* * *
সিলেটের উত্তরেতে সোজা গিয়ে চলে
চৈত্র মাসে, মিঠা রোদে, উজায়ে সুরমা,
গেয়ে সারি, গান–
ধরিয়া পালের দড়ি করিবারে বারুণীর স্নান
মেলা দৃশ্য দেখিয়াছি।
স্তূপীকৃত ধান মণ মণ
দুই পারে
তার পরে
কী রুপালি ঝিলিমিলি সোনালি ধানের
যেন যে হীরার মালা হাজার হাজার
–কাতার কাতার
হেমাঙ্গীর স্বর্ণবক্ষে।
দীর্ঘ শর্বরীর
শিশিরে করিয়া স্নান এলায়েছে দেহ
আতপ্ত কিশোর রৌদ্রে।
অগভীর স্বচ্ছ জল
বালুর বুলায় দেহ।
সে জলে ডুবায়ে গা
দেখিয়াছি
তালহীন শব্দহীন মাছের নাচন,
জলের নিচেতে।
উপরেতে নাচে রবিকর
হীরার নূপুর পরে।
হঠাৎ
কেন না জানি–
তলা থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ওঠে ছোট মাছ।
কটিখানি কাঁপাইয়া নটরাজ দোলে
জলের উপরে মারে ঘা–
যেন কোন খেয়ালি বাদশাহ।
টাকা নিয়ে খেলে ছিনিমিনি।
কখনও বা দেখিয়াছি
দয়ে মজে গিয়ে
একপাল ছোট মাছ চক্রাকার ঘুরপাক খেয়ে
– গরবা নাচের ছাঁদে
ইচ্ছা অনিচ্ছায়
অলখ মাদলে মেতে অজানা সে কিসের নেশায়
ক্রমে ক্রমে উঠে উপরেতে;
মাছরাঙা স্টুকা ডাইভার
পার্ফেক্ট টাইমিং
পড়িল বিদ্যুৎ বেগে হল বজ্রাঘাত।
হুড়মুড় করে
এ ওর ঘাড়েতে পড়ে
মুহূর্তেই হল অন্তর্ধান।
হয়ত বলিতে তুমি
তাতেই বা কী?
এসবের বর্ণনার কী বা আছে বাকি?
হক কথা
তবু যতবার
বসিয়া বিদেশে
চোখ বুজে মনে করি যেন আমি সুর্মা উজিয়ে
বরদার অবিচার অত্যাচার ঝেড়ে ফেলে দিয়ে
চলিয়াছি
তখনই
বড় ব্যথা বাজে প্রাণে,
মনে হয় জানি ঠিক জানি আমার দেশের
স্নিগ্ধ শান্ত শ্যামল বনানী
পশ্চাতে তাহার নীলগিরি যবনিকা
তাহার উপরে লিখা
শুভ্রতার শিখা
রুপার ঝরনা
নীলের উপরে সে যে কী বিচিত্রা মিনা।
পদমূলে
প্রস্তরে উপলে
কলকল উচ্চহাস্য
হাসিছে খাসিয়া নারী পাঁচশো সাতশো।
মধুরের ধ্যানে আমি বার বার ডুবে
যে রাগিণী দেখিয়াছি চতুর্দিকে যার স্বপ্রকাশ
কাব্যে ছন্দে রূপ তার মূর্তি আর হল না বিকাশ।
এ কি বিধাতার লীলা?
রূপে গন্ধে রসে শ্বাসে পরিপূর্ণ এ রমণী হল মূক শিলা
তাই কি শিলেট?
কাব্যে তার মাথা হেঁট!
***
কিন্তু চাচা মাফ করো, আজ কাজ আছে মোর মেলা
কাব্য-সাগর যেদিক পানে যায়নি জীবন-ভেলা–
চড়ায় লেগে আটকে আছে জোয়ার নাহি আসে
পুব হাওয়াও দেয়নি ঠেলা নৌকা নাহি ভাসে।
আগাগোড়া ভুলে ভরা জগা-খিচুড়ি
বয়স হল হিসেব করে দেখি যে দুই কুড়ি।
চহ সালে উরে আজিজ গুজশৎ(৬)
কালাপানির গারদ মাঝে ভালে হানি দণ্ড।(৭)
তাই বলি
সুবুদ্ধি গোয়ালার কুবুদ্ধি হইল
ভাঁড়েতে রাখিয়া দুধ পীরকে ফাঁকি দিল
মানিক পীর ভবনদী পার হইবার লা।
সেই পীরেরে স্মরণ করে তোমার ছোট চাচা ॥
—মৌচাক, কার্তিক ১৩৬০
[১. খসরু-পূর্ব খ্রিস্টপূর্বের তুলনায়, অর্থাৎ খসরুর জন্মের বছর সাতেক পূর্বে। ২. মেজো পিসি।
২.তওবা, তওবা!
৩.বাঁশের চোঙার ভিতর চাল ভরে সেই চোঙা আগুনে ঝলসে তৈরি একরকম পিঠে।
৪.দেওর আইল অর্থাৎ দেবর এল, খসরুর মামার গ্রামের নাম।
৬. ইরানি কবি সাদির বিখ্যাত ছত্র। আমার জীবনের প্রিয় চল্লিশ বৎসর গেল, কিন্তু এখনও ছেলেমানুষি গেল না। খসরু তখন ফারসি শিখেছিল বলে ছত্রটি তোলা হয়েছে।
৭. হাত।
যথা– বেকার-মোকা/বেমক্কা, খামকা, যত্রতত্র।
ওকিবহাল/ বিশেষজ্ঞ, Specialist
বেশুমার অসংখ্য
বে/ Without
শুমার/ Number, আদমশুমারি তুলনীয়
এলেম নব হাসিল/ নবজ্ঞান লাভ
বেশক/দ্বিধাহীন, অসংশয়
লেকিন/কিন্তু]
.
ক্রিকেট
হুজুগে মেতে ক্রিকেট খেলা দেখিতে যদি চাও
মাথাটি মোর খাও–
গাড়োল-পানা প্রশ্ন মেলা ঝেড়ো না খালি খালি
খেলাটা যদি না বোঝো তবে দিয়ো না হাততালি
এলোপাতাড়ি বেগার-মোকা ক্যাবলা হবার মতো।
রয়েছে শত শত।
কায়দা-কেতায় ওকিব-হাল খেলার সমঝদার
শুধিয়ো নাকো ওদের মিছে প্রশ্ন বেশুমার।
শুধাও যদি মানা না শুনে, কী হবে ফল, বলি,
ট্যারচা-মুখো জবাব দিয়ে থামাবে ঢলাঢলি।
যেমন ধরো, জানো না কিছু শুধালে ভয়ে ভয়ে
যে গুণী পাশে আছে বসে– দিন তো মোরে কয়ে,
কাঠের ওই ডাণ্ডাগুলো, কী নাম হয় তার?
পাশের যিনি হইবে মনে রাগত হন যেন
ঘ্যানরঘ্যান লাগিবে ভালো কেন!
বলেন তিনি মিনিট তিন থাকিয়া নিশ্চুপ
উকেট কয়। গলাতে যেন রয়েছে বিদ্রূপ।
হকচকিয়ে দিলে তো তুমি অনেক ধন্যবাদ।
খানিক পরে তবুও মনে হইল তব সাধ
এলেম নব হাসিল লাগি। কিন্তু তাতে ভয়
তেড়ে না যান এবার তিনি গুণী তো নিশ্চয়–
থাকিয়া চুপ, ভাবিয়া খুব, গলাটি সাফ করে
চুলকে ঘাড় শুধালে মৃদু স্বরে
উকেট কয়? বেশ কথা; লেকি, কন্ স্যার
ওসবগুলো হোথায় কেন কী হয় উপকার?
কটমটিয়ে এবার গুণী তাকান তব পানে
বাসনা যেন প্রাণটি তব হানেন আঁখি-বাণে–
হুঙ্কারিয়া হাঁকেন শেষে, ওগুলো কার তরে?
খেলাড়ি সব বসবে বসে ক্লান্ত হলে পরে।
—-মৌচাক, বৈশাখ ১৩৬৭
বছর দুই পূর্বে আমি যখন ঢাকাতে আমার ছোট বোনের বাড়িতে গিয়ে উঠলুম, তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম পাকিস্তানের ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। আমার ভগ্নী আসমা ঘড়িঘড়ি রেডিয়ো খুলে লেটেস্ট স্কোর শুনে নিচ্ছিল। আমি দু একটি প্রশ্ন শুধিয়েই বুঝে গেলুম আসমা ক্রিকেটতত্ত্বে একদম অগা, অর্থাৎ আমার চেয়েও কম ক্রিকেট খেলা বোঝে। এ কবিতাটি তারই উদ্দেশে; এবং যেহেতু কবিতাটি ঢাকায় রচিত তাই ঢাকাই বিদেশি শব্দ একটু বেশি রয়েছে।