এস্থলে সম্পূর্ণ অবান্তর নয় বলে আরেকটি কথা বলি : উত্তরভারতের তাবৎ সংস্কৃতভাবাপন্ন। ভাষার মধ্যে (হিন্দি, মারাঠি, গুজরাতি ইত্যাদি) বাংলাই সবচেয়ে অসংস্কৃত। হিন্দি, মারাঠি পড়বার বা বলবার সময় সংস্কৃত শব্দ খাঁটি সংস্কৃত উচ্চারণে পড়া এবং বলা হয়–পরীক্ষা পড়া হয় পরীক্ষা, আত্মা পড়া হয়আত্মা–কিন্তু বাংলায় সংস্কৃত শব্দ, এমনকি সংস্কৃত ভাষা উচ্চারণ করার সময়ও উচ্চারণ করা হয় বাংলা পদ্ধতিতে। এ বিষয়ে বাঙালি হিন্দু পর্যন্ত উর্দুভাষী মুসলমানের চেয়ে এককাঠি বাড়া। উর্দুভাষী মুসলমান তার ভাষার সংস্কৃত শব্দ উচ্চারণ করে খাঁটি সংস্কৃত কায়দায়, বাঙালি হিন্দু উচ্চারণ করে অনার্য কায়দায়।
না-হয় স্বীকার করেই নিলুম, বাংলাহের্দুয়ানি ভাষা কিন্তু প্রশ্ন, এই ভাষা এতদিন ধরে ব্যবহার করে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমান কি না-পাক, হির্দু হয়ে গিয়েছে? পাকিস্তান-স্বপ্ন সফল করাতে কি পূর্ব পাকিস্তানের না-পাক মুসলমানদের কোনও কৃতিত্ব নেই? পাকিস্তান-স্বপ্ন কি সফল হল লাহোর, লক্ষৌর কৃপায়? পূর্ব পাকিস্তানে যারা লড়ল তারা কি সবাই উর্দুর পাবন্দ আলিম-ফাজিল, মৌলানা-মৌলবির দল? না তো। লড়ল তো তারাই যারা উর্দু জানে না, এবং বাংলার জন্য আজ যারা পুনরায় লড়তে তৈরি আছে। এইসব লড়নেওয়ালারা এতদিনকার ইংরেজ আধিপত্য এবং হিন্দুপ্রভাবের ফলেও যখন হিন্দুভাবাপন্ন হয়ে যায়নি, তখন পাকিস্তান হওয়ার পর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করলেই তারা রাতারাতি ইসলামি জোশ হারিয়ে পাকিস্তানের শত্রু বনে যাবে? এ তো বড় তাজ্জব কথা! বাংলাভাষার এত তাগদ?
দ্বিতীয় বক্তব্য আমরা ইতিহাস নিয়ে আরম্ভ করি। পূর্বেই বলেছি ফিরদৌসির আমলে ইরানের সর্বত্র আরবি প্রচলিত ছিল– ইরানের রাষ্ট্রভাষা ছিল আরবি। তখনকার দিনে যেটুকু ফরাসি প্রচলিত ছিল সে ছিল কাফির, অগ্নি-উপাসক, জরথুস্ত্রিদের ভাষা। সে ভাষায় একেশ্বরবাদের নামগন্ধ তো ছিলই না, তাতে ছিল দ্বৈতবাদের প্রচার, এককথায় সে ভাষা ছিল ন-সিকে ইসলাম-বিরোধী, কাফিরি। তবু কেন সে ভাষা চর্চা করা হল, এবং সে চর্চা করলেন কারা? কাফিরি জরথুস্ত্রিরা করেনি, করেছিলেন আরবি জাননেওয়ালা মুসলমানেরাই। কেন?
তুর্কিতেও তাই। কেন?
এ দুটো খাঁটি ইসলামি দেশের উদাহরণ; এবার স্বদেশে সেই দৃষ্টান্তই খোঁজা যাক। পাঠান-মোগল যুগে এদেশে ফারসি বহাল তবিয়তে রাষ্ট্রভাষার রাজ-সিংহাসনে বসে দিশি ভাষাগুলোর ওপর রাজত্ব করত। কিন্তু তৎসত্ত্বেও সেই ফারসির সঙ্গে দেশজ হিন্দি মিলিয়ে উর্দুভাষা কেন নির্মাণ করা হল? কিন্তু সেটা আসল প্রশ্ন নয়, আসল প্রশ্ন যে হিন্দিকে নিয়ে উর্দু বানানো হল সে ভাষা কিপাক ছিল?
আমরা জানি সে ভাষায় তখন তুলসীদাসের রামায়ণ সর্বশ্রেষ্ঠ পুস্তক– এখনও তাই। সেই পুস্তকের আওতায় সমস্ত হিন্দিসাহিত্য গড়ে উঠেছে এবং তাতে আছে ইসলামদ্রোহী কট্টর মতবাদ। বাল্মীকির রামায়ণে যে ব্যক্তি মানুষ, রাজা এবং বীর, তিনি তুলসীর রামায়ণে খুদ ভগবানের আসন তসরুপ করে বসে আছেন। ইসলামে মানুষকে আল্লার আসনে তোলা সবচেয়ে মারাত্মক কুফর।
আজকের বাংলা ভাষা সেদিনকার হিন্দির তুলনায় বহুগুণে পাক। আজ বাংলা সাহিত্যে যে ঈশ্বর গানে-কবিতায় নন্দিত হচ্ছেন তিনি সুফির মরমের আল্লাহ, হক। তার সন্ধান গীতাঞ্জলিতে– সে পুস্তক তামাম পৃথিবীতে সম্মান লাভ করেছে।
এবার যে দৃষ্টান্ত পেশ করব সেটি সভয়ে এবং ঈষৎ অনিচ্ছায়। দৃষ্টান্তটি কুরানের ভাষা নিয়ে এবং এ জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া করার হক আলিম-ফাজিলদের। কিন্তু শ্রদ্ধেয় গোলাম মোস্তফা সাহেব যখন রসুলুল্লার জীবনী থেকে নজির তুলে পূর্ববঙ্গবাসী মুসলমানকেপাঞ্জাবি প্রভুত্ব বরদাস্ত করতে উপদেশ দিয়েছিলেন, (মক্কা হইতে মোহাজেরগণ যখন দলে দলে মদিনায় পৌঁছিতে লাগিলেন, তখন মদিনার আনসারগণ মক্কাবাসীদিগকে সাদরে গ্রহণ করিতেন, ) আজ তাহারা– পাঞ্জাবিরা আমাদের দুয়ারে অতিথি। আমাদের কি উচিত নয় তাহাদের প্রতি একটু (!) সহানুভূতি দেখানো? (বিস্ময়বোধক চিহ্ন আমার) তখন আমিই-বা এমন কী দোষ করলুম?
আরবি ভাষায় কুরান শরিফ যখন অবতীর্ণ হলেন তখন সে ভাষার কী রূপ ছিল? সে ভাষা কিপাক পবিত্র ছিল, না পৌত্তলিকতার গভীর পঙ্কে নিমজ্জিত ছিল? আমরা জানি লাত, উজ্জা, মনাত প্রভৃতি দেব-দেবীর প্রশস্তিতে সে ভাষা পরিপূর্ণ ছিল এবং একেশ্বরবাদ বা অন্য কোনও সত্যধর্মের (খ্রিস্ট অথবা ইহুদি) কণামাত্র ঐতিহ্য সে ভাষায় ছিল না।
পক্ষান্তরে আরবদেশে বিস্তর ইহুদি ও খ্রিস্টান ছিলেন। হজরতের বহুপূর্বেই হিব্রুভাষা তওরিত, (তোরা এবং ওল্ড টেস্টামেন্ট) বুকে ধরে পবিত্র ভাষারূপে গণ্য হয়েছিল, এবং হিব্রুর উপভাষা আমারমেইকের মাধ্যমে মহাপুরুষ ইসা ইঞ্জিল (এভানজেলিয়াম অথবা বাইবেলেরনিউ টেস্টামেন্ট) প্রচার করেছিলেন। কুরান অবতীর্ণ হবার প্রাক্কালে হিব্রুভাষা একেশ্বরবাদের চূড়ান্তে পৌঁছে গিয়েছে, এবং বাইবেল-ভক্ত মাত্রেই জানেন সেই একেশ্বরবাদ, মৃত্যুর পরের বিচার, এর ফলস্বরূপ স্বর্গ অথবা নরক ইত্যাদি ইসলামের মূল বিশ্বাস (নবুওত ব্যতীত) প্রচারের ফলে হিব্রুভাষা সেমিতি ধর্মজগতে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করেছিল।