তবু কেন সে ভাষায় অবতীর্ণ না-হয়ে কুরান শরিফ পৌত্তলিকের ভাষায় নাজিল হলেন।
এ পরম বিস্ময়ের বস্তু এবং শুধু আমরাই যে আজ বিস্মিত হচ্ছি তা নয়, স্বয়ং মহাপুরুষের আমলেও বিস্ময় বহুমুখে প্রকাশ হয়েছিল।
কিন্তু সে বিস্ময়ের সমাধান স্বয়ং আল্লাহতালা কুরান শরিফে করে দিয়েছেন। পাছে বাংলা অনুবাদে কোনও ভুল হয়ে যায় তাই মৌলানা আব্দুলা য়ুসুফ আলীর কুরান-অনুবাদ থেকে শব্দে শব্দে তুলে দিচ্ছি। আল্লা বলেন,
Had we sent this as
A Quran (in a language)
Other than Arabic, they would
Have said :Why are not
Its verses explained in detail?
What! (a Book) not in Arabic
And (a Messenger) an Arab?
অর্থাৎ আমরা যদি আরবি ভিন্ন অন্য কোনও ভাষায় কুরান পাঠাতুম তা হলে তারা বলত এর বাক্যগুলো ভালো করে বুঝিয়ে বলা হল না কেন? সে কী! (বই) আরবিতে নয় অথচ (পয়গম্বর) আরব!
খুদাতালা স্পষ্ট ভাষায় বলছেন, আরব পয়গম্বর সে আরবি ভাষায় কুরান অবতরণের আধার হবেন সেই তো স্বাভাবিক, এবং অন্য যে কোনও ভাষায় সে কুরান পাঠানো হলে মক্কার লোক নিশ্চয়ই বলত, আমরা তো এর অর্থ বুঝতে পারছিনে।
কুরানের এই অঙ্গুলিনির্দেশ মতো চললেই বুঝতে পারব ভাষার কৌলিন্য-অকৌলীন্য অত্যন্ত অবান্তর প্রশ্ন, আসল উদ্দেশ্য ধর্মপুস্তক যেন আপামর জনসাধারণ বুঝতে পারে। বার বার কতবার কুরানে বলা হয়েছে, এ বই খোলা বই, এ বই আরবিতে অবতীর্ণ হল যাতে করে সর্বসাধারণের জন্য এ বই সরল দিগদর্শক হতে পারে।
সর্বসাধারণ সনাতন ধর্মের বাণী মাতৃভাষায় বুঝুক এই মাহাত্ম্য যে কত গাম্ভীর্যপূর্ণ এবং গুরুত্বব্যঞ্জক সেকথা আমরা এখনও সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম করতে পারিনি।
আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস পূর্বাচার্যগণ এ বাণী হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং সক্ষম হয়েছিলেন বলেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, ধর্মজ্ঞান যদি মুষ্টিমেয় পণ্ডিতের বিদ্যাচর্চার বিলাসবস্তু না হয়ে আপামর জনসাধারণের নিত্য অবলম্বনীয় সখারূপে সপ্রকাশ হতে চায় তবে সে ধর্মশিক্ষা মাতৃভাষাতেই দিতে হবে। কোনও বিদেশি ভাষা দ্বারা জনসাধারণকে ব্যাপকভাবে ধর্মশিক্ষা দেওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব, মাতৃভাষার সাহায্য নিতেই হবে, তা সে মাতৃভাষা পূতপবিত্রই হোক আর ওছা নাপাকই হোক। এ তত্ত্বটা ইরানের মনীষীরা অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন বলেই একদা ইরানে আরবির বহুল প্রচার থাকা সত্ত্বেও নাপাক ফারসি ভাষাকে ধর্মশিক্ষার বাহনরূপে ব্যবহার করেছিলেন। ভারতীয় মনীষীরা ঠিক সেই কারণেই এদেশে বিদেশি ফারসি প্রচলিত থাকা সত্ত্বেও না-পাক হিন্দির সঙ্গে আরবি-ফারসি মিলিয়ে উর্দু নির্মাণ করেছিলেন।
বাংলাদেশের মৌলবি-মাওলানারা সস্তায় কিস্তিমাত করতে চেয়েছিলেন বলেই দেশজ বাংলাকে ধর্মশিক্ষার বাহনরূপে স্বীকার করেননি উর্দু দিয়ে ফাঁকতালে কাজ সারিয়ে নেবার চেষ্টাতেই ছিলেন। তাই পূর্ব পাকিস্তানকে আজ এই খেসারত দিতে হচ্ছে যে নিজ বাসভূমে, পরবাসী হওয়ার মতো নিজ মাতৃভাষায় যে কোনও কিছুরই চর্চা করতে পারেনি। যুক্তপ্রদেশ তথা পাঞ্জাবের মৌলবি-মাওলানাগণ যেরকম মাতৃভাষা উর্দুর সাহায্যে শাস্ত্রচর্চা করেছিলেন, বাঙালি আলিমগণও যদি বাংলায় সেরকম শাস্ত্রচর্চা করে রাখতেন তা হলে সেই সূত্রপাতের খেই ধরে আজ বাঙালি মুসলমান নানা সাহিত্য নির্মাণ করে অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারত। এবং যখন দেখি যে বাঙালি আলিমগণ বাংলায় শাস্ত্রচর্চা না করে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে অজ্ঞ রাখলেন তাঁরাই বাঙালি তরুণকে তার ধর্মশাস্ত্রের অজ্ঞতা নিয়ে তাচ্ছিল্য অবহেলা করেন তখন বিস্ময়ে বাক্যস্ফুরণ হয় না। আপন কর্তব্যচ্যুতি ঢাকবার এই কি সরলতম পন্থা? এবং, তাঁরা এ কথাটাও বুঝলেন না যে, বাঙালি হিন্দু, যেরকম সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতকে শাস্ত্রগ্রন্থ বাংলাতে অনুবাদ ও প্রচার করার জন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি দেয়, তাঁরাও বাংলায় ইসলামি শাস্ত্রের চর্চা করলে বাঙালি মুসলমানের কাছ থেকে সেরকম শ্রদ্ধাঞ্জলি পেতেন।
আবার বলি, এখনও সময় আছে। উর্দু-বাংলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে তারা সরল বাংলা (লিসানু-ম্মুবীন) গ্রহণ করবেন, না আবার উর্দু দিয়ে ফোকটে কাজ সারবার তালে থাকবেন?
ধর্মজগতে পোপকে একদা এই দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তার খাস-পেয়ারা লাতিন সর্বদেশের সর্বমাতৃভাষাকে পদদলিত করে
পাকা রাস্তা বানিয়ে বসে দুঃখীর বুক জুড়ি
ভগবানের ব্যথারপরে হাঁকায় সে চার-ঘুড়ী
–করবে, না তিনি লুথারের প্রস্তাবমতো মাতৃভাষায় শাস্ত্রচর্চা করতে দেবেন? পোপ সত্যপথ দেখতে পাননি, তিনি ভুল করেছিলেন। ফলে খ্রিস্টজগৎ দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল।
আজ যদি জোর করে পোপের ভ্রান্তাদর্শ অনুসরণ করে উর্দুওয়ালা পূর্ব পাকিস্তানের স্কন্ধে উর্দু চাপান তবে লুথারের মতো লোক পূর্ব পাকিস্তানে খাড়া হতে পারে। যারা অখণ্ড পাকিস্তান চান তারা এই কথাটি ভেবে দেখবেন।
ভাষার পাকি না-পাকি সম্বন্ধে আমার শেষ দ্বিধাটি এইবার নিবেদন করি। আমরা যে এত তর্কাতর্কি করছি, কিন্তু নিজের মনকে কি একবারও জিগ্যেস করেছিপাকিস্তান শব্দটির জন্ম কোথায়, সে জাতেপাক, না নাপাক?পাক কথাটা তো আরবি নয়, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিপ (অথবাপে) অক্ষরটি আরবি নয়, প অক্ষরটি ফারসি অর্থাৎ প্রাচীন ইরানি, অর্থাৎ অগ্নি-উপাসক কাফিরদের শব্দ, এবং এই জেন্দা-আবেস্তার শব্দটির সঙ্গে যুক্ত আছে সংস্কৃতপ শব্দ (পা শব্দটি সংস্কৃত নয়, কিন্তু আবেস্তা ও সংস্কৃত যমজ-ভাষা) এবং স্তান কথাটি যে সংস্কৃত স্থানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেকথাও সকলেই জানেন। দুটি শব্দই আরবি নয়, প্রাচীন ইরানি, এবং প্রাচীন ইরানি বাংলা অপেক্ষা কোনওদিক দিয়ে পাক নয়। ভাষার দিক দিয়ে যদি সত্যই সম্পূর্ণপাক নাম দিতে হয় তবে তো পাকিস্তানকে বয়তুল মুদ্দাসের ওজনে মুমলকতুল মুকদ্দস জাতীয় কোনও নাম দিতে হয়।