.
প্রদীপের তলাটাই অন্ধকার কেন?
পিলসুজপরে হেরো জ্বলে দীপশিখা,
চতুর্দিকে যে আঁধার ছিল পূর্বে লিখা
মুহূর্তেই মুছে ফেলে।
কিন্তু অতি অবহেলে
মাভৈঃ বলিয়া তারে ছেড়ে দেয় স্থান
যে আঁধার পায়ে ধরে মাগে পরিত্রাণ।
—সন্দেশ, বৈশাখ ১৩৬৯
.
উচ্ছে ভাজা সন্দেশ
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন যে, স্কুলের, এমনকি কলেজের গোড়ার দিকেও ছেলেমেয়েদের শেক্সপিয়র পড়ানো উচিত নয়। কারণ শেক্সপিয়রের ভাষা প্রাচীন দিনের। সে ভাষার অনেক শব্দ, অনেক ইডিয়ম আজকের দিনের ইংরেজিতে আর ব্যবহার করা হয় না। ছেলেমেয়েরা সেটা না বুঝতে পেরে সেগুলো আপন লেখাতে লাগিয়ে দিয়ে একটা খিচুড়ি ভাষা তৈরি করে বসে। উচিত : প্রথম আধুনিক ইংরেজিটা শিখে নেওয়া এবং তার পর শেক্সপিয়র ইত্যাদি ক্লাসিকস্ পড়া। নিজের থেকেই ছেলেমেয়েরা অনুভব করবে কোনটা প্রাচীন দিনের শব্দ, এখন আর চলে না।
আমার মনে হয় বাংলার বেলায়ও এখন সেই অবস্থা। ধরে নিলুম, তোমার বয়স বারো-চোদ্দ। তুমি যদি বিস্তর বঙ্কিম পড়ো তবে বাংলা লেখার সময় তুমি এমন ভাষা শিখবে যেটা আজকের দিনে পণ্ডিতি-পণ্ডিতি, গুরুগম্ভীর মনে হবে। তাই আমার মনে হয়, এই বয়সে, রবীন্দ্রনাথের শেষদিকের লেখা বার বার পড়ে সেটা আয়ত্ত করে নেওয়া। আয়ত্ত করার অর্থ এ নয় যে তখন তুমি তার মতো লিখতে পারছ। তা হলে তো আর কোনও ভাবনাই ছিল না। আমরা সবাই গণ্ডায় গণ্ডায় নোবেল পুরস্কার পেয়ে যেতুম। তার অর্থ, তুমি মোটামুটি জেনে গেছ, কী কী শব্দ কোন কোন ইডিয়ম ব্যবহার করলে কেউ বলতে পারবে না এগুলো প্রাচীন দিনের, এখন আর চলে না। এটা হয়ে যাওয়ার পর পড়বে রবীন্দ্রনাথের যৌবনকালের লেখা। বিশেষ করে তার প্রাচীন সাহিত্য। কিন্তু সেটা খুব সহজ নয়। আমি একটি ছত্র তুলে দিচ্ছি : একবার মনে করিয়া দেখিলেই হয় দ্রৌপদীর নাম যদি ঊর্মিলা হত, তবে সেই পঞ্চবীর-পতিগর্বিতা ক্ষত্ৰনারীর দীপ্ত তেজ এই তরুণ কোমল নামটির দ্বারা পদে পদে খণ্ডিত হইত। কঠিন বাঙলা। কিন্তু কী সুন্দর! কী মধুর!!
তার পর বঙ্কিম। বিদ্যাসাগর। কালীপ্রসন্নের মহাভারত এবং সর্বশেষেআলালের ঘরের দুলাল ও হুতোম প্যাঁচার নকশা। তারও পরে যদি নিতান্ত কোনও-কিছু না থাকে, বৃষ্টির দিন, বাড়ির থেকে বেরনো যাচ্ছে না, তবে পড়বে– বড় অনিচ্ছায় বলছি- সৈয়দ মুজতবা আলী। কিন্তু তিন সত্য দিয়ে বলছি, পয়সা খরচ করে না। ধার করে।
এ গল্পটা তো জানো? মার্কিন লেখক মার্ক টুয়েনের আপন লাইব্রেরিখানা নাকি সত্যিই দেখবার মতো ছিল। মেঝে থেকে ছাত পর্যন্ত বই, বই, শুধু বই। এমনকি কার্পেটের উপরও গাদা গাদা বই স্তূপীকৃত হয়ে পড়ে থাকত– পা ফেলা ভার। এক বন্ধু তাই মার্ক টুয়েনকে বললেন, বইগুলো নষ্ট হচ্ছে; গুটাকয়েক শেলফ যোগাড় করছ না কেন?
মার্ক টুয়েন খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে ঘাড় চুলকে বললেন, ভাই, বলছ ঠিকই কিন্তু লাইব্রেরিটা যে কায়দায় গড়ে তুলেছি, শেলফ তো আর সে কায়দায় যোগাড় করতে পারিনে। শেলফ তো আর বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ধার চাওয়া যায় না।
উপদেশ দিয়ে আরম্ভ করেছিলুম। সেটা তেতো। উচ্ছে ভাজা। কিন্তু সন্দেশ দিয়ে শেষ করলুম তো!
.
ক্লাইন এর্না
ক্লাইন এর্না জরমনির ছোট্ট একটি মেয়ে। আমাদের যেরকম গোপালভাড় দারুণ চালাক, এই মেয়েটি সেরকম ভীষণ বোকা। তবে, মাঝে মাঝে সে এমন কথা কয় যে তার উত্তর মেলা ভার। যেমন ধর, এর্নার মা বলছে, হেই ক্লাইন এর্না! বেড়ালের ন্যাজটা মিছে মিছে টানছিস কেন? এর্না বলল, আমি টানছি কোথায়? কী যে বল মা! বেড়ালটাই তো খালি খালি টানছে। আমি তো সুদু ন্যাজটা ধরে আছি।
ক্লাইন মানে ছোট, ক্ষুদে। কিন্তু কারও কারও নাম বড় হয়ে যাবার পরও ছোট থেকে যায়। আমাদের দেশেও তাই বাড়ির বড় বড় কর্তারা সব ওপারে চলে গিয়েছেন, কিন্তু ছোট (ক্লাইন বাবুর নামছোট বাবুই রইল।
ক্লাইন এর্নার বেলাও তাই। আর এ গল্পটা আমার বিশেষ করে ভালো লাগে, কারণ গল্পটা আমাদের দেশেও চালু আছে। … ক্লাইন এর্নার তখন একটুখানি বয়স হয়েছে। স্কুলে বয়-ফ্রেন্ড জুটেছে। সে বলল, চল ক্লাইন এর্না। নৌকো ভাড়া করে আমরা ওই হোথাকার চর হেলিগোলান্ডে যাই। দু তিন টাকা লাগবে। সে আমার আছে। কী বল? লক্ষ্মীটি, না বলো না।
আমাদের ক্লাইন এর্না সত্যি লক্ষ্মী মেয়ে। না বলবে কেন? তদ্দশ্যেই রাজি হয়ে গেল।
নৌকো ভাড়া করে বন্ধু শুধোল, ক্লাইন এর্না, তুমি দাঁড় ধরতে পার? আমি তা হলে বৈঠে বাই। নইলে–
ক্লাইন এর্না বাধা দিয়ে বলল, দাঁড় ধরতে পারব না কেন? বাবার সঙ্গে কতবার নৌকোয় করে মাছ ধরতে গিয়েছি।
ঘন্টাখানেক বৈঠে ঠেলার পর ফ্রেন্ড বলল, ক্লাইন এর্না, একঘণ্টা তো হয়ে গেল। এখনও হেলিগোলান্ডে পৌঁছলুম না কেন? ওটা তো দেখা যাচ্ছে না।
ক্লাইন এর্না বলল, অ। তাই বুঝি। আম্মো তো খেয়াল করিনি। নৌকো যে পাড়ে খুঁটিতে এখনও বাধা। আমি খেয়ালই করিনি।
আমাদের দেশেও বলে, পুরা রাইত নাও বাইয়া দেখি, বাড়ির ঘাটেই আছি। এর আসল অর্থ : মোদ্দা, সবচেয়ে যেটা প্রয়োজনীয়, সেটা আগে না করলে বাদবাকি পণ্ডশ্রম।
.
বিদেশি ভাষা–ক্লাইন এর্না
স্বৰ্গত সুকুমার রায় একদা বলেছিলেন, কেই বা শোনে কাহার কথা, কই যে দফে দফে– গাছের ওপর কাঁঠাল দেখে তেল দিয়ো না গোঁফে। অর্থাৎ মানুষ উপদেশ শুনতে মোটেই ভালোবাসে না। বিশেষ করে যারা ছেলেমানুষ। নিজের কথা যদি তুলি তবে নির্ভয়ে, কিন্তু ঈষৎ লজ্জাসহ বলব, আমি যখন ছেলেমানুষ ছিলুম তখন কারওরই কোনও উপদেশে কান দিতুম না। একমাত্র মায়ের আদেশ উপদেশ–না সেকথা বাদ দাও, এখনও, এই পরিপক্ক বৃদ্ধ বয়সে আমার চোখে জল আসে। হ্যাঁ, কী বলছিলুম? বলছিলুম কী, তাই উপদেশ দিতে আমার বড়ই অনিচ্ছা। কিন্তু আজ কিছুটা দিতেই হচ্ছে। খুলে বলি। পরশু দিন আমার প্রতিবেশী একটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ছেলে আমায় শুধোল, স্যর, এটা কি সত্য, ইউ অ্যান্ডারস্টেন্ড টুয়েনটি ল্যাঙগুঁজেস? আমি সঙ্গে সঙ্গে বললুম, সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা। আই মিসআন্ডারস্টেন্ড মোর দেন টুয়েনটি ল্যাঙগুঁজেস। এর থেকেই বোঝা যায় যে, এ পাড়ায় আমার বদনাম আছে, আমি নাকি একাধিক ভাষা জানি। তাই ইংরেজি শেখা সম্বন্ধে দু একটি কথা এই সুবাদে বলে নিতে চাই। মাস্টারমশাইরা সর্বদাই বলে থাকেন, যে বই পড়বে তার কোনও শব্দ জানা না থাকলে অভিধান খুলে দেখে নেবে। এটা অবশ্যই টেকস্ট বই সম্বন্ধে খাটে। কিন্তু ভেবে দেখ তো, তুমি যেসব কঠিন বাঙলা শব্দ শিখেছ, তার কটি অভিধান দেখে? যেসব বাঙলা গল্প উপন্যাস ভ্রমণ-কাহিনী পড়ছ তাতে বার বার কঠিন শব্দ এখানে-ওখানে ঘুরে-ফিরে এসেছে এবং তারই ফলে শব্দগুলোর সঙ্গে মোটামুটি একটা পরিচয় হয়ে গিয়েছে। ইংরেজির বেলাও এই পদ্ধতি প্রযোজ্য।… এবং এই রেপিড রিডিং জিনিসটি আরম্ভ করবে শারলক হোমস, আগাথা ক্রিসটি ইত্যাদির ডিটেকটিভ নভেল দিয়ে। সেগুলো এমনই ইটরেসটিং যে, হেসেখেলে বইয়ের শেষ পাতায় পৌঁছে যাবে। যতক্ষণ অবধি গল্পটা বুঝতে পারছ, ততক্ষণ অভিধানের কোনও প্রয়োজন নেই। এ সম্বন্ধে আরও অল্পবিস্তর বলার আছে। উপস্থিত ভাষা নিয়ে আমাদের ক্লাইন এর্নার একটা গল্প মনে এল।… ক্লাইন এর্না বিয়ে করেছে এক ইংরেজকে, কিন্তু হায়, এক বছর যেতে না যেতে তার বর হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। তার পর তার একটি বাচ্চা হল। কিন্তু হায়, হায়, ছ দিনের দিন বাচ্চাটি মারা গেল। বেচারির কী কান্না, কী কান্না। তার মা তাকে অনেক প্রবোধবাক্য শোনানোর পর শেষটায় বলল, আর দ্যাখ, ক্লাইন এর্না, বাচ্চাটার বাপ তো ইংরেজ। মুখে কথা ফুটতেই সে ইংরেজি বলত। আমি তো ইংরেজি জানিনে। দিদিমা হয়ে তার এক বর্ণও বুঝতে পারব না– সেটা কি খুব ভালো হত?