তাই বলি পাক না-পাকের প্রশ্ন শুধানো ইসলাম-ঐতিহ্য পরিপন্থী। কোনও মানুষকে না-পাক বলে যেমন তাকে কলমা থেকে বঞ্চিত করা যায় না, কোনও ভাষাকে ঠিক তেমনি না-পাক নাম দিয়ে ইসলামি শিক্ষা-ঐতিহ্যের বাহক হওয়া থেকে বঞ্চিত করা যায় না। ছুৎ বাই ইসলামি মার্গ নয়।
কেন্দ্রের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন, কেন্দ্রের চাকরি, কেন্দ্রীয় পরিষদে বক্তৃতাদান ইত্যাদি বিষয়ে বাংলা কতদূর প্রতিবন্ধক হবে-না-হবে সে বিষয়ে আলোচনা অন্য প্রসঙ্গে প্রবন্ধের গোড়ার দিকে করা হয়ে গিয়েছে। বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা সম্বন্ধে আর যেসব ছোটখাটো আপত্তি আছে তার অন্যতম ব্যবসাবাণিজ্য।
উর্দুওয়ালারা বলেন, ইংরেজি তাড়িয়ে দিলুম, উর্দু শিখলুম না, তা হলে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যবসা করব কী করে?
এর উত্তর এতই সরল যে দেওয়াটা বোধহয় নিষ্প্রয়োজন। ইংলন্ডের শতকরা ৯৯ জন ফরাসি জানে না, ফ্রান্সের ৯৯.৯ জন ইংরেজি জানে না, তৎসত্ত্বেও ব্যবসা চলে। তার চেয়েও সরল উদাহরণ আছে। মারোয়াড়িরা প্রায় একশো বৎসর ধরে বাংলাদেশ শুষে খাচ্ছে, আমাদের কাফনের কাপড় বিক্রি করে তারা মারোয়াড়ে তিনতলা বাড়ি বানায় কিন্তু সমস্ত মারোয়াড় দেশে বাংলা পড়াবার জন্য একটা স্কুল নেই, কোনওকালে ছিলও না। এসব তো হল খুচরা ব্যবসায়ের কথা। প্রদেশে প্রদেশে, দেশে দেশে ব্যবসায়ের যোগাযোগ হয় বড় বড় কারবারিদের মধ্যস্থতায়। দমস্কসে যে জর্মন ভদ্রলোক সিমেন শুকার্টের কলকজা বিক্রয় করতেন তিনি তড়বড় করে আরবি বলতে পারতেন– তাই বলে গোটা জর্মনির পাঠশালা-স্কুলে তো আরবি পড়ানো হয় না।
পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের যে বড় বড় ব্যবসা হবে, সে হবে করাচির সঙ্গে। করাচির ভাষা সিন্ধি কারবারি মহলে চলে ইংরেজি, সিন্ধি এবং কিঞ্চিৎ গুজরাতি। ব্যবসায়ের জন্য ভাষা শিখতে হলে তো আমাদের সিন্ধি শিখতে হয়।
ব্যবসা যে করে ভাষার মাথাব্যথা তার। শিক্ষাবিভাগ এবং দেশের দায়িত্ব এইটুকু যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্স বিভাগে তার জন্য সামান্যতম বন্দোবস্ত করে দেওয়া। সেটুকু কেন, তার চেয়ে ঢের বেশি উর্দু আমরা পূর্ব পাকিস্তানে শেখাব। সেকথা পরে হবে।
এ জাতীয় খুঁটিনাটি আরও অনেক সমস্যা আছে কিন্তু তা হলে মূল বক্তব্যে কখনওই পৌঁছানো যাবে না।
উর্দু-বাংলা দ্বন্দ্বের শেষ সমাধান করতে হলে বিচার-বিবেচনা আবশ্যক যে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আদর্শ কী? আশা করি এ কথা কেউ বলবেন না যে একমাত্র উর্দুর সেবা করার জন্যই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
পাকিস্তান তথা পূর্ব পাকিস্তানের আদর্শ কী সে সম্বন্ধে আমার ব্যক্তিগত মত দেবার কোনও অর্থ হয় না। নানা গুণী যে নানা মত দিতেছেন তার মাঝখানে একটি সত্যকথা সকলেই স্বীকার করে নিয়েছেন সে হচ্ছে এই যে পাকিস্তানকে সর্বপ্রথম সমৃদ্ধবান রাষ্ট্র করতে হবে।
তা হলেই প্রশ্ন উঠবে, সমৃদ্ধশালী হতে হলে যে শক্তির প্রয়োজন সে শক্তি সুপ্তাবস্থায় আছে কোন্খানে?
পাকিস্তান তথা ভারত ইউনিয়নের স্বাধীনতা যে সফল হল তার প্রধান কারণ গণআন্দোলন। যতদিন কংগ্রেস বলতেস্টেটসমেনের ভাষায়ভড্রলোক ক্লাস, যতদিন লীগ বলতে রামপুর-ভূপাল খানবাহাদুর-খানসায়েবদের বোঝাত ততদিন ইংরেজস্বরাজ এবংপাকিস্তানের থোড়াই পরোয়া করেছে। কিন্তু যেদিন দেখা গেল যে লীগের পশ্চাতে জনসাধারণ এসে দাঁড়িয়েছে, অর্থাৎ লীগ আন্দোলন গণআন্দোলনের রূপ ধারণ করেছে সেদিন আর পাকিস্তানের দাবি কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারল না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জনসাধারণের শক্তি প্রয়োগে।
জনসাধারণের সেই শক্তি সেদিন বিদ্রোহের রূপ ধারণ করেছিল। আজ সে শক্তি সুষুপ্ত এবং সেই শক্তি যদি পাকিস্তান গঠনে নিয়োজিত না হয় তবে পাকিস্তান কখনওই পূর্ণাবয়ব, প্রাণবন্ত রাষ্ট্ররূপে দুনিয়ার মজলিসে আসন নিতে পারবে না। মার্কসবাদের মূল সিদ্ধান্ত ঠিক কি না সে আলোচনা এ স্থলে সম্পূর্ণ অবান্তর, ইসলামের সঙ্গে যাদের সামান্যতম পরিচয় আছে তারাই জানেন, ইসলাম কোনও বিশেষ বর্ণ, জাতি বা শ্রেণিকে শ্রেষ্ঠত্বের আশীর্বাদ দিয়ে অজরামর করে তুলতে সম্পূর্ণ নারাজ।
যারা ধর্মকে– তা সে ইসলামই হোক্ আর হিন্দুধর্মই হোক–রাজনীতি থেকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্র চালাতে চান তাদের উদ্দেশে আমার এস্থানে দু-একটি বক্তব্য আছে। ধর্মে বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, ধর্ম যে এ দুনিয়ায় এখনও প্রচণ্ড শক্তির আধার সেকথা অস্বীকার করলে আমরা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতি পদে অপ্রত্যাশিত সংকটের সম্মুখে উপস্থিত হব। এই যে আমরা বার বার শুনতে পাই ইয়োরোপ নাস্তিক, ইয়োরোপীয় রাজনীতি ধর্মকে উপেক্ষা করে চলে, সে কথাটা কতদূর সত্য? ফ্রান্স-জর্মনিতে এখনও ক্রিশ্চান পার্টিগুলো কতটা শক্তি ধারণ করে সেকথা সবচেয়ে বেশি জানেন কম্যুনিস্টরা। ক্রিশ্চান ডেমোক্রেট, ক্যাথলিক সেন্টার এদের অবহেলা করে কোনও ব্যাপক রাজনৈতিক আন্দোলন চালানো এখনও ফ্রান্স, জর্মনি, ইতালিতে অসম্ভব। এই তো সেদিন রাজনীতি-ক্ষেত্রে এখনও পোপের কত ক্ষমতা সেটা ধরা পড়ল ইতালির গণভোটে। পোপ এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গ যেদিন সশরীরে কম্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে আসরে নামলেন সেদিন কমরেড তল্লাত্তি প্রমাদ গুনলেন। শেষরক্ষার জন্য ধর্মহীন তল্লাত্তিকে পর্যন্ত বলতে হল, ভবিষ্যৎ ইতালীয় কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রে ধর্মপ্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি, বিষয়-আশয়ে কোনওপ্রকার হস্তক্ষেপ করা হবে না, এযাবৎ তারা যেসব সুখসুবিধা উপভোগ করে আসছেন তার সবকটাই তারা নিশ্চিত মনে উপভোগ করতে পারেন। কিন্তু এ শ্মশান-চিকিৎসায়ও ফল হল না, তল্লাত্তির নির্মম পরাজয়ের কথা সকলেই জানেন। পোপ এই ভোট-মারে নেবে ভালো করেছিলেন কি মন্দ করেছিলেন সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর, আমাদের শুধু এইটুকুই দেখানো উদ্দেশ্য যে ধর্ম এখনও বহু শক্তি ধারণ করে।