তাই দেখতে হবে, মাতৃভাষার যে নিঝরিণী দিয়ে বিদ্যাভ্যাস আরম্ভ, সেই নিঝরিণীই যেন বিশাল এবং বিশালতর হয়ে বিশ্ববিদ্যার অগাধ সমুদ্রে গিয়ে পৌঁছয়। মাঝখানে ইংরেজি বা উর্দুর দশ হাত শুকনো জমি থাকলে চলবে না।
বিশেষ করে উর্দুওয়ালা মৌলবি-মৌলানাদের একথাটি বোঝা উচিত। বাংলাতে ধর্মচর্চা না করার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মুসলিম ধর্মের কুসংস্কারে নিমজ্জিত। ডান দিক থেকে বাঁ দিকে ছাপা বই দেখলেই সে ভয়ে ভক্তিতে বিমূঢ় হয়ে যায় তা সে গুল-ই-বাকাওলির কেচ্ছাই হোক আর দেওয়ান-ই-চিরকিই হোক। রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করবার জন্য তাকে শেখাতে হবে :
১। ইসলামের ইতিহাস* এবং বিশেষ করে শেখাতে হবে এই তথ্যটা যে সে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করা অসম্ভব। আব্বাসি-ওম্মাই যুগের ভেতর দিয়ে মুসলিম সংস্কৃতি যে রূপ নিয়েছে সে রূপ পূর্ব পাকিস্তানে আবার নেবে না। অথচ ইসলামের গণতন্ত্রের খুঁটি এবং ধনবণ্টনে সমতার নোঙর জোর পাকড়ে ধরে থাকতে হবে।
[*পাকিস্তানকে theocratic রাষ্ট্র করার কথা উঠছে না। আমার ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস, ধর্মের নামে যে রাজনৈতিক ধাপ্পা, অর্থনৈতিক শোষণ চলে তার শেষ কোনওদিনই হবে না, যতদিন-না দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় ধর্মালোচনায় প্রবৃত্ত হন। ভারতীয় ইউনিয়ন সম্বন্ধেও এই নীতি প্রযোজ্য।]
২। শত শত বৎসরের জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা করে ইয়োরোপ যে শক্তি সঞ্চয় করেছে, মিশর দমস্ক আজ তাই শিখতে ব্যস্ত। প্রাচীন ঐতিহ্য যেরকম প্রশ্ন জিগ্যেস না করে গ্রহণ করা যায় না, ইয়োরোপীয় কর্ম এবং চিন্তাপদ্ধতি ঠিক সেইরকম বিনাবিচারে গ্রহণ করা চলবে না।
৩। ইসলাম আরবের বাইরে যেখানেই গিয়েছে সেখানেই তথাকার দেশজ জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলাকে গ্রহণ করে নতুন সভ্যতা-সংস্কৃতি নির্মাণ করেছে। ইরানের সুফিতত্ত্বের যশ কোন দেশে পৌঁছয়নি? তাজমহল এই করেই নির্মিত হয়েছে, উর্দু ভাষা এই পদ্ধতিতেই গড়ে উঠল, খেয়াল গান এই করেই গাওয়া হল, মোগল ছবি এই করেই পৃথিবীকে মুগ্ধ করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের ভারতীয় ঐতিহ্য নগণ্য নয়, অবহেলনীয় নয়। পূর্ববঙ্গের বহু হিন্দু ভারতবর্ষের ইতিহাসে স্বনামধন্য হয়েছেন, তাঁদের বংশধরগণ যেদিন নবীন রাষ্ট্রে আসন গ্রহণ করে সভ্যতা-কৃষ্টি আন্দোলনে যোগ দেবেন সেদিনই উভয় সম্প্রদায়ের অর্থহীন তিক্ততার অবসান হবে। (এস্থলে অবান্তর হলেও বলি ঠিক, তেমনি ভারতীয় ইউনিয়নের মুসলমানদের অবহেলা করেও সে রাষ্ট্র পরিপূর্ণতায় পৌঁছতে পারবে না।) একথা কিছুতেই ভুললে চলবে না যে মামুন, হারুনের সময় যখন আরবেরা জ্ঞান-গরিমায় পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান ঠিক তখনই তারা প্রচুর অর্থ ব্যয় করে চরকসুশ্রুতপঞ্চতন্ত্র আরবিতে অনুবাদ করেছিল, গজনির মাহমুদের আমলে ঐতিহাসিক আল-বিরুনি কী বিপুল পরিশ্রম করে সংস্কৃত শিখে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে প্রামাণিক গ্রন্থ লিখেছিলেন।
আরবেরা সমুদ্র উত্তীর্ণ হয়ে ভারতীয় সভ্যতার অনুসন্ধানে এদেশে এল। আর আজ পূর্ব পাকিস্তানের লোক বাংলাভাষার গায়ে বৈষ্ণব নামাবলী দেখে ভড়কে যাচ্ছে! কিমাশ্চর্যমতঃপর
কত গবেষণা, কত সৃজনশক্তি, কত শাস্ত্রাশাস্ত্র বর্জন গ্রহণ, কত গ্রন্থ নির্মাণ, কত পুস্তিকা প্রচার, কত বড় বিরাট, সর্বব্যাপী, আপামর জনসাধারণ সংযুক্ত বিরাট অভিযানের সামনে দাঁড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তান!
এর উৎসাহ-অনুপ্রেরণা যোগাবে কে?
প্রধানত সাহিত্যিকগণ। এবং আমি বিশেষ জোর দিয়ে জানাতে চাই, সে সাহিত্য-সৃষ্টি মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য কোনও ভাষাতে হতে পারে না।
আবার ইতিহাস থেকে নজির সংগ্রহ করি।
ফ্রান্স এবং ইংলন্ডে আঠারো মাইলের ব্যবধান। প্রতি বৎসর হাজার হাজার ইংরেজ প্যারিসে বেড়াতে আসে। বায়রন-শেলি উত্তম ফরাসি জানতেন কিন্তু কই, আজ পর্যন্ত তো একজন ইংরেজ ফরাসি-সাহিত্যে নাম অর্জন করতে পারেননি, আজ পর্যন্ত একজন ফরাসি ইংরেজি লিখে পাঁচজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেননি। অথচ বাংলা-উর্দুতে যে পার্থক্য, ফরাসি-ইংরেজিতে পার্থক্য তার চেয়ে ঢের কম। ফ্রেডরিক দি গ্রেটের যুগে বার্লিন এবং ভিয়েনার শিক্ষিত লোকমাত্রই ফরাসি চর্চা করত (আমরা যতটা ইংরেজি করি তার চেয়ে ঢের বেশি), কিন্তু তবুও তো একজন জর্মন ভাষাভাষী ফরাসি লিখে নাম করতে পারেননি। তুর্গেনিয়ে, তলস্তয়ের আমলে রুশ অভিজাত মাত্রই ফরাসি গভর্নেসের হাতে বড় হতেন, বাল্যকাল হতে ফরাসি লিখতেন (তলস্তয়ের রুশ-পুস্তকে যে পরিমাণ পাতার পর পাতা সির্ফ ফরাসি লেখা আছে সেরকম ইংরেজি-ভর্তি বাংলা বই আমাদের দেশে এখনও বেরোয়নি) কিন্তু তৎসত্ত্বেও একজন রুশ ফরাসিতে সার্থক সৃষ্টিকার্য করতে পারেননি।
অত দূরে যাই কেন? সাতশো বৎসর ফারসির সাধনা করে ভারতবর্ষের সাহিত্যিকেরা এমন একখানা বই লিখতে পারেননি যে বই ইরানে সম্মান লাভ করেছে। যে গালিব আপন ফারসির দম্ভ করতেন তার ফারসি কবিতা ইরানে অনাদৃত, অপাঙক্তেয়, অথচ মাতৃভাষায় লেখা তাঁর উর্দু কবিতা অজর অমর হয়ে থাকবে।
আরও কাছে আসি। মাইকেলের মতো বহুভাষায় সুপণ্ডিত দ্বিতীয় বাঙালি এদেশে জন্মাননি। তাঁর পূর্বে বা পরে কোনও বাঙালি তার মতো ইংরেজি লিখতে পারেননি, তবু দেখি আপ্রাণ চেষ্টা করে তিনিও ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে এতটুকু আঁচড় কেটে যেতে পারেননি। অথচ অল্পায়াসে লেখা তাঁরমেঘনাদ বাংলা সাহিত্য থেকে কখনও বিলুপ্ত হবে না।