অনেকটা এইসব কারণেই ডাকঘর তাই জনপ্রিয় হয়েছিল।
তাই আমার মনে হয়, ইংরেজ রবীন্দ্রনাথের ভাবের দিকটাই দেখেছিল বেশি, তাঁর রস-সৃষ্টি তারা ধরতে পারেনি। আমরা বাঙালি কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে চিনি প্রধানত রসস্রষ্টারূপে; তাই তাঁর বর্ষাবসন্তের গীতি, তাঁর বিরহ-বেদনার প্রতি প্রীতি আমাদের বেশি। রবীন্দ্রনাথ যতই অভিমান করে থাকুন না কেন, আমরা তাঁকে চিনেছি অন্য যে কোনও জাত অপেক্ষা বেশি।
তা সে যাই হোক, মূলকথায় ফিরে গিয়ে বলি, ভাবের পরিবর্তন হয় রসের পরিবর্তনের চেয়ে বেশি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বিজেতা ইংলন্ডেই ভগবানের বিশ্বাস একসঙ্গে অনেকখানি কমে যায়। বরঞ্চ পরাজিত জর্মনি আর কিছু না পেয়ে ভগবানকে আঁকড়ে ধরল। ইংলন্ডে তার জনপ্রিয়তা কমল; জর্মনিতে বাড়ল; তার কয়েক বৎসরের মধ্যেই জর্মন যখন আপন পায়ে খানিকটে দাঁড়াল সেখানেও তার জনপ্রিয়তা কমল– স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সেটা লক্ষ করে উল্লেখ করেছেন।
এর সঙ্গে একটা অত্যন্ত স্থল কথা বলে রাখি। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, ভাবের দিক দিয়ে হয়তো-বা ইউরোপের দু একজন গুণীজ্ঞানী গীতাঞ্জলির ব্রহ্মকে চিনতে পারবেন, কিন্তু ওই মহাদেশের সাধারণজন হয় তাকে অবহেলা করে, নয় চার্চের ভগবানকে নিয়েই তারা সন্তুষ্ট। আপন চেষ্টায় রসস্বরুপ পরমেশ্বরকে পাবার চেষ্টা তাদের নেই বললেও চলে। কিছুটা আছে ক্যাথলিক মিস্টিক ফাদারদের ভিতর কিন্তু তাঁরাও আপন ধর্মের দিগদর্শন নিয়েই সন্তুষ্ট। কাজেই এদিক দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে ইউরোপে কখনও জনপ্রিয় হবেন আমার মনে হয় না।
তাই যখন তার খ্যাতি ইউরোপে কমল, আমরা আশ্চর্য হইনি।
আজ যে রবীন্দ্রনাথের স্মরণে বিশ্ববাসী তাকে সম্মান জানাচ্ছে, তাঁকে নিয়ে আনন্দ করছে তাতে আমরা খুশি। কিন্তু কারণ অনুসন্ধান করলে জানব, আজ পৃথিবীর সব দেশই আমাদের প্রিয় হতে চায় তার অন্যতম কারণদ্বয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। এ উচ্ছ্বাস রবীন্দ্রনাথের সত্য পরিচয়ের উৎস থেকে উদ্বেলিত হয়নি। তাই বর্ষশেষে আবার যদি দেখি–১৯১৯ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত যা দেখেছিলুম– সে জোয়ার কোনও চিহ্নই রেখে যায়নি তাতে যেন বিস্মিত বা মর্মাহত না হই।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আমার অত্যন্ত সুদৃঢ় বিশ্বাস ইউরোপ একদিন রবীন্দ্রনাথের সত্য পরিচয় পাবে। সেটা সম্ভব হবে যেদিন ইংরেজ ফরাসি জর্মনের বেশকিছু লোক বাঙলাভাষার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ব্যাপকভাবে আপন আপন মাতৃভাষায় তাঁর রসসৃষ্টির অনুবাদ করবে। তার কিছু কিছু লক্ষণ এদিক-ওদিক দেখতে পাচ্ছি। একাধিক ক্যাথলিক ইতোমধ্যে অত্যুত্তম বাঙলা শিখে নিয়েছেন এবং একাধিক জর্মন এই নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক বা অন্য যে কোনও কারণেই হোক, আরও অনেক বিদেশি বাঙলা শিখবে এবং অবশেষে রবীন্দ্রনাথের রচনা উপযুক্ত লোক দ্বারা অনূদিত হবে।
আমার ভয় শুধু একটি, এ দেশে তথা বিদেশে ক্লাসিকদের সম্মান ক্রমেই কমে যাচ্ছে। মানুষ মনোরঞ্জক দিকটাই দেখছে বেশি; ক্লাসিকদের স্থায়ী গভীর সচ্চিদানন্দ রস তারা পরিশ্রম করে আস্বাদ করতে চায় না অথচ রবীন্দ্রনাথের মূল উৎস সেইখানেই।
সেই ভয় আমি কাটাই এই ভরসা করে যে, রেনেসাঁসও তো হয়। বিরক্ত হয়ে আধুনিককে বর্জন করে মানুষ এ সংসারে কত-না বার অপেক্ষাকৃত প্রাচীনের সন্ধানে বেরিয়ে নিত্য নবীনের সন্ধান পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ নিত্য নবীন।
.
কবিগুরু গুরুদেব
রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বহু প্রতিষ্ঠান নানা পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করছেন। এঁদের অন্যতম প্রতিষ্ঠান এই সম্পর্কে একটি শর্ত আরোপ করেন যে, কোনও লেখক যেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয়ের উপলক্ষ করে কোনও রচনা না পাঠান। এই প্রতিষ্ঠানটির মনে হয়তো শঙ্কা ছিল, রবীন্দ্রনাথের নাম করে এঁরা হয়তো নিজেদের আত্মজীবনী লিখে বসবেন। শঙ্কাটা কিছু অমূলক নয়।
কিন্তু এ শর্তের ভিতর একটা গলদ রয়ে গেল। এই প্রথম শতবার্ষিকী উপলক্ষেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয়ের কথা উল্লেখ করা যাবে দ্বিতীয় জন্ম-শতবার্ষিকীর সময় এত দীর্ঘায়ু কেউ থাকবেন বলে ভরসা হয় না। কাজেই এই শতবার্ষিকীতে কেউই যদি মানুষ রবীন্দ্রনাথকে কীভাবে চিনেছিলেন, সেকথা না লেখেন, তবে দ্বিতীয় শতবার্ষিকীতে যারা আজকের দিনের প্রকাশিত প্রবন্ধাদি পড়ে মানুষ রবীন্দ্রনাথের মূর্তিটি নির্মাণ করতে চাইবেন, তারা নিশ্চয়ই বিক্ষুব্ধ হবেন। অবশ্য এই নিয়ে যে অন্যত্র ভূরি ভূরি লেখা হয়নি তা নয়, কিন্তু শতবার্ষিকীর নৈমিত্তিক ধ্যান একরকমের, অন্য নিত্য-রচনা অন্য ধরনের।
***
কিন্তু এই মানুষ-রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয়, তারও বর্ণনা দেওয়া কি সহজ? প্রথমত, রবীন্দ্রনাথ, আর পাঁচজন কবি কিংবা গায়কের মতো আপন কবিতা বা গান রচনা করার পর চট করে ধুলার সংসারে ফিরে এসে রাম-শ্যাম-যদুর মতো তাস পিটে, হুঁকো টেনে দিন কাটাতেন না। দৈনন্দিন জীবনে ফিরে আসার পরও তার বেশভূষা, বাক্যালাপ, আচার-আচরণে, দুষ্টের দমনে এবং শিষ্টের পালনে (আশ্রমের ছাত্রদের কথা হচ্ছে) তিনি কবিই থেকে যেতেন। এমনকি, আশ্রমের নর্দমা সম্বন্ধে আলোচনা করার সময় কবিজনোচিত কোনও বাক্য বেমানানসই মনে হলে এবং মনে রাখা উচিত সেই বেমানানসইটাও তাঁর কবিসুলভ হৃদয়ই ধরে নিত– সেটাকে তিনি অন্তত কিছুটা হাস্যরস দিয়ে উচ্চপর্যায়ে তুলে নিয়ে আসতেন। কিংবা সামান্য একটু অন্যধরনের একটি উদাহরণ নিন।