যে করেই হোক সে স্বাধীনতা য়ুনিভার্সিটি-টাউনগুলোর (অর্থাৎ যে শহরগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ই সর্বপ্রধান সর্বজনমান্য প্রতিষ্ঠান) রাস্তাঘাটেও সক্রিয় হয়ে উঠল। অর্থাৎ নিতান্ত খুন, ধর্ষণ জাতীয় পাপাচার না করলে স্বয়ং বিশ্ববিদ্যালয়ই ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আপন জেলে (?) পুরে দিত– বিচারের ভার নিতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’ বা আইন, জুরিসপ্রুডেন্সের প্রফেসরগণ ‘ছাত্র আসামি’ এদেরই একজন বা একাধিকজনকে আপন উকিল নিয়োগ করত– এবং সবকুছ ফ্রি-গ্যাটিস-অ্যান্ড-ফর-নাথিং!
সে-সব দিন গেছে। তবু শুনেছি হাইডেলবের্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংবা অন্য কোনও একটা হতে পারে আমার ঠিক মনে নেই– জেলখানাটা নাকি এখনও মিউজিয়ামের মতো বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে এবং সেটি নাকি সত্যই দ্রষ্টব্য বস্তু!
যে পাঠক বাংলা ভাষায় অতুলনীয় (আমার মতে বাংলা ভাষায় ‘অদ্বিতীয়’) পুস্তক, উপেন বাঁড়ুয্যের নির্বাসিতের আত্মকথা’ পড়েছেন, তিনি হয়তো স্মরণে আনতে পারবেন (আমিও স্মৃতির ওপর নির্ভর করে বলছি; তাই ভুলচুক হবে নিশ্চয়ই, এবং তার জন্য মাফ চাইছি) যে, যখন অরবিন্দ-বারীন-উল্লাস-উপেন-কানাই-সত্যেন এট আল-এর বিরুদ্ধে আলীপুরে বোমার মামলা হয় তখন হাজতে থাকাকালীন ছোকরাদের মধ্যে যাদের অদম্য কবিতৃপ্রকাশব্যাধি ছিল তার লেখনীমস্যাধারাভাবৎ কাঠকয়লা দিয়ে দেয়ালে পদ্য লিখত। তারই একটি,
‘ছিড়িতে ছিড়িতে পাট শরীর হইল কাঠ
সোনার বরণ হৈল কালি
প্রহরী যতেক ব্যাটা বুদ্ধিতে তো বোকা-পাঁঠা
দিনরাত দেয় গালাগালি।’
যতদূর মনে পড়ছে, ‘উপীন’বাবু যেন মুচকি হেসে মন্তব্য করছেন, আহা কী ‘সোনার বরণ’ই বঙ্গসন্তানের হয়!
তার পর যা লিখছেন তার সারমর্ম; মাঝে মাঝে দু-একটি ভালো কবিতাও চোখে পড়ত। উদাহরণস্বরূপ দিয়েছেন,
‘রাধার দুটি রাঙা পায়ে
অনন্ত পড়েছে ধরা,
ওঠে ভাসে কত বিশ্ব
চিদানন্দে মাতোয়ারা।’
এবারে তিনি যেন তাঁর চোখে একফোঁটা জল আসতে না আসতে দুঃখ করছেন, হায়, রে মানুষের মন! কারাগারের পাষাণ-প্রাচীরের ভেতরেও রাধার দুটি রাঙা পায়ের জন্য সে আছাড় খায়!(১)
***
জর্মন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন যুগের আপন জেলখানার কথা হচ্ছিল। তার অন্যতম প্রাচীনতমের নিঃসন্দেহ সর্বোকৃষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন মার্ক টুয়েন। সে বর্ণনাটি এমনই সদ-জাতের-বাড়া চৌম্বকীয় আকর্ষণীয় বর্ণনা যে তারই টানে আমারই চেনা এক সহযাত্রী জর্মন-সীমান্তে পৌঁছেই নাক-বরাবর চলে যান ওই জেল দেখতে– সাঁ সুসি প্রাসাদ, ড্রেসডেনে সঞ্চিত রাফায়েলের মাদোন্না নস্যাৎ করে।
আলীপুরের যেসব ‘কবিরা’ প্রহরীকে পাঁঠা নাম দিয়েছিলেন, কিংবা চোখ বন্ধ করে রাখার দুটি রাঙা পায়ের ধ্যানে মজে গেছেন, তাঁরা কিন্তু বিলক্ষণ জানতেন, তাঁদের জন্য মৃত্যু জেলের চতুর্দিকে ঘোরাফেরা করছে–শহিদ হওয়ার সম্ভাবনা কবি, অকবি সকলেই প্রায় সমান। কিন্তু জর্মন-বিশ্ববিদ্যালয়-জেলে ছাত্রেরা যেত অল্প কয়েক দিনের জন্য, ফাঁসির তো কথাই ওঠে না। তাই মার্ক টুয়েনের পক্ষে সম্ভব হয়েছে অপূর্ব হাস্যরসে রঞ্জিত করে সেই জেলটির বর্ণনা দেবার। কাজেই উপস্থিত আলীপুরের কথা ভুলে যান।
***
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাঁসি-কাঠ না থাকতে পারে, ক্যাবারে কাঁ কাঁর ব্যবস্থা না থাকতে পারে, কিন্তু লেখনী-মস্যাধারের অভাব!–এটা কল্পনাতীত। যদিস্যাৎ ওই জর্মনিরই সর্বোৎকৃষ্ট দশ লিটার বিয়ার প্রসাদাৎ কল্পনাটা করেই ফেলি, তখন চোখের সামনে, বিকল্পে, ভেসে উঠবে পেনসিল– একথা তো ভুললে চলবে না, এদেশের কেতাবপত্রে মহামান্য কাইজারের (ভারতীয় কাইসর-ই-হিন্দ পদক, লাতিন সিজার ইত্যাদি) নাম পড়ার বহু পূর্বেই ভারতীয় ছেলেবুড়ো ব্যবহার করেছে, Koh-i-noor, made by L. &C. Hardmuth in Austria, graphite drawing pencil, compressed lead.
তাই সেই পেনসিল অকৃপণ হস্তে ব্যবহৃত হয়েছে ছাত্র, ‘কয়েদি’র দল দ্বারা বংশপরম্পরায়– সাদা দেয়ালের উপর। শুধু কবিতা না, বহুবিধ অন্যান্য চিজ।
কিন্তু তৎপূর্বে তো জানতে হয়, এরা জেলে আসত কোন কোন ‘অপরাধ’ করে। এর অনেকগুলোই আমি স্বচক্ষে দেখেছি, এবং সাতিশয় সন্তোষ সহকারে স্বীকার করছি, সবল সক্রিয় হিস্যেদারও হয়েছি বহু ক্ষেত্রে অর্থাৎ শুপো-স্টুডেন্টেন, পুলিশ, ভর্সস ছাত্র ‘যুদ্ধে’ কিংবা যুদ্ধ আসন্ন দেখে দ্রুততম গতিতে পলায়নে। কিন্তু সেটা অন্য অধ্যায়।
.
০২.
‘পাজিটা এখনও এল না, ব্যাপারটা কী? বলেছিল না, তার কাকা আসছেন ডানৎসিগ থেকে, ওর জন্য নিয়ে আসবে কয়েক বোতল অত্যুকৃষ্ট ডাৎসিগার গোল্ট ভাসার (ডানৎসিগের-স্বর্ণবারি– সোনালি সোমরস), আমরা সবাই হিস্যে পাব।’
‘একটা ফোন করলে হয় না?’
‘হ্যাঁ! সেই আনন্দেই থাক! টেলিফোন! বুড়ির বাড়িতে এখনও দড়ি টেনে ভেতরের ঘণ্টা বাজাতে হয়। ইলেকট্রিক বেল পর্যন্ত নেই। তবে, হ্যাঁ, গার্লফ্রেন্ডদের যখন তখন আপন কামরায় নিয়ে যেতে দেয়। তদুপরি বুড়ি বদ্ধ কালা। শুনেছি, পায়ের উপর গরম ইস্ত্রিটা হঠাৎ হাত থেকে ফসকে পড়ে গিয়েছিল– শুনতে পায়নি।’
রসালাপ হচ্ছিল শনির সন্ধ্যায় ‘পাব’-এ। জনসাতেক মেম্বর জমায়েত হয়ে একটা গোল টেবিল ঘিরে বিয়ার পান করছেন। সেটার উপর কোনও টেবিল-ক্লথ নেই। আছে গত একশ বছরের স্টুডেন্ট খদ্দেরদের নাম, যারা প্রতি শনিবার এই টেবিলটা ঘিরে গুলতানি করেছে– ছুরি দিয়ে খোদাই করা। আমাদের পলের বাপ ভি হেমের নামও এই টেবিলে আছে। সমস্ত টেবিলটা নামে নামে সম্পূর্ণ ভর্তি হয়ে গিয়েছে– আর নতুন নাম খোদাই করার উপায় নেই।