রবীন্দ্রনাথকে সেভাবে দেখাবার মতো মনীষী এখনও এ জগতে আসেননি।
প্রার্থনা করি, আমাদের জীবদ্দশায়ই তিনি আসেন। বড় বাসনা ছিল, মৃত্যুর পূর্বে তার বিশ্বরূপটি দেখে যাই ৷
.
ইউরোপ ও রবীন্দ্রনাথ
ইউরোপের ভিন্ন ভিন্ন দেশবাসীর সঙ্গে যারাই অন্তরঙ্গভাবে মিশেছেন তারাই হৃদয়ঙ্গম করেছেন যে, ইউরোপবাসী রবীন্দ্রনাথকে চেনে কত অল্পই। অথচ আমরা সকলেই জানি যে, রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি গীতাঞ্জলি যখন প্রথম বিলাতে প্রকাশিত হয় তখন তিনি সেদেশে কী অদ্ভুত সংবর্ধনা পেয়েছিলেন। তার কয়েক বৎসর পর যখন কবি কন্টিনেন্ট ভ্রমণ করেন তখন তাঁকে দেখবার জন্য, তাঁর বক্তৃতা শোনবার জন্য কী অপরিসীম আগ্রহ নিয়ে কত লক্ষ লক্ষ লোক তাঁর চতুর্দিকে সমবেত হয়েছে। এবং সর্বশেষ কথা এ জানি যে, ক্রমে ইউরোপে তার খ্যাতি ম্লান হতে থাকে, এমনকি একাধিক সুপরিচিত সমালোচককে একথাও বলতে শোনা গিয়েছে, তাঁকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হল কোন স্থূল বুদ্ধিতে এবং যারা টমসনের রবীন্দ্রজীবনী মন দিয়ে পড়েছেন তারাও হতাশ হলেন এই দেখে যে তিনি পর্যন্ত কাব্যরসে আদৌ নিমজ্জিত হতে পারেননি, অথচ তিনি যে খানিকটা বাঙলা ভাষা জানতেন সেকথাও সত্য। এ বইখানা রবীন্দ্রনাথকেও কিঞ্চিৎ বিক্ষুব্ধ করেছিল এবং বোধহয় তার প্রধান কারণ তিনিও হতাশ হলেন এই ভেবে যে, টমসনই যখন তার কাব্যরস আস্বাদন করতে পারলেন না তখন ইউরোপের সাধারণ পাঠক করবে কী প্রকারে?
রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি গীতাঞ্জলি নিয়ে যখন ইংরেজ কবিগণ মত্ত তখন এদেশে আমরা আশ্চর্য হয়েছি যে এর ভিতর ইংরেজ কী পাচ্ছে যে তার এত উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছে। গীতাঞ্জলির গান বাংলায় গাওয়া হয় ইংরেজিতে তা নেই- বাঙলায় অনেকখানি জায়গা জুড়ে এ গানগুলো ইংরেজিতে যেন চুম্বক, এবং বাঙলা কবিতারূপে এ গানগুলোর যে গীতিরস পাই (সুর বাদ দিয়েও) ইংরেজিতে তা কই! মনকে তখন এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছি যে, হয়তো ইংরেজ পাঠক ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে তার মাতৃভাষায় এমন এক ইংরেজি গীতিরস পায় যেটা আমাদের অনভ্যস্ত কান ধরতে পারে না।
হংস যেমন মানসযাত্রী তেমনি সারা দিবস রাত্রি
একটি নমস্কারে প্রভু, একটি নমস্কারে
সমস্ত প্রাণ উড়ে চলুক মহামরণপারে।
এটিকে কবিতারূপে পড়ে আমরা যে গীতিরস পাই,
Like a flock of homesick cranes flying night & day back to their mountain nests, let all my life take its voyage to its enternal home, in one salutation to Thee:
পড়ে তো সে-রস পাইনে। তখন মনকে বুঝিয়েছি যে হয়তো এই ইংরেজি অনুবাদে শব্দগুলো এমনভাবে চয়ন ও সাজানো হয়েছে যে ইংরেজ তার ভিতর আপন গীতির পেয়ে মুগ্ধ হয়েছে।
গীতাঞ্জলির ফরাসি জর্মন এবং অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ ইংরেজি অনুবাদ থেকে। সেসব অনুবাদে মূলের রস আরও পরিশুষ্ক হওয়ার কথা।
রসের দিকের কিছুটা বাদ দিয়ে যখন ভাবের দিকটা দেখি তখন বরঞ্চ খানিকটা বুঝতে পারি, ইংরেজি এবং অংশত ফরাসি-জর্মন তথা অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষার গীতাঞ্জলি কেন গুণীজনকে মুগ্ধ করেছিল।
প্রথমত রবীন্দ্রনাথ তাঁর ইংরেজি অনুবাদে ব্যবহার করেছেন কিঞ্চিৎ প্রাচীন ইংরেজি। সে ভাষা কিছুটা ইংরেজি বাইবেলের ভাষা। এদেশের তুলনা নিলে বলব, যে বাঙালি বৈষ্ণবভক্ত বিদ্যাপতি পড়ে আনন্দ পান তিনি ভানুসিংহের পদাবলীর ভাষা পড়েই মুগ্ধ হবেন, তার গভীরে অতখানি প্রবেশ করবেন না– বিশেষত সে যদি অবাঙালি হয় এবং বৈষ্ণব না হয়ে স্লেচ্ছ-যবন হয়।
দ্বিতীয়ত গীতাঞ্জলিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রভু-সখা-প্রিয়কে যে রূপ দিয়েছেন তার সঙ্গে ইংরেজ কিছুটা পরিচিত। বাইবেলের সং অব সংস (সং অব সলোমন) এবং সাম্স গীতির সঙ্গে যারা পরিচিত তাঁরা মিলটি অনায়াসেই দেখতে পাবেন। পার্থক্য শুধু এই যে সং অব সলোমনে প্রেমের দৈহিক দিকটা অনেকখানি প্রাধান্য পেয়েছে– গীতাঞ্জলিতে তা নয়– এবং সামস গীতিতে ভগবানের প্রিয় স্বরূপ কম, তিনি সেখানে দয়াল প্রভু, তিনি সর্বশক্তিমান কর্তা, তিনি ইচ্ছে করলে এ দাসকে তার করুণা থেকে বঞ্চিতও করতে পারেন। এর সঙ্গে যোগ দেওয়া যেতে পারে সান্ খোয়ান দে লা ক্রুসের ভগবদ্ প্রেমের কাব্য। এর মিল সং অব সংসের সঙ্গে কিঞ্চিৎ কায়িক প্রেম। যে ইয়েটস রবীন্দ্রনাথকে ইউরোপের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রপাত করে দিয়েছিলেন তিনি সান খোয়ানের ভক্ত ছিলেন এবং তার রচনাতে এর প্রচুর উদ্ধৃতি আছে। কিছুটা এই কারণেও ইয়েটস এবং তার সম্প্রদায়ের পক্ষে রবীন্দ্রনাথকে বোঝা সহজ হয়েছিল।
তৃতীয়ত গীতাঞ্জলির প্রভু-সখা-প্রিয় কোনও বিশেষ সম্প্রদায় বা ধর্মের ভগবান নহেন। ইংলন্ডে এরকম অনেক ভাবুক আছেন যারা খ্রিস্টধর্ম সম্বন্ধে উদাসীন, এবং তাই সম্প্রদায়মুক্ত চিত্তে ঈশ্বরের কাছে আসতে চান। ওদিকে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু (এখানে ব্রাহ্ম-হিন্দুর পার্থক্যের কথা উঠছে না–বিদেশির কাছে এ-দেশের ব্রাহ্মণ মাত্রই যে হিন্দু সে তারা ধরে নেয়) হয়েও যে ব্রহ্মকে তাদের সামনে কাব্যে রসস্বরূপ প্রকাশ করলেন তা দেখে তাদের বিস্ময়ের অবধি রইল না। এইসব সংস্কারমুক্ত ইংরেজ দূর-বিদেশির আরাধনার ধন আপন সাধনার ধনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে–দুই-ই এক ভগবান। তারা আশ্বস্ত হল, তারা একা নয়। খ্রিস্টধর্মে আস্থা হারিয়েও তারা দেখে ধর্ম তাদের ছাড়েনি।