.
ক্লাইন এর্না
২
ক্লাইন এর্না গোয়ালঘরের সামনে বসে হোম-টাস্ক লিখছে। এমন সময় তার আদরের গাইটি পাশে এসে দাঁড়িয়ে শুধাল, কী লিখছ, ক্লাইন এর্না?
চুলোয় যাক। মোটরগাড়ি সম্বন্ধে লিখতে বলছে। আমার মাথায় কিছু আসছে না।
গোগম্ভীর কণ্ঠে গাই বলল, আমি বলে যাই, তুমি লেখ। মোটরগাড়ি অবিশ্বাস্য অদ্ভুত জানোয়ার। এদের বিকট বিকট দুটো দারুণ উজ্জ্বল চোখ থাকে। কিন্তু সে দুটো শুধু রাতের অন্ধকারেই জ্বলে ওঠে।… এরা যখন রাস্তার উপর দিয়ে হুশ হুশ করে যায় তখন সম্পূর্ণ অচেনার মতো একে অন্যের দিকে কোনও খেয়াল না করে চলে যায়। কিংবা দুম করে একে অন্যকে মারে মরণ-ধাক্কা। তখন দু জনাই মারা যায়। আশ্চর্য, এদের কোনও মধ্যপন্থা বা তৃতীয় পন্থা নেই।… এরা নিজেদের খাবার যোগাড় করতে পারে না। মানুষই এদের জল-তেল আরও কী যেন খেতে দেয়। আমার আশ্চর্য লাগে, ওরা মুখ দিয়ে ও অন্য দিক দিয়ে, দু দিক দিয়েই খায় কী প্রকার!… লোকে ভাবে, ওরা খুব তীব্রগতিতে চলতে পারে। আদৌ না। ওই সেদিন আমার এক বান্ধবী রাস্তা দিয়ে আপন গোয়ালে ফিরছিল। পিছন থেকে, অনেকক্ষণ ধরে ওদেরই একজন কোক-কেক, কেক-কোঁঁক করে চিৎকার করছিল, কিন্তু এগিয়ে যেতে পারছিল না। অবশেষে আমার বান্ধবী যখন বাঁ-দিকে মোড় নিয়ে তার বেডরুমে পৌঁছে গেল তখন বাবু এগোলেন … ওরা রাস্তায় যা ফেলে যান সেটা খুঁটেকুড়োনি ঘৃণার চোখে দেখে।… শেষ প্রশ্ন– ওরা কি মোটেই কোনও বন্ধু-বান্ধব চায় না? সেদিন সন্ধ্যাবেলা ওদেরই একজন রাস্তার পাশে কাটার বেড়া ভেঙে আমাদেরই মাঠের মধ্যিখানে এসে দাঁড়ালেন। ওর সঙ্গীসাথী মানুষরা ওকে ফেলে চলে গেল। আমি ভাবলুম, আহা বেচারি, একা একা রাত কাটাবে। একটুখানি সঙ্গ দিই। কোনও সাড়া পেলুম না। তখন দেখি ওর চোখদুটোও জ্বলছে না। পরদিন সকালবেলা এল তার মা। বিরাট দেহ। দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে চলল শহরপানে। আমি যখন তার মার সামনে দাঁড়িয়ে– নমস্কার, আসুন তবে, বললুম, তখন তিনি সুপ্রসন্ন কোঁক-কোক বলে উত্তর দিলেন। মা-টি মেয়ের চেয়ে ঢের ঢের ভদ্র।
.
গুরুদেব
প্রমথ চৌধুরীর মতো মনীষী যখন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার যোগাযোগের কথা অনবদ্য ভাষায় লেখেন, তখন তা পড়ে আমরা বুঝতে পারি, রবীন্দ্রনাথের বিপুল ব্যক্তিত্বের গৌরব এবং মহিমা তিনি পরিপূর্ণভাবেই উপলব্ধি করেছেন। তাঁর লেখার ভিতর দিয়ে রবীন্দ্র-সাহিত্যের ভাবের গভীরতা, চিন্তার ঐশ্বর্য এবং রবীন্দ্র-জীবনের বৈচিত্র্যের সঙ্গে আমরা নিবিড়ভাবে পরিচিত হতে পারি।
আমার লেখাও সফল হত যদি আমি কবি বা স্রষ্টা হতুম। কবির দৈনন্দিন জীবনের বর্ণনাই হোক, আর তাঁর কাব্যালোচনাই হোক, কিঞ্চিৎ সৃজনী-শক্তি না থাকলে সে রচনা কবির বিরাট ব্যক্তিত্বের পটভূমিতে প্রক্ষিপ্ত হয়ে শুধু বৈচিত্র্যহীনতার পরিচয় দেয়। তাই রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে কিছু লিখতে আমার বড় সংকোচ বোধহয়। ভয় হয়, যত ভেবেচিন্তেই লিখি না কেন বিদগ্ধজনেরা পড়ে বলবেন, দীর্ঘ পাঁচ বত্সর রবীন্দ্রনাথের কাছে শিক্ষালাভ করেও এই ব্যক্তি তাঁর ব্যক্তিত্বের যথার্থ পরিচয় পেল না। এই অভিমত যে নিদারুণ সত্য তা আমি জানি; তাই স্থির করেছিলুম যে, কয়েক বৎসর রবীন্দ্রনাথকে যে তার প্রাত্যহিক জীবনে সহজ, সরলভাবে পেয়েছিলুম, সেকথা একেবারে অপ্রকাশিতই রাখব।
কিন্তু মুশকিল হল এই যে– কবি-প্রণামের রচনা-সংগ্রাহকগণ ও আমার নিজের দেশ শ্রীহট্টের অনেকেই জানেন যে, আমি শান্তিনিকেতনে শিক্ষালাভ করেছি। এই সঞ্চয়িতার মধুকর যে আমার লেখা চেয়ে আমাকে পরম সম্মানিত করেছেন, তার একমাত্র কারণ তিনি জানেন যে, আমি রবীন্দ্রনাথের শিষ্য; তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল। কিন্তু আমার দেশবাসী প্রিয়জনকে কী করে বোঝাই যে, রবীন্দ্রনাথের ঘরের দেয়াল, আসবাব তাঁকে আমার চেয়ে ঢের বেশি দেখেছে। আপনারা বলবেন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তোমার ব্যক্তিগত পরিচয়ের কথা বাদ দাও, তার কাব্য আলোচনা কর। উত্তরে আমি বিনীতভাবে বলতে চাই সে তো সহজ কর্ম নয়।…তবে আর কিছু না হোক, এ আমি নিশ্চয় করে জানি যে, আমার মনোজগৎ রবীন্দ্রনাথের গড়া। প্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বলুন, দর্শন, কাব্য, ধর্মের ভিতর দিয়ে বহুর মধ্যে একের সন্ধান বলুন; কালিদাস, শেলি, কিটসের কাব্যের ভিতর দিয়ে বিশ্ব-সাহিত্যের রসাস্বাদই বলুন– আমার মনোময় জগৎ রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি। জানা-অজানায় পঠিত আমার চিন্তা, অনুভূতির জগতে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। জীবনের ক্রমবিকাশ-পথে নানাদিক থেকে রবীন্দ্রকাব্যের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। কিন্তু, সেই কাব্যসৌন্দর্যের বিশ্লেষণ কতটুকুই-বা আমি করতে পারি? তাই এতদিন সে চেষ্টা করিনি। কিন্তু দেশের ডাকে তো নীরব থাকতে পারলাম না। তাই রবীন্দ্রনাথের জীবিতাবস্থায় আমার অক্ষমতা-নিবন্ধন যা আমি করতে পারিনি, আজ তাঁর জীবনান্তে সেই ব্রত উদযাপন করতে ব্রতী হয়েছি।
একথা তো ভুলতে পারিনে যে, একদিন তার চরণপ্রান্তে বসে আশীর্বাদ লাভ করেছি, তার অজস্র অকৃপণ দাক্ষিণ্যে ধন্য হয়েছি সেই অপরিমেয় স্নেহের ঋণ অপরিশোধ্য। তাই আজ অশ্রুসজল চিত্তে সকলের সঙ্গে কবিগুরুকে আমারও সম্মিলিত প্রণাম নিবেদন করছি।