ঠিক সেই কারণেই, রবীন্দ্রনাথের কবিতা আলোচনা করার দিন বোধহয় এখনও আসেনি। যে পৃথিবীকে তিনি দীর্ঘকাল ধরে অতি নিবিড়ভাবে ভালোবেসেছিলেন সেই পৃথিবী ছেড়ে তিনি মাত্র সেদিন চলে গেছেন। শোকে বাংলাদেশ মুহ্যমান। তাঁর সৃষ্ট সাহিত্য-সমালোচনার জন্য যে পরিমাণ সময়ের ব্যবধান প্রয়োজন তা আমরা এখনও পাইনি।
১৯৩৯ সালে গুরুদেবের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হল শান্তিনিকেতনে।
তাকিয়ে বললেন, লোকটি যে বড় চেনা-চেনা ঠেকছে। তুই নাকি বরোদার মহারাজা হয়ে গেছিস?
আমি আপত্তি জানালুম না। তর্কে তাঁর কাছে বহুবার নাজেহাল হয়েছি। আপত্তি জানালে তিনি প্রমাণ করে ছাড়তেন, আমিই বরোদার মহারাজা, নয়তো কিছু একটা জাঁদরেল গোছের।
নিজেই বললেন, না না। মহারাজা নয়, দেওয়ান-টেওয়ান কিছু একটা।
আমি তখনও চুপ। মহারাজা দিয়ে যখন আরম্ভ করেছেন, কোথায় থামবেন তিনিই জানেন।
তার পর বললেন, কীরকম আছিস? খাওয়া-দাওয়া?
আমি বললুম, আপনি ব্যস্ত হবেন না।
আরে না না, আজকালকার দিনে খাওয়া-দাওয়া যোগাড় করা সহজ কর্ম নয়। তোকে আমি একটা উপদেশ দি। ওই যে দেখতে পাচ্ছিসটাটা ভবন তাতে একটি লোক আছে, তার নাম পঞ্চা; লোকটি রাধে ভালো। তার সঙ্গে তুই যদি যোগাযোগ স্থাপন করতে পারিস তবে ওখানে তোর আহারের দুর্ভাবনা থাকবে না।
আমি তাকে আমার খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হবার জন্যে অনুরোধ জানালাম।
তখন বললেন, তুই এখনও বরোদা কলেজে ধর্মশাস্ত্র পড়াস, না?
আমি জানতুম, তিনি ঠিক জানেন শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্রেরা কে কী করে। তাই মহারাজা বা দেওয়ান আখ্যায় আপত্তি জানাইনি।
তার পর বললেন, জানিস, তোদের যখন রাজা-মহারাজারা ডেকে নিয়ে সম্মান দেখায় তখন আমার মনে কী গর্ব হয়, আমার কী আনন্দ হয়। আমার ছেলেরা দেশ-বিদেশে কৃতী হয়েছে।
তার পর খানিকক্ষণ আপন মনে কী ভেবে বললেন, কিন্তু জানিস, আমার মনে দুঃখও হয়। তোদের আমি গড়ে তুলেছি, এখন আমার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য তোদের প্রয়োজন। গোখলে, শুক্ল, তোরা সব এখানে থেকে আমাকে সাহায্য করবি। কিন্তু তোদের আনবার সামর্থ্য আমার কোথায়?
তা যাক। বলতে পারিস সেই মহাপুরুষ কবে আসছেন কাঁচি হাতে করে?
আমি অবাক। মহাপুরুষ তো আসেন ভগবানের বাণী নিয়ে, অথবা শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মা নিয়ে। কাঁচি হাতে করে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ কাঁচি নিয়ে। সেই কাঁচি দিয়ে সামনের দাড়ি ঘেঁটে দেবেন, পেছনের টিকি কেটে দেবেন। সব চুরমার করে একাকার করে দেবেন। হিন্দু-মুসলমান আর কতদিন এরকম আলাদা হয়ে থাকবে।
তার পর আধঘণ্টা ধরে অনেক কিছু বললেন হিন্দু-মুসলমানের কলহ নিয়ে। তাঁকে যে এই কলহ কত বেদনা দিত সে আমি জানি। আমাকে যে বলতেন তার কারণ বোধহয় আমি তার মুসলমান ছাত্র। বোধহয় মনে করতেন আমি তাকে ঠিক বুঝতে পারব।
গুরুদেব তখন বেশি কথা বললে আঁপিয়ে উঠতেন। আমি তাই তার কথা বন্ধ করার সুযোগ খুঁজছিলাম। তিনিই হঠাৎ লক্ষ করলেন, আমার জামার পকেটে ছোট্ট ক্যামেরা। বললেন, ছবি তোলার মতলব নিয়ে এসেছিস বুঝি। তোল, তোল। ওরে সুধাকান্ত,
পরদাগুলো সরিয়ে দে তো। কীরকম বসব বল।
আমি বললুম, আপনি ব্যস্ত হবেন না; আমি ঠিক তুলে নেব।
তোর বোধহয় খুব দামি ক্যামেরা, জার্মানি থেকে নিয়ে এসেছিস, সব কায়দায় ছবি তোলা যায়। অন্যেরা বড় জ্বালাতন করে; এরকম করে বসুন, ওরকম করে বসুন। কত কী!
ছবি তোলা শেষ হলে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি দেখে বললেন, কী রে, কিছু বলবি নাকি?
আমি বললুম, একটা কথা বলতে চাই যদি কিছু মনে না করেন।
তিনি ক্লাসে যেরকম উৎসাহ দিতেন ঠিক সেইরকমভাবে বললেন, বল, বল, ভয় কী?
আমি বললুম, এই যে আপনি বললেন, আপনার সামর্থ্য নেই আমাদের এখানে নিয়ে আসবার, সেই সম্পর্কে আমি শুধু আমার নিজের তরফ থেকে বলছি যে, বিশ্বভারতীর সেবার জন্য যদি আমাকে প্রয়োজন হয় তবে ডাকলেই আসব। যা দেবেন হাত পেতে নেব।
গুরুদেব বললেন, সে কি আমি জানিনে রে, ভালো করেই জানি। তাই তো তোদের কাছে আমার সামর্থ্যহীনতার কথা স্বীকার করতে সঙ্কোচ হয় না।
মনে হল গুরুদেব খুশি হয়েছেন।
.
গুরুদেব আজ নেই।
কিন্তু সেই হারানো দিনের স্মৃতি আজও আমার মনে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।
.
রবির বিশ্বরূপ
রবীন্দ্রনাথকে সমগ্রভাবে গ্রহণ করার শক্তি আমাদের নেই। গীতাতে উক্ত তিন মার্গেই একসঙ্গে একই মানুষ চলেছে এর উদাহরণ বিরল। তিনি জ্ঞানী ছিলেন; শব্দতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন। তিনি কর্মী ছিলেন; গ্রামোন্নয়ন, কৃষির উৎকর্ষ, সমবায় সমিতি, শ্রীনিকেতন বিদ্যালয় তিনি নির্মাণ করেছিলেন। তিনি রসের সাধক ছিলেন– এটাকে ভক্তিমার্গ বলা যেতে পারে তিনি তাঁর ভগবানকে প্রধানত রসম্বরূপেই আরাধনা করেছিলেন এবং ইহজগতের প্রিয়া, প্রকৃতিকে সেই রসস্বরূপেই কাব্যে, নাট্যে, গানে প্রকাশ করেছেন।
অথচ কোনও স্থলেই তিনি খণ্ডিত বা বিচ্ছিন্ন নন। অর্থাৎ প্রকৃত বৈজ্ঞানিকের মতো যখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শব্দ সঞ্চয় করে ভাষাতত্ত্ব সম্বন্ধে পুস্তিকা লিখছেন তখন তাঁর ভাষা কঠিন শব্দতাত্ত্বিকের নয়, তাঁর ভাষা সরস কবির মতো। এবং সেখানে তিনি কর্মযোগীর ন্যায় এ উপদেশও দিচ্ছেন, কী করে সে ভাষাতত্ত্বের পুস্তক কাজে লাগাতে হয়। পক্ষান্তরে তিনি যখন বর্ষা, বসন্তের গান লিখছেন তখন উদ্ভিদবিদ্যায় অজ্ঞ সাধারণ কবির মতো একই ঋতুতে কদম্ব আমঞ্জরী ফোঁটান না। বস্তুত আমাদের দেশে যে শত শত দিশি বিদেশি ফুল ফোটে, কোন জায়গায় কী সার দিলে ভালো করে ফোটে, এসব খবরও রাখতেন। বিদেশি ফুলের নামকরণ করতেন, একাধিক নাম-না-জানা দিশি ফুলেরও নামকরণ করেছেন। কথিত আছে–শহরাগত এক নবীন শিক্ষক অত্যন্ত সাধারণ জাম না গাবগাছ চিনতে পারেননি বলে কবি তাঁর হাতে শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েদের সঁপে দিতে নারাজ হয়েছিলেন। আবার হাল চালানো, গাছ পোতার মতো নীরস গদ্যময় ব্যাপার কী হতে পারে?– শ্রীনিকেতনে যারাই হলকর্ষণ বৃক্ষরোপণ উৎসব দেখেছেন তারাই জানেন কবি কীভাবে এ দুই সাধারণ কর্মকে সৌন্দর্যের পর্যায়ে তুলে নিয়েছেন। অনেকেরই বিশ্বাস–