এসো এসো হে তৃষ্ণার জল
বর্ষার গান। অন্তত সেই ঋতুতেই গাওয়া হয়। তা হলে প্রশ্ন উঠবেভেদ করি কঠিনের ক্রুর বক্ষতলগূঢ় অন্ধকার হতে কে আসছে? মরুদৈত্য কোন মায়াবলে তোমারে করেছে বন্দী পাষাণশৃঙ্খলে কে সে?
আসলে এটি রচিত হয় শান্তিনিকেতনে প্রথম টিউবওয়েল খননের সময়। মাটির নিচে যে জল বন্দি হয়ে আছে তাকে বেরিয়ে আসবার জন্য কবি কর্মযোগের প্রতীক কলকজার বন্দনা-গীতি ধরেছেন।
সবসময়েই তিনটি জিনিস যে একই আধারে থাকবে এমন কোনও ধরাবাধা নেই কিন্তু মোটামুটি বলা যেতে পারে, তিনি দুই, আড়াই কিংবা তিন ডাইমেনশনেই চলুন, আমরা চলতে জানি শুধু এক ডাইমেনশনে এবং তাই তাঁর সমগ্র রূপ আমাদের পক্ষে ধরা কঠিন, প্রায় অসম্ভব (তিরোধানের পূর্বে তিনি এক চতুর্থ ডাইমেনশনে চলে যান এবং সেটি এমনই রহস্যাবৃত যে, উপস্থিত সেটি উল্লেখ করব না; কারণ ওইটে ভালো করে বোঝবার জন্য আমি এখনও হাতড়ে হাতড়ে এগোচ্ছি)।
সে অসম্ভব কি কখনও সম্ভব হবে, এবং যদি হয় তবে কী প্রকারে হবে?
এটা বোঝানো যায় শুধু তুলনা দিয়ে।
চিত্রকর বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়কে গুণী রসিকেরা চেনেন। তাঁর দৃষ্টিশক্তি বাল্যবয়স থেকেই ক্ষীণ। তিনি চার হাত দূরের থেকেই কোনও জিনিস ভালো করে দেখতে পেতেন না।
যৌবনে তিনি একখানি বিরাট দেয়াল-ছবি বা ফ্রেস্কো আঁকতে আরম্ভ করেন। বড় বড় চিত্রকররাও সম্পূর্ণ ফ্রেস্কোর পূর্ণাঙ্গ রূপ দেখার জন্য বার বার পিছনে হটে ছবিটাকে সমগ্ররূপে দেখে নেন। আমরা, দর্শকরাও ছবি শেষ হওয়ার পর যখন সেটি দেখি তখন দূরের থেকে তার পূর্ণাঙ্গ রূপ দেখি তখন খুঁটিনাটি, সূক্ষ্ম কারুকার্য দেখতে পাইনে– পরে কাছে গিয়ে খুঁটিনাটি দেখি তখন আর তার পূর্ণাঙ্গ রূপ দেখতে পাইনে।
পূর্বেই বলেছি, বিনোদবিহারী দূরের থেকে কিছুই দেখতে পান না। তাই তিনি অনুমানের ওপর নির্ভর করে একদিকে ছবি আঁকা আরম্ভ করে অন্যপ্রান্তে এসে শেষ করতেন, কিংবা খাবলা খাবলা করে যেখানে খুশি খানিকটে এঁকে নিতেন। পরে দেখা যেত পার্সপেকটিভ না দেখতে পেয়েও বিনোদবিহারীর বিরাট ফ্রেস্কোর এ-কোণের হাতি ও-কোণের প্রজাপতির চেয়ে যতখানি বড় হওয়ার কথা ততখানি বড়ই হয়েছে। তিনি অবশ্য কখনও সেটা দেখতে পেতেন না, কারণ যতখানি দূরে এলে আমরা সমগ্র ছবি দেখতে পাই ততখানি দূরে এলে তিনি সবকিছু ধোয়াটে দেখতেন।
একদিন তাঁর এক শিষ্য একটি ক্যামেরা নিয়ে এসে উপস্থিত। যতখানি দূরে দাঁড়ালে পুরো ক্যামেরায় ধরা পড়ে ততখানি দূরে দাঁড়িয়ে সে ক্যামেরায় ঘষা কাঁচের উপর প্রতিবিম্বিত পুরো ফ্রেস্কোটি সে বিনোদবিহারীকে দেখাল। এই তিনি তাঁর আঁকা পূর্ণাঙ্গ ছবি জীবনে প্রথম দেখতে পেলেন। একসঙ্গে এককোণের হাতি ও অন্যকোণের প্রজাপতি দেখতে পেলেন, এক চিত্রাংশ অন্য চিত্রাংশের সঙ্গে ঠিক ঠিক যেমনটি তিনি চেয়েছিলেন খাপ খেয়ে আঁকা হয়েছে কি না দেখতে পেলেন। অবশ্য ঘষা কাঁচের উপর খুঁটিনাটি কারুকার্য দেখতে পাননি, কিন্তু সে জিনিসে তার প্রয়োজন ছিল না; কারণ কাছে দাঁড়িয়ে তো তিনি সেগুলো ভালো করেই দেখতে পান।
এই ক্ষুদ্র রচনায় আমি এত দীর্ঘ একটি উপমা দিলাম কেন? কারণ বহু বৎসর ধরে ভেবে ভেবেও আমি এযাবৎ খুঁজে পাইনি কী করে আরও সংক্ষেপে আমার বক্তব্যটা বোঝাতে পারি।
পূর্বেই বলেছি, সমগ্রভাবে রবীন্দ্রনাথকে দেখতে হলে আমাদের যতখানি দূরে যেতে হয় ততখানি দূরে গেলে আমাদের সবকিছু ধোঁয়া লাগে। ঘষা কাঁচ হলে আমরা তার পূর্ণ রূপ দেখতে পেতুম।
তা হলে এই ঘষা কাচ জিনিসটে কী?
কোনও মহৎ কবির পরবর্তীকালে যখন সবাই তার বিরাট সমগ্র রূপ দেখার চেষ্টা করে নিষ্ফল হচ্ছে তখন হঠাৎ আবির্ভূত হন আরেক মহৎ ব্যক্তি যিনি কবির সর্বাঙ্গসুন্দর সমগ্র ছবি ঘষা কাঁচের মতো তাঁর বুকে ফুটিয়ে তোলেন। তাঁর রচনায়, তাঁর কাব্যে তিনি তখন কবিকে এমনভাবে এঁকে দেন যে আমরা অক্লেশে তার পূর্ণ ছবিটি দেখতে পাই। শক্তিমান জন দ্বারা কোনও দুরূহ কার্য সমাধিত হওয়ার পর সাধারণের পক্ষে তা অতি সহজ হয়ে দাঁড়ায়। তাই কালিদাস বলেছেন,
মণৌ বজ্র-সমুত্তীর্ণে সূত্রস্যেবাস্তি মে গতিঃ
কঠিন মণিকে হীরক দ্বারা বিদ্ধ করিলে যেমন সেই ছিদ্র দিয়া অনায়াসে ওই মণির মধ্যে সূত্রের প্রবেশ সম্ভব।
কালিদাস সুবাদেই বলি, এই এ যুগের আমাদের রবীন্দ্রনাথই তার যে সর্বাঙ্গসুন্দর ছবি এঁকেছেন, ভারতীয় সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে তার যে বিরাট কলেবর আমাদের দেখিয়েছেন, সে তো অন্য কেউ ইতোপূর্বে করে উঠতে পারেননি।
পৃথিবীর ইতিহাসে এ যোগাযোগ বিরল নয়। এ বিষয়ে সর্বাপেক্ষা ভাগ্যবান জর্মন সাহিত্য। গ্যোটের পঞ্চমুখে পঞ্চতন্ত্র কথা একইসঙ্গে শোনবার ক্ষমতা অর্জন করার জন্য জর্মনিকে বহুকাল অপেক্ষা করতে হয়নি। তাদের সৌভাগ্য, অংশত গ্যোটেরও সৌভাগ্য যে, তাঁরই জীবদ্দশায় হাইনের মতো কবি জন্মগ্রহণ করেন। দু জনাতে কয়েক মিনিটের তরে দেখাও হয়েছিল মাত্র একবার। সে অভিজ্ঞতা কারওরই পক্ষে সুখদা হয়নি। কিন্তু পরবর্তী যুগে হাইনে যখন ঘষা কাঁচের মতো তার বুকের উপর গ্যোটের পূর্ণ ছবি প্রতিবিম্বিত করলেন তখন জর্মন মাত্রই গ্যোটের বিরাট ব্যক্তিত্ব অতি সহজে হৃদয়ঙ্গম করতে পারল।