না-হয় ইরান শিয়াই হয়ে গিয়েছিল কিন্তু তুর্কির বেলা কী? তুর্কির আপামর জনসাধারণ সুন্নি এবং শুধু যে সুন্নি তাই নয়, হানিফি সুন্নিও বটে। ইরানেরই মতো একদিন তুর্কিতেও আরবি চালাবার চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু শেষপর্যন্ত সে চেষ্টা সফল হয়নি। শেষপর্যন্ত তুর্কি ভাষাই তুর্কের রাষ্ট্রভাষা হল। উর্দুওয়ালাদের স্মরণ থাকতে পারে যে কয়েক বৎসর পূর্বে তুর্কি ও ইরান উভয় দেশে জোর জাতীয়তাবাদের ফলে চেষ্টা হয় তুর্কি ও ফারসি থেকে বেবাক আরবি শব্দ তাড়িয়ে দেওয়ার। আমরা এ ধরনের উগ্রচণ্ডা জাতীয়তাবাদ ও ভাষাবিশুদ্ধিকরণ বাইয়ের পক্ষপাতী নই; তবুও যে ঘটনাটির কথা উর্দুওয়ালাদের স্মরণ করিয়ে দিলুম তার একমাত্র কারণ, কেন্দ্রের সঙ্গে যোগসূত্র যতই মূল্যবান হোক না কেন, তার জন্য মানুষ সবসময় সবকিছু বিসর্জন দিতে রাজি হয় না। (এস্থলে ঈষৎ অবান্তর হলেও একটি কথা বলে রাখা ভালো পাছে উর্দুওয়ালারা আমাদের নীতি ঠিক বুঝতে না পারেন– আমরা ভাষাশুদ্ধিকরণে বিশ্বাস করি না বলেই বাংলা থেকে সংস্কৃত শব্দ তাড়াতে চাইনে। তা হলে সেই পাগলামির পুনরাবৃত্তি করা হবে মাত্র; আজকের দিনে কে না বুঝতে পারে ফোর্ট উইলিয়ামি পণ্ডিতরা বাংলা থেকে আরবি-ফারসি শব্দ বর্জন করে কী আহাম্মুকিই না করেছিলেন।)
উর্দুওয়ালারা হয়তো প্রশ্ন শুধাবেন, তা হলে মিশরে আরবি চলল কী করে? মুসলমান বিজয়ের পূর্বে মিশরের ভাষা তো আরবি ছিল না। তার উত্তর এই যে, মিশর জয়ের পর লক্ষ লক্ষ আরব মিশরে বসবাস আরম্ভ করে ও কালক্রমে দেশের আদিম অধিবাসী ও বিদেশিতে মিলে গিয়ে যে ভাষা গড়ে ওঠে তারই নাম মিশরি আরবি। সংমিশ্রণ একটি কথা দিয়েই সপ্রমাণ করা যায়; যদিও আরবিতে জিম হরফের উচ্চারণ বাংলার জ-এর মতো, তবু মিশরিরা উচ্চারণ করেগ-এর মতো। জবলকে বলেগবল, নজিবকে বলে নগিব, অল্পশিক্ষিত লোক ইজা জা নসরউল্লা না বলে বলে ইজাগা- ইত্যাদি। অন্যদিক দিয়ে মিশরি ফল্লাহিন (চাষা) ও আরবি বেদুইনের মধ্যে দেহের গঠন, চামড়ার রঙ ইত্যাদিতে বিশেষ কোনও পার্থক্য নেই।
এতগুলো উদাহরণ দেবার পরও যদি কেউ সন্তুষ্ট না হন তবে তার সামনে একটি ঘরোয়া উদাহরণ পেশ করি। পাঠান মোগল (এমনকি ইংরেজ রাজত্বের প্রথমদিকে) যুগে এদেশে শুধু কেন্দ্রে নয়, সুবাগুলোতে পর্যন্ত ফারসি ছিল রাষ্ট্রভাষা। তবু কেন সে ভাষা দেশজ হিন্দি বাংলা প্রভৃতি ভাষাকে মেরে ফেলে নিজে অজরামর হয়ে কায়েমি খুঁটি গাড়তে পারল না? উর্দুওয়ালারা হয়তো বলবেন, ইংরেজ ফারসি উচ্ছেদ করে দিল তাই।
কিন্তু সে উচ্ছেদের ব্যবস্থা তো পাঠান-মোগলরাই করে গিয়েছিলেন। পাঠান আমলের বিখ্যাত কবি আমির খুসরৌ ফারসিতে উচ্চাঙ্গের কাব্য রচনা করে গিয়েছিলেন অথচ দূরদৃষ্টিবলে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, শেষপর্যন্ত ফারসি এদেশে চলবে না, দেশজ ভাষা পুনরায় আপন আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। এ তত্ত্বটা ভালো করে বুঝতে পেরেছিলেন বলেই তিনি ফারসি ও তখনকার দেশজ ভাষা হিন্দি মিশিয়ে কবিতা রচনার একসপেরিমেন্ট করে গিয়েছিলেন। নিচের উদাহরণটি উর্দুওয়ালাদের জানবার কথা :
হিন্দুবাচ্চেরা ব নিগর আজব হুসন্ ধরত হৈ।
দ ওয়কতে সুখন গুফতন্ মুহ ফুল ঝরত হৈ ॥
গুফতম্ বিয়া কে বর লবেতো বোসে বাগিরম
গুফৎ আরে রাম ধরম নষ্ট করত হৈ ॥
হিন্দু তরুণ কী অপূর্ব সৌন্দর্যই-না ধারণ করে। যখন কথা বলে তখন মুখ হতে ফুল ঝরে– বললুম, আয় তোর ঠোঁটে একটি চুমো খাব বললে, আরে রাম! ধর্ম নষ্ট করত হায়–
এই এক্সপেরিমেন্টের ফলেই দেখতে পাই শাহজাহানের আমলে উর্দু ভাষা সৃষ্টি হয়েছে ও অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে দেখতে পাই ফারসি আস্তে আস্তে হটে গিয়ে উর্দুর জন্য জায়গা করে দিচ্ছে। আজকের দিনে পরিস্থিতিটা কী? ফারসির লীলাভূমি দিল্লি-লক্ষ্ণৌয়ে এখন সাহিত্য সৃষ্ট হয় উর্দু ভাষাতে, ফারসি সেখানে আরবি এবং সংস্কৃতের মতো মৃত ভাষা বা ডেড ল্যানগুইজ।
হয়তো উর্দুওয়ালারা বলবেন, উর্দুতে প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ থাকায় তিনি পদে উঠে গেছেন। এর উত্তর বলি, ফারসি যেরকম বিস্তর আরবি শব্দ গ্রহণ করেও ফারসিই থেকে গিয়েছে, উর্দুও সেইরকম বিস্তর আরবি-ফারসি শব্দ গ্রহণ করা সত্ত্বেও উর্দুই থেকে গিয়েছে, সে এই দেশের দেশজ ভাষা। বিদেশি শব্দের প্রাধান্য অপ্রাচুর্য নিয়ে ভাষার বর্ণ, গোত্রের বিচার হয় না। পূর্ববঙ্গের আলিম-ফাজিলগণ যখন অকাতরে আরবি-ফারসি শব্দ প্রয়োগ করে বাংলায়ওয়াজ বাপাবলিক লেকচর দেন তখন সে-ভাষা আরবি, ফারসি বা উর্দু নামে পরিচিত হয় না, সে ভাষা বাংলাই থেকে যায়।
ঘোড়াটি আমার ভালোবাসিত গো শুনিতে আমার গান
এখন হইতে সে ঘোড়াশালেতে বাঁধা রবে দিনমান।
জিনি তরঙ্গ সুন্দরী মোর তাতারবাসিনী সাকি
লীলাচঞ্চলা রঙ্গনিপুণা শিবিরে এসেছি রাখি।
ঘোড়ার আমার জুটিবে সোয়ার ইয়ার পাইবে সাকি
শুধু মা আমার এ বুড়া বয়সে কাঁদিয়া মুদিবে আঁখি।
–সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
শব্দের প্রাচুর্য-অপ্রাচুর্যভেদে যদি ভাষার বংশবিচার করতে হয় তা হলে বলতে হবে এই কবিতার চতুর্থ ছত্র সংস্কৃত, পঞ্চম ছত্র আরবি-ফারসি ও গোটা কবিতাটা খোদায় মালুম কী। কিন্তু উপস্থিত এ আলোচনা মুলতবি থাক–উর্দু কী হিসেবেপাক ও বাংলা না-পাক সে আলোচনা পরে হবে।