর্ণ মধুরতম ভাষায় প্রকাশ করতেন। আমার মনে কণামাত্র দ্বিধা নেই যে, তার ক্লাস-পড়ানো যদি কেউ শব্দে শব্দে লিখে রাখতে পারত তবে সে রচনা তারপঞ্চভূত কিংবা অন্য যে কোনও শ্রেষ্ঠ রচনার সঙ্গে একাসনে বসতে পারত। এমনকি একথাও অনায়াসে বলা যায়, সে হত এক অদ্ভুত তৃতীয় ধরনের রচনা। এবং আশ্চর্য, তারই মাঝে মাঝে তিনি আমাদের প্রশ্নও জিগ্যেস করেছেন, উত্তরগুলো শুদ্ধ করে দিয়েছেন, তার একটি-আধটি শব্দ বদলে কিংবা সামান্য এদিক-ওদিক সরিয়ে তাকে প্রায় সুষ্ঠু দ্র-গদ্যে পরিণত করেছেন।
ছাত্রের সব প্রশ্নের উত্তর কোনও গুরু দিতে পারেন কি না বলা কঠিন, কিন্তু এটুকু বলতে পারি, আমাদের সম্ভব-অসম্ভব সব প্রশ্নের কথা ভেবে নিয়ে প্রতিদিন তিনি অনেক মূল্যবান (মূল্যবান এই অর্থে বলছি যে, তিনি যদি ওই সময়ে বিশ্বজনের জন্য গান কিংবা কবিতা রচনা করতেন, তবে তারা হয়তো বেশি উপকৃত হত) সময় ব্যয় করে পড়া তৈরি করে আসতেন। শেলি-কিটসের বেলা তা না-হয় হল, কিন্তু একথা কি সহজে বিশ্বাস করা যায়, তিনি তার আপন রচনাবলাকা পড়াবার সময়ে পূর্বে দেখে নিয়ে রেখে তৈরি হয়ে আসতেন।
এই ক্লাসেরই বৃহত্তর রূপ আমাদের সাহিত্য-সভা।
রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত নিয়মানুরাগী ছিলেন। যদিও আমাদের সাহিত্য-সভা নিতান্ত ঘরোয়া ব্যাপার তবু তিনি যেভাবে সে সভা চালাতেন, তার থেকে মনে হত অন্তত আইনের দিক দিয়ে যেন তিনি কোনও লিমিটেড কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারের মিটিং পরিচালনা করছেন। কোথায় কখন সভা হবে তার কর্মসূচি বা এজেন্ডা নিয়মানুযায়ী হল কি না, প্রত্যেকটি জিনিস তিনি অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন। একটি সামান্য উদাহরণ দিই।
সভাতে পাকাপাকিভাবে এজেন্ডা অনুযায়ী গান, প্রতিবেদন-পাঠ (মিনিটস অব দি লাস্ট মিটিং), প্রতিবেদনে কোনও আপত্তি থাকলে সে সম্বন্ধে আলোচনা এবং সর্বসম্মতিক্রমে তার পরিবর্তন, প্রবন্ধ পাঠ, আবৃত্তি, সঙ্গীত ইত্যাদির পর সাধারণের বক্তব্য (জেনারেল ডিসকাশন) শেষ হয়ে গেলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সভাপতির বক্তব্য বলতেন। এবং বিষয় গুরুতর হলে তাকে একঘণ্টা দেড়ঘণ্টা ধরে বক্তৃতা দিতেও শুনেছি।
একদা প্রতিবেদন পাঠের সময় সভার সবকিছু উল্লেখ করার পর আমি পড়ে যাচ্ছি। সর্বশেষে গুরুদেব সভাপতির বক্তব্যে বলেন–
এখানে এসে আমি থামলুম। কারণ গুরুদেব তাঁর পূর্ববর্তী সভাতে প্রায় এক ঘণ্টাকাল বক্তৃতা দিয়েছিলেন, এবং আমার প্রতিবেদনে তার সারাংশ লিখতে গিয়ে সাধারণ খাতার প্রায় আট পৃষ্ঠা লেগেছিল। আমার মনে সন্দেহ জাগল, এই দীর্ঘ আট পৃষ্ঠার প্রতিবেদন শোনার মতো ধৈর্য গুরুদেবের থাকবে কি না। কারণ যে জিনিস তিনি অতি সুন্দর ভাষায় একঘণ্টা ধরে বলেছেন, তারই সারাংশ লিখেছে একটি আঠারো বছরের বালক তার কাঁচা, অসংলগ্ন ভাষায়। সেটা শোনা কবির পক্ষে স্বভাবতই পীড়াদায়ক হওয়ার কথা। আমি তাই পড়া বন্ধ করে গুরুদেবের মুখের দিকে তাকিয়ে দ্বিধাভরা স্বরে শুধালুম, এই সারাংশটি আট পৃষ্ঠার। পড়ব কি? তিনি তার চিবুকে হাত রেখে আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন, পড়ো। আমাকে পড়তে হল। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল। কিছুদিন পরে দ্বিতীয় সভাতেও তারই পুনরাবৃত্তি। এবারেও সেই দ্বিধা প্রকাশ করলুম। একই উত্তর, পড়ো।
তখন বুঝলুম, তিনি সম্পূর্ণ না শুনে প্রতিবেদন-পুস্তকে তার নাম সই করবেন না। সেটা নিয়মানুযায়ী– লিগেল নয়।
কিন্তু পাঠককে চিন্তা করতে অনুরোধ করি, আঠারো বছরের ছোকরার কাঁচা বাঙলায় লেখা তাঁরই সর্বাঙ্গসুন্দর বক্তৃতার বিকলাঙ্গ প্রতিবেদন শোনার মতো পীড়াদায়ক অভিজ্ঞতাও তিনি এড়িয়ে যেতেন না। আমার শুধু মনে হত, এই অযথা কালক্ষয় না করে ওই সময়টাকে বাঁচিয়ে তিনি তো কোনও মহৎ কাজ করতে পারতেন।
***
রবীন্দ্রনাথ আমাদের গুরু এবং তিনি কবি। তাই তিনি আমাদের কবিগুরু। তিনি অবশ্য তাবৎ বাঙালির কাছেই কবিগুরু, কিন্তু সেটা অন্যার্থে অন্য সমাস। আমরা তাঁর কবি-রূপ দেখেছি অন্যভাবে।