আমি বলি :
দেশের ভাষার ডাক শোনো ওই হে তরুণ বাংলার
এই বেলা যদি পারো তো পারিলে না হলে হল না আর।
এই বিরাট সাহিত্য নির্মাণের সম্মুখে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি তরুণ যেন সাহস না হারায়। সে যেন না ভাবে যে উর্দু গ্রহণ করলে তার সব মুশকিল আসান হয়ে যেত। সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান বাবদে ইংরেজি ঢের বেশি মুশকিল আসান। উর্দুতে আছে অল্পবিস্তর মসলা-মাসাইলের কেতাব, এন্তার দোয়া-দরুদের বই। তুমি যে রাষ্ট্র নির্মাণ করতে যাচ্ছ তার মালমসলা উর্দুতে যা পেতে সে জিনিস সৃষ্টি করতে তোমার পাঁচ বছরও লাগবে না। ইরান দেশ যেরকম একদিন ইরানি সভ্যতা নির্মাণ করে ফিরদৌসি, রুমি, হাফিজ, সাদি, খৈয়ামের জন্ম দিয়েছিল সেই রকম তুমিও সম্মুখে আদর্শ রাখবে পূর্ব পাকিস্তানে এক নতুন সভ্যতা গড়বার। ইরান আরবি এবং ফারসি দুই মিলিয়ে তার সাহিত্য-সংস্কৃতি গড়েছিল, তুমি আরবি, বাংলা, ফরাসি, সংস্কৃত, উর্দু, ইংরেজি মিলিয়ে ব্যাপকতর এবং মধুর সাহিত্য-সংস্কৃতি সৃষ্টি করবে।
অন্যান্য সম্প্রদায় যেন অযথা ভয় না পান। বৌদ্ধচর্যাপদের সূতিকাগৃহে যে শিশুর জন্ম, বৈষ্ণবের নামাবলী যে শিশুর অঙ্গে বিজড়িত, আরবি-ফারসির রুটি-গোস্ত যে শিশু বিস্তর খেয়েছে, গীতাঞ্জলির একেশ্বরের বন্দনা গেয়ে গেয়ে যে শিশু যৌবনে পৌঁছল, সে যুবক ইসলামের ইতিহাস চর্চা করলে কোনও মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। রাধাকৃষ্ণন, সুরেন দাশগুপ্ত যেসব দর্শনের কেতাব ইংরেজিতে লিখেছেন তাতে বিস্তর সংস্কৃত শব্দ আছে; মার্গোলিয়াত মুইর ইসলাম সম্বন্ধে যেসব গ্রন্থ ইংরেজিতে লিখেছেন তাতেও বিস্তর আরবি শব্দ আছে, তাই বলে ইংরেজি ভাষার জাত যায়নি। ভারতচন্দ্র তাঁর কাব্যে যে পরিমাণ আরবি-ফারসি শব্দ প্রয়োগ করেছেন সে পরিমাণ যদি পুনরায় কাজে লাগে তা হলে আপত্তি কী? আলালের ঘরের দুলালও তো বাংলা বই।
রামমোহন রায় বাংলা ভাষায় যে চিন্তাধারা প্রবর্তন করেছিলেন তার বিরুদ্ধে সে যুগে গোঁড়া হিন্দুরা প্রবল আপত্তি তুলেছিলেন, রামকৃষ্ণদেবকে কেন্দ্র করে বাংলা ভাষায় যে নবচেতনার উৎপত্তি হয়েছিল তখনকার বিদগ্ধ (প্রধানত ব্রাহ্মণ) সমাজ সেটাকে গ্রহণ করতে চাননি, এবং রবীন্দ্রনাথ সনাতন ঐতিহ্যপন্থী নন বলে তাকে পর্যন্ত সুরেশ সমাজপতি, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, শরৎ চট্টোপাধ্যায়ের হাতে লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়েছিল। আজ এসব সংগ্রামের কথা লোকে ভুলে গিয়েছে, এবং বাংলা সাহিত্যে এখন যদি মুসলিম-সংস্কৃতির (এবং সেইটেই যে তার একমাত্র প্রচেষ্টা হবে তা-ও নয়) আলোচনা হয় তা হলে বিচক্ষণ লোক বিভীষিকা দেখবেন না।
আমার মতো অজ্ঞ লোককে বহু হিন্দু-মুসলমান যখন বাংলাতে মুসলিম সংস্কৃতি সম্বন্ধে আলোচনা করতে অনুরোধ জানিয়ে থাকতে পারেন তখন যোগ্যজন এ কর্মে নিয়োজিত হলে যে বহুলোক তাঁকে আশীর্বাদ করবেন তাতে আর কী সন্দেহ?
পূর্ব পাকিস্তানে তা হলে উর্দুর স্থান কোথায়?
প্রথমত বলে রাখা ভালো যে, বর্তমানে আমাদের দেশে যে শিক্ষাপদ্ধতি প্রচলিত আছে তার সঙ্গে আমাদের পরিকল্পনার শিক্ষাপদ্ধতির কোনও তুলনাই হতে পারে না। উপস্থিত দেখতে পাই, স্কুলে চার বৎসর এবং কলেজে চার বৎসর একুনে আট বৎসর পড়েও সাধারণ ছাত্র চলনসই আরবি বা সংস্কৃত শিখতে পারে না। কাজেই যখন বলি উর্দু অপশনাল ভাষা হিসেবে ম্যাট্রিকের শেষের চার শ্রেণিতে পড়ানো হবে তখন উর্দুওয়ালারা যেন না-ভাবেন যে, ছাত্রদের উর্দু-জ্ঞান আমাদের গ্রাজুয়েটদের ফারসি-জ্ঞানেরই মতো হবে। কলেজেও উর্দুর জন্য ব্যাপক বন্দোবস্ত থাকবে। একথা ভুললে চলবে না যে পাকিস্তানের কলেজে ভারতীয় মুসলিম সংস্কৃতি নামক এক বিশেষ বিষয়বস্তু পড়ানো হবে। মোগল স্থাপত্য, চিত্রকলা, সঙ্গীত যেরকম সকলেরই গর্বের বিষয় (কোনও ইংরেজ বা মার্কিন যখন তাজমহলের প্রশংসা করে তখন কোনও হিন্দু তো তাজমহল মুসলমানের সৃষ্টি বলে নিজেকে সে দায় থেকে মুক্ত করেন না, রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ পাওয়া সম্বন্ধে কথা উঠলে কোনও বাঙালি মুসলমানকে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু বলে নতশির হতে তো দেখিনি; অবনীন্দ্রনাথ মোগল শৈলীতে ছবি আঁকেন, তাঁর শিষ্য নন্দলাল অজন্তা শৈলীতে, তাই বলে একথা কারও মুখে শুনিনি যে নন্দলাল গুরুর চেয়ে বড় চিত্রকর) ঠিক তেমনি উর্দু ভাষা এবং সাহিত্য হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই শ্লাঘার সম্পদ। যেসব ছাত্র ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব অথবা আরবি-ফারসি সাহিত্য অধ্যয়ন করবে তাদের বাধ্য হয়ে উর্দুর প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। বেশিরভাগ রাজনৈতিক এবং কেন্দ্রীয় পরিষদে জানেওয়ালা সদস্য এইসব বিষয়ের সঙ্গে ছাত্রজীবনে সংযুক্ত থাকবেন বলে উর্দুর সঙ্গে তাঁদের যথেষ্ট পরিচয় হবে। যারা ভাষা ব্যাপারে অসাধারণ মেধাবী তারা হয়তো করাচিতে উর্দু ভাষায় বক্তৃতা দেবেন কিন্তু অধিকাংশ সদস্যকে কেন বাংলাতেই বক্তৃতা দিতে হবে এবং সেজন্য যে অসুবিধা হবে সেটা কী করে সরাতে হবে তার আলোচনা প্রবন্ধের গোড়ার দিকেই সবিস্তর করেছি।
কেন্দ্রের চাকরি সম্বন্ধে বক্তব্য, যেদিন পূর্ব-পশ্চিম উভয় পাকিস্তান থেকে ইংরেজি অন্তর্ধান করবে সেদিন পাঞ্জাবি মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানে যে প্রকারে চাকরি করবে পূর্ব পাকিস্তানের লোক ঠিক সেই প্রকারেই কেন্দ্রে চাকরি করবে। এবং একথা তো কেউ অস্বীকার করবেন না যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বদৌলতে আমরা আরবি-ফারসির ভেতর দিয়ে উর্দুর সঙ্গে যুক্ত আছি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়েও থাকব, কিন্তু পাঞ্জাবি-সিন্ধির সেরকম বাংলার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কোনও ঐতিহ্য নেই। কাজেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আমরা হারব কেন? কিন্তু এ বিষয়ে অতিরিক্ত বাক্য ব্যয় করার প্রয়োজন নেই। উর্দুওয়ালারাই স্বীকার করে নিয়েছেন যে, সকল অবস্থাতেই বাঙালির জন্য করাচিতে ওয়েটেজ থাকবে। অর্থাৎ স্বয়ং উর্দুওয়ালারাই মেনে নিচ্ছেন যে আমরা প্রাণপণ উর্দু শিখলেও পশ্চিম পাকিস্তানি উর্দুভাষাভাষীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারব না। তাদের এই মেনে নেওয়াটা খুব সম্ভব ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাপ্রসূত। আমরাও বলি, আমাদের আলিম-ফাজিলগণ যখন উর্দুতে যুক্তপ্রদেশের মৌলবিগণকে পরাজিত করতে পারেননি, তখন আমাদের মতো তিফলে মকতব, কমসিনদের দিয়ে কোন জঙ্গ-ই-জবান জয় সম্ভবপর?