আরও কাছে, একদম ঘরের ভেতর চলে আসি। লালন ফকিরও বলেছেন, ঘরের কাছে পাইনে খবর/খুঁজতে গেলেম দিল্লি শহর। পূর্ব পাকিস্তানের আপন ঘরের মৌলবি-মৌলানারা যে শত শত বৎসর ধরে আরবি, ফারসি এবং উর্দুর চর্চা করলেন, এসব সাহিত্যে তাঁদের অবদান কী? গালিব, হালি, ইকবালের কথা বাদ দিন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে একজন দুসরা দরজার উর্দুকবি দেখাতে পারলেই আমরা সন্তুষ্ট হয়ে যাব।
মৌলবি-মৌলানাদের যে কাঠগড়ায় দাঁড় করালুম তার জন্য তারা যেন আমার ওপর অসন্তুষ্ট না হন। নওজোয়ানরা তাদের শ্রদ্ধা করুক আর না-ই করুক, আমি তাঁদের অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখি। উত্তর এবং পশ্চিম ভারতের (হিন্দুস্তানের) বহু মৌলবি-মৌলানার সংস্রবে এসে আমার এ বিশ্বাস আরও বদ্ধমূল হয়েছে যে, পূর্ববঙ্গের আলিম সম্প্রদায় শাস্ত্রচর্চায় তাঁদের চেয়ে কোনও অংশে কম নন। যেখানে সম্পূর্ণ বিদেশি ভাষা নিয়ে কারবার যেমন মনে করুন আরবি সেখানে পূর্ববঙ্গের আলিম অনেক স্থলেইহিন্দুস্তানের আলিমকে হার মানিয়েছেন কিন্তু উর্দুতে সাহিত্যসৃষ্টি তো সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। যে স্পর্শকাতরতা, সূক্ষ্মানুভূতি, হৃদয়াবেগ মাতৃভাষার ভেতর দিয়ে পরিস্ফুট হয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করে সেসব তাঁদের আছে কিন্তু উর্দু তাঁদের মাতৃভাষা নয় বলে তাদের সর্বপ্রচেষ্টা পঙ্গু, আড়ষ্ট ও রসবর্জিত হয়ে যে রূপ ধারণ করে তাকে সাহিত্য বলা চলে না। বিয়ের প্রীতি উপহারেই তার শেষ হদ।
অথচ দেখি, অতি যৎসামান্য আরবি-ফারসির কল্যাণে কাজী নজরুল বাংলা সাহিত্যে কী অক্ষয় খ্যাতি অর্জন করলেন। মুসলমানও যে বাংলাতে সফল সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারে সে তথ্য একা কাজী সাহেবই সপ্রমাণ করে দিয়েছেন।
তাই পুনরায় বলি, মাতৃভাষার সাহায্য ব্যতিরেকে কেউ কখনও কোনও দেশে সার্থক সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারেনি। আজ যদি আমাদের সাহিত্যপ্রচেষ্টা উর্দু স্বর্ণমৃগের পশ্চাতে ধাবমান হয় তবে তার চরম অবসান হবে অনুর্বর মরুভূমিতে। সমস্ত উনবিংশ ও এ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলা ভাষা ও সাহিত্য উর্ধ্বশ্বাসে প্রগতির দিকে ছুটে চলল; অর্থাভাবে, শিক্ষার অভাবে, দুঃখের তাড়নায় বাঙালি মুসলমান সে কাফেলাকে এগিয়ে যেতে দেখল কিন্তু সঙ্গী হতে পারল না। এখনও কি সময় হয়নি যে সে তার সৃজনশক্তির সদ্ব্যবহার করার সুযোগ পায়?
অথচ দেখি, অশিক্ষিত চাষা এবং অর্ধশিক্ষিত মুন্সিমোল্লা আপন সাহিত্য সৃষ্টি করে গিয়েছেন। পূর্ববঙ্গের লোকসাহিত্য যখন বিশ্বজনের সম্মুখে আত্মপ্রকাশ করল তখন দেশে-বিদেশে বহু রসিকজন তার যে প্রশংসা করলেন সে প্রশংসা অন্য কোনও দেশের লোকসাহিত্যের প্রতি উচ্ছ্বসিত হয়নি। ভাষার বাজারে বহু বৎসর ধরে এ অধম বড় বড় মহাজনদের তামাক সেজে ফাই-ফর্মাস খেটে দিয়ে তাঁদের আড়তের সন্ধান নিয়েছে, এবং সে হলপ খেয়ে বলতে প্রস্তুত, লোকসাহিত্যের ফরাসি, জর্মন, ইতালি, ইংরেজি আড়তের কোনওটিতেই পূর্ববঙ্গ লোকসাহিত্যের মতো সরেস মাল নেই।
আমাদের ভাটিয়ালি মধুর কাছে ভগার গান চিটেগুড়– হাসন রাজা, লালন ফকির, সৈয়দ শাহনূরের মজলিশে এসে দাঁড়াতে পারেন এমন একজন গুণীও ইয়োরোপীয় লোকসাহিত্য দেখাতে পারবে না।
অথচ কী আশ্চর্য, কী তিলিস্মাৎ, পূর্ববঙ্গের মুসলিম শিক্ষিত সম্প্রদায় কিছুই রচনা করতে পারলেন না! ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গে শিক্ষিত বলতে বোঝাত উর্দুসেবীগণ, তার পরের দুঃখ-দৈন্যের ইতিহাস তো পূর্বেই নিবেদন করেছি। কাজেই যারা শত শত বৎসর ফারসি এবং উর্দুর সেবা করে কোনও সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারেননি, অন্তত তাদের মুখে একথা শোভা পায় না যে বাঙালি মুসলমান বাংলা সাহিত্যের সেবা করে সে ভাষাকে আপন করে নিতে পারেনি।
কিন্তু কার দোষ বেশি, আর কার দোষ কম সেকথা নিয়ে এখানে আর আলোচনা করব না। এখানে শুধু এইটুকু নিবেদন করি : যে দেশের চাষি-মাঝি ভুবনবরেণ্য লোকসঙ্গীত রচনা করতে পারল সেদেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় সফল সাহিত্য রচনা করতে পারবে না একথা কি কখনও বিশ্বাস করা যায়? ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে বাধো বাধো ঠেকে কিন্তু না বলে উপায় নেই, তাই অতি সবিনয় নিবেদন করছি, খুদাতালা এ অধমের জন্য বহু দেশে রুটি রেখেছিলেন। আরব, মিশর, আফগানিস্তান, ফ্রান্স, জর্মনি প্রভৃতি নানা দেশে নানা পণ্ডিত নানা সাহিত্যিকের সেবা করে এ অধমের ধ্রুব বিশ্বাস জন্মেছে, পূর্ববঙ্গে সাহিত্যসৃষ্টির যে উপাদান আছে এবং পূর্ববঙ্গবাসীর হৃদয়মনে যে সামান আছে তার বদৌলতে একদিন সে অতি উচ্চাঙ্গের সাহিত্য সৃষ্টি করবে।
সোয়া চার কোটি মানুষ সাহিত্যসৃষ্টির জন্য উদ্গ্রীব হয়ে আছে। বহুশত বৎসর ধরে তাদের আতুর হিয়া প্রকাশের জন্য আকুলি-বিকুলি করেছে; কখনও ফারসি, কখনও উর্দুর মরুপথে তাদের ফল্গুধারা উষ্ণবাষ্পে পরিণত হয়ে গিয়েছে, আজ সেসব হৃদয় শুধু মর্মবাণীরই সন্ধানে নয়, আজ নবরাষ্ট্র নির্মাণের প্রদোষে তারা ওজস্বিনী ভাষায় দেশের জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে চায়।
হাঙ্গেরির জাতীয় সঙ্গীতে আছে :
দেশের দশের ডাক শোনা ওই ওঠো ওঠো মাডিয়ার
এই বেলা যদি পারো তো পারিলে না হলে হল না আর।