***
১৯২৯ সালে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন পড়তে যাই। বিদ্যালয়ের বিশাল প্রাসাদে পথ ভুলে ফনেটিক ইনসৃটিটুটের বক্তৃতাগৃহে উপস্থিত হই। বহু ছাত্রছাত্রী ভিড় করে বসে আছে– বক্তৃতা শুরু হবার দেরি নেই। চারিদিকে তাকিয়ে দেখি দেশবাসী কেউ নেই। ভয়ে ভয়ে বসে পড়লুম। প্রোফেসার বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন, অদ্যকার বক্তৃতা ফনেটিক বিজ্ঞানের অবতরণিকা। নানা ভাষায় নানা দেশের লোকের নানা উচ্চারণ আজ শোনানো হবে। ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিয়ে দেয়ালে ম্যাজিক লেন্টনের ছবি ফেলা হল।…রবীন্দ্রনাথ!–সঙ্গে সঙ্গে কলের গান বেজে উঠল, সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর :
Through ages India has sent her voice– অন্ধকার ঘরে রবীন্দ্রনাথের ঋজুদীর্ঘ মূর্তির আলোকোদ্ভাসিত প্রতিচ্ছবি। কণ্ঠস্বর রবীন্দ্রনাথের না তপোবনের ঋষির শৃন্বন্তু বিশ্বে, ভারতবর্ষের সেই চিরন্তন বাণী।
আবার আলো জ্বলল। অধ্যাপক বললেন, এমন গলা, ঠিক জায়গায় জোর দিয়ে অর্থ প্রকাশ করার এমন ক্ষমতা শুধু প্রাচ্যেই সম্ভব। পূর্বদেশে মানুষ এখনও বটকে (শহ্ম) বিশ্বাস করে। রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বরে তারই পূর্ণতম অভিব্যক্তি। কণ্ঠস্বরের এমন মাধুর্য, বাক্যের এমন ওজস্বিতা পশ্চিমে কখনও হয় না।
গর্বে আমার বুক ভরে উঠল। ডাইনে তাকালুম, বাঁয়ে তাকালুম। ভাবটা এই, আলবৎ, ঠিক কথা, ভারতবাসীই শুধু এমন ধ্বনির ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করতে পারে। ক্লাসের বহু ছাত্রছাত্রী সে সন্ধ্যায় আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। আমি মাথা উঁচু করে বসেছিলুম। আমার গুরুদেব ভারতবর্ষের, আমিও ভারতবাসী।
***
তার চেয়েও আশ্চর্য হয়েছিলুম ১৯২৭ সালে জর্মনি যাওয়ার দুই বত্সর পূর্বে–কাবুলে।
ইউরোপ যাওয়ার জন্য অর্থ-সংস্থান করতে গিয়েছিলুম কাবুলে। ফরাসি ও ফারসি জানি বলে অনায়াসে চাকরি পেয়েছিলুম। তখনকার দিনে বিশ্বভারতীই ছিল একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেখানে ফরাসি, ফারসি, জর্মন একসঙ্গে শেখা যেত।
দুশো টাকা মাইনেতে গিয়েছিলুম; কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই কাবুল সরকার আবিষ্কার করলেন যে আমি জর্মনও জানি। মাইনে ধা করে একশো টাকা বেড়ে গেল। পাঞ্জাবি ভায়ারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওজিরে মাওয়ারিফের (শিক্ষামন্ত্রী) কাছে ডেপুটেশন নিয়ে ধরনা দিয়ে বললেন, সৈয়দ মুজতবা এক অনরেকগনাইজড় বিদ্যালয়ের ডিপ্লোমাধারী। আমরা পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এ; এম.এ। আমাদের মাইনে শ-দেড়শো; তার মাইনে তিনশো, এ অন্যায়।
শিক্ষামন্ত্রীর সেক্রেটারি ছিলেন আমাদের বন্ধু। তিনি আমার কাছে ঘটনাটা বর্ণনা করেছিলেন ফারসিতে।*–জানো, বন্ধু, শিক্ষামন্ত্রী তখন কী বললেন? খানিকক্ষণ চুপ করে জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বললেন– বিলকুল ঠিক। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই, তোমাদের ডিগ্রিতে দস্তখত রয়েছে পাঞ্জাবের লাটসাহেবের। তাকে আমরা চিনি না, দুনিয়াতে বিস্তর লাটবেলাট আছেন– আমাদের ক্ষুদ্র আফগানিস্তানেও গোটাপাঁচেক লাট আছেন। কিন্তু মুজতবা আলীর সনদে আছে রবীন্দ্রনাথের দস্তখত– সেই রবীন্দ্রনাথ, যিনি সমগ্র প্রাচ্যের মুখ উজ্জ্বল করেছেন।
[*(খ্রি দানি আগাজান, ওজিরে মাওয়ারিফ চি গুফতন্দ)।]
***
এসব অভিজ্ঞতা যে কোনওদিন হবে সে তো স্বপ্নেরও অগোচর ছিল, যখন ১৯২১ সালে শান্তিনিকেতনে পড়তে যাই। বিশ্বভারতীর কলেজ বিভাগ তখনও খোলা হয়নি। ছ মাস পরে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের পৌরোহিত্যে তার ভিত্তিপত্তন হয়। বিশ্বভারতীতে তখন জনদশেক ছাত্রছাত্রী ছিলেন, তাঁরা সবাই শান্তিনিকেতন স্কুল থেকেই কলেজে ঢুকেছেন–শ্রীহট্টবাসীরূপে আমার গর্ব এই যে বিশ্বভারতীর কলেজ বিভাগে আমিই প্রথম বাইরের ছাত্র।**
[**রবীন্দ্রনাথকে প্রথম দেখি ১৯১৯-এ শ্রীহট্ট শহরে। পূজ্যপাদ গোবিন্দনারায়ণ সিংহের আমন্ত্রণে তিনি শ্রীহট্টের আতিথ্য স্বীকার করেছিলেন।]
প্রথম সাক্ষাতে গুরুদেব জিজ্ঞাসা করলেন, কী পড়তে চাও?
আমি বললুম, তা তো ঠিক জানিনে তবে কোনও একটা জিনিস খুব ভালো করে শিখতে চাই।
তিনি বললেন, নানা জিনিস শিখতে আপত্তি কী?
আমি বললুম, মনকে চারদিকে ছড়িয়ে দিলে কোনও জিনিস বোধহয় ভালো করে শেখা যায় না।
গুরুদেব আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, একথা কে বলেছে?
আমার বয়স তখন সতেরো থতমত খেয়ে বললুম, কনান ডয়েল।
গুরুদেব বললেন, ইংরেজের পক্ষে এ বলা আশ্চর্য নয়।
কাজেই ঠিক করলুম, অনেক কিছু শিখতে হবে। সম্ভব অসম্ভব বহু ব্যাপারে ঝাঁপিয়ে পড়লুম। গুরুদেবের সঙ্গে তখন সাক্ষাৎ হত ইংরেজি ও বাংলা ক্লাসে। তিনি শেলি, কিটস আরবলাকা পড়াতেন।
তার পর ১৯২২-এর কাছাকাছি শান্তিনিকেতনে টলস্টয়ের ভাবধারা হঠাৎ ছাত্রছাত্রীদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করল। আমরা বললুম, শান্তিনিকেতনে আমরা যে জীবনযাপন করছি সেটা বুর্জুয়া জীবন, বিলাসের জীবন। তাতে সরলতা নেই, সাম্য নেই, স্থৈর্য নেই। আমাদের উচিত সেই সহজ সরল জীবনকে ফিরিয়ে আনা, মাটির টানে প্রকৃতির কোলে ফিরে গিয়ে ক্ষেত করা, ফসল ফলানো। আমাদের মতবাদ যখন প্রবল হয়ে বিদ্রোহের আকার ধরেছে, তখন একদিন গুরুদেব আমাদের ডেকে পাঠালেন। আমাদের মতবাদের বিরুদ্ধে তিনি তর্ক করলেন। নাস্তানাবুদ হয়ে আমরা আধঘণ্টার ভেতর চুপচাপ। সবশেষে তিনি বললেন, আমি জানি একতারা থেকে যে সুর বেলোয় তাতে সরলতা আছে কিন্তু সে সরলতা একঘেয়েমির সরলতা। বীণা বাজানো ঢের শক্ত। বীণাযন্ত্রের তার অনেক বেশি, তাতে জটিলতাও অনেক বেশি। বাজাতে না জানলে বীণা থেকে বিকট শব্দ বেরোয় কিন্তু যদি বীণাটাকে আয়ত্ত করতে পার তবে বহুর মধ্যে যে সামঞ্জস্যের সৃষ্টি হয় হারমনি ইন্ মল্টিপ্লিসিটি) তা একতারার একঘেয়েমির সরলতার (মনটনস্ সিমপ্লিসিটি) চেয়ে ঢের বেশি উপভোগ্য। আমাদের সভ্যতা বীণার মতো, কিন্তু আমরা এখনও ঠিকমতো বাজাতে শিখিনি। তাই বলে সে কি বীণার দোষ, আর বলতে হবে যে একতারাটাই সবচেয়ে ভালো বাদ্যযন্ত্র।