এ সম্পর্কে আরেকটি কথা বলে রাখা ভালো। পরাধীন এবং অনুন্নত দেশেই চাকরি নিয়ে মাথা ফাটাফাটি খুন-রেজি। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকলা, কৃষি-খনিজ, দুগ্ধ-ঘৃত উৎপাদন করে যে দেশ সমৃদ্ধশালী সে-দেশে চাকরি করে অল্প লোক, তাদের সম্মানও অনেক কম। দৃষ্টান্তস্বরূপ অঙ্গুলি নির্দেশ করি চাটগাঁয়ের দিকে। পাকিস্তান হয়েছে মাত্র এক বছর এর মাঝেই শুনতে পাই চাটগাঁয়ের কোনও কোনও বড় সরকারি কর্মচারী নোকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা আরম্ভ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন। দেশ সমৃদ্ধশালী হলে কটা লোক বিদেশ যায়, তা-ও আবার চাকরির সন্ধানেই? দেশের ভেতরেই দেখতে পাই, যে বৎসর খেত-খামার ভালো হয় সে বৎসরে শহরে বাসার চাকরের জন্য হাহাকার পড়ে যায়।
মুসলিম ঐতিহ্যও চাকরির প্রশংসা করেনি, প্রশংসা করেছে ব্যবসা-বাণিজ্যের। ইসলাম দেশদেশান্তরে বিস্তৃতি লাভ করেছে ধর্মপ্রচারকদের কর্মতৎপরতায় এবং সদাগরদের ধর্মানুরাগে। এখনও মধ্য-আফ্রিকায় ক্রিশ্চান মিশনারিদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে হাতির দাঁতের ব্যবসায়ী মুসলমান সদাগরেরা। ক্রিস্টান মিশনারিরা সবাই মাইনে পায়, তারা চাকুরে। তাদের দুঃখের অন্ত নেই যে তারা সদাগরদের সঙ্গে পেরে উঠছে না।
পূর্ব পাকিস্তানের আদর্শ কী সে সম্বন্ধে বিচার করার সময় উর্দুওয়ালারা একটা ভয়ঙ্কর জুজুর ভয় দেখান। তাঁরা বলেন, পূর্ব পাকিস্তান যদি উর্দু গ্রহণ না করে তবে সে পশ্চিম পাকিস্তান তথা কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং তারই সুযোগে ভারতীয় ডোমিনিয়ন পূর্ব পাকিস্তানটিকে বিনা নুন-লঙ্কায় কপাৎ করে গিলে ফেলবে।
ভারতীয় ইউনিয়নে এবং পাকিস্তানে লড়াই হবে কি না, হলে কবে হবে এ আলোচনায় এত যদি এবংকিন্তু আছে যে সে আলোচনা যুক্তি-তর্কের বিষয়বস্তু না হয়ে ফলিত জ্যোতিষের ভবিষ্যদ্বাণীর জিনিস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা ফলিত জ্যোতিষ জানিনে, উপস্থিত আমরা ধরে নিচ্ছি যে লড়াইটা লাগবে, কারণ সেটা ধরে না নিলে জুজুর ভয় ভাঙানো যাবে না। অন্ধকার ঘরে বাচ্চা ছেলেকে ভূত নেই বললে তার ভয় যায় না, বরঞ্চ ভূত মেনে নিলেও আপত্তি নেই, যদি সঙ্গে সঙ্গে আলো জ্বালানো হয়। তাই আলোর সন্ধানই করা যাক।
কে মিত্র, কে শত্রু সে কি ভাষার ওপরই নির্ভর করে আমেরিকা, ফ্রান্স, রুশ লড়ল জর্মন, ইতালির বিরুদ্ধে। আমেরিকা, ফ্রান্স এবং রুশ তাই বলে কি একই ভাষায় কথাবার্তা কয়, না জর্মনি ইতালির ভাষাই-বা এক? আজ বলছি রুশের বিরুদ্ধে ধনতান্ত্রিক ফ্রান্সের একমাত্র ভরসা মার্কিন সাহায্য। আজ যদি উর্দুওয়ালাদের কায়দায় ফ্রান্সকে বলা হয়, তোমরা যদি ইংরেজি গ্রহণ না কর তবে তোমরা আমেরিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, এবং রুশ ফ্রান্সটিকে বিনা মাস্টার্ডে কপাৎ করে গিলে ফেলবে, তা হলে কি ফ্রান্সের লোক মাতৃভাষা বর্জন করে মাথায় গামছা বেঁধে ইংরেজি শিখতে লেগে যাবে?
পক্ষান্তরে এক ভাষা হলেই তো হৃদ্যতা চরমে পৌঁছয় না। আমেরিকা যখন ইংরেজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াই লড়েছিল তখনও সে ইংরেজি বলত। আইরিশমেনের মাতৃভাষা ইংরেজি, তাই বলে সে কি ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়েনি? পশতুভাষী মুসলিম পাঠানের একদল লড়ল সুভাষচন্দ্রের ঝাণ্ডার নিচে দাঁড়িয়ে জাপানের হয়ে, আরেকদল লড়ল ইংরেজের ঝাণ্ডার নিচে দাঁড়িয়ে তাদের হয়ে।
তার চেয়েও ভালো উদাহরণ আছে আরবদেশে। আরবের লোক কথা বলে আরবি ভাষায়, তারা সকলেই এক এক গোষ্ঠীর লোক (একবর্ণ), তারা সকলেই মুসলিম অথচ আজ সে দেশ (১) ইরাক, (২) সিরিয়া, (৩) লেবানন, (৪) ফিলিস্তিন, (৫) ট্রান্স-জর্ডন, (৬) সউদি আরব, (৭) ইয়েমেনে খণ্ডিত-বিখণ্ডিত (এগুলো ছাড়া আরবি-ভাষাভাষী মিশর, টুনিস, আলজেরিয়া, মরক্কোও রয়েছে)।
এই সাত রাষ্ট্রের মধ্যে মন-কষাকষির অন্ত নেই। ইবনে সউদ এবং মক্কার শরিফের মধ্যে যে লড়াই হয়েছিল সে তো আমাদের সকলেরই স্পষ্ট মনে আছে। তার জের এখনও চলছে আমির আব্দুল্লা এবং ইবনে সউদের শত্রুতার মধ্যে। আজ যে ফিলিস্তিন অসহায় হয়ে ইহুদির হাতে মার খাচ্ছে তার প্রধান কারণ এই যে ইবনে সউদ আর আব্দুল্লার মধ্যে ঠিক ঠিক মনের মিল হচ্ছে না। আরব লিগের সর্বপ্রচেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে– অথচ সকলেই জানেন যে উপযুক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সমঝাতা হয়ে গেলে দশদিনের ভেতর ইহুদিদের রাজ্যলিপ্সাফি নারি জাহান্নামে পাঠানো সম্ভবপর হবে।
পক্ষান্তরে সুইজারল্যান্ডে তিনটি (চতুর্থটির লোকসংখ্যা অত্যন্ত কম) ভাষা, বেলজিয়ামে দুইটি, চেকোশ্লোভাকিয়ায় দুইটি, যুগোশ্লোভাকিয়ায় গোটা চারেক, কানাডায় দুইটি ইত্যাদি ইত্যাদি। সুইজারল্যান্ডের দৃষ্টান্ত বিশেষ করে দ্রষ্টব্য। সেদেশের প্রধান দুই অংশ জর্মন এবং ফরাসি বলে। বন্দোবস্ত থাকা সত্ত্বেও একে অন্যের ভাষা সাধারণত রপ্ত করতে পারে না (ভাষা শেখা বাবতে সুইসরা বড়ই কাহিল), অথচ ফ্রান্স এবং জর্মনিতে যখন লড়াই লাগে তখন ফ্রেঞ্চ সুইসরা একথা কখনও বলেনি যে তারা ফ্রান্সের হয়ে লড়বে, জর্মন সুইও অনুরূপ ভয় দেখায়নি। গত যুদ্ধে দু জনে মিলে নিরপেক্ষ ছিল এবং হিটলার জানতেন যে সুইস-জর্মন যদিও তার জাতভাই, তবু তাদের কাছ থেকে কোনও সাহায্য পাওয়া যাবে না।