আমার মনে হয় এইটেই ছিল রবীন্দ্রনাথের মূল সুর। চিরজীবন তিনি বহু-র ভেতর একের সন্ধান করেছিলেন। তার সে সাধনা আমি প্রত্যক্ষ দেখেছি। সৌভাগ্যক্রমে প্রায় এক বৎসর শান্তিনিকেতনে আমি ছিলুম এক ঘরের নিচের তলায়। সেখান থেকে জানালা দিয়ে মুখ বাড়ালেই দেখতে পেতুম, গুরুদেব তাঁর জানালার পাশে বসে লেখাপড়া করছেন। সকালে চারটার সময় দুঘন্টা উপাসনা করতেন। তার পর ছটার সময় স্কুলের ছেলেদের মতো লেখাপড়া করতেন। সাতটা, আটটা, নটা, তার পর দশ মিনিটের ফাঁকে জলখাবার। আবার কাজ–দশটা, এগারোটা, বারোটা। তার পর খেয়েদেয়ে আধঘণ্টা বিশ্রাম। আবার কাজ– লেখাপড়া; একটা, দুটো, তিনটে, চারটা, পাঁচটা কাজ, কাজ, কাজ। পাঁচটা থেকে সাতটা ছেলেমেয়েদের গান শেখাতেন– বা দিনুবাবুর আসরে বসে গান শুনতেন, অথবা গল্প-সল্প করতেন। তার পর খাওয়াদাওয়া সেরে আবার লেখাপড়া, মাঝে মাঝে গুনগুন করে গান– আটটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত! কী অমানুষিক কাজ করার ক্ষমতা। আর কী অপরিসীম জ্ঞানতৃষ্ণা!
আমি তখন নিতান্তই তরুণ। আমার থেকে যারা প্রবীণ এবং জ্ঞানী তারা গুরুদেবের জীবনের অনেক ইতিহাস জানেন। তারা রবীন্দ্রনাথের নানা সৃষ্টির নানা আলোচনা করবেন। তাঁর সৃষ্টির অনেক কিছু অমর হয়ে থাকবে, অনেক কিছু লোপ পাবে।
কিন্তু এ বিষয়ে আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, চিরন্তন হয়ে থাকবে রবীন্দ্রনাথের গান। জর্মনিরলিডর গান ইউরোপের গীতিকাব্যের মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ একথা বললে অত্যুক্তি হয় না। এমন সব গান লিডরে আছে যার কথা দিয়েছেন গ্যেটের মতো কবি আর সুর দিয়েছেন বেটোফেনের মতো সুনিপুণ সুরশিল্পী। আমার মনে হয়, তার চাইতেও শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রনাথের গান। কারণ রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল একাধারে গীতিকার এবং সুরস্রষ্টার প্রতিভা। রবীন্দ্রনাথের গান বাঙালির কণ্ঠে চিরকাল বেঁচে থাকবে। কেউ যদি বলেন, না, চিরস্থায়ী তা হবে না– আমি তর্ক করব না। কারণ আর যা নিয়ে চলুক; গান নিয়ে, গীতি-কবিতা নিয়ে তর্ক চলে না। গানের আবেদন সরাসরি একেবারে মানুষের মর্মস্থলে গিয়ে পৌঁছায়। গান হৃদয়কে দোলা দেয়, অন্তরে জাগায় অনির্বচনীয় অনুভূতি; যুক্তিতর্কের অপেক্ষা রাখে না।
প্রসঙ্গক্রমে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য এবং সঙ্গীত সম্বন্ধে দু চারটি কথা বললাম। সে বিপুল সাহিত্যের খানিকটা বুঝেছি, বেশিরভাগই বুঝিনি। কিন্তু, তার সাহিত্যালোচনার দিন আজ নয়। আজ শুধু আমার স্নেহপ্রবণ গুরুদেবের সংবেদনশীল অন্তরটির পরিচয় দেবার জন্যেই আরও কয়েকটি কথা বলে এ প্রসঙ্গ শেষ করব। কবি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ধরা-ছোঁয়ার অতীত; সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। কিন্তু আমাদের কাছে তিনি যে ছিলেন স্নেহাসক্ত গুরু, নিতান্তই মাটির মানুষ। কিন্তু মানুষ রবীন্দ্রনাথের স্বরূপ উদঘাটিত করাও যে দুঃসাধ্য। হিমালয়ের পাদমূলে বসে বিচিত্র পুষ্প চয়নকালেও ক্ষণে ক্ষণে গৌরী-শিখরের বিরাট, বিশাল, গম্ভীর মহিমা হৃদয়কে নির্বাক বিস্ময়ে স্তম্ভিত করে দিয়েছে।
শান্তিনিকেতন লাইব্রেরিতে অবসর সময়ে ক্যাটালগ তৈরি করতুম। তখন প্রতিদিন দেখতুম পাঠান্তে নতুন পুরাতন বই তিনি লাইব্রেরিতে ফেরত পাঠাতেন। রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, নতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, দর্শন, কাব্য, কত বলব! এমন বিষয় নেই যাতে তাঁর অনুসন্ধিৎসা ছিল না।
এদিক দিয়ে তিনি ছিলেন আজীবন জ্ঞান-সাধক। কিন্তু তাই বলে জীবনকে সকল দিক থেকে বঞ্চিত করে কঠোর জ্ঞানমার্গ তিনি অবলম্বন করেননি। তিনি তার একটি বিখ্যাত কবিতায় বলেছেন ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করি যোগাসন সে নহে আমার পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ উপভোগের আকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন কঠোর সংযমী। এক হিসেবে তিনি ছিলেন প্রকৃত তপস্বী। তপস্যা;- সে তো শক্তি সঞ্চয়ের জন্যেই। তার একটি কবিতায় আছে–
জানি জানি এ তপস্যা দীর্ঘ রাত্রি
করিছে সন্ধান,
চঞ্চলের মৃত্যুস্রোতে আপন উন্মত্ত অবসান।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, রবীন্দ্রনাথ জীবনে অতীন্দ্রিয় সত্যের সন্ধান পেয়েছিলেন। তাঁর ঋষি-দৃষ্টির সমক্ষে সত্যের স্বরূপটি উদ্ঘাটিত হয়েছিল পরিপূর্ণ মহিমায়। তারই পরিচয় তার অজস্র গানে, কবিতায়, ধর্ম এবং শান্তিনিকেতনের নিবন্ধগুলোতে। রবীন্দ্রনাথের জ্ঞান শুধু পুঁথি-পড়া জ্ঞান নয়, তা সম্পূর্ণই অনুভূতির।
মহুয়া প্রকাশিত হওয়ার কিছুদিন পরে রবীন্দ্রনাথ নিজে চয়ন করে সঞ্চয়িতা প্রকাশ করেন; তাতে মহুয়ার অতি অল্প কবিতা স্থান পায়। তখন রব উঠেছেমহুয়াতে কবির সৃজনী-শক্তির অপ্রাচুর্যের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। ভয় হল, রবীন্দ্রনাথও বুঝি তাই বিশ্বাস করে মহুয়ার যথেষ্ট কবিতা সঞ্চয়িতায় স্থান দেননি। কলকাতায় থাকতুম; শান্তিনিকেতনে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলুম, আপনি সঞ্চয়িতাতে মহুয়ার আরও কবিতা দিলেন না কেন? আমাকে যদি সঞ্চয়িতা সম্পাদন করার ভার দেওয়া হত, আমি তা হলে মহুয়ার মলাট ছিঁড়েসওয়িতা নাম দিয়ে প্রকাশ করতুম। বলতুম, এতেই সবচাইতে ভালো কবিতা সন্নিবিষ্ট হয়েছে।
গুরুদেব হেসে বললেন, ভাগ্যিস তোমাকে সঞ্চয়িতা তৈরি করবার ভার দেওয়া হয়নি। আমি মহুয়ার কবিতা সঞ্চয়িতাতে যে বেশি পরিমাণে দিইনি, তার কারণ এই যে, মহুয়ার কাব্য-সৌন্দর্য সম্বন্ধে আমি সন্দিহান। আসলে মহুয়ার কবিতাগুলো মাত্র সেদিনের লেখা। কবিতার ভালোমন্দ বিচার করার জন্য যে দূরত্বের প্রয়োজন সেটা মহুয়ার বেলায় এখনও যথেষ্ট হয়নি।