[*বছর কয়েক পূর্বে কিন্তু রসসমুদ্রে এহেন একটা টর্নাডো-ম্যালস্ট্রোম হব-হচ্ছে–হচ্ছের পাঁয়তারা কষছিল এমন সময় জানিনে কার হুকুমে শেষ পর্যন্ত কিছুই হল না। রীতিমত বিল তৈরি হয়েছিল; ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ সায়েব স্থির করে দেবেন, কোন্ নাটক উত্তম, অভিনয় করা যেতে পারে!]
.
এবারে শেষ কথা।
চেনা বামুনের গলে পৈতা কেন মিছে?– ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছি। অবধূতের গলায় আমি আবার পৈতে পরাতে যাচ্ছি কেন– বিশেষত তিনি যখন উক্তৃষ্ট রাঢ়ি ব্রাহ্মণ? কিন্তু তিনি যে গেরুয়া পরেন এবং যতদূর জানি, গেরুয়া পৈতে দুটো একসঙ্গে পরা নিষিদ্ধ। তবু যে আমি নবপরিচিতির এই পৈতেটি তার গণ্ডে জড়িয়ে দিচ্ছি তার কারণ তিনি মায়াজালে বন্ধ হয়ে কিছুদিন ধরে আমাদের সঙ্গে বাস করছেন তিনি যা করুন, করুন– আমাদের উচিত তাঁর সাহিত্যিক খ্যাতি-পরিচিতির পৈতেটি তাঁর সামনে নিবেদন করা। এবং সঙ্গে সঙ্গে আমি আল্লার কসম খেয়ে বলতে পারি, ওই-পৈতেটিও ভস্ম করে তিনি একদিন অন্তর্ধান করবেন–নীলকণ্ঠের কণ্ঠে কিংবা ধূর্জটির জটায়। সেই পৈতেটি এই (এবং একমাত্র এই পৈতেটিই আমার চেনা এক নম্বরের অবধূত, দুই নম্বরের লেখক অবধূত ও তিন নম্বরের গ্রন্থেরআমি অবধূত তিনজনকেই একসঙ্গে পরানো যায়।
তিন অবধূতেরই বোধহয় সবচেয়ে প্রিয় শ্লোক–
ঘৃণা লজ্জা ভয়ং শোকো জুগুপ্সা চেতি পঞ্চমী।
কুলং শীলং তথা জাতিরষ্টো পাশাঃ প্রকীর্তিতাঃ ॥
ঘৃণা, লজ্জা, ভয়, শোক, নিন্দা করার প্রবৃত্তি, কুল, শীল তথা জাতের বড়াই– এসব থেকে মুক্ত হতে হবে। অত্যুত্তম প্রস্তাব। তাই নীলকণ্ঠে দেখতে পাই, খেতে না পেয়েও তার কষ্ট হচ্ছে না দেখে তিনি উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করছেন- সন্ন্যাসীবর ক্ষুধা জয় করে ফেলেছেন!– পরক্ষণেই আনগ্ন গাত্রে বরফে গড়াগড়ি দিলেও তাঁর শৈত্য বোধ হয় না দেখে তিনি তো সপ্তম স্বর্গে। নীলকণ্ঠের উচ্চতর স্তরে যে দুটি সাক্ষাৎ কৃতান্তদ্বয়, দারুণ অন্নাভাব ও নিদারুণ শৈত্য, এ দুটিই– নামে অবধূত এখন সিদ্ধিতে অবধূত– জয় করে ফেলেছেন! এবারে তিনি টেলিফোন খুঁজছেন, লর্ড কেদারনাথের সঙ্গে একটা রাঁদেভু স্থির করে তাঁর সঙ্গে শেকহ্যান্ড করবেন বলে!
আর লজ্জা ঘৃণা ভয় ইত্যাদি সে তো অবধূত কবে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন– পুস্তকে বিনয়বশত যা বলুক বলুক। আমি পুনরায় এক কোমর গঙ্গাজলে দাঁড়িয়ে পৈতে স্পর্শ করে পাঁচপীরের কসম খেতে রাজি আছি।
কিন্তু হায়, অবধূত এ-পৃথিবীতে এসেছেন অশুভক্ষণে। তাঁর নির্ঘণ্ট দীর্ঘ, তিনি কোন্ কোন পাশ হতে মুক্ত হতে চান, তিনি কোন কোন রিপু জয় করতে চান! অনেকগুলি জয় করতে করতে তো উঠছেন তিনি ঊর্ধ্ব থেকে ঊতর লোকে– চিত্তলোক এবং ইহলোক উভয়েতেই পৌঁছেই গেছেন গরুড়চটি। সম্মুখে আর চড়াই নেই- কেদার ক্রোশমাত্র দূরে। অবধূত নিশ্চিন্ত মনে নিদ্রা দিলেন। কিন্তু, হা-হতোস্মি, সকালে দেখেন এ কী! রাতারাতি হড়হড়িয়ে নেবে গেছেন যাত্রারম্ভস্থল দেবপ্রয়াগে!… আবার আরম্ভ হল নতুন করে রিপুজয় চিত্তজয় অজগর-পন্থা পঞ্ছী-পন্থা মারফত, আরোহণ করলেন না জানি আরও কত উচ্চ ভূমিতে। এবারে রাতারাতি হড়হড়িয়ে চুড়োয়–হ্যাঁ, আমাদের এই কুঁচড়োয়!
কেন? কেন এ-দুর্দৈব?
আমার দৃঢ় বিশ্বাস অবশ্য অবধূত এবং বাঙালি পাঠক আমার সঙ্গে একমত না হলে আমি বিস্মিত হব না– তিন অবধূতে একজোটে যে-সব পাশ ছিন্ন করার মতলব নিয়ে সেগুলোর নির্ঘণ্ট নির্মাণ করেন তখন একটি পাশের কথা বেবাক ভুলে গিয়েছিলেন। সেটি কী?
ইংরেজিতে বলে milk of human kindness। দুঃখীর প্রতি দরদ, অপমানিতের প্রতি সহানুভূতি, অত্যাচারীর প্রতি প্রকাণ্ড আক্রোশ (এমনিতে অবধূত রাগের পাশে বাঁধা পড়েন না)– এককথায় পীড়িত, বঞ্চিত, ধূলিলুণ্ঠিত জনের প্রতি ক্ষণে ক্ষণে তার বুক যেন বেদনাভরে, করুণাভারে ভেঙে পড়ে যেতে চায় (যে অবস্থায় পূর্ব বাংলার মেয়ে বলেছিল, ইচ্ছা করে, হৃদয়রে, গামছা দিয়া বান্ধি) কিন্তু থাক্, এটা গুছিয়ে বলবার মতো ভাষা আমার নেই।
এই মিলক্ অব হিউমেন কাইভনেসের পাশ সম্বন্ধে না তিনি সচেতন, না তিনি তপস্যা করেন সেটা ছিন্ন করতে! তবে কি মুক্তপুরুষের হৃদয়ে আমাদের মতো বন্ধুজনের প্রতি করুণাধারা প্রবাহিত হয় না? অবশ্যই হয়। লক্ষগুণ বেশি হয়। কিন্তু তার পূর্বে মুক্ত হওয়ার জন্য এ-পাশও ছিন্ন করতে হয়।
কিন্তু আমি নিরাশ হচ্ছিনে। এই নীলকণ্ঠ হিমালয়েই, এই পথ দিয়ে যাবার সময়ই ক্ষুদ্ৰহৃদয়দৌর্বল্যবশত (Milk of human kindness!) ধর্মপুত্র স্বেচ্ছায়-সঙ্গী সারমেয়টিকে ত্যাগ করতে সম্মত হননি। ধর্মরাজ তৎসত্ত্বেও তার জন্য স্বর্গদ্বার খুলে দেন। সেই ব্যত্যয় কি আবার হতে পারে? নীলকণ্ঠের উপাসক মাত্রই এর উত্তর দিতে ভয় পাবেন। আমি তার উপাসক নই। আমি নিরপেক্ষ তৃতীয়পক্ষ। আমি নির্ভয়ে বলব, এই ক্ষুদ্র হৃদয়-দৌর্বল্য হৃদয়ে ধারণ করেই অবধূত নীলকণ্ঠের হৃদয়ে স্থান পাবেন। কিন্তু খ্রিস্ট সাধুর স্মরণে বলি, মোক্ষ? মোক্ষ নিশ্চয়ই চাই, প্রভু, কিন্তু not just yet! অবধূতের মোক্ষটিও যেন বিলম্বে আসে। কারণ, পূর্বোক্ত খ্রিস্ট সাধু বলেছেন, তখন মুক্ত পুরুষ মৌন হয়ে যান। অবধূত পূর্ণ তিন বছর নীলকণ্ঠে মৌন্বতী ছিলেন আমাদের কোনও ক্ষতি হয়নি, কারণ তার পর তিনি বাংলা সাহিত্য-মজলিশে তাঁর সাধনার ধন সঙ্গীতে পরিবর্তিত করে গান গাইলেন এক যুগ ধরে।