তাই বলি unity (ঐক্য) ও uniformity (সমতা) এক জিনিস নয়। সমতা হলেই ঐক্য হয় না। আর যারা সমতা চায় তাদের জেদ-বয়নাক্কার অন্ত নেই। আজ তারা বলবে ভাষায় সমতা চাই, পূর্ব পাকিস্তান উর্দু নাও; কাল বলবে পোশাকের সমতা চাই, শেলওয়ার কুর্তা পাগড়ি পরো; পরশু বলবে খাদ্যের সমতা চাই, মাছ-ভাত ছেড়ে গোস্ত-রুটি ধরো; তার পরদিন বলবে নৌকা বখদু জিনিস, তার বদলে গরুর গাড়ি চালাও। তার পর যদি একদিন পূর্ব পাকিস্তানি পাঞ্জাবিদের বলে, দৈর্ঘ্যের সমতা হলে আরও ভালো হয়, লড়াইয়ের জন্য ইউনিফর্ম বানাতে তা হলে সুবিধে হবে, কিন্তু তোমরা বড় উঁচু, তোমাদের পায়ের অথবা মাথার দিকের ইঞ্চি তিনেক কেটে ফেল, তা হলেই হয়েছে!
ঐক্য বা ইউনিটি অন্য জিনিস। প্রত্যেকে আপন বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে যখন সংঘবদ্ধ হয়ে মানুষ একই স্বার্থ, একই আদর্শের দিকে ধাবমান হয় তখনই তাকে বলে ঐক্য। তুলনা দিতে গিয়ে শুণীরা বলেছেন, বীণার প্রত্যেক তারের আপন আপন ধ্বনি আছে– সব তার যখন আপন আপন বিশিষ্ট ধ্বনি প্রকাশ করে, একই সুরের ভেতর দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে তখনই সৃষ্ট হয় উচ্চাঙ্গের সঙ্গীত। সবকটা তারই যদি একধরনের বাধা হয় তবে বীণায় আর একতারায় কোনও তফাৎ থাকে না। সে যন্ত্র বিদগ্ধ সঙ্গীত প্রকাশ করতে অক্ষম।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে আপন আপন বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে, কী প্রকারে এক আদর্শের রাখি বেঁধে সম্মিলিত করা যায় তার সাধনা করবেন রাষ্ট্রের কর্ণধারগণ। উপস্থিত শুধু আমরা এইটুকু বলতে পারি, পূর্ব পাকিস্তানের অনিচ্ছা সত্ত্বেও যদি তার ঘাড়ে উর্দু চাপানো হয় তবে স্বভাবতই উর্দু ভাষাভাষী বহু নিষ্কর্মা শুধু ভাষার জোরে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করার চেষ্টা করবে– এ জিনিস অত্যন্ত স্বাভাবিক, তার জন্য উর্দু ভাষাভাষীকে দোষ দিয়ে লাভ নেই– এবং ফলে জনসাধারণ একদিন বিদ্রোহ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। বর্ণের কৌলীন্য যেমন শোষণের কারণ হতে পারে, ভাষার কৌলীন্যও ঠিক সেইরকম শোষণপন্থা প্রশস্ততর করে দেয়।
তারই একটি মর্মন্তুদ দৃষ্টান্ত নিন : তুর্কি একদা তাবৎ আরবখণ্ডের ওপর রাজত্ব করত। তুর্কি সুলতান সর্ব-আরবের খলিফাও ছিলেন বটে। তৎসত্ত্বেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সমস্ত আরব ভূখণ্ড খলিফার জিহাদ ফরমান উপেক্ষা করে সারা ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তুর্কিকে পর্যুদস্ত করল। আমাদের কাছে এ বড় বিস্ময়ের কথা খলিফার জিহাদ হুকুমের বিরুদ্ধে লড়া মানে তো কাফির হয়ে যাওয়া। যে আরবদের ভেতর দিয়ে ইসলাম প্রথম সপ্রকাশ হলেন তারা ধর্মবুদ্ধি হারাল?
তাই আমাদের সবিনয় নিবেদন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান যেন কোনও মহত্তর আদর্শের অনুপ্রেরণায় ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ হয়। পূর্বেই নিবেদন করেছি গুণীরা সে আদর্শের সন্ধান করবেন। আমার জ্ঞান-অভিজ্ঞতা অত্যল্প কিন্তু নানা দেশের গুণীদের মুখে শুনেছি, নানা সগ্রন্থে পড়েছি, দীন ইসলাম বলেন, সে আদর্শ হবে রাষ্ট্রের দীনদুঃখীর সেবা করা। উভয় পাকিস্তান যদি এই আদর্শ সামনে ধরে যে তাদের রাষ্ট্রভিত্তিও নির্মিত হবে চাষামজুরকে অন্ন দিয়ে, দুস্থকে সেবা করে, অজ্ঞকে জ্ঞানদান করে, এককথায়সাইলকে (অভাবে আতুরকে)গনি (অভাবমুক্ত করে, তা হলে আর ভয় নেই, ভাবনা নেই। উভয় প্রান্তে গণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তারা যে ঐক্যসূত্রে সম্মিলিত হবে সে সূত্র ভিন্ন হওয়ার ভয় নেই।
সেই মহান আদর্শের দিকে উদ্দীপ্ত উদ্বুদ্ধ করতে পারে সতেজ সবল সাহিত্য। সে জাতীয় সাহিত্য মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য কোনও ভাষাতে কেউ কখনও নির্মাণ করতে পারেনি। জনগণের মাতৃভাষা উপেক্ষা করে গণরাষ্ট্র কখনওই নির্মিত হতে পারে না।
উপসংহারে বক্তব্য : যুদ্ধ কাম্যবস্তু নয়। অন্যের বিনাশ বাসনা সর্বা বর্জনীয়। পাকিস্তান বিনষ্ট হলে ভারতীয় ইউনিয়নের লাভ নেই, ভারতীয় ইউনিয়ন বিনষ্ট হলে পাকিস্তানের লাভ নেই। উভয় রাষ্ট্র সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে বিত্তবান হোক, এই আমাদের প্রধান কাম্য। ইয়োরোপের তাণ্ডবলীলা থেকে আমরা কি কোনও শিক্ষাগ্রহণ করব না?
শিক্ষাগ্রহণ করি আর না-ই করি, কিন্তু আক্রান্ত হওয়ার ভয় অহরহ বুকে পুষে সেই দৃষ্টিবিন্দু থেকে সর্বসমস্যার সমাধান অনুসন্ধান করা মারাত্মক ভুল। বাড়িতে আগুন লাগার ভয়ে অষ্টপ্রহর চালে জল ঢালা বুদ্ধিমানের কর্ম নয়।
আজ যদি আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় মাতৃভাষা বর্জন করি তবে কাল প্রাণ যাওয়ার ভয়ে মাতৃভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হব।
অপ্রকাশিত রচনা – ১০
শ্রীমান খসরু বাবাজিউ,
সুবুদ্ধি গোয়ালার কুবুদ্ধি হইল,
ভাঁড়েতে রাখিয়া দুধ পীরকে ফাঁকি দিল
মানিক পীর ভবনদী পার হইবার লা–
আমার হল তাই;
ছিলাম সুখে সিলেট জেলায় ঢুকল মাথায় পোকা
কাণ্ড দেখে বুঝল সবাই লোকটা গবেট বোকা।
বহুত দেশ তো দেখা হল খেলাম মেলাই ঘোল
চোখের জলে ভাসি এখন, খুঁজি মায়ের কোল।
চক্ষু বুজে বসে যখন ভাবি বরদায়
–দেহখানা বন্ধ ঘরে– দেশপানে মন ধায়
মেলাই ছবি আঁকি, মনের পটে বুলাই তুলি
দুঃখ কষ্ট এই ফিকিরে অনেক কিছুই ভুলি ॥
মনে হল আমি যেন পেরিয়ে বছর কুড়ি
ফিরে গেছি সিলেট আবার চড়ি খেয়াল-ঘুড়ি
বড়দিনের ছুটির সময় নাইব নদীর জলে
বালুর চড়ায় বসে আছি, গামছা নিয়ে গলে।
লাল্লুমিয়ার দোকান থেকে খানিকটা নুন নিয়ে
ডান হাতে কুল, বাঁ হাতে নুন তাই মিলিয়ে দিয়ে
মঞ্চসুধার সৃষ্টি যেন। নাই কিছুরই তাড়া
পরীক্ষা বা অন্য বালাই সামনেও নেই খাড়া
অলস চোখে দেখছি চেয়ে এপার ওপার যাওয়া
খেয়া নায়ের চিরন্তনী টিমে তেতাল বাওয়া।
মহাজনি নৌকা চলে গদাই লশকরি
কমলানেবু বোঝাই করা; লোভ করে ফস করি
গণ্ডা দুয়েক সরিয়ে নেব, কিন্তু চাচা, শোনো
চেষ্টা কবু কোরোনাকো লাভ তাতে নেই কোনও।
ব্যাটারা সব লক্ষ্মীছাড়া খায় না কেন গুলি,
কোনও বাঙাল নেইকো বসে চোখে দিয়ে ঠুলি।
যতই কেন বাড়াও না হাত মহা সন্তর্পণে
ব্যাটারা সব চালাক অতি বৈঠার ঘা অর্পণে।
থাক সে কথা, গামছা কাঁধে নাওয়ার বেলা যায়
আবার বলি বদ্ধ ঘরে দেশ পানে মন ধায়।
খসরু-পূর্ব(১) বছর সাতেক, বসন্ত কী শীতে,
তোমার মাইজুলা ফুফুর(২) বিয়া হৈল চৌকিতে।
চৌকি আছে নবীগঞ্জের গায়ের সঙ্গে মিশে
সেখান থেকে কই পাঠালেন তোমার মেজ পিসে।
বাপ রে সে কী বিরাট বপু উদর আণ্ডাময়
মুখে দিলে মাখন যেন জঠর ঠাণ্ডা হয়।
তোমার মা তো সেই দেশেরই যেথায় শুনি লোক
মাছ না পেলে ব্যাঙ-ভাজাতে ভোলে মাছের শোক।
শুধালে কি পাবে খবর তুমি তাঁহার কাছে
নউজ বিল্লা(৩); সত্যি খবর তোমার বাবার আছে।
তামাম জাহান খোদার কাছে সব কিছু নেয় মাগি,
আমার পেটের আঁকুপাঁকু কই মাছেরই লাগি ॥
আরো একটা জিনিস খসরু সত্যি তোমায় বলি।
যার লাগিয়া তৈরি আমি জানটা দিতে বলি।
–ভাবনা শুধু জানা গেলে খাব কেমন করে
পেট আর জান তো একই দেহে, আছে একই ঘরে–
তোমার মায়ের দেশের জিনিস বড়ই চমৎকার
অর্ধ জগৎ ঘুরে আমি পাইনি জুড়ি তার
চোঙ্গা-পিঠা,(৪) আহা চাচা বোলব তোমায় কী?
যখন ভাবি ইচ্ছা হয় যে রেজিগনেশন দি।
ধরে সোজা পয়লা গাড়িদেওর আইলে(৫) দি ছুট
চাকরি-বাঁধন, রাজার শাসন সবকিছু ঝুটমুট।
নামটা সত্যি হলে পরে খাতির পাব মেলা
খানা-পিনা ধুম-ধামেতে কাটবে সারা বেলা।
চোঙ্গা-পিঠার সঙ্গে মালাই দেবে তোয়াজ করে।
নয়ত দেবে হরিণ-শিকার হয়ত আছে ঘরে।
করিমগঞ্জের হরিণ সে যে বড়ই খান্দানি।
খোরাক তাদের আমলকি ফল, ঝরনা-মিঠা পানি।
মহীমিয়ার বাবা ছিলেন বাঘা শিকারি।
নুন আর মরিচ সঙ্গে নিয়ে হাতির সোয়ারি–
পাহাড় ঘেঁষে চলে যেতেন গভীর বনের পাশ
হরিণ শিকার খেতেন স্রেফ ঝাড়া তিনটি মাস।
সঙ্গীবিহীন অন্ধ ঘরে আসন্ন সন্ধ্যায়
সুর্মা নদীর দেশের পানে উদাসী মন ধায় ॥
চটছে হয়ত মনে মনে ভাবছ একি হল
চাচার যেসব কাব্যি ছিল সব কিছু আজ ম’ল
খাবার কথা কয় যে খালি আর কি কিছু নেই।
তাও আছে; তোমার পাতে সন্তর্পণে দেই।