মৃত্যুর পর বেহেশত বা মোক্ষ দান করাই ধর্মের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। বিশেষত ইসলাম সংসারের সর্বস্ব ত্যাগ করে গুহা-গহ্বরে বসে নাসিকাগ্রে মনোনিবেশ করার ঘোরতর বিরুদ্ধ মতবাদ প্রচার করে। আল্লাতালা কুরান শরিফে বার বার বলেছেন যে এই সংসারে তিনি নানারকম জিনিস মানুষকে দিয়েছেন তার আনন্দ বর্ধনের জন্য। তাই মুসলিম মাত্রই প্রার্থনা করে, হে আমাদের প্রভু, ইহলোকে আমাদের শুভ হোক, পরলোকে আমাদের শুভ হোক। এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় ইহলোকের মঙ্গল অতীব কাম্য, তাই প্রশ্ন ওঠে পার্থিব বস্তু কোন পদ্ধতিতে উপভোগ করব যাতে করে অমঙ্গল না হয়?
তাই বিশেষ করে ইসলামই পার্থিব বস্তুর ভাগবাটোয়ারা সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন। কুরান শরিফ বার বার ধনবন্টন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন, এবং সে বিষয়ে প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত দেন।
মহাপুরুষ মুহম্মদের (স.) সঙ্গে মক্কাবাসীদের দ্বন্দ হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ পার্থিব বস্তুর নবীন বণ্টনপদ্ধতি নিয়ে। সাইল অর্থ ভিখারি নয়, সাইল বলতে আজকাল আমরা ইংরেজিতে হ্যাভ নট বাক্যে যা বুঝি তাই। সাইলকে বিমুখ করো না এই আদেশ মক্কার ধনপতিগণ গ্রহণ করতে কিছুতেই সম্মত হয়নি, অথচ এই নবীন পদ্ধতি দুস্থ নিপীড়িত বিত্তহীনদের প্রাণে নতুন আশার বাণী এনে দিয়েছিল। ফলে দেখতে পাই মহাপুরুষের প্রথম শিষ্যদের ভেতর বিত্তহীন ও দাসের সংখ্যা বেশি।
ইহকাল-পরকালের মঙ্গল আদর্শ নিয়ে এই যে আন্দোলন সৃষ্ট হল তার বিজয় অভিযান পৃথিবীর ইতিহাসে আপন স্থান করে নিয়েছে কিন্তু সে ইতিহাস আলোচনা করা এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু এইটুকু দেখাতে চাই, মহাপুরুষের চতুর্দিকে যে বিরাট আন্দোলন ক্রমে ক্রমে জাগ্রত হল সে আন্দোলন গণআন্দোলন। মহাপুরুষ যে নবীন আন্দোলন সফল করে তুললেন সে এই জনগণের সাহায্যে।
আজ পাকিস্তান যে বিরাট আন্দোলনের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে আন্দোলন জনগণ দিয়েই গঠিত হবে। এ আন্দোলনে থাকবে নতুন ধনবন্টন পদ্ধতি, নতুন ধনার্জন পন্থা, শিক্ষার প্রসার, গণতান্ত্রিক নির্বাচনপন্থা, স্বাস্থ্যের উন্নতি, সংস্কৃতি-বৈদগ্ধ্য নির্মাণপ্রচেষ্টা– এককথায় প্রাচীন শোষণনীতি সমূলে উৎপাটন করে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার সর্বাঙ্গীণ সম্পূর্ণ বিকাশ।
কিন্তু যদি জনগণ এ আন্দোলনে অংশীদার না হয় তবে সমস্ত আন্দোলন ব্যর্থ হবে। জনসাধারণ যদি আন্দোলনের উদ্দেশ্য বুঝতে না পারে এবং না বুঝতে পেরে আপন প্রচেষ্টা নিয়োগ করতে কুণ্ঠিত হয়, অথবা প্রয়োজনমতো স্বার্থ ত্যাগ করতে প্রস্তুত না হয় কিংবা ধনপতিদের উৎকোচে বশীভূত হয়, অথবা দু চার আনা মজুরি বৃদ্ধিতেই যদি বৃহত্তর স্বার্থকে ত্যাগ করে তবে সম্পূর্ণ আন্দোলন নিষ্ফল হবে।
এবং এস্থলে আমার কণ্ঠে যত শক্তি আছে তাই দিয়ে আমি চিৎকার করে বলতে চাই, মাতৃভাষা বাংলার সাহায্য বিনা জনসাধারণকে এই বিরাট আন্দোলনের বিস্তৃত শাখা-প্রশাখা সম্বন্ধে সচেতন এবং ওয়াকিবহাল করা যাবে না, যাবে না, যাবে না।
উর্দুওয়ালারা বলবেন, উচ্চশিক্ষা উর্দুর মাধ্যমিকে দেব বটে কিন্তু শিক্ষিতেরা কেতাব লিখবেন বাংলায়।
আমার বক্তব্য, ঠিক ওই জিনিসটেই হয় না, কখনও হয়নি। দৃষ্টান্তস্বরূপ দেখাই, ইংরেজ আমাদিগকে কখনও ইংরেজি বই লিখতে বাধ্য করেনি, তবুও ভারতবর্ষ সম্বন্ধে গত একশত বৎসর ধরে যত উত্তম উত্তম ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজতন্ত্র, দর্শন সম্বন্ধে বই বেরিয়েছে তার শতকরা ৯৫ খানা ইংরেজিতে কেন? জ্ঞানচর্চা করব এক ভাষায় আর তার ফল প্রকাশ করব অন্য ভাষায়, এই বন্ধ্যা-প্রসব কখনও কস্মিনকালেও হয় না। মানুষ যখন আপন মাতৃভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞানের বিষয় চিন্তা করতে শেখে তখনই সে মাতৃভাষায় লিখতে শেখে।
অর্থাৎ ইংরেজি আমলে যা হয়েছিল তারই পুনরাবৃত্তি হবে। একদল উর্দুশিক্ষিত লোক উর্দুতে লেখাপড়া শিখবেন, বড় বড় নোকরি করবেন, বহিরাগত উর্দুভাষীদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে এক নতুন অভিজাত সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, আর বাদবাকি আমরা চাষাভুষো পাঁচজন যে তিমিরে ছিলুম সেই তিমিরেই থাকব।
তাই পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিই হজরতের চতুর্দিকে যে আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছিল এবং পরে যে রাষ্ট্র-সংগঠন অভিযান আরম্ভ হয়েছিল তার মাধ্যমিক ছিল আপামর জনসাধারণের ভাষা– আরবি। বিদগ্ধ হিব্রুকে তখন সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছিল।
উর্দুওয়ালারা বলবেন– বাংলা জানলেই কি সব বাংলা বই পড়া যায়? বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি বাংলা চালাই, এবং ফলে যদি সকল রকমের বই-ই বাংলাতে লেখা হয় তা হলেই কি আপামর জনসাধারণ সেসব বই পড়তে পারবে?
উত্তরে বলি, সকলে পারবে না, কিন্তু অসংখ্য লোক পারবে।
আমি যে শিক্ষাব্যবস্থার স্বপ্ন দেখছি তাতে দেশের শতকরা নব্বইজন মাইনর, ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়বে। এবং সে মাইনর-ম্যাট্রিকের শিক্ষাদান অনেক বেশি উন্নত পর্যায়ের হবে। ইংরেজি বা উর্দুর জন্য জান পানি করবে না বলে তারা অতি উত্তম বাংলা শিখবে এবং ইংলন্ড, ফ্রান্স, মিশর, ইরানে যেরকম সাধারণ শিক্ষিত লোক মাতৃভাষায় লেখা দেশের শ্রেষ্ঠ পুস্তক পড়তে পারে, এরাও ঠিক তেমনি দেশের উন্নততম জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। দেশের তাবৎ লোকই যে উত্তম উত্তম পুস্তক পড়বে সেকথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়–কারণ সকলেই জানেন জ্ঞানতৃষ্ণা কোনও বিশেষ শ্রেণি বা সমাজের মধ্যে নিবদ্ধ নয়, এমনকি উচ্চশিক্ষা পাওয়া না পাওয়ার ওপরও সে জিনিস সম্পূর্ণ নির্ভর করে না; কত বিএ, এমএ, পরীক্ষা পাসের পর চেকবই ছাড়া অন্য কোনও বইয়ের সন্ধানে সময় নষ্ট করেন না, আর কত মাইনরের ছেলে গোগ্রাসে যা পায় তাই গেলে– কিন্তু মাতৃভাষা দেশের শিক্ষাদীক্ষার বাহন হলে কোনও তত্ত্বানুসন্ধিৎসু অল্প চেষ্টাতেই দেশের সর্বোত্তম প্রচেষ্টার সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে। এর সত্যতা সপ্রমাণ হয় আরেকটি তথ্য থেকে ইয়োরোপের বহু সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক-আবিষ্কর্তা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন না-করেও যশস্বী সৃষ্টিকার হতে সমর্থ হয়েছেন।