মরিয়া হয়ে অন্যতম প্রধান পাদ্রি নিযুক্ত করলেন গুপ্তঘাতক। রাসপুতিন শুধু যে অনায়াসে সঙ্কট অতিক্রম করলেন তাই নয়, এ সুবাদে রাজপ্রাসাদে তাঁর প্রভাব এমনই নিরঙ্কুশ হয়ে গেল যে, স্বয়ং জার পর্যন্ত আর এখন উচ্চবাচ্য করেন না। অবশ্য সমস্ত ইয়োরোপই বিলক্ষণ অবগত ছিল যে, জার অতিশয় দুর্বল চরিত্রের ‘যাকগে, যেতে দাও না’– ধরনের নিবীর্য ‘শাসক’। কার্যত তাঁকে শাসন করেন জারিনা। এবং তাঁর সম্মুখে রাসপুতিনের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করার মতো সাহস তখন কারও ছিল না।
রাসপুতিনকে হত্যা করার চেষ্টা নিষ্ফল হওয়ার পরই তিনি জারিনাকে সর্বজনসমক্ষে গম্ভীর প্যাকম্বরীকণ্ঠে ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেন (বা শাসান), ‘আমার মৃত্যুর এক বৎসরের মধ্যে গোষ্ঠীসুদ্ধ রমানৃষ্ণ পরিবার (অর্থাৎ সপরিবারে তখনকার জার) নিহত হবে।’ নিহত তাঁরা হয়েছিলেন, এবং অতিশয় নিষ্ঠুর পদ্ধতিতেই, কিন্তু সেটা ঠিক এক বৎসরের ভিতরই কি না বলতে পারব না, দু বৎসরও হতে পারে।
কিন্তু জারিনা? তাঁর শোচনীয় অবস্থা তখন দেখে কে? কুসংস্কারাচ্ছন্ন অতিপ্রাকৃতে অন্ধবিশ্বাসী এই মূঢ় রমণীর যত দোষই থাক, একটা কথা অতিশয় সত্য, তিনি তাঁর পুত্রকন্যাকে বুকে চেপে ধরে রেখেছিলেন পাগলিনীপারা। উদয়াস্ত তাঁর আর্ত সশঙ্ক দৃষ্টি, না জানি কোন অজানা অন্ধকার অন্তরাল থেকে কোন অজানা এক নতুন সঙ্কট অকস্মাৎ এসে উপস্থিত হবে, তাঁর কোনও একটি বসকে ছিনিয়ে নেবার জন্য!
অতএব প্রাণপণ প্রহরা দাও রাসপুতিনের চতুর্দিকে। তিনি একমাত্র মুশকিল্-আসান। এই ‘হোলিম্যান’ আততায়ীর হস্তে নিহত হলে সর্বলোকে সর্বনাশ!
কিন্তু বিশ্বসংসারের সকলেই রাসপুতিনের সাবধানবাণী বা শাসানোতে বিশ্বাস করেননি এবং ভয়ও পাননি। বিশেষ করে রাজপ্রাসাদের সর্বোচ্চস্তরের রাজরক্তধারী একাধিক ব্যক্তি। এরা ক্রমাগত জার-জারিনাকে রাসপুতিন সম্বন্ধে সাবধান হতে বলেছেন, এবং ফলে তাঁদের প্রতি বর্ষিত অপমানসূচক কটুবাক্য মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিদিন। রাজপ্রাসাদে এঁরা হচ্ছেন। অপমানিত অথচ রাসপুতিনের ‘শুভাগমনে’র পূর্বে এঁরাই ছিলেন সেখানে প্রধান মন্ত্রণাদাতা। এখন তাদের এমনই অবস্থা যে, বাইরের সমাজে তাঁরা আর মুখ দেখাতে পারেন না। তাঁদের পদমর্যাদা, অভিজাত রক্ত প্রকাশ্য ব্যঙ্গপি থেকে তাঁদের বাঁচিয়ে রেখেছে সত্য, কিন্তু ভেতরে বাইরে, ফুট-অস্ফুট নিত্যদিনের এ অপমান আর কাহাতক সহ্য করা যায়! ওদিকে ‘হোলি রাশা’ যে কোন জাহান্নমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন কে জানে!
অপমানিত সর্বোচ্চ অভিজাতবংশজাত তিনজন বসলেন মন্ত্রণাসভায়।
স্থির হল, ইউসুপফই হত্যা করবেন রাসপুতিনকে। তাই আজও লোকে বলে, ‘তোমার স্ত্রীকে রাসপুতিন ধর্ষণ করেছিল বলেই তো তুমি প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলে, নইলে রাশাতে কি আর অন্য লোক ছিল না?’ ইউসুপফ এটা অস্বীকার করেন। আবার কেউ কেউ বলেন, প্রধানদের আদেশানুযায়ীই তিনি ওই কর্মে লিপ্ত হন, আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় নিজেকে ভলন্টিয়ার করেন যদিও তাঁর স্ত্রী ধর্ষিতা হননি। এ সম্বন্ধে ইউসুপফের আপন জবানি পাঠক বিশ্বাস করতে পারেন, না-ও করতে পারেন; আমি শুধু বগদানফ সাহেবের জবানিটি পেশ করছি। না হয় সেটা ভ্রান্তই হল, তাতেই-বা কী? তদুপরি আমার স্মৃতিশক্তি আমার কলম নিয়ে কী যে খেলছে, জানব কী করে?
এবং আশ্চর্য! হত্যা করবেন আপন বাড়িতেই তাঁকে সসম্মান নিমন্ত্রণ করে! পুলিশকে ভয় করতেন এঁরা থোড়াই। কিন্তু জারিনা? তিনি যে শেষ পর্যন্ত হত্যাকারী কে, সে খবরটা প্রায় নিশ্চয়ই জেনে যাবেন, এবং তার ফলাফল কী হতে পারে, না পারে, সে নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল এছাড়া গত্যন্তর নেই–নান্য পন্থা বিদ্যতে।
ইউসুপফ-পক্ষ যে রাসপুতিনের শত্রু, তিনি এটা জেনেশুনেও ইউসুপফের বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে এলেন কেন? কেউ বলে, ইউসুপফের সুন্দরী স্ত্রী ইরেনে তাকে ‘বিশেষ’ প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলেন, কেউ বলে, রাসপুতিন সত্যই আশা করেছিলেন, মুখোমুখি আলাপ আলোচনার ফলে হয়তো প্রাসাদের এই শত্রুপক্ষের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপিত হতে পারে, কেউ বলে রাসপুতিন প্রাসাদ জয় করেছিলেন বটে কিন্তু ইউসুপফের মতো অভিজাতবংশের কেউ কখনও তাকে নিমন্ত্রণ করা দূরে থাক, বাড়িতে পর্যন্ত ঢুকতে দিতেন না। ইউসুপফ-জয় অর্থই প্ৰেত্রোগ্রাদ-অভিজাতকুল জয়। তার অর্থ, নতুন শিষ্য, নতুন… একটা সম্পূর্ণ নতুন ভাণ্ডার।
প্রায় সবাই বলেছেন, মদে দেওয়া হয়েছিল প্রচুর পটাসিয়াম সায়েনাইড, কিন্তু অধ্যাপক বলেছিলেন, মধুভরা বিরাট কেকের সঙ্গে মিশিয়ে। আমার মনে হয় দ্বিতীয় পন্থাতেই আততায়ীর ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম। মহামান্য অতিথি রাসপুতিনকে অবশ্যই দিতে হত বংশানুক্রমে সযত্নে রক্ষিত অত্যুকৃষ্ট খানদানি মদ্য; এবং ভদ্রতা রক্ষার জন্য অতিথি সেবককেও নিতে হত সেই বোতল থেকেই। এইটেই সাধারণ রীতি। পার্টিতে সবাই তো আর কে কিন্তু খায় না– তা-ও আবার তিন-ডবল মধুভর্তি স্পেশাল রাসপুতিন কে’ তদুপরি বিরাট কেকের দু আধা দুই পদ্ধতিতে নির্মাণ করে জোড়া দেওয়া অতি সহজ।