Site icon BnBoi.Com

দু-হারা – সৈয়দ মুজতবা আলী

দু-হারা – সৈয়দ মুজতবা আলী

অদৃষ্টের রঙ্গরস

আওরঙ্গজেব মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাবৎ ভারতবর্ষে লেগে গেল ধুন্ধুমার। বাদশাহ হবেন কে?

এস্থলে স্মরণ করিয়ে দিই যে, আর্য এবং একাধিক আর্যেতর জাতির মধ্যে প্রথা– রাজার মৃত্যু হলে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র বিনা বাধায় সিংহাসনে বসেন। কিন্তু তুর্কমানিস্তানের মোগলদের ভিতর এরকম কোনও ঐতিহ্য ছিল না। তাদের ছিল জোর যার মুলুক তার। আরবদের ভিতর গোড়ার দিকে এই একই প্রবাদ অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট (খলিফা) নিযুক্ত হতেন, তবে জোরের বদলে সেখানে ছিল চরিত্রের, শৌর্যবীর্যের, জ্ঞান-বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব। তাই বলা হত, সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হবেন খলিফা হন-না তিনি হাবশি (নিগ্রো)। এবং সেটাও ঠিক করা হত গণভোট দিয়ে।

তাই মোগল রাজা মারা যাওয়া মাত্রই, কিংবা তিনি অথর্ব অসমর্থ হয়ে পড়লেই লেগে যেত রাজপুত্রদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ। কোনও কোনও সময় রাজার নাতিরাও এবং অন্য বাজে লোকও এই লড়াইয়ের লটারিতে নেবে যেতেন। অবশ্য রাজরক্ত না থাকলে তার সম্রাট হবার সম্ভাবনা থাকত না। পাঠকের স্মরণ থাকতে পারে, ফররুখসিয়ারের রাজত্বের শেষের দিক থেকে মুহম্মদ শাহ বাদশা রঙিলার সিংহাসনারোহণ পর্যন্ত সিন্ধু দেশের সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় দিল্লিতে সিংহাসনের সব ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিলেন। রাজার পর রাজাকে তাঁদের হাতে পুতুলের মতো নাচতে হয়েছে। কিন্তু খ্যাতি, শক্তি, অর্থবলের মধ্যাহ্নগগনে থাকাকালীনও তাঁদের কারও তখৃৎ-ই-তাউসে বসবার দুঃসাহস হয়নি। সৈয়দ পয়গম্বরের বংশধর– তিনি সম্মান পাবেন। মসজিদে, মক্তবে, মাদ্রাসায়– রাজসভায় কবিরূপে, ঐতিহাসিকরূপে সমাজে গুরুরূপে, কিন্তু মোগল রাজবংশের রক্ত তাঁদের ধমনীতে ছিল না বলে দিল্লির হিন্দু-মুসলমান তাঁদের বাদশাহ-সালামতরূপে কিছুতেই এঁদের স্বীকার করত না। ঠিক ওই একই কারণে মারাঠা ও ইংরেজ দিল্লির সিংহাসনে বসতে চায়নি। সিপাহি বিদ্রোহ চূর্ণবিচূর্ণ না করা পর্যন্ত ইংরেজ স্বয়ং মহারানি ভিক্টোরিয়াকে ভারতের অধীশ্বরী বলে ঘোষণা করার সাহস পায়নি। এবং সেটাও করেছিল অতিশয় সভয়ে।

রাজা ও সার্বভৌম আমিরের মৃত্যুর পর যুবরাজদের ভিতর ভ্রাতৃযুদ্ধের মারফতে কে সবচেয়ে শক্তিশালী সেটা বের করা তুর্কমানিস্তানের ছোট ছোট প্রদেশে প্রবল বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে না। কিন্তু ভারতের (এবং অনেক সময় কাবুল কান্দাহার গজনির ওপরও দিল্লির আধিপত্য থাকত) মতো বিরাট দেশে এ প্রকারের যুদ্ধ বিকট অরাজকতা ও দীর্ঘকালব্যাপী অশান্তির সৃষ্টি করত। লোকক্ষয়, অর্থক্ষয় তো হতই,–অনেক সময় একই ভূখণ্ডের উপর ক্রমাগত অভিযান ও পাল্টা অভিযান হওয়ার ফলে সেখানে চাষবাস হত না, ফলে পরের বৎসর দুর্ভিক্ষ হত। সাধারণজনের বাড়িঘরদোর তো নষ্ট হতই, কলাসৃষ্টির উত্তম উত্তম নিদর্শনও লোপ পেত। এইসব যুদ্ধবিগ্রহের ফলেই ইউরোপের তুলনায় এদেশে বেঁচে আছে অতি অল্প রাজপ্রাসাদ। কোনও কোনও স্থলে পলায়মান সৈন্য পথপ্রান্তের প্রতিটি ইদারাতে বিষ ফেলে যেত। ফলে বৎসরের পর বত্সর ধরে পার্শ্ববর্তী জনপদবাসীর একমাত্র জলের সন্ধান অব্যবহার্য হয়ে থাকত।

এই দলাদলি মারামারি থেকে, কি দিল্লি-আগ্রার মতো বৃহৎ নগর, কি সুদূর সুবের (প্রভিন) ছোট শহর, আমির-ওমরাহ, সিপাহসালার, ফৌজদার প্রায় কেউ নিষ্কৃতি পেতেন না। কারণ এঁদের প্রায় প্রত্যেকেই আহ্বান, আদেশ, অনুনয়-ভরা চিঠি পেতেন প্রত্যেক যুযুধান, রাজপুত্রের কাছ থেকে আমাকে অর্থবল সৈন্যবলসহ এসে সাহায্য কর। তখন প্রত্যেক আমিরের সামনে জীবনমরণ সমস্যা দাঁড়াত আখেরে জিতবে কোন ঘোড়াটা, ব্যাক্ করি কোনটাকে? অতিশয় বিচক্ষণ কূটনৈতিকরাও রং হর্স ব্যা করে আপন, এবং কোনও কোনও স্থলে সপরিবার, প্রাণ দিয়ে ভুলের খেসারতি দিয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিরপেক্ষ থাকবার উপায় ছিল না। মোগল রাজপুত্র মাত্রই ইংরেজি প্রবাদটাতে বিশ্বাস করতেন, ওয়ান হু ইজ নট উইদ্ মি ইজ এগেস্ট মি, যে আমার সঙ্গে নয়, সে আমার বিপক্ষে।

নির্ঝঞ্ঝাটে প্রতিষ্ঠিত বাদশাদের তো কথাই নেই, অতিশয় টলটলায়মান সিংহাসনে বসে দুদিনের রাজাও সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দিতেন সেপাই-শান্ত্রি, ফাঁসুড়ের দল– তাঁর নিকটতম আত্মীয়দের উভয় চক্ষু অন্ধ করে দেবার জন্য যেন তারা চিরতরে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে সিংহাসন লাভের জন্য যুদ্ধ ঘোষণা না করতে পারে। শান্তিকামী, ধর্মাচরণে আজীবন নিযুক্ত, সিংহাসনে আরোহণে সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক জনেরও নিষ্কৃতি ছিল না। নিষ্কৃতি ছিল একমাত্র পন্থায়– আত্মীয়-স্বজন দশ-দেশ ত্যাগ করে মক্কায় গিয়ে আশ্রয় নেওয়া। তবে সেটাও করতে হত আগেভাগে পরিপূর্ণ শান্তির সময়। একবার ধুন্ধুমার লেগে যাওয়া মাত্রই তামাম দেশে এসে যেত এমনই অশান্তি, লুটতরাজ যে তখন আর বন্দরে গিয়ে জাহাজ ধরার উপায় থাকত না। এমনকি পরিপূর্ণ শান্তির সময়ও আগেভাগে শেষরক্ষা বাবদে কসম খাওয়া যেত না– মক্কাতে নির্বাসিত বাইরাম খান নাকি পথমধ্যে গুজরাতে আকবরের গুপ্তচর দ্বারা নিহত হন।

ইংরেজ ফারসিতে লিখিত ইতিহাসরাজির সবকটাকেই গণ্ডায় আণ্ডা মিলিয়ে নিন্দাবাদ করে বলেছে, এ-সবেতে আছে শুধু লড়াই আর লড়াই। বিবেচনা করি, ওগুলোতে যদি গণ্ডায় গণ্ডায় শান্তিকামী পীর-দরবেশ ঘুরে বেড়াতেন, কিংবা তার চেয়েও ভালো হত যদি রাজা-প্রজায় সবাই মিলে চাঁদনি চৌকে হাল্লেলুইয়া হৰ্ষরব তুলে ইংরেজের আগমনী গান ধরতেন, তা হলে বোধহয় শ্বেত সমালোচকেরা সন্তুষ্ট হতেন। দুর্ভাগ্যক্রমে মোগলরা যে-ঐতিহ্য সঙ্গে এনেছিল সেটা তার বিকৃততমরূপে দেখা দিল তাদের পতনের সময়। ফলে স্বার্থে স্বার্থে যে সংঘাত উপস্থিত হল তার সমাধান যুদ্ধ ভিন্ন অন্য কোনও পন্থায় সম্ভব ছিল না। ঐতিহাসিকরা সেসব যুদ্ধের বর্ণনা না দিয়ে দি নেশন অব শপলিফটারসের জন্য সেই সঙ্কর্মের টেকনিক্ বয়ান করলে সত্যের অপলাপ হত।

কিন্তু এসব ইতিহাস শুধু যুদ্ধে যুদ্ধে ভর্তি ছিল একথা বললে আরেকটা খুব বড় সত্য গোপন করা হয়। এদের প্রচুর সাহিত্যিক মূল্যও যে ছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

তার পূর্বেই একটি সত্য স্বীকার করে নিই। বিদেশাগত কিছু লোক ভিন্ন এদেশের কারওরই মাতৃভাষা ফারসি ছিল না। এবং মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষাতে শত ভেল্কিবাজি দেখাতে পারলেও সেখানে সত্যকার সাহিত্য সৃষ্টি করা যায় না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ তত্ত্বও অনস্বীকার্য যে, সাহিত্য যে উপাদানে নির্মিত হয় তার অভাব ভারতবর্ষে রচিত ফারসি ইতিহাসে কখনও ঘটেনি। তুলনা দিয়ে বলা যায়, রামায়ণের কাহিনী যত কাঁচা ভাষাতেই রচা হোক না কেন, তার চিত্তাকর্ষণী শক্তি কিছু না কিছু থাকবেই।

তাই ফারসি ভাষায় রচনাকারী ঐতিহাসিকরা হামেশাই কোনও বাদশার রাজত্বকালের তাবৎ লড়াই, বাদশার প্রসন্ন দৃষ্টি লাভের জন্য আমিরদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, কূটনৈতিক চতুরঙ্গ ক্রীড়ার মারপ্যাঁচ ইত্যাদি বর্ণনা করার পর পঞ্চমুখ হতেন বাদশার বিবাহের সালঙ্কার বর্ণনা দিতে; সেই উপলক্ষে সম্মিলিত কবিকুলের বর্ণনা দিতে, এবং সর্বশেষে বাদশার ব্যক্তিগত গুণাগুণের উল্লেখ করতে। সবসময় যে তারা নিরপেক্ষতা রক্ষা করতে সমর্থ হতেন তা নয়, কিন্তু বাদশা সজ্জন হলে তাঁর গুণ বর্ণনায় পঞ্চমুখ হতে কোনও অসুবিধাই উপস্থিত হত না।

যেমন গুজরাতের এক বাদশা ছিলেন অত্যন্ত আচারনিষ্ঠ, পুণ্যশীল। তাঁর জীবিতাবস্থায়ই গুণমুগ্ধ প্রজাসাধারণ তাঁর নাম দেন অল-হালি পুণ্যশীল। মিরাৎ-ই সিকন্দরি গুজরাতের প্রখ্যাত ইতিহাস। তার লেখক অল-হালিমের সময়কালীন যুদ্ধবিগ্রহের বর্ণনা দেবার পর পরমানন্দে হুজুর বাদশার সর্বপ্রকারের পুণ্যশীল খামখেয়ালির বর্ণন-পর্বে প্রবেশ করেছেন। কে বলবে তখন আমাদের এই ঐতিহাসিক শুধু যুদ্ধবিগ্রহের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েই উল্লাস বোধ করেন। বস্তুত এই অনুচ্ছেদে প্রবেশ করার পর মনে হয় তাঁর যেন আর কোনও তাড়া নেই, মাথুরে পৌঁছনোর পর কীর্তনিয়ার যে অবস্থা হয়। এ ইতিহাস তাকে যে একদিন শেষ করে তামাম্ শুদৃ লিখতে হবে সে ভাবনা তার চৈতন্য থেকে যেন সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছে।

হুজুর অল-হালিমকে এক বিদেশাগত পাঁচক এক নতুন ধরনের পোলাও খাওয়ালে পর হুজুর পরম পরিতৃপ্তি প্রকাশ করে বললেন, উজির! আমার প্রজারা কি কখনও-সখনও এ রকমের পোলাও খায়? উজির স্মিতহাস্য করে বললেন, হুজুর, তা কখনও হয়! হুজুর বললেন, একা একা খেয়ে আমি কেমন যেন সুখ পাচ্ছিনে। হুকুম দিলেন, মহল্লা মহল্লায় বিরাট বিরাট পাত্রে করে যেন হুবহু ওইরকমের পোলাও তৈরি করে তাবৎ আহমদাবাদবাসীদের খাওয়ানো হয়। আমাদের ঐতিহাসিকটি যেন ঈষৎ আমোদ উপভোগ করে ইঙ্গিত করেছেন, প্রধানমন্ত্রী হুজুরের এসব খামখেয়ালির অপব্যয় দেখে ভারি বিরক্ত হতেন।

তা সে যা-ই হোক-তাবৎ আহমদাবাদবাসী সেদিন কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে দিনভর ফিস্টি খেল। যে সাবরমতীর পারে বসে বহু যুগ পরে রবীন্দ্রনাথ ক্ষুধিত পাষাণ রচেছিলেন সেই সাবরমতীর পারে সেদিন আর কেউ ক্ষুধিত রইল না।

ঠিক ওইরকমই দিল্লির শেষ মোগলদের কোনও এক বাদশার বিয়ের শোভাযাত্রায় উঁচু হাতির পিঠ থেকে রুপো দিয়ে বানানো ফুল রাস্তার দু পাশের দর্শকদের উপর মুঠো মুঠো ছড়ানো হয়। ঐতিহাসিক খাফি খান–কিংবা খুশ হা-চন্দ বা অন্য কেউ হতে পারেন, আমার মনে নেই- যখন তার ইতিহাস লিখলেন তখন দিল্লির বড় দুঃখের দিন। সেই আঁকজমক শান-শওকতের স্মরণে যেন উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছেন, এ অধমও সেই দর্শকদের মধ্যে ছিল। সে-ও তার কুর্তার দাম (অগ্রভাগ, অঞ্চল) দু হাত দিয়ে প্রসারিত করে উদ্গ্রীব আকাক্ষায় প্রতীক্ষা করল। এ অধমের কী সৌভাগ্য, কী খুশ-কিস্মাৎ! আম্বো তিনটে ছোট ছোট ফুল পেয়ে গেলুম। জয় হোক দিল্লিশ্বরের! জগদীশ্বর তাকে দীর্ঘজীবী করুন!

এ যুগের ইতিহাস বিষাদময়, কিন্তু ঘটনাবহুল বলে একাধিক ফারসিজ্ঞ হিন্দুও তার সুদীর্ঘ বিবরণ লিখে গিয়েছেন। তার একটি ঘটনার বর্ণনা দেবার জন্য বক্ষ্যমাণ লেখন। কিন্তু তৎপূর্বে এক লহমার তরে আহমদাবাদ ফিরে যাই।

মিরাৎ-ই সিকন্দরি ইতিহাস বলে, অল্-হালিম্ আহমদাবাদের দুর্দান্ত শীতে লক্ষ করলেন, গৃহহীনদের দুরবস্থা। আদেশ দিলেন যে, প্রতি চৌরাস্তায় যেন সন্ধ্যার পর কাঠ পুড়িয়ে আগুন জ্বালানো হয়। বহু গৃহহীন এমনকি গৃহস্থও সেই আগুন ঘিরে বসে আগুন পোহাতে পোহাতে গাল-গল্প, গান-বাজনা করে রাত কাটাত। এতেও সন্তুষ্ট না হয়ে অল্-হালিম্ বৃহৎ আবাস নির্মাণ করে দিলেন– ভিখিরি-গরিবদের বসবাসের জন্য। ঐতিহাসিকরা বলতে পারবেন, এ ধরনের পুয়োর হোম পৃথিবীর এই সর্বপ্রথম কি না।

শীতে যাতে তারা কষ্ট না পায় তার জন্য লেপের ব্যবস্থাও হল। মিরাৎ-ই-সিকন্দরির লেখক বলছেন, কিন্তু এসব লক্ষ্মীছাড়া ভ্যাগাবন্ডদের কেউ কেউ আপন আপন লেপ বিক্রি করে দিয়ে মদ খেত। খবরটা কী করে জানি হুজুরের কানে গিয়ে পৌঁছল। আমার মনে সন্দেহ হয়, হয়তো-বা আমাদের সেই সিনিক প্রধানমন্ত্রী উজির-ই-আজম্ সাহেবই মজা চেখে চেখে বাঁকা নয়নে তাকিয়ে হুজুরের অপব্যয়ের চরম পরিণামটি হুজুরেরই খেদমতে পেশ করেন!

তিনি নিজে করে থাকলে সেটা বুমেরাঙের মতো তারই কাছে ফিরে আসে। হুজুর বললেন, এটা কী করে ঠেকানো যায়, বল তো উজির। উজির অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে ভাবখানা করলেন, স্বাধীন সম্রান্ত আসমুদ্র রাজস্থানব্যাপী গুর্জরভূমির মহামান্য সম্রাটের অতিমান্য প্রধানমন্ত্রী নেপাতা নিয়ে মাথা ঘামাতে পারেন না! হুজুর কিন্তু উজিরের অতশত সূক্ষ্মানুভূতির পশ্চাদ্ধাবন করেন না। বললেন, রাতটা ভেবে দেখ। উজির-ই আলা যেভাবে কুর্নিশ করে বিদায় নিলেন তাতে মনে হল না যে, তিনি ত্রিযামা-যামিনী অনিদ্রায় যাপন করবেন।

পরদিন ফজরের নামাজের পরই, অর্থাৎ ব্রাহ্ম-মুহূর্তেই প্রধানমন্ত্রীর তলব পড়ল। হুজুর সহাস্য আস্যে তাঁকে বললেন, বুঝলে হে উজির সাহেব, আমিই কাল রাত্রে চিন্তা করে দাওয়াইটা বের করেছি। প্রত্যেককে আলাদা লেপ না দিয়ে চার-চারজনকে এক-একটা করে বড় লেপ দাও। চারজনই তো আর মদের গোলাম হবে না যে একজোট হয়ে লেপ বিক্রি করে দেবে। যারা খায় না তারা ঠেকাবে।

এ ধরনের চুটকিতে মিরাৎ-ই-সিকন্দরি ভর্তি। তাছাড়া দীর্ঘতর কাহিনীও এ কেতাবে আছে। এমনকি বিশাল বিরাট বীরপুরুষ মুহম্মদ বেগড়ার (এর গোঁফ নাকি এতই দীর্ঘ ছিল যে তিনি তার দুই প্রান্ত মাথা ঘুরিয়ে পিছনে এনে ঘাড়ের উপরে গিঠ বেঁধে রাখতেন!) যৌনজীবনও তিনি নির্বিকারচিত্তে সালঙ্কার বর্ণনা করেছেন। কিন্তু প্রাদেশিক ইতিহাস বলে, এ কেতাব তার ন্যায্য মূল্য পায়নি।

শেষ মোগলদের ইতিহাসে একটি অতিশয় হতভাগ্যের জীবন ও একটি ঈষৎ হাস্যরস-মিশ্রিত ঘটনা– এই দুই আমার মনে আসে। পুজোর বাজারে অন্য পত্রিকায় একটা করুণ রস লিখে আমার রেশন খতম। দ্বিতীয়টাই শুনুন।

পূর্বেই নিবেদন করেছি মোগলসম্রাট মাত্রেরই মৃত্যু হলে রাজপুত্রদের ভিতর লাগত যুদ্ধ। আওরেঙ্গজেবের মৃত্যুর পরও তার ব্যতিক্রম হল না। লড়াই জিতে বাদশাহ হলেন শাহ আলম বাহাদুর শাহ। পাঁচ বৎসর রাজত্বের পর তাঁর মৃত্যু হলে পুত্র জাহান্দার শাহ তখতে বসলেন। মোগল বংশের ওপর আর কেউ এর মতো কলঙ্ক-কালিমা লেপন করেননি। একটি মাত্র উদাহরণ দিচ্ছি। একটি বাইজি– লালকুনওরকে তিনি দিয়েছিলেন বেগমের সম্মান ও তাঁকে নিয়ে বেরোতেন দিল্লির প্রকাশ্য রাস্তায় মদ্যপান করতে।* তখনকার দিনে আজকের পানওলার দোকানের মতো মদের দোকান থাকত– অর্থাৎ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চো করে একপাত্র মদ্যপান করে ফের অন্য দোকানে আরেক পাত্র করে করে বাড়ি পৌঁছানো যেত। কিংবা রাস্তায় গড়াগড়ি দেওয়া যেত। হুজুর বাদশাহ সালামত সেই বাইজি লালকুনওরের পাশে দাঁড়িয়ে এইসব অতি সাধারণ শ্রেণির দোকান ও তাদের খদ্দেরের সঙ্গে ঢলাঢলি করতে করতে পাত্রের পর পাত্র গলায় ঢালতেন এবং লালকুনওরের তো কথাই নেই। তিনি একদা যে হাফ-গেরস্থ অঞ্চলে (ফরাসিতে হুবহু একেই বলে দেমি-দ, এদের স্ত্রীলোক বাসিন্দা দেমিমঁদেন) তাঁর ব্যবসা চালাতেন, সেখানকার লোফাররা এসে সেখানে জুটত। বাদশাহ সালামত দরাজ দিলে ঢালাই পাইকিরি হিসেবে মদ্য বিতরণ করতেন। তখনকার দিনে দিল্লির বাদশারা বয়েলের গাড়ি চড়ে বেড়াতে ভালোবাসতেন। তার ড্রাইভারও সেই সর্বজনীন গণতান্ত্রিক পানোৎসবে অপাঙক্তেয় হয়ে রইত না। রাস্তায় ভিড় জমে যেত। আমির-ওমরাহ হঠাৎ এসে পড়লে পাল্কি ঘুরিয়ে নিতেন; পদাতিক ভদ্রজন এই বেলেল্লাপনার মাঝখানে পড়ে ব্ৰিত না হওয়ার জন্য গুত্তা মেরে ডাইনে-বাঁয়ের কোনও দোকানে আশ্রয় নিতেন।

[*এ যুগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পূর্বে হিটলারের প্রধান সেনাপতি ব্লমবের্ক বৃদ্ধ বয়সে ভালো করে অনুসন্ধান না করে তাঁর স্টেনোকে বিয়ে করে ফেলেন। অথচ ইনি একদা একাধিক শহরে দেমি-দেন ছিলেন। বিয়ের রাত্রে পৃথিবীর এই সর্বপ্রাচীন ব্যবসায়ের মেয়েরা তাদের পাড়ায়। পাড়ায় বিয়েটা সেলেব্রেট করে– যেন তারা সমাজে কল্কে পেয়ে গেল এবং শুধু তাই না, যেসব পুলিশ তাদের ওপর চোটপাট করত তাদের ফোন করে তাদের হেলথ ড্রিঙ্ক করে। পরে হিমলার দলিল-দস্তাবেজসহ হিটলারের কাছে কেলেঙ্কারিটা ফাস করলে পরে তিনি ব্লবের্ককে রিটায়ার করতে আদেশ দেন।]

মুসলমান শাস্ত্রে মদ্যপান নিষিদ্ধ। অবশ্য দেশবাসী জানত যে রাজা-বাদশারা এ আইনটি এড়িয়ে যান, কিন্তু তারাও চক্ষুলজ্জার খাতিরে খোলাখুলিভাবে সচরাচর মদ্যপান করতেন না। এ যুগে রাজা ফারুক প্রায় জাহান্দার শার মতো আচরণ করে কাইরোর জনসাধারণের আক্কেল গুডুম করে দেন। রোজার মাসে আবার বলছি উপবাসের মাসে তিনি তাঁর নিত্যপরিবর্তিত দেমি-দেন নিয়ে প্রশস্ত দিবালোকে এক বার থেকে আরেক বারে ঘুরে বেড়াতেন মাতা এবং প্রাসাদের অন্যান্য মুরুব্বিদের সর্ব সদুপদেশ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে। এরই পরিত্যক্তা এক দেমি-দেন প্রেয়সী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, এই মহাপুরুষটি গুরুভোজন বা অত্যধিক পানের ফলে গতাসু হবেন। বন্ন ভক্ষণ করে রাজ্যচ্যুত অবস্থায় ইনি অধুনা রোম শহর থেকে সাধনোচিত ধামে গেছেন– ঝিনুকের ভিতরকার বস্তু মাত্রাধিক খাওয়ার ফলে।

তা যা-ই হোক, জাহান্দার শাহ একদিন ইত্যাকার রোদ মারতে মারতে বেএক্তেয়ার হয়ে যান না হওয়াটাই ছিল ব্যত্যয়– এবং আধামাতাল গাড়োয়ান হুজুর ও লালকুনওরকে কোনও গতিকে গাড়িতে তুলে পাশাপাশি শুইয়ে দিয়ে লালকেল্লা পানে গাড়ি চালায়। বয়েল দুটো সর্বশ্রেষ্ঠ জাতের। পথ চিনে সোজা কেল্লার ভিতরে প্রাসাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। লালকুনওর টলতে টলতে প্রাসাদে ঢুকলেন। বয়েল দুটো চলল– আপন মনে বয়েলখানার দিকে, কারণ গাড়োয়ান সম্পূর্ণ বেহুশ।

ঘণ্টাখানেক পরে পড়ল খোঁজ খোঁজ রব। বাদশা কোথায়, বাদশা কোথায়? এ যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। খবরটা যদি রটে যায় তবে বাদশার যে কোনও ভাই, চাচা, ভাতিজা নিজেকে রাজা বলে অবশ্যই ঘোষণা করবেন এবং তা হলেই তো চিত্তির। বিরাট লালকেল্লা তন্ন তন্ন করে খোজা হল, কিন্তু হুজুর যেন মহাশূন্যে অন্তর্ধান করেছেন।

তখন এক সুবুদ্ধিমানের মাথায় অলৌকিক অনুপ্রেরণা এল। এক মাইল দূরের বয়েলখানাতে অনুসন্ধান করে দেখা গেল, হজুর অঘোর নিদ্রায়, গাড়োয়ানও তদ্বৎ।

বলা বাহুল্য, পথচারী মদ্যপায়ী মহলে হুজুর অতিশয় জনপ্রিয় হলেও আমির ওমরাহ মায় প্রধানমন্ত্রী, যদিও তিনি জানতেন; জাহান্দার শাহ তখৎ-হীন হলে তাঁরও নবীন রাজার হাতে জীবন সংশয়– সকলেই তার ওপর বিরূপ হয়ে উঠেছিলেন।

ওদিকে দুই প্রধান আমির সিন্ধু দেশের সৈয়দ আব্দুল্লা ও সৈয়দ হুসেন আলি ব্যাক করছেন অন্য ঘোড়া– জাহান্দার শাহ্-এর ভ্রাতা আজীম্ উশ-শান-এর পুত্র সুদর্শন, সুপুরুষ–বলা হয় তৈমুরের বংশে এরকম বলবান সুপুরুষ আর জন্মাননি- ফররুখসিয়ারকে। তারা দিল্লির দিকে রওনা হয়েছেন সিংহাসন অধিকার করতে। যুদ্ধে জাহান্দার পরাজিত হয়ে বন্দি হলেন। সিংহাসন হারিয়ে তিনি যত না শোক প্রকাশ করেছিলেন তার চেয়ে বেশি মর্মবেদনা প্রকাশ করলেন, বার বার বেদনাতুর, মিনতিভরা আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে, আমার লালকুনওকে আমার কাছে আসতে দাও, দয়া করে লালকুনওরকে আসতে দাও। সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় তখনই তাদের স্বরূপ দেখাতে আরম্ভ করেছেন–অর্থাৎ তারা গ্লাডস্টোনের মতো কিংমেকার, তারা রাজা ম্যানুফেকচার করেন– লাকুনওর অনুমতি পেলেন জাহান্দার-এর বন্দি জীবনের সাথী হওয়ার।

অধম শুধু পটভূমিটি নির্মাণ করছে; নইলে জাহান্দার শাহ বা ফররুখসিয়ার কেউই আমার লক্ষ্য প্রাণী নন। তবু ফররুখসিয়ার সম্বন্ধে যৎসামান্য বলতে হয়। ইনি বুদ্ধি ধরতেন কম, এবং যে কূটনীতিতে ছিলেন সম্পূর্ণ অজ্ঞ সেইটে প্রয়োগ করতে চাইতেন দুই ধুরন্ধর পকৃসিদ্ধ, অস্বাভাবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষী সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের বিরুদ্ধে। তাঁদের একজন প্রধানমন্ত্রীর ও অন্যজন প্রধান সেনাপতির পদ গ্রহণ করে বাদশা সালামতকে প্রায় উপেক্ষা করে রাজত্ব চালনা করতে লাগলেন। নানাপ্রকার মেহেরবানি বণ্টন করে দুই ভাই শক্তিশালী আমির-ওমরাহ গোষ্ঠী নির্মাণ করলেন এবং প্রত্যক্ষত সন্দেহ রইল না যে সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় স্বাধিকারপ্রমত্ত হয়ে যা-ই করুন না কেন, শাহি ফৌজ তাঁদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে না। বেচারা বাদশাহ ক্রমেই ক্ষমতা হারাতে লাগলেন এবং শেষটায় চেষ্টা দিলেন, যেসব ভাগ্যান্বেষী অ্যাডভেনচারাররা ইরান-তুরান থেকে দিল্লি আসত তাদের নিয়ে একটা দল সৃষ্টি করতে।

একদা এদের মধ্যে যারা সত্যকার কৃতবিদ্য কিংবা রণবিশারদ তারা দিল্লি দরবারে ও জনসাধারণের ভিতর সম্মান পেতেন। কিন্তু পাঁচশো বসুর মোগল রাজত্ব চলার পর দিল্লির খাসবাসিন্দা মুসলমান ও হিন্দুগণ একটা জোরদার স্বদেশী পার্টি তৈরি করে ফেলেছিলেন। সৈয়দ ভাইরা ছিলেন এ দলের নেতা। (দুর্ভাগ্যক্রমে এ যুগের ঐতিহাসিকরা এই স্বদেশী দলের মাহাত্ম্য পরিপূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম করেননি; আর ইংরেজ ঐতিহাসিক অবশ্যই চাইত না যে, এরই অনুকরণে নিত্য নবাগত ইংরেজ ভাগ্যান্বেষীদের বিরুদ্ধে ভারতে একটা স্বদেশী পার্টি গড়ে উঠুক)।

নিরুপায় হয়ে ফররুখসিয়ার তার শ্বশুর যোধপুরের রাজা অজিত সিংকে দিল্লিতে আসবার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়ে দূত পাঠালেন। কারণ তখন তিনি সত্যই বুঝে গিয়েছিলেন। যে সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় তাঁকে আর বেশিদিন বরদাস্ত করবেন না। তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করে অন্য ক্রীড়নককে তখৎ-ই-তাউসে বসাবেন।

অজিত সিং দিল্লি পৌঁছানো মাত্রই সৈয়দরা তাঁকে সংবর্ধনা করতে অগ্রসর হলেন– বাদশা সালামত তখন কার্যত লালকেল্লায় বন্দি। তারা ওই স্বদেশী বিদেশির জিগিরটি উচ্চকণ্ঠে গাইলেন। অজিত সিং-ও বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন, সৈয়দদের সঙ্গে মোকাবেলা করার মতো শক্তি তার নেই। ফররুখসিয়ারকে সিংহাসনচ্যুত করা বাবদে তিনি সম্পূর্ণ সম্মতি স্পষ্ট ভাষায় দিয়েছিলেন কি না বলা কঠিন।

সৈয়দদ্বয় ফররুখসিয়ারকে ধরে আনবার জন্য অন্দরে সৈন্য পাঠালেন। হারেমে রমণীরা উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করে উঠলেন। তুর্কি রমণীদের সাহস যথেষ্ট, নূরজাহান-জাহানারা অতি কৃতিত্বের সঙ্গে তাবৎ ভারত শাসন করেছেন, কিন্তু এঁদের ভিতর কেউ সেরকম ছিলেন না, কিংবা হয়তো দম্ভী ফররুখসিয়ার এঁদের মন্ত্রণায় কর্ণপাত করেননি। অবশ্য তাকে সবলে টেনে আনতে দূতদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। কারণ তাঁর শরীরে ছিল অসাধারণ বল।

সৈয়দদ্বয়ের সামনে তাকে আনা হলে তাঁদের একজন আপন কলম-দান খুলে, চোখে সুরমা (কাজল) লাগাবার শলাকা ঘাতকের হাতে দিলেন। ফররুখসিয়ারকে সবলে চিৎ করে ফেলে অন্ধ করা হল। তবে কোনও কোনও ঐতিহাসিক বলেন, ওই নিষ্ঠুর কর্ম যে করেছিল সে তাঁকে সম্পূর্ণ অন্ধ করেনি সে ভেবেছিল, বলা তো যায় না, হয়তো একদিন তিনি আবার রাজা না হলেও যথেষ্ট শক্তিশালী হবেন, তখন সে মৃত্যুদণ্ড তো এড়াবেই, হয়তোবা বখশিশও পেতে পারে। ফররুকসিয়ারকে নহবতখানায় বন্দি করে রাখা হল। লালকেল্লার আজকের দিনের প্রধান প্রবেশপথ ও দেওয়ান-ই-আম-এর মাঝখানে এটা পড়ে।

ওদিকে কিন্তু দিল্লির অন্য এক মহল্লায় এক ভিন্ন কমেডি শুরু হয়েছে।

সৈয়দদ্বয় অনেক চিন্তা ততোধিক তর্কবিতর্ক আলোচনা করে স্থির করেছেন যে, ফররুখসিয়ারের খুড়ো রফি-উশ-শানের (ইনি আজিম-উশ-শানের পরের ভ্রাতা আওরঙ্গজেবের দৌহিত্র) জ্যেষ্ঠ পুত্র তরুণ মুহম্মদ ইব্রাহিমকে সিংহাসনে বসানো হবে। সেই মর্মে দূত পাঠানো হয়েছে রফি-উশ-শানের হাভেলিতে। সেখানে ইব্রাহিম তাঁর ভাই ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনসহ বাস করেন।

দূতের দল উপস্থিত হওয়ামাত্রই হাভেলিতে উচ্চৈঃস্বরে বামাকণ্ঠের ক্রন্দন রোদন চিৎকার অভিসম্পাত আরম্ভ হল।

কারণটা সরল। কয়েকদিন ধরেই দিল্লি শহর শত রকমের গুজবে ম-ম করছে। ফররুখসিয়ার সিংহাসনচ্যুত হলে হতেও পারেন যদিও অনেকেই প্রাণপণ আশা করছিলেন, অজিত সিং যা-ই করুন, আপন জামাতাকে সিংহাসনচ্যুতি থেকে রক্ষা করবেন নিশ্চয়ই, নইলে তাঁর নিধন অবধারিত ও দিল্লিবাসীদের কাছে যে ব্যক্তি পুত্রকে হত্যা করে তার চেয়েও ঘৃণ্য– যে তার মেয়েকে বিধবা হতে দেয়। কিছুদিন পর ফররুখসিয়ার নিহত হওয়ার পর অজিত সিং রাস্তায় বেরোলেই তার সশস্ত্র পাইক-বরকন্দাজকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা। করে রাস্তার ছোঁড়ারা তাঁর পাল্কির দুই পাশে ছুটতে ছুটতে তারস্বরে ঐক্যতান ধরত, দামাদকুশ, দামাদকুশ জামাতৃহন্তা, জামাতৃহন্তা! পুত্রকে হত্যা করে কেউ এভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন বলে আমার স্মরণে আসছে না।)

ফররুখসিয়ার সিংহাসন হারালে সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের যে কার প্রতি নেক্‌-নজর–অবশ্য যে-ই রাজা হোন তাঁকে হতে হবে ভ্রাতৃদয়ের হস্তে পুত্তলিকা মাত্র– পড়বে তার কিছু স্থিরতা ছিল না। দূতরা তাই যখন হাভেলির সামনে এসে সুসংবাদ দিল, তারা এসেছে সমারোহ। সহকারে নবীন রাজা মুহম্মদ ইব্রাহিমকে তাঁর অভিষেকের জন্য নিয়ে যেতে, তখন সবাই নিঃসন্দেহে ভাবল এটা একটা আস্ত ধাপ্পা। আসলে আর কেউ বাদশা হয়ে দূত পাঠিয়েছেন ইব্রাহিমকে ছলে বলে পকড় করে নিয়ে গিয়ে হয় হত্যা করতে, নিদেন অন্ধ করে দিতে– যাতে করে পরবর্তী প্রতিদ্বন্দীরা সম্পূর্ণ নির্মূল হয়; এ রেওয়াজ তো রাস্তার ভিখিরি পর্যন্ত জানে, জানবে না শুধু রাজবাড়ির হারেমের মহিলারা! তওবা! তওবা!!

বিরাট বাড়ি। বিস্তর কুঠুরি, চিলেকোঠা। তদুপরি এসব কারবার তো দিল্লি শহরে হামে-হাল লেগেই আছে। তাই দু-চারটে গুপ্তঘর, পালিয়ে যাবার সুড়ঙ্গও যে নেই, এ কথাই বা বলবে কে? হারেম-মহিলারা তড়িঘড়ি ইব্রাহিম ও তার ছোট ভাই রফি উদ্-দৌলাকে কোথায় যে লুকিয়ে ফেললেন তার সন্ধান পেতে আদৌ যদি পাওয়া যায়– লাগবে সময়। ওদিকে দূতদের পই পই করে বলা হয়েছে, তারা যাবে আর আসবে, ছররার মতো দ্রুতবেগে, এবং পথমধ্যে যেন তিলার্ধকাল বিলম্ব না করে। কারণটি অতিশয় স্বপ্রকাশ। দিল্লি শহরের দুগ্ধপোষ্য শিশু পর্যন্ত জানে, একবার যদি খবর রটে যায় এবং সেটা কিছুমাত্র অসম্ভব নয়– যে ফররুখসিয়ার সিংহাসনচ্যুত হয়ে গিয়েছেন এবং সে সিংহাসন তখনও শূন্য তা হলে আওরেঙ্গজেব-বংশের যে কোনও রাজপুত্র দুঃসাহসে ভর করে নিজেকে বাদশা বলে ঘোষণা করে দেবে। সৈয়দ-ভায়েরা বিলক্ষণ জানতেন যে, যদিও আমির-ওমরাহ সোওয়ার-সেপাই তাদের পক্ষে, তবু এ তত্ত্বটি ভুললে বিলকুল চলবে না যে, ফররুখসিয়ার ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় সম্রাট। তার পর আরেকটা কথা। আওরেঙ্গজেবের এক বংশধর যদি অন্য বংশধরকে খেদিয়ে দিয়ে সিংহাসন দখল করেন, তবে জনসাধারণ হয়তো কোনও পক্ষই নেবে না। কিন্তু সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় তো কোনও রাজাদেশে, সিংহাসনে হক্কধারী কোনও রাজপুত্রের হুকুমে বাদশাহ ফররুখসিয়ারকে সিংহাসনচ্যুত করেননি। তারা কে? আসলে সিন্ধু প্রদেশের দুই ভাগ্যান্বেষী। একজন ফররুখসিয়ারের প্রধানমন্ত্রী, অন্যজন প্রধান সেনাপতি। অর্থাৎ তার কর্মচারী এবং তাঁরই নুননেমক খেয়েছেন অন্তত দু-টি বছর ধরে। তাই মনিবকে সিংহাসনচ্যুত করে এঁরা যে অপকর্মটি করলেন এটা নেমকহারামির চূড়ান্ত! দিল্লির জনসাধারণ উজবুক নয়। তারা যদি ক্ষেপে যায় তবে সৈন্য-সামন্ত নিয়েও দিল্লিকে ঠাণ্ডা করা রীতিমতো মুশকিল হবে।

অতএব সৈয়দদের সর্বাপেক্ষা জরুরি প্রয়োজন, তড়িঘড়ি আওরেঙ্গজেবের কোনও সন্তানকে সিংহাসনে বসিয়ে তার কাছ থেকে ফরমান নিয়ে আইনত এবং ঐতিহ্যগত পন্থায় দিল্লির রাজভক্ত প্রজাগণকে মোকাবেলা করা।

কিন্তু দূতরা গুপ্তঘরের সন্ধান পাবে কী করে? বাচ্চাটিকে কেড়ে নিতে চাইলে বেড়ালটা পর্যন্ত মারমুখো হয়ে ওঠে। এরা আবার তুর্কি রমণী– যুগ যুগ ধরে ইয়া তাগড়া তাগড়া মর্দকে কড়ে আঙুলের চতুর্দিকে ঘুরিয়েছে।

অবশ্যই পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, ফররুখসিয়ায়কে হারেমের ভিতর থেকে ধরে আনা গেল, আর এখন এই চ্যাংড়াটাকে কাবু করা যাচ্ছে না?

ব্যাপারটা সরল। ফররুখসিয়ারের হারেমের তুর্কি রমণীরা যে বাদশার সঙ্গে সঙ্গে সর্ব সম্মান হারিয়ে বসেছেন। এরা বাধা দিলে সেপাইরা তাদের ওপর প্রয়োগ করবে পশুবল। এরা জানে দুদিন বাদেই এইসব নিষ্প্রভ, হতজ্যোতি, লুপ্তসম্মান সুন্দরীদের পাঠিয়ে দেওয়া। হবে সোহাগপুরাতে। আল্লা জানেন কোন কারসিক এই পরিত্যক্তা রমণীদের দীনদরিদ্র নির্লজ্জভাবে অবহেলিত শেষ আশ্রয়স্থলকে সোহাগপুরা নাম দিয়েছিল। এরা সেখানে পাবেন সে গ্রাসাচ্ছাদন। তার বীভৎস বর্ণনা থেকে আমি পাঠককে নিষ্কৃতি দিলুম।… কিন্তু যে ইব্রাহিম এখন রাজা হতে চললেন তাঁর মুরুব্বিদের তো ভিন্ন শিরঃপীড়া।

তাই নতুন রাজাকে আনতে গিয়ে দূতদের প্রাণ যায় যায়। মরিয়া হয়ে তাঁর মা, মাসি, জ্যেঠি, খুড়ি এককথায় তাবৎ রমণীরা আরম্ভ করেছেন দূতের গুষ্টিকে বেধড়ক ঠ্যাঙাতে। হেঁড়া জুতো, খোঁচা-খোঁচা খ্যাংরা-খররা হেন বস্তু নেই যা দিয়ে তাঁরা ওদের পেটাতে কসুর করছেন। বেচারিরা খাচ্ছে বেদরদ মার, দু হাত দিয়ে যতখানি পারে সে মার ঠেকাবার চেষ্টা করছে। একখানা কাঠির ঝাটার সপাং করে মুখের উপর মার– সেটা কোন জঙ্গিলাটের কোন অস্ত্রের চেয়ে কম! বেচারিরা এদের গায়ে হাত তোলা দূরে থাক, ঠেলাটি পর্যন্ত দিতে পারে না। কালই তো এরা লালকেল্লার প্রাসাদে গিয়ে আবাস নেবেন। তখন বেচারিদের হালটা হবে কী? খুদ বাদশা সালামতের পিসিকে মেরেছিল ধাক্কা, খুড়িকে মেরেছিল কনুই দিয়ে গুত্তা— বেয়াদবি বেতমিজি তবে আর কাকে বলে! বন্দ কর ব্যাটাদের পিঞ্জরা সেঁ, ঝুলিয়ে রাখো বদমাইশদের লাহোরি দরওয়াজার উপর! সৈয়দ-ভায়ারা কি তখন আর তাদের স্মরণে আনবেন।

এই একতরফা জেনানা আক্রমণ, তথা গৃহনির্মিত সাতিশয় মারাত্মক অস্ত্র-শস্ত্রের দফে দফে বয়ান প্রত্যেক ঐতিহাসিক দিয়েছেন বড়ই প্রেমসে। এই মারপিটের বর্ণনাতে পৌঁছে এ যুগের ঐতিহাসিকরা ভাবেন, তারা যেন বেহেশতে পৌঁছে গেছেন—নড়বার নামটি পর্যন্ত করেন না।

আর আর্তচিৎকার উঠছে সম্মার্জনী-লাঞ্ছিত হতভাগ্যদের দোহাই আল্লার, কসম আল্লার, পয়গম্বর সাক্ষী, আমরা কোনও কুমতলব নিয়ে আসিনি। আমরা এসেছি হুজুরকে তার ন্যায্য তখৃতের উপর বসাতে। কিন্তু অরণ্যে রোদন আর জনারণ্যে রোদনে ফারাক থাকলে জনসমাবেশকে অরণ্য নাম দেওয়া হল কেন?

ওদিকে দুই কিং-মেকার্স বা রাজা নির্মাণের রাজমিস্ত্রি মহা প্রতাপান্বিত শ্ৰীযুত সৈয়দ আব্দুল্লা ও সৈয়দ হুসেন আলি লালকেল্লার দিওয়ান-ই-আম-এর ভিতর বসে আছেন যেন কাঠ-কয়লার আগুনে আঙ্গিঠার উপর। দূতের পর দূত পাঠিয়ে যাচ্ছেন রফি-উশ-শানের হাভেলিতে, কিন্তু সে যেন সিংহের গুহাতে মানুষ পাঠানো। কেউই আর ফিরে আসে না। যে যায়, সে-ই বঁটা-পেটার দয়ে লীন হয়ে যায়, কিংবা রাস্তা দিয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে অগুরু-চন্দনকাঠের ভাষায় বোঝাতে চেষ্টা করে যে, প্রতিটি মুহূর্ত জীবন-মরণ সমস্যা সঙ্কটময় করে তুলছে। ভিতরে একপাল লোক ছুটেছে গুপ্তঘরের সন্ধানে, তাঁদের পিছনে ছুটেছে জেনানা-রেজিমেন্ট পেটিকোট-পল্টন আসমান-ফাটানো চিল্লি-চিৎকার করতে করতে। সর্বপ্রকারের সংগ্রামনভিজ্ঞ আপনাদের সেবক, এই দীন লেখক, তাদের হাতে যেসব মারণাস্ত্র আছে, তাঁদের রণকৌশল, বৃহনির্মাণাদির আর কী বর্ণনা দেবে? বাবুর্চিখানার খুন্তি সাঁড়াশি থেকে আরম্ভ করে সেই মোগল যুগে কত কী থাকত তার বর্ণনা দেব নিরীহ বাঙালি, আমি! মাশাল্লা!

চতুর্দিকে, আকাশে-বাতাসে সেই অভূতপূর্ব উত্তেজনা, দ্রুতগতিতে ধাবমান বহুবিধ নরনারী, চিৎকার আতাঁরব, আল্লার শপথ, রসুলের নামোচ্চারণ, হজরত আলির অনুকম্পার জন্য করুণ ফরিয়াদ, মহরমের দিনের ইমাম হাসান-হুসেনের ঝাণ্ডা নিয়ে কাড়াকাড়ি যেন, এমন সময়

এমন সময় অতি ধীরে ধীরে একটি বালক বালকই বটে, কারণ সে অজাতশত্রু অজাতগুফ– ওই যে হোথা মুদির দোকান দেখা যাচ্ছে, সেখান থেকে ধীরে ধীরে এই হাভেলির সামনে এসে একবারমাত্র সেই হুলস্থুল কাণ্ডের দিকে একটা শান্ত দৃষ্টি ফেলে বাড়িতে ঢুকল। তার পরনে নুনময়লা সুতির পাজামা, তার উপর একটা অতি সাধারণ কুর্তা। মাথায় টুপিটি পর্যন্ত নেই, পায়ে চটি আছে কি না ঠিক ঠাহর হল না। সে কুর্তার সামনের দিকটার (পূর্বোল্লিখিত দামন বা অঞ্চল) দুই খুঁট দুই হাত দিয়ে এগিয়ে ধরে তাতে সামলে রেখেছে পায়রাকে খাওয়াবার দানা। স্পষ্ট বোঝা গেল, এইমাত্র পাড়ার মুদির দোকান থেকে সে বেসাতিটা কিনে এনেছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে তার বুঝতে বিলম্ব হল না যে, হট্টগোলের উৎপাতে পায়রাগুলো উধাও হয়ে গিয়েছে। তখন তার খেয়াল গেল চতুর্দিকে ছুটোছুটি আর চেল্লাচেল্লির দিকে। সে কিন্তু নির্বিকার। আস্তে আস্তে এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করতে লাগল– বাড়িটা যেন চাঁদনি চৌক।

এবারে বাইরে শোনা গেল এক পদস্থ অশ্বারোহীর কটুবাক্য আর তীব্র চিৎকার– ইনি অন্ততপক্ষে ফৌজদারই হবেন। ওরে সব না-মর্দ, বেওকুফ, বেকার নাকম্মার দল। এই এখখুনি বেরিয়ে আয়, কাম খতম করে। নইলে হজরত আলীর ঝাণ্ডার কসম খেয়ে বলছি, তোদের কিয়ামতের শেষ-বিচারের দিন এই লহমাতেই হাজির হবে। আল্লার গজব, আল্লার লানৎ তোদের ওপর, তোদের বা-বাচ্চার ওপর।

এই হুঁশিয়ারি, এই দিব্যিদিলাশা যেন তিলিস্মাৎ-ভানুমতীর কাজ করল।

দূতদের দুজনার দৃষ্টি হঠাৎ গেল সেই দামনে-দানা-ভরা বালকটির দিকে। লাফ দিয়ে পড়ল সেই দুই নরদানব তার উপর। এক ঝটকায় তাকে কাঁধে ফেলে দে-ছুট দে-ছুট দেউড়ির দিকে, দেউড়ি ছাড়িয়ে রাস্তা পেরিয়ে আল্লায় মালুম কোন দিকে! কী যে ঘটল কিছুই বোঝা গেল না। সঙ্গে সঙ্গে উঠল বামাকুলের আর্তনাদ ইয়াল্লা, এরা যে রফি-উদ্-দরজাৎকে নিয়ে গেল রে। ধরো, পাকড়ো ওদের। পাকড়ো পাকড়ো, জানে ন্ পায়, যেতে না পায় যেন! ইয়া রহমান, ইয়া রহিম।

কিন্তু কে ধরে তখন কাকে?

হারেমের মেয়েরা ভাবতেই পারেননি যে, রফি-উশ-শানের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র নাবালক বাচ্চা রফি-উদ্-দরজাকে ধরে এরা চম্পট দেবে। যতক্ষণ এরা জেনানা জঙ্গিলাট হয়ে সার্বভৌম মহম্মদ ইব্রাহিম আর মধ্যম রফি-উদ্-দৌলাকে পঞ্চত্ব, কমসেকম অন্ধত্ব থেকে রক্ষা করেছিলেন, ততক্ষণে, যার নিরাপত্তা সম্বন্ধে কোনও ভয়-ভীতি ছিল না, সেই সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা রফি-উদ্-দরজাৎকে নিয়ে দুশমন উধাও হয়ে গিয়েছে।

আজব সেই লড়াই তাজ্জবভাবে ফৌরন থেমে গেল। দোস্ত-দুশমন কোনও পক্ষের কেউ মারা গেল না, হার মানল না, সন্ধি করল না, ধরা দিল না– আচানক্ সবকুচহ্ বিলকুল ঠাণ্ডা!

সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় দিওয়ান-ই-আম্ থেকে নহবখানা পর্যন্ত পাইচারির বদলে ছুটোছুটি আরম্ভ করেছেন। এঁরা বিস্তর লড়াই লড়েছেন, জীবন এঁদের বহুবার বিপন্ন হয়েছে, কিন্তু এবারে তারা যেরকম ঘেমে-নেয়ে কাঁই হয়ে গেলেন এরকমটা আর কখনও হননি। ক্রোধে, জিঘাংসায় তারা শুধু একে অন্যকে বলছেন, যে-কটা না-মর্দকে তারা পাঠিয়েছিলেন তাদের জ্যান্ত শরীর থেকে চামড়া তোলবার হুকুম দেবেন, নয় ফোঁটা ফোঁটা গরম তেল তাদের ব্রহ্মতালুতে ঢেলে ঢেলে নিধন করবেন।

এমন সময় সেই দুই পাহলোয়ান এসে উপস্থিত শাহজাদা রফি-উদ্-দরজাৎকে সঙ্গে নিয়ে।

শাহজাদা হোক আর ফকিরজাদাই হোক, সে কিন্তু পুঁটুলি পাকিয়ে দু হাত দিয়ে জোরে পাকড়ে আছে পায়রার দানা-ভর্তি তার কোঁচড়। এসব বাদশা-উজিরের ব্যাপার দিল্লি শহরে এখন আছে তো তখন নেই কিন্তু পায়রার দানা কটি পায়রার দানা, শাহজাদা মিয়া রফির কাছে এটা ভয়ঙ্কর সত্য।

ইতোমধ্যে সৈয়দ ভায়ারা হুঙ্কার দিয়ে উঠেছেন, কম্বৎ, না-দা– এ কাকে ধরে এনেছ তোমরা? বাদশা হবেন বড় ভাই, ধরে আনলে ছোটটাকে! তোমাদের জ্যান্ত না পুঁতলে–

সৈয়দদ্বয় তখন নাগরিক, ফৌজদার এমনকি তৈমুরের বংশধর, বাবুর-হুমায়ুনের পুত্র-পৌত্র বাদশাহ-সালামদের ও জান-মালের মালিক। এসব কথা দূত দুটি ভালো করেই জানে। কিন্তু আজকের আঁটার মার তাদের করে দিয়েছে বেপরোয়া। চরম বিরক্তি আর তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, যা পেয়েছেন তাই নিয়ে সন্তুষ্ট হোন। আর আমাদের মারুন আর কাটুন, যা খুশি করুন।

দুই ভাই তাড়াতাড়িতে ব্যাপারটা জানতে পেরে বুঝলেন, এখন আবার নতুন করে পাইক-বরকন্দাজ পাঠিয়ে বড় দুই ভাইয়ের একজনকে তারা ইব্রাহিমের চেয়ে রফি-উদ-দৌলাকে পছন্দ করেছিলেন বেশি– ধরে আনাতে সময় লেগে যাবে বিস্তর। আজকের ভাষায় ততক্ষণ টাইম-বম্ ফেটে যাবে।

একে দিয়েই তা হলে কাজ চালিয়ে নিতে হবে। গত্যন্তর কী?

আর ও নিয়ে মাথা ঘামিয়েই-বা লাভ কী? ইব্রাহিমই হোক আর রফি-উদ্-দৌলাই হোক, যেই হোক, তাকে তো হতে হবে ওঁদের হাতেরই পুতুল। সে পুতুল তার মায়ের গর্ভ-ফ্যাক্টরি থেকে পয়লা চালানে বেরিয়েছে, না তেসরা কিস্তিতে তাতে কীই-বা যায় আসে? ফরাসি সম্রাটের চেয়েও সরল কণ্ঠে তখন তারা বলতে পারতেন, লে তা সে নু ভারতবর্ষ? সে তো আমরা দু ভাই! বাদশাহ যে কোনও গড়-ড্যাম আওরঙ্গজেব-বংশের গর্ভস্রাব।

নবীন রাজার অভিষেকের জন্য দুই ভ্রাতা তাঁর দুদিকে চলেছেন রাজার দুই বাহু ধরে। আল্লা জানেন, কার আদেশে তাঁর দুই বদ্ধমুঠি শিথিল করার ফলে এই এখন পায়রার দানা ঝরঝর করে দিওয়ান-ই-আমের পাথরের মেঝেয় ছড়িয়ে পড়ল।

চতুর্দিকে সৈয়দদের মিত্র ও পরামর্শদাতা আমির-ওমরাহ তাদের মহামূল্যবান কিংখাবের পাগড়ি, শুভ্র মলমলের আঙ্গারাখা, তার ভিতর দিয়ে ফুটে বেরুচ্ছে নিচের সাচ্চা জরির বোনা সদরিয়ার সোনালি আভা, কোমরে কাশ্মিরের সর্বশ্রেষ্ঠ শাল দিয়ে তৈরি কোমরবন্ধ, তার বা দিকে গোঁজা জাতির মতো জামৃদর অস্ত্র, ডাইনে ঝুলছে দিমিশকের তলোয়ার খাপের উপর মুষ্টিতে বিচিত্র মণিমাণিক্যের জড়োয়া কাজ, পরনে সাটিনের পায়জামা, পায়ে জরির কাজ করা শুড়-তোলা সিলিমশাহি। উষ্ণীষে মুক্তোর সিরর্পেচ, বুকে মোতির হার, হাতে হীরের আংটি।

এদের ভিতর দিয়ে চলেছেন বাদশাহজাদা। পরনে নুনময়লা পাজামা, গায়ে মামুলি কুর্তা। ব্যস। পাঁচ লহমা পরে যিনি হবেন দিল্লিশুরো বা জগদীশুরো বা! এ যে জগদীশ্বরের কৌতুকবোধের চূড়ান্ত নিদর্শন।

সৈয়দদের একজন শাহজাদার মাথায় বসিয়ে দিলেন তাঁর আপন পাগড়ি মস্তকাভরণহীন অভিষেক কল্পনাতীত। সেই বিরাট সাইজের পাগড়ি শাহজাদার কানদুটো গিলে ফেলল। অন্য ভ্রাতা তাঁর মুক্তোর সাতলখা হার পরিয়ে দিলেন তাঁর গলায়। ময়লা কুর্তার উপর সে মালা দেখাল ঘোলা জলের উপর রাজহংস!

এবং রফি-উদ্-দরজাৎ এই বেশেই বসলেন– যা-তা সিংহাসনের উপর নয়– আসল ময়ূর-সিংহাসনের উপর। এ-ও আরেক রঙ্গ। কারণ সচরাচর মোগল বাদশারা বসতেন আটপৌরে সিংহাসনের উপর। ফররুখসিয়ারের অভিষেকের বাত্সরিক পরব না অন্য কোনও উপলক্ষে তোষাখানা থেকে আগের দিন ময়ূর-সিংহাসন আনানো হয়েছিল; সেটা তখনও তোষাখানায় ফেরত পাঠানো হয়নি বলে যেন কন্ট্রাস্টটা চরমে পৌঁছনোর জন্য পাজামা-কুর্তা পরে শ্ৰীযুত রফি বসলেন তারই উপর!

এর পরের ইতিহাস আরও চমকপ্রদ, আরও অচিন্ত্যনীয়। কিন্তু তার ভিতর খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে যাবেন, কিন্তু এরকম কৌতুকজনক বড়-কিছু একটা পাবেন না। আমি একেবারে কিছু পাইনি। শুধু খুন আর লড়াই। নৃশংস আর বীভৎস। আমি তাই বাকিটা সংক্ষেপেই বলি– নিতান্ত যারা ছোটগল্প পড়ার পরও শুধোন, তার পর কী হল? তাঁদের জন্য।

সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় শত্রুর শেষ রাখতে নেই বলে ফাঁসুড়ে পাঠিয়ে ফররুখসিয়ারকে খুন করালেন। এক বছরের ভিতরই ধরা পড়ল রফি-উদ-দরজাতের যক্ষ্মা। সে বছর যেতে না যেতেই তিনি মারা গেলেন। মারা যাওয়ার পূর্বে তিনি তার বড় ভাই রফি-উল-দৌলাকে সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে গেলেন। তিনিও ওই বৎসরই মারা গেলেন। তার পর বাদশা হলেন মুহম্মদ শাহ বাদশাহ। তিনি প্রায় ত্রিশ বৎসর রাজত্ব করেন। ইতোমধ্যে সৈয়দ ভ্রাতাদের দুর্দিন ঘনিয়ে এল। একজন আততায়ীর ছুরিকাঘাতে নিহত হলেন, অন্যজন বন্দি অবস্থায় বিষপ্রয়োগবশত।

বস্তুত এ যুগের ইতিহাস পড়লে বার বার স্মরণে আসে :

রাজত্ব-বধূরে যে-ই করে আলিঙ্গন।
তীক্ষ্ণধার অসি পরে সে দেয় চুম্বন!

একটি অনমিত নাম : বনবিহারী মুখোপাধ্যায়

স্বর্গীয় লিখতে গিয়েই কলম থেমে গেল; এমনকি ক্ষণজন্মা, পুরুষসিংহ বনবিহারী মুখোপাধ্যায় পরলোক গমন করেছেন– এটা লিখতেও বাধো-বাধো ঠেকছে, কারণ বনবিহারী স্বর্গ, পরলোক, আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না।

বনবিহারীর পূর্ণাঙ্গ জীবনী লেখা প্রায় অসম্ভব, কারণ চাকরিজীবনে তাকে বাধ্য হয়ে আজ পাকশী, কাল মৈমনসিং, পরশু বগুড়া করতে হয়েছে এবং অসময়ে বেকসুর বদলি হলেও তিনি হয়তো প্রতিবাদ জানাতেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনও মেহেরবানি চাইতেন না। বনবিহারী এ জীবনে কারও কাছ থেকে কোনও ফেবার চাননি, এবং ভগবানের কাছ থেকে অতি অবশ্য, নিশ্চয়ই না। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি সর্বপ্রথম কোথায় যান জানিনে, কিন্তু তার পরই চলে যান দেরাদুনে। সেখানে বেশ কয়েক বৎসর একটানা হোটেলে বাস করার পর হঠাৎ চলে যান বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, আন্দামান। স্বেচ্ছায় এবং অতিশয় প্রসন্ন চিত্তে। বলা বাহুল্য, সেখানে রোমান্সের সন্ধানে যাননি। কাব্যে, সাহিত্যে তিনি কতখানি রোমান্টিসিজম বরদাস্ত করতেন বলা কঠিন, কিন্তু সংসার-জীবনে তিনি রোমান্টিসিজমের পিছনে দেখতে পেতেন, make belief, সত্য থেকে আত্মগোপন, একেপিজম এবং ভণ্ডামি এবং এর সবকটাকেই তিনি অত্যন্ত কুটিকুটিল নয়নে তিরস্কার জানাতেন। তার পর হঠাৎ একদিন তিনি আবার ভারতে ফিরে এলেন। বৃদ্ধ বয়সে তার বাসস্থান পরিবর্তন আমাকে বড় পীড়া দিত। তাই তাঁকে অনুরোধ জানালুম, তিনি যেন দয়া করে আমার সঙ্গে বসবাস করেন। উত্তম হোক মধ্যম হোক, আমি মোগলাই, বিলিতি কিছু কিছু রাধতে পারি; সে সময়ে আমার বাসস্থানটি ছিল প্রশস্ত ও নির্জনে– শুশানের কাছে অবস্থিত। আমার নিজস্ব বই তো ছিলই, তদুপরি তার পরিচিত একটি লাইব্রেরি কাছেই ছিল। অবশ্য সর্বপ্রধান প্রলোভন ছিলেন তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা শ্ৰীযুত বিনোদবিহারী মুখুয্যে। তাঁর বাসাও নিকটে। এই ভাইটিকে বনবিহারী আপন হাতে মানুষ করেন এবং সে যেন ধর্ম, ঈশ্বর, পরকাল, উপাসনা ইত্যাদি সর্বপ্রকার সংস্কার থেকে মুক্ত থাকে সে জন্য কোনও ব্যবস্থার ত্রুটি করেননি। বিনোদবিহারীর ডাকনাম নন্তু। বনবিহারী তাকে ডাকতেন নাস্তিক বা নাস্তে। আমার বাড়িতে এসে বাস করলে তিনি যে তাঁর নাস্তেকে অক্লেশে দু বেলা দেখতে পাবেন সেইটেতে বিশেষ জোর দিয়ে আমি আমার চিঠিতে নিবেদন জানিয়েছিলুম। বিনোদবিহারী প্রায় দশ বত্সর পূর্বে তাঁর চোখের জ্যোতি সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেন; তাই তাঁর পক্ষে অগ্রজ সন্নিধানে যাওয়া কঠিন ছিল।

আমি ক্ষীণ আশা নিয়েই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলুম, কারণ আমি তাঁর কৃতবিদ্য, বিত্তশালী, পিতৃভক্ত পুত্রকে উত্তমরূপেই চিনি। তাঁর শত কাতর অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি পুত্রের গৃহে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে রাজি হননি। আমার আশা ছিল, আমি তাঁর কেউ নই, তিনি জানতেন যে আমি ধর্মে, সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী একটি আস্ত জড়ভরত হওয়া সত্ত্বেও তাকে অবিচল ভক্তি করি, এবং দাসের মতো সেবা করব; বিশ্বসংসার নিয়ে তার যত রকমের সমালোচনা, ব্যঙ্গবিদ্রূপ আমি সহাস্য বদনে শুনেছি এবং শুনব এবং তর্কযুদ্ধ করার মতো লোকের অভাব হলে আমাকে দিয়েও কিছুটা কাজ চলবে– তিনি জানতেন, আমার জীবন কেটেছে তুলনাত্মক ধর্ম চর্চায়।

তিনি এলেন না সত্য, কিন্তু আমাকে একটি অতিশয় প্রীতিপূর্ণ (তিনি সেন্টিমেন্টের আতিশয্য এতই অপছন্দ করতেন যে, সেফসাইডে থাকার জন্য সেটা বাক্যে, পত্রে সর্বত্র বর্জন করতেন) পত্র লিখে জানালেন, তোমার নিমন্ত্রণ মনে রইল, সময় হলেই আসব।

আমার ক্ষোভ-শোকের অন্ত নেই যে তার সময় আর হল না। মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিই, আমি কে যে তিনি আমার সেবা গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করতেন।

শেষদিন পর্যন্ত, এতসব ঘোরাঘুরির মাঝখানেও সর্বত্র তাকে সঙ্গ দিয়েছেন তাঁর ভ্রাতা শ্ৰীযুক্ত বন্ধুবিহারী। বনবিহারীর অধিকাংশ লেখাই ছাপাখানা পর্যন্ত পৌঁছত না। প্রকাশিত হলে ফাইলে রাখতেন না, নিতান্ত অন্তরঙ্গ বন্ধুকেও বলতেন না, অমুক কাগজে আমার লেখা বেরিয়েছে, পড়ে দেখ। তাঁর পরিপকু যৌবনে কিন্তু তিনি আমাদের মতো বালকদের প্রতি সদয় ছিলেন। সম্পূর্ণ, অসম্পূর্ণ বহু লেখা তিনি সোৎসাহে আমাদের পড়ে শুনিয়েছেন।

এখনও যা-কিছু আছে তাই নিয়ে শ্রীযুত বন্ধুবিহারী প্রামাণিক নিবন্ধ লিখতে পারবেন। কোন লেখা কোন উপলক্ষে লেখা হয়েছিল, কোন ব্যঙ্গচিত্র আঁকবার সময় কাকে তিনি মনে মনে সামনে দাঁড় করিয়েছিলেন, কীভাবে সমাজের কোন গুপ্ত পাপাচার তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, এর বেশিরভাগই একমাত্র তাঁরই জানার কথা। এবং চিকিৎসাশাস্ত্রের এত বড় পণ্ডিত, অধ্যাপক ওই বিষয়ে কখনও কিছু লেখেননি এটা কেমন জানি বিশ্বাস করতে অসুবিধা হয়। আমি নিজে জানি, ছাত্রদের দুই ধরনের ব্যান্ডেজ শিখিয়ে তাদের নাম বলে, দোষগুণ আপন অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ দিয়ে যাচাই করার পর একটা তৃতীয় ব্যান্ডেজ হয়তো শেখালেন। কোনও বুদ্ধিমান ছেলে হয়তো লক্ষ করল এটার নাম তিনি বলেননি; শুধোলে পর বলতেন, ওহ! দ্যাট ওয়ান? ওটা ব্যান্ডেজ আ লা বনবিহারী (তিনি নিজের চেষ্টায় সুন্দর ফরাসি শিখেছিলেন ও উচ্চারণটিও তার চমৎকার ছিল। আমি ফরাসি শিখতে আরম্ভ করেছি জেনে তিনি আমাকে মপাস পড়ে শুনিয়েছিলেন; নতুবা নিতান্ত বাধ্য না হওয়া পর্যন্ত বনবিহারী আপন বৃহৎ-ক্ষুদ্র সর্বকৃতিত্বই লুকিয়ে রাখতেন)।

বনবিহারী সম্বন্ধে প্রামাণিক কিছু লেখা প্রায় অসম্ভব। কারণ প্রায় অসম্ভব শুধুমাত্র তার প্রকাশিত লেখা ও ব্যঙ্গচিত্র জোগাড় করা। বেনামে ছদ্মনামে তো লিখেছেনই, তদুপরি নিজের সৃষ্টির প্রতি তাঁর কোনওপ্রকারের মোহ ছিল না বলে সেগুলোকে তাদের ন্যায্য সম্মান দেবার জন্য তিনি কোনও চেষ্টা তো করতেনই না, উল্টো নিতান্ত অজানা অচেনা কাগজে প্রায়ই বাছাই বাছাই লেখা ছাপিয়ে দিতেন। এবং আমার জানতে সত্যই ইচ্ছে করে, তিনি তার লেখার জন্যে কখনও কোনও দক্ষিণা পেয়েছেন কি না।

উপস্থিত আমি শুধু তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয়ের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ নিবেদন করছি; যদি কোনওদিন তাঁর প্রকাশিত রচনা ও ছবির দশমাংশের এক অংশও জোগাড় করতে পারি তবে তার জীবন-দর্শন সম্বন্ধেও কিছু পেশ করার ভরসা রাখি। অথবা হয়তো তখন দেখব, তাঁর জীবন-দর্শন ছিল যে, মানুষের পক্ষে কোনও প্রকারের শাশ্বত জীবনদর্শনে পৌঁছনো সম্পূর্ণ অসম্ভব, কারণ শাশ্বত বলে কোনও বস্তু, ধারণা বা আদর্শ এ-সংসারে আদপেই নেই।

ভ্যানিটি অব ভ্যানিটিজ অল ইজ ভ্যানিটি বাইবেলের এই আপ্তবাক্য তার মুখ দিয়ে বলাতে আমার বাধছে, কারণ নাটকীয় ভঙ্গিতে কোনও জিনিসই প্রকাশ করাতে তাঁর ঘোর আপত্তি। কারণ এসব ভঙ্গি, স্টাইল, পোজ থেকে উদ্ভূত হয় ধর্মগুরুর দঙ্গল এবং বনবিহারীর সুদৃঢ় ধারণা ছিল যে তাঁদের সম্বন্ধে আমরা যত কম শুনতে পাই ততই ভালো। বলার মতো বিশেষ কিছু তো নেই–হয়তো বলতেন বনবিহারী– তা হলে বলতে গিয়ে অত ধানাইপানাই কেন?

বৃষের মতো স্কন্ধ, আজানুলম্বিত বাহু– এসব শাস্ত্রসম্মত লক্ষণ দিয়ে বিচার করলে বনবিহারী নিশ্চয়ই সুপুরুষের পর্যায়ে পড়তেন না, তৎসত্ত্বেও বলি, বনবিহারীর মতো অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত, তেজন সুপুরুষ আমি দেশ-বিদেশে অতি অল্পই দেখেছি। বাঙালি ফর্সা রঙ পছন্দ করে, কিন্তু বনবিহারীর গৌরবর্ণ আমি অন্য কোনও বাঙালির চর্মে দেখিনি। বলা বাহুল্য যে, সে বর্ণ ইংরেজের ধবলকুষ্ঠ শ্বেত নয়। গৌর হয়েও সে বর্ণে ছিল কৃষ্ণের স্নিগ্ধতা। তপ্তকাঞ্চন তো সে নয়ই, চাঁদের অমিয়াসনে চন্দন বাটিয়াও সে বর্ণ মাজা হয়নি। নদীয়ার গোসাঁইকে আমি দেখিনি, কিন্তু তাঁকে কল্পনায় দেখতে গেলে তার অঙ্গে আমি বনবিহারীর বর্ণ চাপাই। তার চুল ছিল কটা। আমি একদিন তাকে বলেছিলুম, ঋগ্বেদে না কোথায় যেন অগ্নির দাড়িকে রক্তবর্ণ বলা হয়েছে; আপনি দাড়ি রাখলে সেটা ক্রমে ক্রমে রক্তবর্ণ ধারণ করবে। আমার সত্যই মনে হত কেমন যেন এক অলৌকিক প্রক্রিয়ায় কী যেন এক অ্যাটাভিজমের ফলে তিন হাজার বৎসর পর আর্য ঋষি গৌড়দ্বিজের গৃহে আবির্ভাব হয়েছেন। বনবিহারী তার স্বভাবসিদ্ধ তর্কজাল বিস্তার করে পর্যায়ক্রমে, অপ্রমত্ত চিত্তে যে-সিদ্ধান্তটি সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন তার অর্থ : যারা বলে বাঙালির গায়ে কিঞ্চিৎ আর্যরক্ত আছে এটা তাদের ভ্রম– যারা বলে বাঙালি পরিপূর্ণ আর্য তাদের ভ্রমের চেয়েও মারাত্মক দুষ্টবুদ্ধিজাত ভ্রম।

ওই সময়ে আমি রেনার খ্রিস্ট-জীবনী পড়ি অধ্যাপক হিড়জিভাই মরিসের কাছে। প্রথম অধ্যায়েই তিনি লিখেছেন যে তোক মানুষে মানুষে পার্থক্য ঘোচাবার জন্য সর্বাধিক প্রচেষ্টা দিয়েছেন (অর্থাৎ খ্রিস্ট) তাঁর ধমনীতে কোন্ জাতের রক্ত প্রবাহিত সে অনুসন্ধান করতে যাওয়া অনুচিত। বনবিহারী সমস্ত জীবন ধরে বিস্তর অক্লান্ত জিহাদ লড়েছেন, কিন্তু বর্ণবৈষম্য চোখে পড়লেই তিনি নিষ্কাশিত করতেন শাণিততম তরবারি। এস্থলে বলে রাখা ভালো, বনবিহারী তাঁর জিহাদ চালাতেন হৃদয়হীন যুযুধানের মতো। তাই সত্যের অপলাপ না করে অনায়াসে বলতে পারি, তার মতো মিলিটেন্ট নাস্তিক এদেশে তো কখনওই জন্মায়নি, বিদেশেও নিশ্চয়ই মুষ্টিমেয়। পিসফুল কো-এগৃজিস্টেন নীতিটি তিনি আদপেই বরদাস্ত করতে পারতেন না। তিনি ছিলেন হাসপাতালের ভিতরে-বাইরে সর্বত্রই, এবং টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স ডিউটির সার্জন। তাঁর বক্তব্য, তোমার পায়ে হয়েছে গ্যাঙরিন, সেটা আমি কেটে ফেলে দেব। গ্যারিনের সঙ্গে আবার পিসফুল কো-এগৃজিস্টেনস্ কী? কিন্তু পাঠক ভুলে ক্ষণতরেও ভাববেন না, বনবিহারী অসহিষ্ণু ছিলেন। এর চেয়ে বৃহত্তর, হীনতর মিথ্যা ভাষণ কিছুই হতে পারে না। তুমি আস্তিক। তোমার মস্তিষ্ক থেকে আমি সেই অংশ ছুরি দিয়ে কেটে ফেলব। কিন্তু তোমার প্রতি আমি অসহিষ্ণু হব কেন? বস্তুত চিকিত্সক বলে আমার সহিষ্ণুতা অনেক বেশি। তোমার পরিচিত কারও সিফিলিস হলে তুমি শুধু সিফিলিস না, সেই লোকটিকেও বর্জন কর। আমি সিফিলিস দূরীভূত করি, কিন্তু সে হতভাগ্যকে তো দূর দূর করে দূরীভূত করার চিন্তা আমার স্বপ্নেও ঠাই দিই না। প্লেগ এলে তুমি এ শহরের নাগরিকদের বিষবৎ বিবেচনা করে তাদের বর্জন কর; আমি তা করিনে। এবং আমি ব্যক্তিগতভাবে শপথ করতে রাজি আছি এটা তার বাগাস্কালন নয়। কাব্যে আমরা বাক্ ও অর্থের সমন্বয় অনুসন্ধান করি, জীবনে করি বাক ও কর্মের। এ দুটির সমন্বয় বনবিহারীতে প্রকৃতিগত ছিল। বলতে যাচ্ছিলুম বিধিদত্ত, কিন্তু তার আত্মাকে ক্ষুব্ধ করতে চাইনে। আবার ভুল করলুম, তিনি আত্মাকে বিশ্বাস করতেন না, কাজেই হাওয়ার কোমরে রশি বাধার মতোই তাঁর আত্মাকে নিপীড়িত করার সম্ভাবনা!

বনবিহারী তাঁর বাল্যবয়সের অধিকাংশটা কাটান তাঁর মাতামহের সঙ্গে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমি তাঁর নাম ভুলে গিয়েছি কিন্তু সেটা বের করা কঠিন হবে না। এই মাতামহটি ছিলেন গত শতাব্দীর ধনুর্ধর, অপরাজিত দার্শনিক এবং নৈয়ায়িক। যে দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রাচ্য-পাশ্চাত্য উভয় দর্শনে ছিলেন সে যুগের চূড়ামণি, তিনি ছিলেন তাঁর নিত্যালাপী সখা। যে দ্বিজেন্দ্রনাথের গৃহে বঙ্কিমাদি মনীষীগণ আসতেন তত্ত্বালোচনার জন্য সেই দ্বিজেন্দ্রনাথ গিয়েছেন দিনের পর দিন এই নৈয়ায়িকের অপরিসর পথের ক্ষুদ্রতর গৃহে। দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন এমনই আপন-ভোলা সাদা দিলের মানুষ যে তর্কে বিরক্তির সঞ্চার হলে তার কণ্ঠ তপ্ততর ও উচ্চতর হতে আরম্ভ করত– বনবিহারীর মাতামহ এ তত্ত্ব জানতেন বলে সেটা আদৌ গায়ে না মেখে পূর্বের চেয়ে ক্ষীণতর কণ্ঠে মোক্ষমতর যুক্তি পেশ করতেন। খাওয়ার বেলা গড়িয়ে যায়–দ্বিজেন্দ্রনাথ সে সম্বন্ধে বেহুঁশ। শেষটা বেলা প্রায় তিনটায় উত্তেজিত হয়ে আসন ত্যাগ করে বলতেন, ঝকমারি, ঝকমারি, এসব লোকের সঙ্গে তর্ক করা; আমি চললুম এবং এই আমার শেষ আসা। বনবিহারীর মাতামহ ক্ষীণকণ্ঠে বলতেন, গিন্নি পুঁইচচ্চড়ি বেঁধেছিল। অট্টহাস্য করে দ্বিজেন্দ্রনাথ টেনে টেনে বলতেন, সেটা আগে বললেই হত, আগে কইলেই হত। তার পর বারান্দায় প্রতীক্ষমাণ তাঁর গার্জেনকে বলতেন (মহর্ষিদেব এই আপন-ভোলা যুবরাজের জন্য একটি তদারকদার নিযুক্ত করে রেখেছিলেন), যাও, বাড়ি থেকে দাঁত নিয়ে এসোগে। শুধু খাবার সময়ই তিনি বাঁধানো দাঁত ব্যবহার করতেন। আমার ভাবতে বড় কৌতুক বোধ হয় যে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠতম দৌহিত্র বাড়ির কোর্মা-কালিয়া ছেড়ে অনাড়ম্বর নৈয়ায়িকের অপরিসর বারান্দায় পিঁড়িতে বসে পুইচচ্চড়ি চিবোতে চিবোতে উচ্চকণ্ঠে পাড়া সচকিত করে তার অকৃপণ প্রশস্তি গেয়ে চলেছেন।

পরদিন নাউ-চিঙড়ি! নাউ–লাউ না!

এ ধরনের একাধিক বিচিত্র বিষয় আমি ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছি প্রাগুক্ত বিনোদবিহারী মহাশয়ের কাছ থেকে।

দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁর সুচিন্তিত প্রবন্ধরাজিতে মাত্র দুজন দার্শনিক পণ্ডিতের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে সপ্রশংস চিত্তে উল্লেখ করেছেন যারা দার্শনিক ও তত্ত্ববিদের গুরুভার কর্তব্য আপন আপন স্বন্ধে অনায়াসে তুলে নিতে পারেন; এদের একজন পুইচচ্চড়ি-রসিক দার্শনিক বনবিহারীর মাতামহ। এবং তার সম্বন্ধে বলি, সে যুগে পিরিলি ঠাকুররা অন্যান্য ব্রাহ্মণদের কাছে অপাঙক্তেয় ছিলেন।

বিশ্বস্তসূত্রে অবগত আছি, বনবিহারী বাল্য বয়সে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ছিলেন। মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবস্থায়ও সূর্যোদয় থেকে প্রারম্ভ পূজা-অর্চনা শেষ করতে করতে কোনও কোনও দিন ক্লাসের সময় পেরিয়ে যেত। এটাতে আমার সামান্য বিস্ময় লাগে, কারণ আমি যে কয়টি প্রাচীনপন্থী নৈয়ায়িককে চিনি তাঁদের সকলেই পূজা-অর্চনা সম্বন্ধে ঈষৎ উদাসীন ছিলেন। আমার আপন গুরু পথে যেতে যেতে বারোয়ারি সরস্বতী প্রতিমা দেখে। নাসিকা কুঞ্চিত করে বলেছিলেন, ন দেবায়, ন ধর্মায়। অর্থাৎ হিন্দুশাস্ত্রে (অবশ্য তিনি স্মৃতি জানতেন অত্যল্পই এবং সে জন্য তার কণামাত্র ক্ষোভও ছিল না) এরকম পুজোর কোনও ব্যবস্থা নেই, বৌদ্ধধর্মে (ন ধর্মায়-এর ধর্ম এস্থলে ধর্মং শরণং গচ্ছামি থেকে নেওয়া) তো থাকার কথাই নয়। সঙ্গে সঙ্গে হয়তো সরস্বতীর যে কুখ্যাতি (হয়তো অমূলক) আছে সেটা তার স্মরণে আসত। তা সে যাক। কারণ আমার ধর্মের সুফিদের ও খ্রিস্টান মিস্টিকদের ভিতরও ক্রিয়াকর্মের প্রতি কিঞ্চিৎ অনাসক্তি লুক্কায়িত রয়েছে।

অকস্মাৎ একদিন বনবিহারী নাস্তিকরূপে সমাজে আত্মপ্রকাশ করলেন ও শুধু শাস্ত্রীয় ক্রিয়াকর্ম (রিচুয়েল) নয়, শঙ্করাচার্যের নিষ্ঠুণ ব্ৰহ্ম থেকে হাঁচি টিকটিকির বিরুদ্ধে তীব্র কর্কশ কণ্ঠে মারমুখো জিহাদ ঘোষণা করলেন। খ্রিস্টান মিশনারি পর্যন্ত তাঁর বিশ্বাসের দৃঢ়তা, উদ্দীপনা এবং যুদ্ধংদেহি মনোভাব দেখলে বিস্ময়ের সঙ্গে পরাজয় স্বীকার করত। এই যে সামান্য আমি, আমার বয়স তখন কত হবে? ষোলগোছ– আমাকে পর্যন্ত প্রথম দর্শনের পাঁচ মিনিটের ভিতর, কলার অভাবে কুর্তার গলার মুরি ধরে শুধোলেন, তুমি ঈশ্বর মানো?

আমি ভীত কণ্ঠে বললুম, আজ্ঞে আমার বিশ্বাস দৃঢ় নয়, অবিশ্বাসও দৃঢ় নয়। আমি তখন জানতুম না, এই উত্তরই চার দশক পরে কলকাতার মডার্ন মহিলাদের ভিতর ফ্যাশন হয়ে দাঁড়াবে।

তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বিশ্বাস দৃঢ়ই হোক, আর শিথিলই হোক, সেইটে কিসের উপর স্থাপিত আমাকে বুঝিয়ে বল।

কী যুক্তি দেব আমি? যেটাই পেশ করি, সেটাই বুমেরাঙের মতো ফিরে আসে ফের আমারই গলায়। ইতোমধ্যে আমার জন্য উত্তম মমলেট, ঘোলের শরবত এসেছে–দুপুর অবধি তর্ক চালালে অবশ্যই পুঁইচচ্চড়ি আসত!

আমি রণেভঙ্গ দিতে চাইলেও তিনি ছাড়েন না। আমি যে ধর্মের অধর্ম পথে চলেছি সেইটে তিনি সপ্রমাণ করতে চান, সর্বদৃষ্টিকোণ থেকে, সর্বদৃষ্টিবিন্দু থেকে। এবং আমার সবচেয়ে বিস্ময় বোধ হল যে, আমি যে কজন ইউরোপীয় নাস্তিক দার্শনিকের নাম জানতুম– অবশ্য অত্যন্ত ভাসা-ভাসাভাবে তাঁদের কাছ থেকে বনবিহারী ঈশ্বরম্ন ধর্মগ্ন যুক্তি আহরণ করলেন না। বিস্তর তর্কজাল বিস্তৃত করার পর, মাঝে মাঝে তিনি সেগুলো সাম্-আপ করতেন, এ-দেশি পরিভাষায় সূত্ররূপে প্রকাশ করতেন সংস্কৃত শ্লোক উদ্ধৃত করে! এই প্রথম আমার গোচরে এল যে, আর্যাবর্তের মতো ধর্মাবর্তের দেশেও অসংখ্য নাস্তিক প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধে বহুযুগ পূর্বেই বিদ্রোহ ঘোষণা করে গিয়েছেন।

সেদিন আমি বড়ই উপকৃত হয়েছিলুম। ঈশ্বরবিশ্বাসে যেসব বাতিল যুক্তি আছে সেগুলো থেকে মুক্ত হয়ে আমি ঈশ্বর সন্ধানে সত্য যুক্তি ও নিজস্ব অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের কথা চিন্তা করলুম। কিন্তু আমার কথা থাক।

পাঠক, আপনি মোটেই ভাববেন না, বনবিহারীর প্রধান সংগ্রাম ছিল ঈশ্বরের বিরুদ্ধে। তাঁর সংগ্রাম ছিল জড়তা, কুসংস্কার, ধর্মের নামে পাপাচার, সামাজিক অনাচার, তথাকথিত অপরাধীজনের প্রতি অসহিষ্ণুতা, যাজক সম্প্রদায়ের শোষণ, চিন্তা না করে বাঁধা পথে চলার বদঅভ্যাস, মহরমের তাজিয়ার সামনে কুমড়ো-গড়াগড়ি, যৌনসম্পর্কের ওপর তথাকথিত শালীনতার পর্দা টেনে আড়ালে আড়ালে কুমারী ও বিধবার সর্বনাশ, অশিক্ষিত ব্রাহ্মণের অকারণ দম্ভ, অব্রাহ্মণের অহেতুক দাস্যমনোবৃত্তি, তথাকথিত সত্যরক্ষার্থে সত্য গোপন, স্বার্থান্বেষণে বিদেশির পদলেহন ও অন্ধানুকরণ, কিন্তু যেখানে সে মহৎ সেটা প্রচলিত ধর্মের দোহাই দিয়ে বর্জন, বসরের পর বৎসর, প্রতি বৎসর রুগণা অর্ধমৃতা স্ত্রীকে গর্ভদান করে তার কাতর রোদন অনুনয়-বিনয় পদদলিত করে তাকে অবশ্যম্ভাবী অকালমৃত্যুর দিকে বিতাড়ন এবং সঙ্গে সঙ্গে সমাজে, ধর্মসভায় সচ্চরিত্র সজ্জন খ্যাতি অর্জন (বলা বাহুল্য চিকিৎসক হিসেবে ঠিক এই ট্র্যাজেডি তার সামনে এসেছে বহু, বহুবার), গণিকালয় থেকে একাধিকবার বিবিধ মারাত্মক ব্যাধি আহরণ করে নিরপরাধ অর্ধাঙ্গিনীর শিরায় শিরায় সেই বিষ সংক্রামণ, একবার একটিমাত্র ভুল করার জন্য অনুতপ্তা রমণীকে ব্ল্যাকমেল করে তাকে পুনঃপুন ব্যভিচার করাতে বাধ্যকরণ–

হে ভগবান! এ যে অফুরন্ত ফর্দ! কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বনবিহারীর সিকি পরিমাণ প্রকাশিত– অপ্রকাশিতের হিসাব নিচ্ছিনে এবং অধিকাংশ লেখাই যে তিনি ছিঁড়ে ফেলতেন সে-ও বাদ দিচ্ছি– গদ্য পদ্য ব্যঙ্গচিত্র সগ্রহ করে কেউ যদি তার জিহাদের লক্ষ্য বিষয়গুলো সংকলন করেন তবে এ-স্থলে আমার প্রদত্ত নির্ঘণ্টের চেয়ে বহুগুণে বৃহত্তর ও কঠোরতর হবে।

কী নিদারুণ ব্যঙ্গ, বিতৃষ্ণা ও ঘৃণার সঙ্গে তিনি অন্যায় আচরণ, ভণ্ড কাপুরুষতাকে আক্রমণ করতেন সে তার গুণগ্রাহী পাঠকমাত্রই জানেন। ভাষার শাণিত তরবারি তার হাতে বিদ্যুত্বহ্নি বিচ্ছুরণ করত এবং এই মরমিয়া মোলায়েম আ মরি বাঙলা ভাষাও যে কতখানি বহ্নিগর্ভা সে তত্ত্ব উদঘাটিত হত বনবিহারীর অদম্য, নিঃশঙ্ক আঘাতের পর আঘাত থেকে। প্রত্যেক শব্দ প্রত্যেকটি বর্ণ বিশুদ্ধ যুক্তির ওপর দণ্ডায়মান। শাস্ত্র ভাঙতে যখন যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন তখন শাস্ত্রের দোহাইয়ের তো কথাই ওঠে না, তিনি বিজ্ঞানের দোহাইও দিতেন না। কোনওকিছুই অভ্রান্ত নয়, কোনও সত্যই শাশ্বত নয়; অতএব প্রত্যেকটি সমস্যা নতুন করে যাচাই করে দেখতে হবে, এবং এই সাধনা চলবে আমৃত্যু।

ঈশ্বর-বিশ্বাসকে যে তিনি গোড়াতেই আক্রমণ করেছিলেন তার অর্থ এই নয় যে, তিনি এই বিশ্বাস by itself, per se অন্যান্য সংস্কারের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক বলে মনে করতেন। তার ধারণা জন্মেছিল এবং সেটা বিস্তর অনুসন্ধান ও গবেষণা করার পর, যে- এই বাঙলা দেশে যতপ্রকারের সামাজিক, অর্থনৈতিক অন্যায় অবিচার হচ্ছে, যা কিছু নারীর ন্যায্য অধিকার ও পরিপূর্ণ বিকাশের অন্তরায় হচ্ছে আর ধর্মের নামে অনাচার শোষণের তো কথাই নেই– এ সবকিছু হচ্ছে ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে।

যেসব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বনবিহারী লড়াই দিতেন তাদের বিরুদ্ধে কি অন্য বাঙালি লড়েনি? নিশ্চয়ই লড়েছে। বর্ণবৈষম্য, আহারে-বিহারে স্ব স্ব সংকীর্ণ গণ্ডি নির্মাণ, ধর্মের নামে অধর্মচর্চা শাস্ত্রাধিকার থেকে জনগণকে বঞ্চিত করে তাদের কুসংস্কারে নিমজ্জিত রাখা, বিধবা, স্বামী-পরিত্যক্তাকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন থেকে বঞ্চিত করা, ধর্মত্যাগীকে পুনরায় স্বধর্মে প্রত্যাবর্তন করার পথ চিরতরে রুদ্ধ করে দেওয়া ইত্যাকার বহু বহু সংস্কার আচার দূর করার জন্য চৈতন্য সংগ্রাম দেন ও সর্বজনীন বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেন। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ এঁরা এবং আরও অনেকে মূঢ়তা, কুসংস্কার ও একাধিক পাপাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। এঁদের তুলনায় বনবিহারীকে চেনে কে?

কারণ বনবিহারী অন্য পন্থা অবলম্বন করেছিলেন।

প্রাগুক্ত সকলেই দেশ-দশকে পাপচিন্তা-পাপাচার থেকে মুক্ত করার জন্য শাস্ত্রের অর্থাৎ ধর্মের শরণ নিয়েছেন। বনবিহারী মানবিকতার শরণ নেন। প্রচলিত ধর্মও তাঁর শত্রু। একমাত্র ধর্মের moral, ethical যেটুকু পরীক্ষা-নিরীক্ষার ধোপে টেকে সেইটুকু গ্রহণ করা যেতে পারে।

বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে একখানা চিঠিতে যা লেখেন তার নির্যাস ছিল এই, শাস্ত্র মেনে হিন্দু তার সামাজিক জীবনযাপন করে না। সে মানে লোকাঁচার, দেশাচার। বিদ্যাসাগর যদি সর্বশাস্ত্র দিয়েও দ্ব্যর্থহীন নিরঙ্কুশ সপ্রমাণ করেন যে, বিধবা-বিবাহ শাস্ত্রসম্মত, শাস্ত্ৰসিদ্ধ তবু হিন্দু সে-মীমাংসা গ্রাহ্য না করে আপন লোকাঁচার দেশাচার আগেরই মতো মেনে নিয়ে বিধবার বিয়ে দেবে না। অতএব বিদ্যাসাগরের উচিত যুক্তি ন্যায় ও মানবিকতার (এই ধরনেরই কিছু, আমার সঠিক মনে নেই, তবে মোদ্দা– Reason-এর ওপর নির্ভর করা, শাস্ত্রের ওপর না করে) ওপর নির্ভর করা।

বিদ্যাসাগর উত্তরে কী লিখেছিলেন, আদৌ উত্তর দিয়েছিলেন কি না সেটা বহু অনুসন্ধান করেও আমি খুঁজে পাইনি। কিন্তু তিনি যে বঙ্কিমের উপদেশ গ্রহণ করেননি, সেকথা কারও অবিদিত নেই। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, শাস্ত্রের সাহায্যে হয়তো-বা কিছু কার্যোদ্ধার হবে, যুক্তিতর্ক দিয়ে কিছুই হবে না। বিদ্যাসাগর আপন দেশবাসীকে বিলক্ষণ চিনতেন।

অতএব প্রাগুক্ত রামমোহনাদি সকলেই লুথার জাতীয় সমাজ ও ধর্মসংস্কারক। যে বাইবেল পোপ মানেন, খ্রিস্টান মাত্রই মানে সেই বাইবেল দিয়েই তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন যে, প্রত্যেক মানুষেরই বিধিদত্ত অধিকার আছে– আপন বুদ্ধি অনুযায়ী বাইবেল থেকে বাণী গ্রহণ করে আপন জীবন চালনা করার; চিরন্তন, অভ্রান্ত কোনও পোপকে স্বীকার করার প্রয়োজন নেই। তলস্তয়, গাঁধী এই সম্প্রদায়ের।

ভলতেয়ার এ পথ স্বীকার করেননি। তিনি নির্ভর করেছিলেন যুক্তি (রিজন), শুভবুদ্ধি (মোটামুটি কমনসেন্স), মানবতা ও ইতিহাসের শিক্ষার ওপর। তাঁর কমনসেন্স ও ইতিহাসের ওপর বরাত মানার একটা উদাহরণ দিই। দক্ষিণ ভারতের হিন্দুরা ধর্মান্ধ হয়ে যে প্রথম খ্রিস্টান মিশনারি সিন টমাসকে আক্রমণ করে হত্যা করেছিল বা পশ্চাদ্ধাবিত হলে পর তিনি গুহাগহ্বরে বিলীন হয়ে যান, সেই কিংবদন্তি অস্বীকার করে আলোচনা করতে গিয়ে ব্যঙ্গের সুরে ভলতেয়ার বলছেন, যে হিন্দুর পরধর্মে সহিষ্ণুতা সম্বন্ধে আমরা বহুকাল ধরে বহু পর্যটকের কাছ থেকে শুনে আসছি, সেইটে হঠাৎ অবিশ্বাস করতে কাণ্ডজ্ঞানে (কমনসেনসে) বাধে। এদেশের বনবিহারী ভলতেয়ার কিন্তু তিনি ভলতেয়ারের শিষ্য নন।

তবে জনসাধারণ বনবিহারীকে চেনে না কেন? তার সর্বপ্রধান কারণ, বনবিহারী নিজেকে কখনও সংস্কারক, যুগান্তকারী মহাপুরুষরূপে দেখেননি। হয়তো তিনি ভাবতেন, উচ্চাসনে দণ্ডায়মান হয়ে অনলবর্ষী ভাষণের সাহায্যে জনসাধারণকে উত্তেজিত করে, কিংবা ভাবালুতার বন্যায় দেশকে ভাসিয়ে দিয়ে কোনও দীর্ঘস্থায়ী সুদৃঢ় পরিবর্তন আনা যায় না। কিংবা হয়তো স্বভাবসিদ্ধ আন্তরিক বিনয়বশত (সামান্য পরিচয়ের নসিকে লোক ভাবত, তাঁর মতো দম্ভী গর্বী ত্রিসংসারে বিরল– বিশেষত লোকটা যখন স্বয়ং ঈশ্বরকে তার যুগযুগাধিকৃত স্বর্গীয় সিংহাসন থেকে সরাতে চায়!) তিনি পেডেস্টেলে আরোহণ করতে চাইতেন না, কিংবা হয়তো তিনি নৈরাশ্যবাদী ছিলেন। তা সে যা-হোক, আমরা যে তার মতো কিংবা তার চেয়েও শক্তিশালী লোকের জন্য এখনও প্রস্তুত হইনি সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ।

কিন্তু কেন?

বনবিহারী তো এমন কিছু নতুন কথা বলেননি যা ভারতে কেউ কখনও বলেনি। স্থির হয়ে একটু ভাবলেই ধরা পড়বে ভারতবর্ষের চিন্তা-জগৎ (ধর্ম-শাস্ত্ৰ-নীতি-আচার-ঐতিহ্য-কলা জ্ঞানবিজ্ঞান) কী দিয়ে গড়া।

১। সনাতন হিন্দুধর্ম ২। বৌদ্ধধর্ম ৩। জৈনধর্ম ৪। দর্শনের মধ্যে নিরীশ্বর সাংখ্য ৫। চার্বাক প্রভৃতি লোকায়ত মতবাদ।

প্রথমটি বাদ দিলে বাকি চারটি চিন্তাধারাতেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বার বার সাবধান-বাণী প্রচারিত হয়েছে, তোমার সুখ-শান্তি, তোমার পরমাগতি সম্পূর্ণ তোমারই হাতে; দৃশ্য এবং অদৃশ্য কোনও লোকেই এমন কোনও অলৌকিক শক্তি নেই যে তোমাকে কোনওপ্রকারে কণামাত্র সাহায্য করতে পারে। এই চিন্তাধারা আদৌ অর্বাচীন নয়। বৈদিক যুগে দেবদেবীদের উদ্দেশে যখন যাগযজ্ঞহোমপশুবলি সর্বত্র স্বীকৃত, ঋষিকবিগণ যখন তাঁদের উদ্দেশে সবিস্ময়ে অপৌরুষেয় মন্ত্র উচ্চারণ করছেন, তখন তার সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পাচ্ছি আরেকটি দ্বিধাজড়িত কণ্ঠ, আরেক সত্যান্বেষী প্রশ্ন জিগ্যেস করছেন– ধন্য হোক সে প্রশ্ন, ধন্য হোক তার জন্মলগ্ন– তা হলে কোন দেবতাকে আমি স্বীকার করব? এই প্রশ্ন থেকেই আরম্ভ হল, চরম সত্যের আলটিমেট রিয়েলিটির অনুসন্ধান। এই প্রশ্নের দুটি উত্তর পাওয়া যাচ্ছে পরবর্তী আরণ্যক-উপনিষদের যুগে বেদান্তের মূল সূত্র সবকিছুই ব্ৰহ্ম, এই তিন ভুবন আনন্দময় ব্রহ্ম থেকে উদ্ভূত। দ্বিতীয় সম্পূর্ণ বিপরীত উত্তর জন্ম নেয় ওই সময়েই, হয়তো তার পূর্বেই, সবল কণ্ঠে ধ্বনিত হয় লোকায়ত মতবাদে এবং তারও পরে তীর্থঙ্করদের কণ্ঠে, বুদ্ধদেবের কণ্ঠে– দেবদেবীতে পরিপূর্ণ অনাস্থা প্রকাশ করে মানুষকে সৃষ্টির কেন্দ্ররূপে স্বীকার করা। এরই চরম বিকৃতরূপ– চার্বাকের মতবাদ, যে মতবাদ নৈতিক দায়িত্বে পর্যন্ত বিশ্বাস করে না।

বৌদ্ধধর্ম এ-দেশ থেকে লোপ পেয়েছে, কিন্তু সে মতবাদ সম্পূর্ণ বহিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। তর্কযুদ্ধে পরাজিত কোনও এক সাংখ্যতীর্থ বোধহয় বৌদ্ধবৈরী শঙ্করাচার্য সম্বন্ধে বক্রোক্তি করেছিলেন, বৌদ্ধদর্শনের সঙ্গে সে এতখানি সন্ধি করেছে যে, সে মতবাদ আত্মসাৎ করতে তার বাধেনি, তাকে প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ বলব না, তবে কী বলব?

আর নিরীশ্বর জৈনরা তো, এখনও ভারতবর্ষে বাস করেন।

নিরীশ্বর সাংখ্যের চর্চা করেন এখনও বহু পণ্ডিত : যাঁদের মতে ঈশ্বর প্রমাণাভাবে অসিদ্ধ।

নৈয়ায়িকরা কোন পন্থায়?

এবং এদেশের সহজিয়ারা সৃষ্টিকেন্দ্র করেছেন মানুষকে : সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।

পূর্বেই বলেছি, বনবিহারী ভলতেয়ারের শিষ্য নন। তিনি ভলতেয়ারের শিষ্য এ-কথা তাঁর সামনে বললে তিনি নিশ্চয়ই তেড়ে আসতেন। অবশ্যই বলতেন, ভলতেয়ার যদি দেখেন যে তার মতবাদ আমার মতবাদের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে তবে তিনি গর্ব অনুভব করতে পারেন; আমার তাতে কী? আবার তাঁকে যদি বলা হত, তিনি ঐতিহ্যগত বৌদ্ধ-জৈন-সাংখ্য দর্শন প্রচার করছেন তবে তিনি নিশ্চয়ই আরও মারমুখো হতেন। নিশ্চয়ই বলতেন, চুলোয় যাক্ (জাহান্নমে যাক, নিশ্চয়ই বলতেন না, কারণ যে জায়গা নেই, সেখানে কোনও মতবাদকে পাঠিয়ে বনবিহারী অবশ্যই সন্তুষ্ট হতেন না!) তোমার সাংখ্য জৈন মতবাদ; পিছন পানে তাকাও কেন? নিজের বুদ্ধি, নিজের যুক্তি, নিজের রেশনালিটির ওপর নির্ভর করতে পার না? কপিল-জীনের ঠ্যাকনা ছাড়া বুঝি দাঁড়ানো যায় না? তুমি আছ, আমি আছি– ব্যস। আমরা বের করে নেব ন্যায় আচরণ কী? আর রাগ কোরও না, আমি আমারটা বহুপূর্বেই একাই বের করে নিয়েছি।

ডন কুইকসটের সঙ্গে বনবিহারীর মাত্র একটা বিষয়ে পার্থক্য। বিস্তর মধ্যযুগীয় রোমান্টিক কাহিনী পড়ে পড়ে ডনের মাথা গরম হয়ে যায়। তিনি ভাবলেন তিনি সে যুগের শিভালরাস্ নাইটদের একজন। ব্যস, আর যাবে কোথায়। দিগ্বিদিক-জ্ঞানশূন্য হয়ে একাকী, সম্পূর্ণ একা তিনি খোলা তলওয়ার হাতে আক্রমণ করলেন জলযন্ত্রকে (উইন্ডমিলকে)।

তারও বহু পরে যিনি এ-যুগের সর্বশেষ নাটক বলে নিজেকে প্রচার করেন তিনি ফিল্ড মার্শাল হেরমান গ্যেরি নর্নবের্গ মোকদ্দমায়। তাঁর কৃতিত্ব : জর্মনিতে তিনিই সর্বপ্রথম কনট্রেশন ক্যাম্প স্থাপনা করেন (অবশ্য তার বহু পূর্বে ইংরেজ করেছিল বোয়ার-যুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকায়) এবং আইষমানের ইহুদিহননে তার সম্মতি ছিল। নিহত ইহুদিদের ভিতর লক্ষাধিক কুমারী কন্যাও ছিল।

বনবিহারী কপিল-জীন-চার্বাক পড়ে পড়ে ডনের মতো মাথা গরম করেননি। ধীরস্থির মনে চিন্তা করে, মীমাংসায় পৌঁছে তিনি আক্রমণ করলেন বঙ্গদেশের জগদ্দল জাড্যকে। এখনও তার মাথা কতখানি ঠাণ্ডা সেটা বোঝা যায় এর থেকে যে, তখনও তার ঠোঁটে হাস্য-ব্যঙ্গ-রস– তাঁর নব-প্রকাশিত নাস্তিক্য প্রচারকামী পত্রিকা বেপরোয়ার (বাঙলা দেশে

এ ধরনের কাগজ বোধহয় এই প্রথম আর এই শেষ) প্রথম সংখ্যায় প্রথম war song-এ তিনি বললেন,

টুলবো না কো অনুস্বার আর বিসর্গের
ঐ ছররাতে
কিংবা দেখে টিকির খাড়া সঙ্গীন!

সে পত্রিকায় কী না থাকত? ধর্ম, দর্শন, নীতিশাস্ত্র থেকে আরম্ভ করে সাহিত্য, চিত্র– এস্তেক পদিপিসির মাদুলি, হচি-টিকটিকি। এর পূর্বে তিনি ভারতবর্ষে ব্যঙ্গচিত্রসহ বঙ্গজীবনবৈচিত্র্য তাবলো পদ্ধতিতে প্রকাশ করেছেন : তার একটি ছিল কেরানি– লোলচর্ম অস্থিসার জীর্ণবেশ রুক্ষ-কেশ কেরানির ছবির নিচে ছিল–

চাকরি গেল, চাকরি গেল, চাকরি রাখা
বিষম দায়
ঐ গো, বুঝি নটা বাজে, ওই গো বুঝি
চাকরি যায়।
বিজলি-বাতির ফানুস হেন ঠুনকো
মোদের চাকরি ভাই!
ফট করে সে ফাটে, কিন্তু ফাটার শব্দে
চমকে যাই।

সর্বশেষে কেরানি যেন বৈদ্যগুরু, কবিরাজ, ডাক্তার, মহামান্য শ্ৰীযুত বনবিহারী মুখোপাধ্যায়কেই ব্যঙ্গ করে বলছে (উইথ ও টুইস্টেড আইরিশ স্মাইল)–

ভরা পেটে ছুটতে মানা? চিবিয়ে খাওয়া স্বাস্থ্যকর?
চাকরি আগে বাচাই দাদা, প্রাণ বাঁচানো সে তার পর।

রবীন্দ্রসৃষ্টির সঙ্গে আমি ঈষৎ পরিচিত। রবীন্দ্ররসিকদের রচনা আমি পড়েছি। অধুনা রবীন্দ্ৰায়ণও (অত্যুকৃষ্ট প্রবন্ধ সংকলন, তদুপরি অতুলনীয় সম্পাদন) অধ্যয়ন করেছি। তার পরও বলব, মুক্তকণ্ঠে বলব, বনবিহারীর মতো রবীন্দ্রসৃষ্টির চৌকস সমঝদার আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি। তাই আজ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের যেসব বিরুদ্ধ সমালোচনা বেরিয়েছে, তার মধ্যে বনবিহারীর সমালোচনাই সর্বোকৃষ্ট। পক্ষান্তরে রবীন্দ্রনাথের অন্য সমালোচকদের প্রতি তিনি ছিলেন হাড়ে হাড়ে চটা। বিরক্তি ভরা কণ্ঠে বলতেন, রসসৃষ্টির পথে যত সব অবান্তর বস্তু নিয়ে বর্বস্য শক্তিক্ষয়! রবীন্দ্রনাথ নাকি নগ্ন যৌনের অশ্লীল ছবি আঁকেন– তা তিনি আঁকেননি। আর যদি আঁকেনই বা, তাতেই-বা কী? এসব তো সম্পূর্ণ অবান্তর- রসসৃষ্টি হলেই হল! রবীন্দ্রনাথের রূপক নাকি অস্পষ্ট! তা হলে চশমা নাও– ওঁকে দোষ দিচ্ছ কেন?

তার পর বুঝিয়ে বলতেন, দে আর অল বার্কিং আপ দি রং ট্রি–অর্থাৎ বেড়ালটা উঠেছে একটা গাছে, আর কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করছে অন্য গাছের গোড়ায়।

সত্যেন দত্তকে আজকের দিনে তোক আর স্মরণে আনেন না; অথচ তিনি যখন সবে আসরে নেমেছেন, সেই সময় থেকেই বনবিহারী তার প্রশংসা গেয়েছেন। সেই সত্যেন দত্তই যখন এই শতাব্দীর দ্বিতীয় শতকে মাঝে মাঝে অনুপ্রাস ও ছন্দের ম্যাজিকের (জাগলারি) কেরদানি দেখাতেন, তখন বনবিহারী অতিষ্ঠ হয়ে বেপরোয়াতে অপ্রিয় সমালোচনা করেন। আমরা তখন তাকে বলি, এগুলো নিছক এক্সপেরিমেন্ট জাতীয় জিনিস; আপনি অত সিরিয়াসলি নিচ্ছেন কেন? আরেক টিপ নস্য নিয়ে– এইটাই ছিল তাঁর একমাত্র বদঅভ্যাস, আর ওই করে করে করেছিলেন তাঁর কণ্ঠস্বরের সর্বনাশ বললেন, তা হলে ছাপানো কেন? যে প্রচেষ্টা রসের পর্যায়ে ওঠেনি সেটা প্রকাশ করে বিড়ম্বিত হওয়ার কী প্রয়োজন?

দ্বিজেন্দ্রনাথের পৌত্র, রবীন্দ্রনাথের গানের ভাণ্ডারি দিনেন্দ্রনাথও বলতেন,

শতং বদ
মা লিখো
শতং লিখো
মা ছাপো।

***

আরও বহু স্মৃতি বার বার মনে উদয় হচ্ছে। একদা দুরারোগ্য রোগের অসহ্য যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পাবার পথ তিনি আমাকে দেখিয়ে দেন। রিটায়ার করার বহু পরে তিনি একবার কলকাতায় এসে কী করে খবর পান আমি অসুস্থ। বিশ বছর ধরে আমাদের দেখাসাক্ষাৎ নেই। তিনি খবর পাঠালেন। সব শুনে বললেন, এ রোগ সারে না– তবু তুমি পরেশ চক্রবর্তীর কাছে যাও। আমি বহু ছেলে পড়িয়েছি– সব ব্ল্যাঙ্কো। ওই একটি ছেলের আক্কেলবুদ্ধি ছিল। বিলেত থেকে ও নিয়ে এসেছে এ টু জেড বিস্তর ডিগ্রি। আমি তার কাছে গেলে সে ডাক্তার বলেন, শুরু এই প্রথম আমাকে একটি রোগী পাঠালেন। কী বলেছেন উনি? এ রোগ সারে না? না, সারে। তিনি আমাকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে দিয়েছিলেন। এক্সপেরিমেন্ট করে করে নয়। প্রথম ওষুধ দিয়েই। কিন্তু সে আরেক কাহিনী। এবং সবচেয়ে সন্তাপের কথা, এই কৃতবিদ্য চিকিৎসক অল্প বয়সে গত হন।

***

৫ জুলাই বনবিহারী পঞ্চভূতে লীন হন।

সাহিত্যিকশ্রেষ্ঠ বনফুল তার সম্বন্ধে দেশ পত্রিকার ১৫ই শ্রাবণ সংখ্যায় অতি অল্প কয়েকটি কথা বলেছেন, কিন্তু হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে, এবং তার প্রত্যেকটি শব্দ যেন আমার বুকের উপর হাতুড়ি পিটছে। আমি এই নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে যা প্রকাশ করতে সক্ষম হইনি, তিনি অল্প কথাতেই সেটি মূর্তমান করেছেন।

বঙ্গ সাহিত্য-ভাণ্ডারে তাঁর (বনবিহারীর) দান চিরকাল অম্লান হয়ে থাকবে। রাজনৈতিক সামাজিক কোনও অন্যায়ের সঙ্গে কখনও তিনি রফা করেননি। অনবদ্য তীক্ষ্ণ ভঙ্গিতে সে-সবের বিরুদ্ধে সাহিত্যিক প্রতিবাদ তিনি করে গেছেন। সেকালের ভারতবর্ষ, বঙ্গবাণী, শনিবারের চিঠি, বেপরোয়া প্রভৃতি সাময়িক পত্রিকাগুলির পৃষ্ঠায় তাঁর কীর্তি এখনও মণি-মুক্তার মতো ঝলমল করছে। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অনমনীয় দুর্বার প্রকৃতির লোক। কখনও কারও অন্যায় সহ্য করতে পারেননি। সুতরাং কারও সঙ্গে তিনি মানিয়ে চলতে পারেননি, কারও সঙ্গে তার বনেনি। এজন্যে শেষ জীবনে প্রায় একা একা নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতে হয়েছে তাঁকে। অতিশয় বিচক্ষণ চিকিৎসক ছিলেন। সিভিল সার্জন হয়ে বগুড়া থেকে রিটায়ার করেন।… পৃথিবীতে নিখুঁত মানুষ নেই, নিখুঁত মানুষের সন্ধানেই তাঁর সারা জীবন কেটেছে। কিন্তু কোথাও সে মানুষ পাননি। নিঃসঙ্গ জীবনই কাটাতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর একটি ভাই তাঁকে ছাড়েননি। বন্ধুবিহারীই শেষ পর্যন্ত ছিলেন তার সঙ্গে। শেষে তিনি নিজের ঠিকানাও কাউকে জানাতেন না। গত ৫ জুলাই তিনি মারা গেছেন।

বনফুল তো চেনে বনবিহারীকে। আর এই বনবিহারী নাম সার্থক দিয়েছিলেন তার গুরুজন! জনসমাজে বাস করেও তিনি যেন সারাজীবন বনেই বিহার করলেন।

আমার আর মাত্র দুটি কথা বলার আছে।

বনবিহারী যে হিন্দু-সমাজ ও বাঙালির কঠোর সমালোচনা করে গিয়েছেন তার কারণ এই নয় যে, তিনি এই দুটিকেই পৃথিবীর নিকৃষ্টতম বলে মনে করতেন। তিনি নিজেকে প্রফেট বা রিফর্মার বলে মনে করতেন না। কাজেই বিশ্বভুবনের তাবৎ জাড্য দূর করার ভার আপন স্বন্ধে তিনি তুলে নেননি। এমনকি তার হাতের আলোটিও তিনি উঁচু করে তুলে ধরেননি। সে-আলো তাই পড়েছিল মাত্র তার আশপাশের সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি, সাহিত্যের ওপর। তারই মলিনতাটুকু তিনি দেখিয়ে গিয়েছেন মাত্র। তবুও আমার মনে হয়েছে, তিনি রবীন্দ্রনাথের জ্যাঠামশাই ও রলাঁর জ্যাঁ ক্রিসতফ-এর সমন্বয় কোনও কোনও ক্ষেত্রে। জ্যাঁ ক্রিসতফ বনবিহারীর অন্যতম প্রিয় পুস্তক (ডাক্তার হয়েও সিরিয়াস ডাক্তাররা সাহিত্যচর্চার সময় পান কম– তিনি সম্পূর্ণ নিজের সাধনায় বিশ্বসাহিত্যের কতখানি আয়ত্ত করেছিলেন সেটা বোঝাবার চেষ্টা করব না)।

আজ তিনি জীবিত নেই, তাই বলবার সাহস পাচ্ছি, তিনি বাঙালিকে ভালোবাসতেন। তাঁর জীবিতাবস্থায় একথা বললে তিনি বোধহয় আর আমার মুখ দর্শন করতেন না। বাঙালি বলতে তিনি হিন্দু বিশেষ করে তথাকথিত নিম্নশ্রেণির হিন্দু-মুসলমান, ইলিয়ট রোড অঞ্চলের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, সকলকেই বুঝতেন।

এইবারে আমার শেষ বক্তব্যটি নিবেদন করি। এ কথাটি তার জীবিতাবস্থায় বললে তিনি সুনিশ্চিত রামদা নিয়ে আমার পশ্চাদ্দেশে ধাবমান হতেন।

ইংরেজিতে বলে– মিল্ক অব হিউমেন কাইনেস্।

অনিচ্ছায় বলছি, কিন্তু এস্থলে বলার প্রয়োজন, আমি বিস্তর দেশ-বিদেশ দেখেছি। বহু সমাজসেবী, হাসপাতাল চালক মিশনারি, রেডক্রসের একনিষ্ঠ সেবক কর্মী, সর্বত্যাগী মহাজন, স্তালিনগ্রাদের বিভীষিকাময় রক্তাক্ত রণাঙ্গন-প্রত্যাগত সার্জনকে আমি চিনি। বনবিহারীর হৃদয়ের অতিশয় গোপন কোণে যে ভুবন-জোড়া স্নেহমমতার ভাণ্ডার ছিল– সেরকম তো আর কোথাও দেখলুম না। সেই স্নেহমমতাই তাঁর আপন সুখশান্তি হরণ করেছিল। সেই বেদনাবোধই তাঁকে উত্তেজিত করত খড়গ ধারণ করে অন্যায়, অসত্য, অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে।

এই স্নেহমমতা তিনি এমনই সঙ্গোপনে রেখেছিলেন যে, অধিকাংশ লোকই তাঁর কঠোর ভাষা, তীব্র কণ্ঠ, নির্মম ব্যঙ্গ শুনে বিভ্রান্ত হয়েছে। বনবিহারীর সে জন্য কণামাত্র ক্ষোভ ছিল না। তাঁর সহানুভূতি তিনি রাখতেন আরও গোপন করে।

আমরা বোধহয় অত্যন্ত সহিষ্ণু। কিংবা যথেষ্ট ইতিহাস পড়িনি। নইলে সোক্রাতে খ্রিস্টের জন্য একদা যে ব্যবস্থা করা হয়েছিল বনবিহারীর জন্য সেটা করা হল না কেন?

কিন্তু এই অনুভূতিগত অভিজ্ঞতা গদ্যে প্রকাশ করা যায় না।

বনবিহারীর প্রয়াণ উপলক্ষে বনফুল যে সনেটটি লিখেছেন সেটি উদ্ধৃত করি :

‘বনবিহারী মুখোপাধ্যায়’

পাষাণে আঘাত হানি, অসি তীক্ষ্ণধার চূর্ণ-বিচূর্ণ হল? কঙ্কর কন্টক

জয়ী হল বিক্ষত করিয়া বার বার বলিষ্ঠ পথিক-পদ? ধূর্ত ও বঞ্চক সাধুরে লাঞ্ছিত করি বিজয়-কেতন আস্ফালন করিল আকাশে? অন্ধকার গ্রাসিল কি রবি? না– না– নতি-নিবেদন করি পদে উচ্চকণ্ঠে কহি বারংবার নহে ব্যর্থ, পরাজিত, হে বহ্নি-কমল তমোহন্ত্রী, হে প্রদীপ্ত মশাল-বর্তিকা, অগ্নি তব অনির্বাণ, চির-সমুজ্জ্বল, অনবদ্য অপরূপ ঊর্ধ্বমুখী শিখা। মহাপ্রস্থানের পথে বিগত অর্জুন অস্ত্রাগারে রেখে গেছে শরপূর্ণ তূণ।

কোষ্ঠী-বিচার

আমি তো রেগে টং।

মুসলমান বাড়িতে সচরাচর গণস্কার আসে না, যদিও শুনেছি ঔরঙ্গজেবের মতো গোড়া মুসলমান, হিটলারের মতো কট্টর বিজ্ঞান-বিশ্বাসীরা নাকি রাশিকুণ্ডলী মাঝে-মধ্যে দেখে নিতেন। আমাদের বাড়িতে গণস্কার এসেছিল। তা আসুক। মেয়েরা জটলা পাকিয়েছিল। তা পাকাক। কাউকে রাজরানি, কাউকে রাজেশ্বরী, কাউকে ডাক্তার হওয়ার আশা দিয়ে গিয়েছে তা দিক, তাতেও আমার আপত্তি নেই। আমি রাগে টং হলুম যখন শুনলুম, পাশের বাড়ির আট বছরের মেয়ে মাধুরীলতা, আমার বোনের ক্লাসফ্রেন্ড, সে-ও নাকি এসেছিল এবং গণকার বলেছে, তার কপালে বাল-বৈধব্য আছে।

বাল-বৈধব্য তার কপালে থাকতেও পারে, না-ও থাকতে পারে– আমি জানব কী করে, আর গণকারই-বা জানবে কী করে? আর যদি ধরেও নিই গণষ্কার জানতই, তবে সে বরাহমিহির সেটা বলতে গেল কেন মেয়েটাকে– ওই আট বছরের ফুলের মতো মেয়েটিকে?

এই দৈববাণীর ফল আরম্ভ হল পরের দিন থেকেই।

মাধুরী শুরু করল দুনিয়ার কুল্লে ব্রত-উপবাস, পূজা-পারণা। ইতু, ঘেঁচু হেন দেবতা নেই যে সে খুঁজে খুঁজে বের করে বাড়িতে তার পুজো লাগায়নি। তার বাড়িতে ছিলেন আমাদের দেশে সবচাইতে নামকরা নিষ্ঠাবতী ঠাকুরমা- তিনি পর্যন্ত অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন, মাধুরীর পুজোপাটের ঠেলায়।

এসবের অর্থ অতি সরল। অতিশয় প্রাঞ্জল। মাধুরী ত্রিলোকবাসী সর্বদেব, সর্বমানব, এমনকি সর্ব ভূতপ্রেতকেও প্রসন্ন রাখতে চায়, যাতে করে তারা তাকে বাল-বৈধব্যের হাত থেকে ঠেকিয়ে রাখেন।

কিন্তু মাধুরীর মুখের হাসি শুকিয়ে গিয়েছিল আমার রাগ সেইখানটাতে। তার সর্বচৈতন্যে, সর্ব অস্তিত্বে মাত্র একটি চিন্তা; তাকে আমৃত্যু বাল্য-বৈধব্য বয়ে বেড়াতে হবে। এবং সে নাকি হবে শতায়ু! তার বাপ-ঠাকুরদা তাকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সে তখন শুধু তার ডাগর চোখ দুটি মেলে তাকাত, কোনও কথা বলত না; স্পষ্ট বোঝা যেত আর সান্ত্বনাবাণী, স্তোকবাক্যে, তত্ত্বকথা তার মনের ওপর কোনও দাগ কাটছে না।

মাধুরী তেমন কিছু অসাধারণ সুন্দরী ছিল না। তবে হ্যাঁ, তার চোখ দুটির মতো চোখ আমি আর কোথাও দেখিনি। সেই চোখ দুটিতে তার আট বছর বয়সে যে মধুর হাসি আমি দেখতে পেয়েছিলুম সেটি আর কখনও দেখিনি। তার রঙ ছিল শ্যাম। কিন্তু মাধুর্যে ভরা। তাই সবসময়ই মনে হত, এ মেয়ের নাম মাধুরী সার্থক। সে সুন্দর নয়, মধুর। মধু তো আর গোলাপফুলের মতো দেখতে সুন্দর হয় না।

ষোল বছর বয়সে মাধুরীর বিয়ে হল। কুলীন ঘরের মেয়ে। সে-দিক দিয়ে অন্তত সবাই লুফে নেবে। ছেলেটি বিলেত-ফের্তা ইঞ্জিনিয়ার। মাদ্রাজে কর্ম করে। মাধুরীকে দেখে ওদের বাড়ির সকলেরই পছন্দ হয়েছে। আমি তখন বিদেশে।

আমার বোন মাধুরীকে বড় ভালোবাসত। তাই আমাকে লেখা তার চিঠি ভর্তি থাকত মাধুরীর কথায়। পুজোপাট তার নাকি বিয়ের পর আরও অসম্ভব রকম বেড়ে গিয়েছে। মাদ্রাজে গিয়ে পেয়েছে আরেক নতুন সেট দেবদেবী। ওঁয়ারা তো ছিলেনই, এঁয়ারাও এসে জুটলেন। হ্যাঁ, বলতে ভুলে গিয়েছিলুম, শুক্কুরবারে শুক্কুরবারে মসজিদে শিরনি পাঠাতেও মাধুরীর কামাই যেত না।

বোন লিখেছিল, মাধুরীর স্বামীটি নাকি পয়লা নম্বরের বৈজ্ঞানিক, দেবদ্বিজে আদৌ ভক্তি নেই। মাধুরীর পালপার্বণের ঘটা দেখে সে নাকি রঙ্গ-রস করত, সেই পালপার্বণের আদিখ্যেতার –তার ভাষায়– কারণ শুনে নাকি হাসাহাসি করেছিল তার চেয়েও বেশি। তবে ছেলেটি খানদানি ঘরের ভদ্রছেলে ছিল বলে এসব কথা তুলে মাধুরীর মনে কষ্ট দিতে চাইত না।

কিন্তু মোদ্দা কথা– বোন লিখেছিল মাধুরী সুখী, মাধুরী স্বামী-সোহাগিনী।

যাক। চিঠি পেয়ে ভারি খুশি হলুম।

তার ছ মাস পরে বজ্রাঘাত।

মাদ্রাজে যুদ্ধের সময়, এক্সপ্লোশন না বোমাপাতের ফলে মাধুরীর স্বামী আপিসের চেয়ারের উপরই প্রাণত্যাগ করে।

সেদিন আপিস যাবার সময় সে নাকি মাধুরীকে বলে গিয়েছিল, তোমরা বাঙালিরা বড় ঢিলে। সময়ের কোনও জ্ঞান নেই। আমি বাড়ি ফিরব সাড়ে পাঁচটায়। তোমাকে যেন তৈরি পাই। দশ মিনিটের ভিতরে যেন বেরোতে পারি। সিনেমা তোমার জন্য অপেক্ষা করবে না।

মাধুরী পাঁচটা থেকে তৈরি হয়ে বসে ছিল। কে জানে, কোন্ শাড়িখানা পরেছিল? সেই হলদে রঙেরটা? যেটা আমি তাকে প্রেজেন্ট করেছিলুম ওর রঙের সঙ্গে সুন্দর মানাত বলে? থাক ওসব। মোহনীয়া গল্প শোনাতে আমি আসিনি। সমস্ত ব্যাপারটাই এমনি ট্র্যাজিক যে তার ওপর অলঙ্কার চাপাতে ইচ্ছে করে না।

ছ-টা বাজল সাতটা বাজল করে করে রাত এগারোটা হল। মাধুরী তার স্বামীকে এই প্রথম অনপনকচুয়েল হতে দেখল— এবং এই শেষ।

আর পাঁচজন বাঙালিই প্রথম দুর্ঘটনার খবর পান। তাঁরা রাত এগারোটায় এসে মাধুরীকে খবরটা দেন। সঙ্গে এসেছিলেন মাধুরীর এক বান্ধবী ধর্মে তাঁর বিশ্বাস অবিচল ছিল বলে মাধুরীর সঙ্গে সখ্য হয়। তিনি খবরটা ভাঙেন। কী ভাষায়, সোজাসুজি না আশকথা-পাশপথা পাড়ার পর, জানিনে। তবে শুনেছি, মাধুরী একসঙ্গে এতজন লোককে রাত এগারোটার সময় বাড়িতে আসতে দেখেই কেঁদে উঠেছিল।

মাধুরী কলকাতায় ফিরে এল।

এখানেই শেষ? গণকারের কথাই ফলল? তা-ও নয়।

মাদ্রাজ ছাড়ার পূর্বে মাধুরী তার সখীকে তার কোষাকোষী আর সব পুজোপাটার জিনিসপত্র তার হাতে দিয়ে বলে, সমুদ্রে ডুবিয়ে দিতে। মাধুরী বলেনি কিন্তু সখী বললেন, ও বলতে চেয়েছিল, এত করেও যখন দেবতাদের মন পেলুম না, তখন তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে আমার আর কী হবে? আমার তো অন্য আর কোনও জিনিসের প্রয়োজন নেই।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়।

কলকাতায় ফিরে মাধুরী চাকরি নেয়। বস্তিতে করপরেশনের ইস্কুলে। সেখানে তার বসন্ত হয়। তার বোনঝি– ডাক্তার বলল, ওয়ান বিগ ব্লার্ব করবার কিছু নাই।

সে শতায়ু হয়ে বাল-বৈধব্যের যন্ত্রণা উপভোগ করেনি। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে সে গত হয়। পরোপকারে প্রাণ দেয়। সে জিন্নবাসিনী, অমর্ত্যলোকে অনন্ত স্বামী-সোহাগিনী।

 দু-হারা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে বরোদার বিখ্যাত মহারাজা সয়াজি রাওয়ের কাছে আমি চাকরি নিয়ে যাই। শহরের আকার ও লোকসংখ্যা গুজরাতের অন্যান্য শহরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য নয়, কিন্তু স্বাধীন রাজ্য বলে ছোটখাটো মিউজিয়াম, তোষাখানা, চিড়িয়াখানা, রাজপ্রাসাদ, পালপরবে গাওনা-বাজনা এবং আর পাঁচটা জিনিস ছিল বলে একদিক দিয়ে দেখতে গেলে পাশের ধনী শহর আহমদাবাদের তুলনায় এর আপন বৈশিষ্ট্য ছিল।

আজ আর আমার ঠিক মনে নেই, মহারাজা নিজে মদ না খেলেও তার কটি ছেলে দিবারাত্র বোতল সেবা করে করে বাপ-মায়ের চোখের সামনে মারা যান। ওঁদের মদ খাওয়া বন্ধ করার জন্য কিছুদিনের তরে তিনি তাবৎ বরোদা শহর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ড্রাই করে দেন, কিন্তু তাতেও কোনও ফলোদয় হয়নি। শেষ পর্যন্ত বাকি ছিলেন একমাত্র ধৈর্যশীল রাও। একেও সাদা চোখে বড় একটা দেখা যেত না।

মহারাজার বড় ছেলের ছেলে–তিনিই তখন যুবরাজপ্রতাপসিং রাও-ও প্রচুর মদ্যপান করতেন– এ নিয়ে বুড়ো মহারাজার বড়ই দুঃখ ছিল কিন্তু নাতি তখনও দু কান কাটা হয়ে যাননি। রাজা হওয়ার পর তিনিও সম্পূর্ণ বেসামাল হয়ে গেলেন এবং ভারত স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর তিনি আকাট মূর্খ ইয়ারবক্সির প্ররোচনায় ভারতের সঙ্গে লড়াই করতে চেয়েছিলেন। তিনি গদিচ্যুত হওয়ার পর তার ছেলে ফতেহ্ সিং রাও মহারাজা উপাধি পান– এবং বর্তমান ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে সংযুক্ত বলে অনেকেই তাকে চেনেন। শুনেছি, মানুষ হিসেবে চমৎকার।

কিন্তু এসব অনেক পরের কথা।

বুড়া মহারাজার মদ্যের প্রতি অনীহা ছিল বলে বরোদা শহরে সংযমের পরিচয় পাওয়া যেত– বিশেষ করে যখন অন্যান্য নেটিভ স্টেটে মদ্যপানটাই সবচেয়ে বড় রাজকার্য বলে বিবেচনা করা হত, ও প্রজারাও যখন রাজাদর্শ অনুকরণে পরাজুখ ছিল না।

কিন্তু বুড়া মহারাজা বিস্তর বিলাতফেৰ্তা জোগাড় করেছিলেন বলে প্রায়ই কারও না কারও বাড়িতে পার্টি বসত। দু-এক জায়গায় যে মদ নিয়ে বাড়াবাড়ি হত না, সে কথা বলতে পারিনে। তবে সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করত গৃহকর্তার আপন সংযমের ওপর।

এরই দু-একটা পার্টিতে একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়। ভুল বললুম, পরিচয় হয়। কারণ এরকম স্বল্পভাষী লোক আমি জীবনে কমই দেখেছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি চুপ করে বসে থাকতেন একপাশে, এবং অতিশয় মনোযোগ সহকারে ধীরে ধীরে গেলাসের পর গেলাস নামিয়ে যেতেন। কিন্তু বানচাল হওয়া দূরে থাক, তাঁর চোখের পাতাটিও কখনও নড়তে দেখিনি। আমি জানতুম, ইনি বন্ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বছর দশেক পূর্বে ডক্টরেট পাস করে বরোদায় ফিরে এসে উচ্চতর পদে বহাল হন। আমিও বন্ থেকে বছর তিনেক পূর্বে পাস করে আসি ও তিনি যেসব গুরুর কাছে পড়াশোনা করেছিলেন, আমিও তাদের কয়েকজনের কাছে বিদ্যার্জন করার চেষ্টা করি। আমি তাই আশা করেছিলুম তিনি অন্তত আমার সঙ্গে দু-চারিটি কথা বলবেন–ব বিশ্ববিদ্যালয়, তার সহপাঠী, তার আমার উভয়ের শুরু, রাইন নদী, শহরের চতুর্দিকের বন-নদী-পাহাড়ের পিকনিক নিয়ে তিনি পুরনো দিনের স্মৃতি ঝালাবেন, নিদেন দু-একটা প্রশ্ন জিগ্যেস করবেন। আমি দু-তিনবার চেষ্টা দিয়ে দেখলুম, আমার পক্ষে তিনি বন্ থেকে পাস না করে উত্তর মেরু থেকে পাস করে থাকলে একই ফল হত। সাপের খোলসের মতো তিনি বন শহরের স্মৃতি কোন আঁস্তাকুড়ে নির্বিকার চিত্তে ফেলে এসেছেন। আমি আর তাঁকে ঘাটালুম না।

এরপর কার্যোপলক্ষে আমি এক-আধবার তাঁর দফতরে যাই। এক্ষেত্রেও তদ্বৎ। নিতান্ত প্রয়োজন হলে বলেন ইয়েস, নইলে জিভে ক্লোরোফরম মেখে নিয়ে নিশ্চুপ।

বাড়ি ফিরে এসে তার থিসিসখানা জোগাড় করে নিয়ে পড়লুম। অত্যুকৃষ্ট জর্মনে লেখা। নিশ্চয়ই কোনও জর্মনের সাহায্য নিয়ে। তা সে আমরা সবাই নিয়েছি এবং এখনও সর্ব অজর্মনই নিশ্চয়ই নেয়, কিন্তু ইনি পেয়েছিলেন সত্যকারের জউরির সাহায্য। তবে তিনি এখন কতখানি জর্মন বলতে এবং বুঝতে পড়তে পারেন তার হদিস পেলুম না। কারণ বরোদায় আসে অতি অল্প জর্মন, তারাও আবার ইংরেজি শেখার জন্য তৎপর। তদুপরি তৃতীয় ব্যক্তির সাক্ষাতে দেখা হলে এবং সে যদি জর্মন না জানে তবে তার অজানা ভাষায় কথা বলাটা বেয়াদবিও বটে। এতাবৎ হয়তো তাই শ্ৰীযুত কাণের সামনে জর্মন বলার কোনও অনিবার্য পরিস্থিতি উপস্থিত হয়নি।

এর পরে আরও দু বৎসর কেটে গেছে ওই একইভাবে। তবে ইতোমধ্যে আমার সর্বজ্ঞ বন্ধু পারসি অধ্যাপক সোহরাব ওয়াডিয়া আমাকে বললেন, আপন অন্তরঙ্গ জাতভাইদের সঙ্গে নিভৃতে তিনি নাকি জিভটাতে লুব্রিকেটিং তেল ঢেলে দেন এবং তখন তাঁর কথাবার্তা নাকি flows smoothly like oil. রসনার ওপর অন্যত্র তার সংযম অবিশ্বাস্য।

এই দু বছর কাটার পর আমার হাতে ফোকটে কিঞ্চিৎ অর্থ জমে যায়। দয়াময় জানেন সেটা আমার দোষ নয়। সে যুগে বরোদায় খরচ করতে চাইলেও খরচ করার উপায় ছিল না। ওদিকে জর্মনিতে হিটলারের নাচন-কুদন দেখে অন্তত আমার মনে কোনও সন্দেহ রইল না, তার ওয়াটস্ নাচ এবারে জর্মনির গণ্ডি ছাড়িয়ে বাইরেও গড়াবে। এবং সেটা আকছারই গড়ায় প্রতিবেশী ফ্রান্সের আঙিনায়। দুই দেশেই আমার বিস্তর বন্ধু। এইবেলা তা হলে তাদের শেষ দর্শনে যাই। ১৯১৮ সালে জর্মনরা আকাশ থেকে বোমাবর্ষণ করে ও রণাঙ্গনে গ্যাসও চালায়। এবারে শুরুই হবে ওসব দিয়ে অনেক দূরপাল্লার বোমারু এবং জঙ্গিবিমান নিয়ে, তীব্রতর বিষাক্ত গ্যাস নিয়ে। ধুন্দুমার শেষ হলে আমার কজন বন্ধু যে আস্ত চামড়া নিয়ে বেরিয়ে আসবেন বলা কঠিন।

১৯৩৮-এর গরমিকালে ভেনিস মিলান হয়ে বন্ শহরে পৌঁছলুম। জাহাজে বিশেষ কিছু লক্ষ করবার ফুরসত পাইনি। প্রথমদিনেই আলাপ হয়ে যায় এক ফ্রেঞ্চ ইভোচায়নার তরুণীর সঙ্গে। অপূর্ব সুন্দরী। অপূর্ব বললুম ভেবেচিন্তেই। আমার নিজের বিশ্বাস এবং আমার সে-বিশ্বাসে আমার এক বিশৃপর্যটক বন্ধু সোসাহে সায় দেন– দোআঁসলা রমণীরা সৌন্দর্যে সবসময়ই খাঁটিকে হার মানায়। পার্টিশনের পরের কথা বলতে পারিনে, কিন্তু তার পূর্বে কলকাতার ইলিয়ট রোড, ম্যাকলাউড স্ট্রিটের যে অংশে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সুন্দরীদের হাট বসত- খারাপ অর্থে নেবেন না– সেরকমটা আমি প্যারিস-ভিয়েনা কোথাও দেখিনি।

কিন্তু এ তো গেল আর্যে আর্যে সংমিশ্রণ। কিন্তু ইভোচায়নায় ফ্রেঞ্চ আর্য রক্ত ও চীনা মঙ্গোলিয়ান রক্তে সংমিশ্রণ। এ জিনিস আমার কাছে অপূর্ব বলে মনে হয়েছিল। শুধু আমার কাছে নয়, অন্য অনেকেরই কাছে। কিন্তু হলে কী হয়, পানির দেবতা বদর পীর আমার প্রতি বড্ডই মেহেরবানি ধরেন– সপত্নদের কেউই একবর্ণ ফরাসি বলতে পারেন না। আমি যে অত্যুত্তম ফরাসি বলতে পারি তা-ও নয়। কিন্তু কথায় আছে, শয়তানও বিপদে পড়লে মাছি ধরে ধরে খায়। তরুণী যাবেন কোথায়! জাহাজে অবশ্য দু-একটি পাড় টুরিস্ট ছিলেন যারা ফরাসি জানেন, কিন্তু পাড় টুরিস্ট হতে সময় লাগে– বয়সটা ততদিন কিছু চুপ করে দাঁড়িয়ে যাত্রাগান দেখে না– পাঁড় টুরিস্ট হয় বুড়ো-হাবড়া। ওদিকে সুভাষিত আছে, বৃদ্ধার আলিঙ্গন অপেক্ষা তরুণীর পদাঘাত শ্রেয়।

প্রবাদটা উল্টো দিক থেকেও আকছারই খাটে। আমার তখন তরুণ বয়স, তদুপরি আমি বাঙলা দেশের লোক গায়ে বেশ কিছুটা চীনা-মঙ্গোল রক্ত আছে। তরুণীর সেটা ভারি পছন্দ হয়েছে– বলতেও কসুর করলেন না।

আমার তখন এমনই অবস্থা যে ওঁর সঙ্গে পৃথিবীর অন্য প্রান্ত অবধি যেতে পারি। অবশ্য জানি, পৃথিবীটা গোল আবার মোকামে ফিরে আসব নিশ্চয়ই, এই যা ভরসা।

ভেনিস পৌঁছে জানা গেল, এ জাহাজ পৃথিবীর অন্য প্রান্ত অবধি যায় না। ইনি শুধু মাকু মারেন ইতালি ও বোম্বাইয়ের মধ্যিখানে। আমাদের মধ্যে প্রেম হয়েছিল গভীর, কিন্তু ব্যাডমিন্টনের শাটল কক্ হতে যতখানি প্রেমের প্রয়োজন ততখানি তখনও হয়ে ওঠেনি। আসলে সবকিছু ভণ্ডুল হয়ে গিয়েছিল সফরটা তেরো দিনের ছিল বলে। তেরো সংখ্যাটা অপয়া। বারো কিংবা চোদ্দ দিনের হলে হয়তো একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যেত। ভেনিস বন্দরে সজল নয়নে আমরা একে অন্যের কাছ থেকে বিদায় নিলুম। আমার যেসব সপত্নরা (আজকের দিনের ভাষায় পুংসতীন) ফরাসি জানত না বলে বিফল মনোরথ হয়েছিল তাদের মুখে পরিতৃপ্তির স্মিতহাস্য ফুটে উঠেছিল। বিদ্যেসাগর মশাই নাকি মানুষের মুখে হাসি ফোঁটাতে পারলে উল্লাস বোধ করতেন; জানিনে তিনি কখনও এমন হাসি দেখেছেন কি না যেটা দেখলে মানুষের মাথায় খুন চাপে।

ব্রেন্নার পাস, অস্ট্রিয়া হয়ে জর্মনিতে ঢুকলুম। বন শহরে পৌঁছলুম সন্ধ্যার সময়।

বন প্রাচীন দিনের গলি-খুঁচির শহর। একে আমি আপন হাতের উল্টো পিঠের চেয়েও ভালো করে চিনি। মালপত্র হোটেলে নামিয়ে বেরিয়ে পড়লুম প্রাচীন দিনের সন্ধানে।

ওই তো সামনে হাসে রেস্তোরাঁ। দেখি তো, আমার দোস্ত বুড়ো ওয়েটার হাস্ এখনও টিকে আছে কি না। যেই না ঢোকা, হাসের সঙ্গে প্রায় হেড-অন্ কলিশন। বুড়ো হাস্ বাজিকর। দু হাতে সে একসঙ্গে পাঁচ প্লেট দু হাতে চার প্লেট, পঞ্চমটা এই চারটের মধ্যিখানে, উপরে সুপ রান্নাঘর থেকে খাবারঘরে তার চির প্রচলিত পদ্ধতিতে নিয়ে আসছিল। কোনওগতিকে সামলে নিয়ে হুঙ্কার দিল, ওই রে, আবার এসেছে সেই কালো শয়তানটা! আমি বললুম, তোর জান নিতে। হিটলার তোর জান নেবে–তুই ইহুদি! দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে সেই লোকটার কথা ভাবলুম, যে দুঃখ করে বলেছিল, হায় মা, টাক তো দিলি, কিন্তু ক-এর সঙ্গে আকারটা দিতে ভুলে গেলি। আমি বললুম, ইহুদির কালো চুল দিলি, মা, কিন্তু তার পকেটের রেস্তটা দিতে ভুলে গেলি। হামৃকে শুধালুম, তোমার ডিউটি কটা অবধি? ন-টা। তা হলে কাইজার কার্লে এসো ন-টায়। কেন? আমেরিকার পয়সাওলা কাকা মারা গেছে নাকি? না, কোলারে। সে আবার কোথায়? ভারতবর্ষে সোনার খনি। ওহ! তা হলে একটা গোল্ড-ডিগার সঙ্গে নিয়ে আসব।

গোল্ড-ডিগার মানে যেসব খাবসুরৎ মেয়ে প্রেমের অভিনয় করে আপনার মনি-ব্যাগটি ফাঁকা করতে সাহায্য করে। আপনারই উপকারার্থে। পোকা লাগার ভয়ে সেটাতে বাতাস খেলাতে চায়।

গোরস্তানে ঢুকলে আমরা চেনা লোকের গোরের সন্ধান করি; অচেনা লাইব্রেরিতে ঢুকলে চেনা লেখকের বই আছে কি না তারই সন্ধান করি প্রথম। বন্ শহর নতুনত্ব অত্যন্ত অপছন্দ করে; তৎসত্ত্বেও দু-চারটে নতুন রেস্তোরাঁ কাফে জন্ম নিয়েছে। সেগুলো তদারক করার কণামাত্র কৌতূহল অনুভব করলুম না। কে বলে মানুষ নতুনত্ব চায়?

কুকুর যেরকম পথ হারিয়ে ফেললে আপন গন্ধ এঁকে এঁকে বাড়ি ফেরে, আমিও ঠিক তেমনি সাত দিন ধরে আজ ভেন্‌সবের্গ, কাল গোডেসবের্গ, পরশু জীবেনগেবের্গে, পরের দিন রাইনে লঞ্চ-বিহার করে করে আপন প্রাচীন দিনের গন্ধ খুঁজে খুঁজে কাটালুম; আর শহরের ভিতরকার গলি-ঘুচির রেস্তোরাঁ-বারের তো কথাই নেই।

অষ্টম দিনে ডুসলডর্কে আমার প্রাচীন দিনের সতীর্থ পাউলকে ট্রাঙ্ক করলুম। প্রথমটায় সে একচোট গালাগালি দিল আমি কেন আগে জানাইনি। আমি বললুম, কেন? বেতার তো আমার টুরের খবর প্রতিদিন বুলেটিনে ঝাড়ছে।

শুধাল, কোন্ বেতার? দক্ষিণ মেরুর?

না, কন্সানট্রেশন ক্যাম্পের।

এই! চুপ চুপ!

না রে না, ভয় পাসনি। তোদের ফুরারের সঙ্গে আমাদের এখন খুব দোস্তি। তিনি গোপনে আমাদের দু-একজন বেসরকারি নেতাকে শুধিয়েছেন, তিনি যদি ব্রিটেন আক্রমণ করেন তবে ভারতীয়েরা তার মোক নিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে কি না।

থাক্ থাক্। আজ সন্ধ্যায় দেখা হবে।

অমি বললুম, হাইল হিটলার।

রিসিভার রাখার এক মিনিট যেতে না যেতে টেলিফোন বাজল। রিসিভার তুললুম। অপর প্রান্ত থেকে অনুরোধ এল বামাকণ্ঠে, আমি কি ডক্টর সায়েডের সঙ্গে কথা বলতে পারি?

কথা বলছি।

আমি ট্রাঙ্ককল দফতর থেকে কথা বলছি। খানিকক্ষণ আগে আপনি ডুসলডর্ফে ট্রাঙ্ককল করেছিলেন না?

সর্বনাশ! পাউলের ভয় তা হলে অমূলক নয়। নিশ্চয়ই নাৎসি স্পাই। আমাদের কথাবার্তা ট্যাপ করেছে। ক্ষীণকণ্ঠে বললুম, হ্যাঁ।

আপনি ইন্ডিয়ান?

কী করে—

না, না, মাফ করবেন আপনার জর্মন উচ্চারণ খুবই খাঁটি, কিন্তু কি জানেন, আমি ট্রাঙ্ককল একচেঞ্জে কাজ করি বলে নানান দেশের নানান ভাষা নানান উচ্চারণের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয়। শুধু কণ্ঠস্বর নিয়ে সবকিছু বুঝতে হয় বলে অল্প দিনের ভিতরেই এ জিনিসটা আমাদের আয়ত্ত হয়ে যায়।

আশ্চর্য নয়। মানুষ তার মাতৃভাষার বৈশিষ্ট্য বিদেশি ভাষা বলার সময় আপন অজান্তে প্রকাশ করে ফেলে আর ওকিবহাল ব্যক্তি সেটা ধরে ফেলতে পারেন। শুনেছি লন্ডনের কোন এক আর্ট একাডেমির অধ্যক্ষ যে কোনও ছবি দেখেই বলে দিতে পারতেন, কোন দেশের লোক এটা একেছে। একই মডেল দেখে দেড়শোটি ছেলে স্কেচ করেছে; তিনি দিব্য বলতে পারতেন, কোনটা ইংরেজের, কোনটা চীনার, আর কোনটা ভারতীয়ের। এবং যদিও মডেলের মেয়েটি ইংরেজ তবু সবচাইতে ভালো এঁকেছে ইন্ডিয়ান। মনকে এরই স্মরণে সান্তনা দিলুম, তবে বোধহয় আমার জর্মন উচ্চারণ জর্মনদের চেয়েও ভালো।

অনেক ইতিউতি করে নারীকণ্ঠ বলল, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আমি বার বার ক্ষমা চাইছি, আমি কি পাঁচ মিনিটের জন্য আপনার দর্শন পেতে পারি? আমার একটু দরকার আছে। সেটা কিন্তু জরুরি নয়; আপনার যেদিন যখন সুবিধে হয়।

তাড়াতাড়ি বললুম, পাঁচ মিনিট কেন– পাঁচ ঘণ্টা নিন। আমি এখানে ছুটিতে। দিন ক্ষণ আপনিই ঠিক করুন।

কাল হবে? আমার ডিউটি বিকেল পাঁচটা অবধি। আপনার হোটেলের পাশেই তো কাফে হুশ্লাগ। সেখানে সাড়ে পাঁচটায়? আমি আপনাকে ঠিক চিনে নেব। বন্ শহরে আপনিই হয়তো একমাত্র ইন্ডিয়ান।

পরদিন কাফের মুখেই একটি মহিলা এগিয়ে এসে বললেন, গুটটাখ! হের সায়েড!

আমি বললুম, গুটনটাখ, ফ্রলাইন–

এস্থলে প্রথম পরিচয়ে আপন নাম বলা হয়। ফ্রলাইন (কুমারী, মিস) কী একটা অস্পষ্ট কণ্ঠে বললেন, আমি ঠিক ধরতে পারলুম না। কিন্তু নিতান্ত জরুরি প্রয়োজন না হলে এস্থলে দুবার প্রশ্ন করা– বিশেষ করে মহিলাকে আদব-দুরস্ত নয়।

দেহের গঠনটি ভারি সুন্দর, আঁটসাঁট, দোহারা। প্রলম্বিত বাহু দুখানি এমনি সুডৌল যে, মনে হয় যেন দু গুচ্ছ রজনীগন্ধা। রাস্তার উজ্জ্বল আলোতে দেখছিলুম বলে লক্ষ করলুম কনুইয়ের কাছে মণি-খনির মতো দুটি টোল। গোটা দেহটি যেন রসে রসে ভরা। শুধু দেহটি দেখলে যে কেউ বলবে, মধুভরা পূর্ণ যুবতী।

কিন্তু মুখটির দিকে তাকানো মাত্র যে কোনও মানুষের মনের ভাব সম্পূর্ণ বদলে যাবে। ব্লাউজের গলার বোতাম থেকে আরম্ভ করে মাথার চুল পর্যন্ত–মনে হল এ যেন অন্য বয়সের ভিন্ন নারী। মুখের চামড়ায় এক কণা লাবণ্য এক কাচ্চা মসৃণতার তেল নেই। গলার চামড়া পর্যন্ত বেশ কিছুটা ঝুলে পড়েছে। সিকি পরিমাণ চুলে পাক ধরেছে। আর চোখ দুটি– সেগুলোর যেন দর্শনশক্তিও হারিয়ে গিয়েছে– জ্যোতিহীন, প্রাণহীন। এর বয়স কত হবে?– শুধু যদি মুখ থেকেই বিচার করতে হয়? আর সে কী বিষণ্ণ মুখ! বয়স বিচারের সময় সেই বিষণ্ণতাই তো হবে প্রধান সাক্ষী– জ্যোতিভ্রষ্ট চক্ষুতারকার চেয়েও কণ্ঠদেশের লোলচর্মের চেয়েও।

ইতোমধ্যে আমরা কাফেতে ঢুকে আসন নিয়েছি। মহিলাটি– না যুবতীটি, কী বলব? (সেই যে কালিদাসের গল্পে বুড়ো স্বামীর ধড়ের সঙ্গে জোয়ান ভাইয়ের কাটা মুণ্ড জুড়ে দিয়েছিল এক নারী)– ইতোমধ্যে দস্তানা খুলে নিয়েছেন। মুখের সঙ্গে মিলিয়ে বেরুল হাত দুখানা রসে ফাটো-ফাটো দেহের সঙ্গে মিলিয়ে নয়– নির্জীব, কোঁকড়ানো চামড়া, ইংরেজিতে বলে ক্রোজ ফিট, কাকের পা! অতি কষ্টে নিজেকে সামলেছিলুম!

বললেন, আপনাকে আমি নিমন্ত্রণ করেছি। অর্থাৎ তিনি বিল শোধ করবেন। অন্য সময় হলে এ বারতা আমার কর্ণকুহরে নন্দন-কাননের স্বর্ণোজ্জ্বল মধুসিঞ্চন করত। কিন্তু এই বিষণ্ণ মুখের সামনে আমার গলা দিয়ে যে কিছুই নামবে না। বললুম, আমি যখন এখানে পড়তুম–

বাধা দিয়ে শুধোলেন, আপনিও পড়েছেন নাকি?

এই ও-টার অর্থ কী?

আমি বললুম, তখন তো কোনও অবিবাহিত রমণীর নিমন্ত্রণ গ্রহণ করা আমাদের মধ্যে রেওয়াজ ছিল না।

তার কণ্ঠটি ছিল এমনিতেই ক্ষীণ— এখন শোনাল মুমূর্ষ প্রায়। যেন মাফ চেয়ে বললেন, ব্যত্যয় সবসময়ই দুটো একটা থাকে। কিন্তু দয়া করে আপনি এসব গায়ে মাখবেন না। আমি আপনার অপ্রিয় কোনও কাজ করতে চাইনে।

কাফেতে এ সময়ে জর্মনদের ইয়া ইয়া লাশ ভামিনীদের ভিড়। ওয়েট্রেস এক কোণে একটি খালি টেবিল দিল। বুঝলুম, মহিলাটি পূর্বাহেই টেবিলটি রিজার্ভ করে রেখেছিলেন। ব্যাগ খুলতে খুলতে বললেন, আপনি কী খেতে ভালোবাসেন? চা নিশ্চয়ই। কিন্তু এদেশে যে চা বিক্রি হয় সে তো অখাদ্য। তবে আমার কাছে ভালো চা আছে। আমি লন্ডন থেকে সেটা আনাই। ব্যাগ থেকে বের করে একটি ছোট্ট পুলিন্দা তিনি ওয়েট্রেসের হাতে তুলে দিলেন। সে কিছু বলল না বলে বুঝলুম, এ ব্যবস্থায় সে অভ্যস্ত।

আমাদের অর্ডার না দেওয়া সত্ত্বেও ভালো ভালো কেক, স্যানউইজ, টার্ট উপস্থিত হল। বুঝলুম, এগুলো পূর্বের থেকেই অর্ডার দেওয়া ছিল।

কিছুক্ষণ পরে জিগ্যেস করলেন, আপনাদের দেশের খুব বেশি ছাত্র জর্মনিতে পড়তে আসে না– কী বলেন?

আমি বললুম, অতি অল্পই। তা-ও বেশিরভাগ শিখতে আসে সায়ান্স আর টেকনিকাল বিদ্যা।

একটু হেসে বললেন, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, আপনি হিউম্যানিটিজের। আর বন তো তারই জন্য বিখ্যাত। তবে এখানে এসেছেন অল্প ভারতীয়ই। আপনারা যারা এসেছিলেন, ভারতে তাদের কোনও সংঘ আছে কি, যার মাধ্যমে একে অন্যের সঙ্গে আপনারা যুক্ত থাকতে পারেন?

আমি বললুম, না। এমনকি আমি এদের মাত্র দু একজনকে চিনি। ভারতবর্ষ বিরাট দেশ বলে আমি চায়ে চুমুক দিলুম। তিনি বললেন, ডিব্ৰুগড় থেকে দ্বারকা, কুলু থেকে কন্যাকুমারী। আমি তো অবাক! আশ্চর্য হয়ে বললুম, আপনি অত ডিটেল জানলেন কোথা থেকে? এখানকার শিক্ষিত লোককে পর্যন্ত ইভার (ভারতীয়) আর ইন্ডিয়ানার (রেড ইন্ডিয়ান) এ দুয়ের পার্থক্য বুঝিয়ে বলতে হয়।

এবং তার পরও কেউ কেউ আপনাকে শুধোয়, আপনি সেটাল আফ্রিকানার (সেন্ট্রাল আফ্রিকান) না জুড় ইটালিয়েনার (সাউৎ ইটালিয়ান)?

আমি আরও আশ্চর্য হয়ে বললুম আপনি অতশত জানলেন কী করে?

পরে বলব। কিন্তু আপনি ভারতে বন-এর ছাত্রদের সম্বন্ধে কী যেন বলছিলেন?

ভারতের বুদ্ধিজীবীর প্রধান অংশ থাকেন কলকাতায়। সেখানে থাকলেও খানিকটা যোগসূত্র থাকে। আমি থাকি ছোট্ট বরোদায়–

অস্ফুট শব্দ শুনে আমি ওঁর মুখের দিকে তাকালুম। দেখি, তার পাংশু মুখে যে দু-ফোঁটা রক্ত ছিল তা-ও অন্তর্ধান করেছে। ভয় পেয়ে শুধালুম, কী হল আপনার?

ঢোঁক গিলে খানিকটা সামলে নিয়ে বললেন, ও কিছু না। আমি অনিদ্রায় ভুগে ভুগে দুর্বল হয়ে পড়েছি। এখানে বড় লোকের ভিড়। সব বন্ধ। আমি আমার অফিস-ঘরের জানালা শীত-গ্রীষ্ম সবসময় খোলা রাখি।

আমি বললুম, তা হলে খোলায় চলুন। তার পর শুধালুম, আপনার সহকর্মী অন্য মেয়েরা কিছু বলে না?

প্রথমটায় ঠিক বুঝতে পারেননি। পরে বললেন, ও। আমি এককালে টেলিফোন গার্লই ছিলুম। এখন তারই বড় অফিসে কাজ করি। অ্যাডমিনিসট্রেটিভ কাজ। কিন্তু আগেরটাই ছিল ভালো।

বাইরে বেরিয়ে আসতেই আমি বললুম, আমার মনে হচ্ছে আপনি বেশি হাঁটাহাঁটি করতে পারবেন না। তার চেয়ে চলুন, ওই যে প্রাচীন যুগের একখানা ঘোড়ার গাড়ি এখনও অবশিষ্ট আছে, তাই চড়ে রাইনের পাড়ে গিয়ে বসি।

মাথা নেড়ে সায় দিলেন।

আস্তে আস্তে শুধোলেন, গেলটুনার যে ঋগ্বেদের জর্মন অনুবাদ করেন সেইটের ওপর নির্ভর করে যে একটি ইংরেজি অনুবাদ ভারতবর্ষ থেকে বেরোবার কথা ছিল, তার কী হল?

আমি এবারে সত্যই অবাক হলুম। গেলটুনারের অনুবাদ অনবদ্য। গত একশো বছরে ঋগ্বেদ সম্বন্ধে ইউরোপ তথা ভারতে যত গবেষণা হয়েছে গেলটুনারের কাছে তার একটিও অজানা ছিল না, এবং অনুবাদ করার সময় যেখানে যেটি দরকার হয়েছে সেখানে সেইটে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এ মহিলাটি যে অতিশয় সমীচীন ও সময়োপযোগী প্রস্তাবটির কথা বললেন সে সম্বন্ধে আমি কিছুই জানতুম না। বিস্ময় প্রকাশ করে বললুম, কিন্তু আপনি এসবের খবর পেলেন কোথায়?

তিনি চুপ করে রইলেন। গাড়ি মন্থর গতিতে বেটোফেনের প্রতিমূর্তির পাশ দিয়ে মনসটার গির্জে পেরিয়ে, ইউনিভার্সিটি হয়ে রাইনের পাশে এসে দাঁড়াল।

গাড়ি থেকে নেমে তাকিয়ে দেখি, মহিলার মুখ তখনও ফ্যাকাসে। প্রস্তাব করলুম, ওই কাফেটার খোলা বারান্দায় গিয়ে বসি, আর আপনি কিছু একটা কড়া খান। ওয়েটরকে বললুম কন্যাক নিয়ে আসতে।

দুই ঢোঁক কন্যাক্ খেয়ে যেন বল পেলেন। বললেন, আমি এখনও অবসরমতো কিছু কিছু ইভলজির চর্চা করি। বছর বারো পূর্বে যখন আরম্ভ করি তখন পূর্ণোদ্যমেই করেছিলুম।

তার পর আবার অনেকক্ষণ ধরে চিন্তা করলেন। রাইনের জলের উপর তখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। দু একখানা মোটর বোট আসা-যাওয়া করছে মাত্র। বাতাস নিস্তব্ধ। এমনিতেই রাইনের সন্ধ্যা আমাকে বিষণ্ণ করে তোলে, আজ যেন রাইনের জলে চোখের জল ছলছল করছে।

মহিলাটি বললেন, কাল থেকে ভাবছি, কী করে কথাটি পাড়ি।

যে কোনও কারণেই হোক মহিলাটি যে বেদনাতুর হয়ে আছেন সে কথা আমি ততক্ষণে বুঝতে পেরেছি। বললুম, আপনি দয়া করে কোনও সঙ্কোচ করবেন না। আমাদ্বারা যদি কোনও কিছু করা সম্ভব হয়, কিংবা সুদ্ধমাত্র আমাকে কিছু বলতে পেরে আপনার মন হালকা হয়–

মানুষকে ক্রমাগত সান্ত্বনার বাক্য দিয়ে প্রত্যয় দিতে থাকলেই যে সে মনস্থির করতে পারে তা নয়; বরঞ্চ কথা বন্ধ করে দিলে সে আপন মনে ভাববার এবং সিদ্ধান্তে পৌঁছবার সুযোগ পায়। আমি বন্-বয়েল শহরের মাঝখানে রাইনের উপরের পাথরের মোটা মোটা থামের তুলে-ধরা বিস্তীর্ণ স্পানওলা সুন্দর সেতুটির দিকে তাকিয়ে রইলুম। লোহার পুল কেমন যেন নদীর সঙ্গে খাপ খায় না– পাথর যেন জলের সঙ্গে মিশে এক হয়ে যায়, উভয়েরই রঙ এক।

দুনিয়াতে হেন তালা আবিষ্কৃত হয়নি যেটা কলেকৌশলে, কখনও-বা পশুবল প্রয়োগ করে, কখনও-বা মোলায়েম আদরসোহাগ করে খোলা যায় না; ওদিকে আবার গেস্তাপো, ওগপু এ সবকটা পদ্ধতি এবং আরও মেলা নয়া নয়া কৌশল খাঁটিয়েও বহু মানুষের মনের তালা খুলতে পারেনি। এবং হঠাৎ অকারণে কেন যে সেটা খুলে যায় তার হদিস কনফেশনের পাদ্রিসায়েব থেকে আরম্ভ করে আমাদের যৌবনকালের টেগার্ট পাষণ্ডও সন্ধান পায়নি।

মহিলা জিগ্যেস করলেন, আচ্ছা বলুন তো, দময়ন্তী নিদ্রাভঙ্গের পর দেখলেন নলরাজ নেই; তার পর তাঁর ইহজীবনে যদি নলের সঙ্গে আদৌ সাক্ষাৎ না হত তবে তিনি নল সম্বন্ধে বা আপন অদৃষ্ট সম্বন্ধে কী ভাবতেন?

নলোপাখ্যানের উল্লেখে আমি আশ্চর্য হলুম না। যে রমণী গেলটুনারের বেদানুবাদের সঙ্গে সুপরিচিতা, নলরাজ তো তাঁর নিত্যালাপী আত্মীয়!

আমি একটু ভেবে বললুম, রসরাজও তো বৃন্দাবনে শ্ৰীমতীর কাছে ফিরে যাননি। তবু তো তিনি তাঁর প্রতি প্রত্যয় ত্যাগ করেননি। মহাত্মা উদ্ধব যখন বৃন্দাবন দর্শন করে মথুরা ফিরে এলেন তখন রসরাজ সব শুনে বলেছিলেন, বিরহাগ্নি যদি তার এতই প্রবল হয় তবে তিনি জ্বলেপুড়ে ভস্ম হয়ে যাননি কেন? কী বেদরদী প্রশ্ন! কিন্তু শ্রীরাধা সেটা জানতেন বলে উদ্ধবকে বলতে বলে দিয়েছিলেন, তার অবিরাম অশ্রুধারা সেই অগ্নি বার বার নির্বাপিত করছে– তনু জরি জাত জো ন অপুঁয়া ঢর উপো –যুদুপতি শেষ প্রশ্ন শুধান, আমার বিরহে তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায়নি কেন? এর উত্তরও উদ্ধব শিখে নিয়েছিলেন, আপনি একদিন না একদিন বৃন্দাবনে ফিরবেন এই প্রত্যয়ই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

দময়ন্তী নিশ্চয়ই প্রত্যয় ছাড়েননি।

মহিলা বললেন, তুলনাটা কি ঠিক হল? শ্রীরাধা তো মাঝে মাঝে শ্রীকৃষ্ণের সংবাদ পেতেন, তিনি কংস বধ করেছেন, তিনি কুরু-পাণ্ডবের মধ্যে শান্তি স্থাপনার্থ দৌত্য করেছেন, জনসমাজের বৃহত্তর সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন এই ভেবে মনে সান্ত্বনা পেতেন–

আমি বাধা দিয়ে বললুম, এবং রুক্মিণীকে– সে কুমারী আবার শিশুপালের বাগদত্তা বধূ– বিয়ে করেছেন, তার পর সত্যভামাকে, সর্বশেষ ভালুকী–

আমি নিজের থেকে থেমে গেলে পর মহিলাটি বললেন, শ্রীকৃষ্ণের উদাহরণ আপনিই তুলেছিলেন; আমি তুলিনি।

আমি বললুম, আপনি দময়ন্তীর কথা তুলেছিলেন- ভগবান করুন, আপনার নল যেন

তিনি মাথা নাড়তে আমি চুপ করে গেলুম।

বললেন, আপনি গোডেসবের্গ চেনেন?

আমি বললুম, বা রে, সেখানে তো আমি এক বছর বাস করেছি।

প্রফেসর কিফেল সেখানে বাস করতেন। আমরা ছিলাম তার প্রতিবেশী। আমি প্রতিদিন বন শহরে আসতুম চাকরি করতে। হঠাৎ একদিন দেখি তার পরের স্টপেজ হোঋ-ক্রয়েৎসে একজন বিদেশি উঠলেন। মুখোনা বিষণ্ণ। সেদিন আর কিছু লক্ষ করিনি। কাইজার প্লাসের স্টপেজে উনিও নামলেন। আমি বইয়ের দোকান র্যোরশাইটে কাজ করতুম। আপন অজান্তেই লক্ষ করলুম বিদেশি ইউনিভার্সিতে ঢুকলেন।

তিন-চার মাস প্রায় রোজই একই ট্রামে যেতুম, ভদ্রলোকের প্রতি আমার কোনও কৌতূহল ছিল না কিন্তু লক্ষ করলুম, বিদেশির বিষণ্ণ ভাব আর কাটল না।

তার পর একদিন তিনি আমাদের দোকানে এসে ঢুকলেন। আমি এগিয়ে গিয়ে অভ্যর্থনা জানাতে তিনি একেবারে থতমত খেয়ে গেলেন। ভাবলুম এ আবার কোন দেশের লোক? এত লাজুক কেন?

ভাঙা ভাঙা জর্মন ভাষায় এক জর্মন ইলজিস্টের বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ চাইলেন। আমি একটু আশ্চর্য হলুম : জর্মনিতে বসে জর্মনের লেখা বই পড়লেই হয়। বললুম, এটা লন্ডন থেকে আনাতে হবে। তার পর কিন্তু কিন্তু করে বললুম, মূল জর্মনটা পড়লেই তো ভালো হয়।

তিনি বললেন, আমার আছে, কিন্তু বুঝতে বড় অসুবিধা হয়। সঙ্গে সঙ্গে বইখানা পোর্টফোলিও থেকে বের করে কাউন্টারের উপর রাখলেন।

আমি তখনও ইন্ডলজির কিছুই জানতুম না– নামটাম টুকে নিয়ে তাঁকে দু-চারখানা ভালো অভিধান, সরল জর্মন বই, ব্যাকরণ দেখালুম। আমি ইংরেজি জানতুম বলে তার ঠিক কোন কোনটা কাজে লাগবে সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞের মতো সৎপরামর্শ দিলুম। আমি যেটা দেখাই সেটাই তিনি কিনে ফেলেন। শেষটায় আমিই হেসে বললুম, এগুলো শেষ করুন। এর পরের ধাপের বই আমি বেছে রাখব। টাকা দিয়ে বইগুলো নিয়ে যখন চলে গেলেন তখন দেখি তার ইভলজির বইখানা কাউন্টারে ফেলে গেছেন। তা যান, কাল ট্রামে দিয়ে দিলেই হবে।

ইন্ডিয়া সম্বন্ধে এই আমার প্রথম পাঠ। এবং এখনও সে বইখানা মাঝে মাঝে পড়ি। ভিন্টারনিৎসের ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস। এ বই দিয়ে আরম্ভ না করলে হয়তো ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি আমার কৌতূহল অঙ্কুরেই মারা যেত।

ভিন্টারনিৎস লেখেন অতি সরল জর্মন; তাই আশ্চর্য হলুম যে বইয়ের মালিক এতদিনেও এতখানি জর্মন শিখে উঠতে পারেননি কেন?

আমি চেপে গেলুম যে, ঠিক এই বইখানাই ভিন্টারনিৎস শান্তিনিকেতনে আমাদের পাঠিয়েছিলেন।

আর পাঁচজন জর্মনের তুলনায় বিদেশিদের সম্বন্ধে আমার কৌতূহল কম। বইয়ের দোকানে কাজ করলে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় জাত-বেজাতের বই পড়া হয়ে যায়। আমার কৌতূহল নিবৃত্তি হয়ে গিয়েছিল অনেকখানি– ওই করে।

কিন্তু এই লোকটির প্রতি কেমন যেন আমার একটু দয়া হল। তবু এটা ঠিক, আমি নিশ্চয়ই গায়ে-পড়ে তাকে সাহায্য করতে যেতুম না। তবে একথাও ঠিক, ভিন্টারনিৎসের বেদ অনুচ্ছেদে উষস্ আবাহন এবং জুয়াড়ির মনস্তাপ দুটোই আমার কল্পনাকে এক অপূর্ব উত্তেজনায় আলোড়িত করেছিল। ঊষামন্ত্র লিরিক, রহস্যময়, ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, আর অবিশ্বাস্য বলে মনে হল যে, ওই একই সময়ে অতিশয় নিদারুণ বাস্তব জুয়াখেলা ও জুয়োড়ি-জীবনের নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা একই সঞ্চয়নে স্থান পেয়েছে। আমার বাবা ছিলেন গ্রিক ভাষার অধ্যাপক। স্কুলে আর পাঁচটা ছেলেমেয়ে যা গ্রিক শেখে সেটা ম্যাট্রিক পাসের পরই ভুলে যায়। আমার পিতা সেটা হতে দেননি। এখন আমার ইচ্ছে হল সংস্কৃত শেখার। তাই তার সঙ্গে ভালো করে আলাপ করলুম। আমি তাঁর জন্য ভিন্টারনিৎসের জর্মন থেকে ইংরেজি অনুবাদ করে দিতুম, আর তিনি আমাকে সংস্কৃত পড়াতেন।

আমার মনে সর্বক্ষণ নানা প্রশ্নের উদয় হচ্ছিল, কিন্তু মহিলাকে বাধা দিলুম না।

ততক্ষণে কাফেতে উল্লাস, হৈ চৈ পড়ে গিয়েছে। জর্মন জনগণের বহুদিনের মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে। ঘড়ি ঘড়ি খবর আসছে, নাৎসি বিজয়-সেনানী কীভাবে অস্ট্রিয়ার শহরের পর শহর দখল করে যাচ্ছে, তারা কীভাবে সর্বত্র উদ্বাহু অভিনন্দিত হচ্ছে।

আমি একটু মুচকি হেসে বললুম, ভালুকও মানুষকে আলিঙ্গন করে শুনেছি, কিন্তু সে আলিঙ্গন– যা গে।

মহিলাটি একটু চমকে উঠলেন। বললেন, এসব মন্তব্য আপনি সাবধানে করবেন। কী করে জানলেন, আমি নাৎসি নই?

আমি হেসে বললুম, জলবত্তরল– আপনি তো সংস্কৃত জানেন। তার মানে যে-জন বেদ পড়েছে, সে-ই জানে বেদের আর্যধর্মের সঙ্গে নাৎসিদের এই আর্যামির বড়ফাটাইয়ের সূচ্যগ্র পরিমাণ সম্বন্ধ নেই। কিন্তু আপনি চিত্তবিক্ষেপ হতে দেবেন না। তার পরের কথা বলুন।

একটু চিন্তা করে বললেন, প্রথমে সাহচর্য, তার পর বন্ধুত্ব, সর্বশেষে প্রণয় হল আমাদের দুজনাতে।

এবারে অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, তিন বছরের প্রণয়– তার পর দশ বছর ধরে আমি তার কোনও খবর পাইনি। এই দশ বছর আমার একা একা কেটেছে। এই দীর্ঘ তেরো বছরের কথা আপনাকে বলতে গেলে ক মাস ক বছর লাগবার কথা তার সামান্যতম অনুমান আমার নেই।

এই শেষের দশ বৎসর কী করে কেটেছে, এখন কী করে কাটছে সেটা বোঝাবার চেষ্টাও আমি করব না। আর সেটা শোনাবার জন্যও আমি আপনার দর্শন কামনা করিনি। এই যে বন্ বিশ্ববিদ্যালয় আমরা পেরিয়ে এলুম, এখানে পড়বার সময় ঠিক একশো বছর আগে, আমাদের সবচেয়ে সেরা লিরিক কবি হাইনে একটি চার লাইনের কবিতা লেখেন :

প্রথমে আশাহত হয়েছিনু
ভেবেছিনু সবে না বেদনা;
তবু তো কোনো মতে সয়েছি।
কী করে যে সে কথা শুধিয়ো না।

তীব্র বেদনার তীক্ষ্ণ প্রকাশ দেবার চেষ্টা করেছেন হাইনে বার বার, কিন্তু হার মেনে উপরের চতুষ্পদীটি রচেন। একশো বছর ধরে দেশ-বিদেশে লক্ষ লক্ষ নরনারী সেগুলো পড়ছে

এবারে আমি বাধা দিয়ে বললুম, আমাদের পোয়েট টেগোর তার প্রথম যৌবনে এক জর্মন মহিলার কাছ থেকে অল্প জর্মন শেখার পরেই তাঁর শুটিদশেক কবিতা বাঙলায় অনুবাদ করেন। আপনি যেটি বললেন সেই চতুষ্পদীটিও তাতে আছে।

প্রথম যৌবনে তিনি কি শোক পেয়েছিলেন?

তাঁর প্রাণাধিকা ভ্রাতৃবধূ আত্মহত্যা করেন। কিন্তু সে কথা আরেকদিন হবে। আমি নিজে কাপুরুষতম এসকেপিস্ট; তাই দুঃখের কথা এড়িয়ে চলি। তার চেয়ে আপনাদের সেই তিন বছরের আনন্দের কথা বলুন।

প্রথম বছর কেটেছে স্বপ্নের মতো। স্বপ্ন যেমন চেনা-অচেনায় মিশে যায়, হঠাৎ চেনা জিনিস, চেনা মানুষ মনে হয় অচেনা, আবার অচেনা জন চেনা, এ যেন তাই। তাঁকে যখন মনে হয়েছে এর সবকিছু আমার চেনা হয়ে গিয়েছে তখন হঠাৎ মনে হয়েছে যেন ইনি আমার সম্পূর্ণ অজানা জন। আবার কেমন যেন এক প্রহেলিকার সামনে অন্ধকারে ব্যাকুল হয়ে হাতড়াচ্ছি– মধ্যরাত্রে হঠাৎ তার ঘুমন্ত হাত পড়ল আমার গাঁয়ের উপর আর সঙ্গে সঙ্গে আমার সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে গেল। আমার চৈতন্যে তখন বিশ্বব্যাপী মাত্র একটি অনুভূতি– এই লোকটির মাঝেই আমার অস্তিত্ব, আমার অন্য কোনও সত্তা নেই। গোডেসবের্গের পিছনে নির্জনে গভীর পাইন বনে সকাল থেকে পরের দিন ভোর অবধি কাটিয়েছি একটানা, রাইনের ওপারে বরফ ভেঙে ভেঙে উঠেছি মারগারেটেন হ্যোহ অবধি, ফ্যান্‌সি বলে শ্যাম্পেনের পর শ্যাম্পেন খেয়ে আমি অবশ হয়ে শুয়ে পড়েছি ডান্স-হলের সামনের ঘাসের উপর তিনি পৌঁছে দিয়েছেন বাড়িতে।

কেন জানিনে, হঠাৎ জিগ্যেস করে বসলুম, উনি কখনও বে-এতেয়ার হতেন না?

বললেন, আশ্চর্য, আপনি যে এ-প্রশ্ন জিগ্যেস করলেন! না, কখনো না। এখানকার পড়দের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়ে তাকে খেতে দেখেছি বহুবার, চোখের পাতাটি পর্যন্ত নড়ত না। অথচ তিনি একাধিকবার আমাকে বলেছেন, তার জানামতে তার সাত পুরুষের কেউ কখনও মদ খায়নি।

কিন্তু প্রথম বছরের চেয়েও অন্তত আমার পক্ষে মধুরতর আর গৌরবময় শেষের দুই বছর।

এক বৎসর ক্লাস আর সেমিনার করার পর অধ্যাপকের আদেশে তিনি আরম্ভ করলেন তাঁর ডক্টরেট থিসিসের প্রথম খসড়া–অবশ্য ইংরেজিতে। মোটামুটি তিনি কী লিখলেন সে সম্বন্ধে তিনি আমার সঙ্গে আলোচনাও করেছিলেন।

থেমে গিয়ে তিনি অত্যন্ত করুণ নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার কাছে আমার একটা ভিক্ষা আছে–

আমি বাধা দিয়ে বললুম, ছি ছি। আপনি আমাকে এখনও চিনলেন না!

চিনেছি বলেই চাইছি। এখন যা বলব, আপনি প্রতিজ্ঞা করুন, কাউকে বলবেন না।

আমি তাঁর হাতে সেই শুষ্ক, জরাজীর্ণ হাতে চাপ দিলুম।

প্রথম পরিচ্ছেদের কাঁচা খসড়া পড়ে আমি অবাক। একেবারে কিছুই হয়নি বললে অত্যুক্তি হয়, কিন্তু এতে যে কোনও বাধই নেই, বক্তব্য কোন্ দিকে যাচ্ছে তার কোনও নির্দেশ নেই আছে গাদা গাদা ফ্যাক্টস, এবং তার মধ্যেও কোনও সিসটেম্ নেই।

কারণ ইতোমধ্যে আমি যে খুব বেশি সংস্কৃত শিখেছি তা নয়, তবে আপনি তো জানেন, জর্মন, ফরাসি এবং ইংরেজি, মাত্র এই তিনটি ভাষাতেই ইন্ডিয়া সম্বন্ধে এত বই লেখা হয়ে গিয়েছে যে সেগুলো মন দিয়ে বার বার পড়লে, নোট টুকে মুখস্থ করলে কার সাধ্য বলে আপনি সংস্কৃত জানেন না! যেদিন তিনি আমায় প্রথম তার থিসিসের সাবজেক্ট গুপ্তযুগের কালচারাল লাইফ- বলেন সেদিন থেকেই আমি ওই বিষয়ের ওপর যা পাওয়া যায় তাই পড়তে আরম্ভ করেছি, নোট টুকেছি, মুখস্থ না করেও যতখানি সম্ভব মনে রাখবার চেষ্টা করেছি। আর সংস্কৃত তো সঙ্গে সঙ্গে চলছেই। আপনি তো আমাদের সিস্টেম জানেন। তাই তিন মাস যেতে না যেতেই আমি র‍্যাপিড় রিডিং সিসটেমে খানিকটা বুঝে কিছুটা না বুঝে কালিদাসের সব লেখা এমনকি কালিদাসের নামে প্রচলিত অন্য জিনিসও পড়ে ফেলেছি। তবে আমার ব্যাকরণজ্ঞান এখনও কাঁচা, যদিও গ্রিকের সাহায্যে শব্দতত্ত্বে আমার কিছুটা দখল আছে।

ওঁর ইংরেজিটা যে আমি জৰ্মনে অনুবাদ করব সেটা তো ধরেই নেওয়া হয়েছিল। তারই অছিলা নিয়ে আমি সমস্তটা ঢেলে সেজে লিখলুম। পাছে তাঁর আত্মসম্মানে লাগে তাই বললুম, তুমি এ-কাঠামোর উপর আরও ফ্যাটের কাদামাটি চাপাও, রঙ বোলাও।

ইতোমধ্যে আমার বইয়ের দোকান আমাকে পাঠাল লন্ডন, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজে আমাদের বইয়ের বাজার প্রসার করতে। তিনিও তার প্রফেসরের কাছ থেকে ছুটি নিলেন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে ও ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে মাল-মশলার সন্ধানে যাবার জন্য।

সে সুযোগের অবহেলা আমি না করে আমাদের প্রকাশিত আর বিরল আউট অব প্রিন্ট কিছু কিছু বই নিয়ে দেখা করতে গেলুম লন্ডন স্কুল অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজের ইন্ডলজি-অধ্যাপকদের সঙ্গে। তাঁরা আমায় ভারি খাতির করলেন, কেউ কেউ চা-য় ডিনারে নিমন্ত্রণও করলেন। আমি ঘুরেফিরে শুধু গুপ্ত যুগের কালচারাল লাইফের দিকে কথার মোড় ফেরাই। ওঁরা অকৃপণ হৃদয়ে আপন আপন গবেষণার ফল বলে যেতে লাগলেন। একদিন এক অধ্যাপকের বাড়িতে নিমন্ত্রণে ছিলেন আরও দুজন ইন্ডলজির অধ্যাপক। আমি গুপ্ত যুগ টুইয়ে দিতেই লেগে গেল তিন পণ্ডিতে লড়াই। ঘণ্টাখানেকের ভিতরই পরিষ্কার হয়ে গেল তিনজনার তিন থিসিস। একজন বললেন : গুপ্ত কেন, তার পরবর্তী যুগেরও সব নাট্যের কাঠামো গ্রিক নাট্য থেকে নেওয়া। দ্বিতীয়জনের বক্তব্য : গুপ্ত যুগের চোদ্দ আনা কৃষ্টির মূলে দ্রাবিড়। বেদ উপনিষদ রামায়ণ মহাভারতের চোরাবালির ভিতর দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে গুপ্ত যুগে এসে নির্মল তৃষাহরা হ্রদে পরিণত হয়েছে। আর তৃতীয়জনের মতে গুপ্ত যুগের বেশিরভাগ পরবর্তী যুগের– গুপ্ত যুগের নামে পাচার হচ্ছে। যেরকম ওমর খৈয়ামের দু-শ বছর পরের রচনা বিস্তর চতুষ্পদী তাঁর সঙ্কলনে ঢুকে গেছে।

ভোরের প্রথম বাস্ ধরে আমরা যে-যার বাসায় ফিরেছিলুম।

তার পূর্বে আমি সবিনয়ে শুধিয়েছিলুম, আমি তাঁদের বক্তব্যের কিছু কিছু ব্যবহার করতে পারি কি না। তিনজন একবাক্যে বলেছিলেন, আলবত, নিশ্চয়, অতি অবশ্যই। এসব তো কমন নলেজ। তাই দয়া করে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো না। আমাদের বদনাম হবে যে আমরা কমন নলেজ গবেষণা বলে পাচার করি। একেই বলে প্রকৃত বিনয়!

বাসে বাসেই আমি যতখানি স্মরণে আনতে পারি শর্টহ্যান্ড টুকতে আরম্ভ করি। বাড়ি ফিরে বিছানা না নিয়ে যখন কাজ প্রায় শেষ করে এনেছি তখন বন্ধু বিছানায় বসে চোখ কচলাতে কচলাতে বেড়-টির জন্য ঘণ্টা বাজালেন।

অক্সফোর্ড-কেমব্রিজেও অধ্যাপকদের সাহায্য পেলুম।

তার পর বনে ফিরে এসে সেইসব বস্তু গুছিয়ে, খসড়া বানিয়ে ফেয়ার কপি টাইপ করে, তাঁর প্রোফেসরের মেরামতির পর সে অনুযায়ী আবার টাইপ করে পরিপূর্ণ থিসিস তৈরি হল।

আমি বললুম, অর্থাৎ–

তিনি ব্যাকুল হয়ে চিৎকার করে উঠলেন, না, না, না। আপনি ভুল ইনফারেন্স্ করছেন। সংস্কৃত ভাষাটি ছিল তার সম্পূর্ণ করায়ত্ত। হেন ব্যাকরণ নেই যার প্রত্যেকটি সূত্র, নিপাতন, আর্যপ্রয়োগ তার কণ্ঠস্থ ছিল না। কঠিন কঠিন টেস্ট দু-বার না পড়েই তিনি অর্থ বের করে দিতে পারতেন। বললে বিশ্বাস করবেন না, তিনি তাঁর অধ্যাপককে এই দুরূহ ব্যাপারে সাহায্য করতেন। তাঁর থিসিসে যে অসংখ্য বস্তু মূল সংস্কৃত থেকে নেওয়া হয়েছে তার অনুবাদে তো কোনও ভুল পাবেনই না, আর সেগুলোই করেছে তার বইখানাকে রিচ ইন টেকচারসমৃদ্ধশালী। তাঁর কৃতিত্ব অনন্যসাধারণ–

আমি বাধা দিয়ে বললুম, আমি আপনার প্রত্যেকটি কথা মেনে নিচ্ছি।

রমণীটি বড়ই সরলা। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, বাঁচালেন। এসব কথা আমি এ জীবনে কাউকে বলিনি। এবং আরেকটা কথা, ওঁকে তো ভাইভাও দিতে হয়েছিল।

আমি বললুম, নিশ্চয়ই। ভাইভাতে কোন ক্লাস, আর রিটনে (অর্থাৎ) থিসিসে কোন ক্লাস পেয়েছিলেন সেটা আর শুধালুম না। তা হলে সর্বনাশ হয়ে যেত।

হঠাৎ মহিলাটি চমকে উঠে বললেন, ছি ছি! অনেক রাত হয়ে গিয়েছে; ওদিকে আপনার ডিনারের কথা আমি একবারও তুলিনি। কোথায় খাবেন বলুন?

আমি কিন্তু কিন্তু করছি দেখে বললেন, আমার ফ্ল্যাটে যাবেন? এখানেই, বেশি দূরে না। গোডেসবের্গের সে বাড়িতে আমি আর যাই না।

আমি ইতোমধ্যে একাধিকবার লক্ষ করেছি যে, মহিলাটি এখনও তার ক্লান্তি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তাঁকে বাড়িতে শুইয়ে দেওয়াই ভালো।

মোড় নিতেই দেখি সেই প্রাচীন দিনের শেষ ঘোড়ার গাড়িখানা যেন আমাদের জন্যই দাঁড়িয়ে। মহিলাটি যে আমলের কথা বলছিলেন তখন এরও ছিল ভরা যৌবন। আমি বললুম, কি হে যাবে নাকি?

টপ্ হ্যাট তুলে বাও করে বলল, নিশ্চয়ই, স্যার। ঘোড়াকে বলল, চল্ বারবা রসসা গোডেসবের্গ।

আমি চেঁচিয়ে বললুম, না হে না–

বলল, সরি, স্যর! এই বছর পাঁচেক পূর্বেও তো আপনাকে ফ্যান্‌সি ডান্স থেকে ভোরবেলা হোথায় নিয়ে গিয়েছিলুম! হা হহা, হা হহা, আপনি তখন ভারি জলি ছিলেন, স্যর, নামবার সময় ঝপ করে আমার হ্যাঁটটি কেড়ে নিয়ে হাওয়া। হাহহা– পরে আমার ওল্ড উম্যান বলে কি না আমি হ্যাঁট বন্ধক দিয়ে বিয়ার খেয়েছি। হাহা হাহা! চল, বারবা রসা।

মহিলাটি হেসে উঠলেন। তাঁর চেনা দিনের ভোলা দিনের দমকা বাতাস যেন হঠাৎ গলিটাকে ভরে দিয়ে সব শুকনো পাতা উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল রাইন বাগে। শহরের গলির ভিতর নির্বাসিত সুসান্ দিবাস্বপ্নে যেরকম তার গাঁয়ের নদীটিকে শহরের গলি দিয়ে বয়ে যেতে দেখেছিল।*[* সরু গলির মোড়ে যখন দিনের আলো ঝরে
ময়না দাড়ে গাহে এমন গাইছে বছর ধরে।–ওয়ার্ডসওয়ার্থ, অনুবাদক সত্যেন দত্ত।]

তখনও আমার বয়েস ছিল কম, জানতুম না, আমার কপালে ভাগ্যবিধাতা লিখে রেখেছেন এমনই দুর্দৈব যে তখন আমার অন্ধ কারাগারে না বইবে চেনা দিনের ভোলা দিনের বাতাস, না বইবে সুসানের গ্রামের নদী– স্মৃতির আবর্জনা উড়িয়ে নিতে ভাসিয়ে দিতে।

গাড়ি-ভাড়াটা দেবার পর্যন্ত মোকা পেলুম না।

গেট খুলে বাড়িতে ঢোকার সময় শুনি, কোচম্যান বলছে, চ বারুবা রসূসা, দেখলি তো, তখনি তো তোকে বলিনি অন্য সোয়ারি নিনি। আজ আর না। চ, বাড়ি যাই। আমার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে বলল, রেতে-বেরাতে যখন খুশি ওই সামনের গলিতে ঢুকে পয়লা বাড়ির সামনে বলবেন, ডার্লিং বাবা রসা! সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি পাবেন তৈরি। সম্রাট বারবা রসার মতো আপনার বাবা রসাও দেখবেন ক্রুসেড লড়তে হোলি ল্যান্ডে যেতে তৈরি।

জর্মন কেন, প্রায় সব জাতের লোকই কোনও বিশেষ দেশ ভ্রমণ করে এলে বা সে দেশ নিয়ে চর্চা করলে আপন বাড়ি ভর্তি করে ফেলে সে দেশের ভালোমন্দ মাঝারি রাবিশ-জাঙ্ক-বিলজ কিচ দিয়ে। এর বাড়িতে পরিপূর্ণ ব্যত্যয় না হলেও একথা কেউ বলতে পারবে না যে ইনি সারাজীবন শুধু ইন্ডিয়া ইন্ডিয়াই করেছেন। মাত্র একখানি ছবি– অজন্তার। রাহুল-জননী পুত্রকে তথাগতের (তিনি ছবিতে নেই) সামনে। আর লেখা-পড়ার টেবিলের উপর সাংখ্যকার মহর্ষি কপিলের একটি মূর্তি। ইনি এটি জোগাড় করলেন কোথা থেকে? ওটা মূলে মূর্তি কি না জানি নে হয়তো-বা রিলিফ। আমি দেখেছি ছবিতে– বহু বৎসর হল।

কিন্তু অত বড় বড় ঘরওলা ফ্ল্যাট তিনি পোষেন কী করে?

আমার অনুমান ভুল নয়। ফ্ল্যাটে ঢুকে আমাকে আসন নিতে অনুরোধ করে তিনি সোফায় শুয়ে পড়লেন। একটু মাফ-চাওয়ার সুরে বললেন, আপনাদের দার্শনিক সর্বপল্লী মহাশয় নাকি লেখাপড়া পর্যন্ত খাটে শুয়ে শুয়ে করেন।

ফটোগ্রাফে মহারানি ভিক্টোরিয়ার বৃদ্ধ বয়সের যে ছবি দেখি হুবহু ঠিক সেই পোশাক পরে উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যখণ্ড যেন ঘরে এসে ঢুকলেন। মহিলা আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, আমার আইমা। ঠাকুরমার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাড়িতে আসেন। তার ছেলে-নাতিরা ভালো ভালো ব্যবসা করেন। আইমা কিন্তু আমার সঙ্গেই থাকতে ভালোবাসেন।

আমি বার বার বললুম, আমি নিরামিষাশী নই, আমার আহারাদির জন্য তুলকালাম করে রাইনের জলে আগুন লাগাতে হবে না, আমি সব খাই, টিনের খাদ্যেও অরুচি নেই।

মহিলা বললেন, জানেন কি, হিটলার কড়া নিরামিষাশী?

আমি বললুম, তা হলে নিরামিষ ভোজনের বিপক্ষে আরেকটা কড়া যুক্তি পেলুম। আর আপনি?

ক্লান্তির সুরে বলল, আইমা যা দেয়, তাই খাই।

আমি বললুম, আপনি তা হলে বৌদ্ধ ভিক্ষুণী!

অন্তত হিটলারের মতো জৈন গৃহীও নই।

ইনি সব জানেন।

আমাকে চেয়ারটা কাছে টেনে আনবার অনুরোধ করে বললেন, আচ্ছা, আপনি নিওরসিস, সাইকসিস, মনমেনিয়া ইদে ফিস– এসব কথাগুলোর অর্থ জানেন?

আমি বললুম, যারা এসব নিয়ে কারবার করেন, তাঁরাই কি জানেন? এই যে আমরা নিত্য নিত্য ধর্ম, নীতি, মর্যালটি, রিয়ালিজম, আইডিয়ালিজম শব্দ ব্যবহার করি, এগুলোর ঠিক ঠিক অর্থ জানি? তবে আপনি যেগুলো বললেন, তার ভিতর একটা জিনিস সব কটারই আছে : কোনও একটা চিন্তা সর্বচৈতন্যকে এমনই গ্রাস করে ফেলে যে মানুষ তার থেকে অহোরাত্র চেষ্টা করেও নিষ্কৃতি পায় না।

দুষ্মন্ত যেরকম বলেছিলেন, তিনি শকুন্তলার চিন্তা মন থেকে কিছুতেই সরাতে পারছেন না, অপমানিত জন যেরকম আপ্রাণ চেষ্টা করেও অপমানের স্মৃতি মন থেকে তাড়াতে পারে না– বার বার সেটা ফিরে আসে। তার পর বললেন, কিন্তু আশ্চর্য, কালিদাস অপমানের সঙ্গে বিরহবেদনার তুলনা দিলেন কেন? শকুন্তলা তো দুষ্মন্তকে কোনও পীড়া দেননি– অপমান দূরে থাক!

আমি বললুম শত্রু কাছে এসে দহন করে; মিত্র দূরে গিয়ে দহন করে। দুজনেই দুঃখ দেয় শত্রু-মিত্রে কী প্রভেদঃ

শহতি সংযোগে বিয়োগে মিত্রমপ্যহো।
উভয়য়োর্দুঃখ দায়িত্ব কো ভেদঃ শত্ৰুমিত্রয়োঃ?

দুশমন দুষ্মন্তকে অপমানিত করলে তার যে বেদনা-বোধ হত, শকুন্তলার বিরহও তাকে সেই পীড়াই দিচ্ছিল। তাই বোধহয় কালিদাস উভয়কে পাশাপাশি বসিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথও কিছুদিন পূর্বে বলেছেন, তার জন্মদিন ও মৃত্যুদিন কাছাকাছি এসে গেছে। একই মন্ত্রে দুজনকে আহ্বান জানাবেন।

ঘরের আলো যদিও সূক্ষ্ম মলমলের ভিতর দিয়ে রক্তাঙ্গীণ গোলাপি আভার মতো মোলায়েম, তবু শ্ৰীমতী দু হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রেখেছিলেন।

এবারে উঠে বসে আমাকে বললেন, আপনাকে সর্বক্ষণ আমার আপন কথা বলে উৎপীড়িত করার ইচ্ছা আমার নেই– বিশেষ করে বাড়িতে টেনে এনে।

আর এখন বার বার মনে হচ্ছে কী লাভ? নিউরটিক ইত্যাদি যে শব্দগুলো বললুম, তার ক-টা আমার বেলা প্রযোজ্য আমি জানিনে। কিন্তু এ-কথা দৃঢ়নিশ্চয় জানি, আমি নর্মাল নই। কখনও মনে হয়, আমার এই অনুভূতিটা সত্যের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত, আবার হঠাৎ মাঝরাতে জেগে উঠে দেখি, সেটা সম্পূর্ণ মতিভ্রম। একটা ইদে ফি– ফিট আইডিয়া থেকে কিছুতেই নিষ্কৃতি পাইনে, এবং নিজের কোনও সিদ্ধান্তকে আর অবিচল চিত্তে গ্রহণ করতে পারিনে। তাই দয়া করে আপনি এই নিউটিক, মনমেনিয়াকের কোনও কথা গায়ে মাখবেন না।

আমি বললুম, তথাস্তু (এবং সংস্কৃতেই বলেছিলুম)। কিন্তু আপনি কী যেন জানবার জন্য আমাকে ফোন করেছিলেন?

আরেক দিন হবে। আপনি এখানে আর কতদিন আছেন?

অন্তত দেড় মাস। কয়েকদিনের জন্য ডুসলডর্ফ যাব, সেই যে বন্ধু পাউলকে ট্রাঙ্ককল করেছিলুম, তার ওখানে। আপনিও চলুন না।

বললেন, মন্দ নয়; পরে দেখা যাবে।

ইতোমধ্যে আইমা একটা বরফে ভর্তি অত্যুজ্জ্বল রুপালি বালতিতে করে এক বোতল শ্যাম্পেন আর এক বোতল মোজেল নিয়ে এসেছেন।

আমি বললুম সর্বনাশ! আইমা কী যেন একটা বললেন। শুধু মাটিলডে শব্দটি বুঝতে পারলুম। তা হলে এর ক্রিশ্চান নাম ওই।

তিনি বললেন, হোখ ডয়েচস্ হাই জর্মন– ব্যুনেন আউস্প্ৰাখে দিয়ে উচ্চারণ করার ফ্যাশান আইমার কুমারী বয়সে চালু হয়নি বলে আমরা এখনও আলজাসের ডায়লেক্ট বলি। আর বোতলগুলো যদিও অত পুরনো নয়, তবু আমার পিতার আমলের। শ্যাম্পেন নাকি পুরনো হলে খারাপ হয়ে যায়। ভালো না লাগলে মোজেলটা খাবেন।

আমি নিজে খাই আর না-খাই, এর মনে যদি একটু রঙ লাগে তবে আমি খুশি।

শুধালুম, আপনি কি এখনও ভারতীয় শাস্ত্রের চর্চা রেখেছেন? আপনার বিশেষ ইন্টারেসট কিসে?

বিষয়টা কঠিন নয়। আপনি নিশ্চয় লক্ষ করেছেন, বৈদিক যুগে স্ত্রী-পুরুষের সমান অধিকার ছিল। এমনকি হোমযজ্ঞেও স্ত্রী-পুরুষে সমান অধিকার।

আমি বাধা দিলুম, ইন্ডলজি আমার সাবজেক্ট নয়। আপনি সবিস্তার না বললে মোষের সামনে বীণা বাজানোর মতো হবে।

তিনি বললেন, সে কী, আপনি তো ইন্ডিয়ান!

আমি বললুম আপনাদের ইহুদিদের মতো আমারও লয়েলটি দ্বি-ধা। আমাকে আমার পারিবারিক মুসলিম ঐতিহ্যের সঙ্গে যোগ রাখতে হয় আর যে দেশে পুরুষানুক্রমে আছি তার অতীত গৌরবেও আমার হিস্যে আছে। তবে আমাদের দেশের মেজরিটি আপনাদের নাৎসিদের মতো নয়। আমাদের মুসলমান কবি কাজীকে হিন্দুরা মাথায় তুলে নাচে, আর সেদিন নাৎসিদের একখানা বইয়ে পড়ছিলুম, ইহুদি হাইনে সম্বন্ধে বলছে, ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে অপরিচিত। উচ্চাঙ্গের রসিকতা বলতে হবে। যে লোককে ১৮১৭/২০ থেকে তাবৎ জর্মনি ও পরবর্তী যুগের রসগ্রাহী বিশ্বজন চেনে তিনি ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে হঠাৎ অপরিচিত হয়ে গেলেন, যেদিন হিটলার চ্যানসেলর হলেন!

তার পর তাড়াতাড়ি বললুম, কিন্তু এসব থাক। আপনার কথা বলুন।

বৈদিক যুগে স্ত্রী-পুরুষের সমান অধিকার। স্মার্ত যুগেই সেটা কমতে আরম্ভ করল। করে করে শেষ পর্যন্ত সতীদাহ পর্যন্ত।

তার পর তিনি যেরকম সবিস্তর ধাপে ধাপে নামতে লাগলেন তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। স্মৃতির আমি জানি সামান্যই কজন হিন্দুই জানে, স্মার্ত পণ্ডিত ভিন্নঃ মৰাদি যেসব শাস্ত্রকারদের নাম তিনি বললেন, তার বারো আনাই আমার অজানা। এবং যেটা আমার সবচেয়ে আশ্চর্য লাগল সেটা এই যে, সর্বদাই তিনি চেষ্টা করছিলেন প্রত্যেক বিধানের পিছনে কী অর্থনৈতিক কারণ থাকতে পারে সেটা খুঁজে বার করার। অন্যতম মূল সূত্রস্বরূপ তিনি গোড়াতেই বলেছিলেন, কার্ল মার্কস বলেছেন, যুগান্তকারী সামাজিক বিবর্তনের পিছনে রয়েছে অর্থনৈতিক কারণ –কিন্তু সেটা আমি একমাত্র কারণ বলে স্বীকার করিনে; সার্টেনলি, যদিও সেটা দি মোস্ট ইমপর্টেন্ট কারণ। এই সূত্রটি তিনি বার বার অতি সুকৌশলে প্রয়োগ করছিলেন।

সে রাত্রে তিনি যা বলেছিলেন তার সিকিভাগ লিখতে গেলে আমাকে একখানা পূর্ণাঙ্গ থিসিস বানাতে হয়!

শেষ করলেন এই বলে, শুনেছি, আপনাদের মডার্ন মেয়েরা এখন নাকি তাদের সর্ব পরাধীনতা, দুরবস্থার জন্য স্মৃতিকারদের অর্থাৎ পুরুষদের দোষ দেয়। কিন্তু সম্পূর্ণ দোষ ওঁদের নয়। মেয়েদেরও আছে। সে কথা আরেকদিন হবে। আইমা নোটিশ দিয়েছেন।

ইতোমধ্যে আমি একটি গেলাস চেয়ে নিয়ে সেইটে মোজেলে ভরে আইমার জন্য রান্নাঘরে নিয়ে যেতে বুড়ি প্রাচীন দিনের পদ্ধতিতে দাঁড়িয়ে উঠে দু হাতে দু দিকের স্কার্ট সামান্য তুলে কার্টসি করলেন। বললেন, না বাছা, অতখানি না। বসার ঘরে এসে মাটিলডের গেলাসে প্রায় সবখানি ঢেলে দিয়ে স্বাস্থ্য পান করলেন।

আমি মাটিলডেকে বললুম, আপনি না বলছিলেন, আপনি নিওরটিক? কিন্তু এতক্ষণ ধরে আপনি যে শাস্ত্র-চর্চা করলেন তার প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত তো যুক্তিসঙ্গত প্রতিজ্ঞা, প্রত্যক্ষ ও ন্যায়সঙ্গত অনুমোদনের দৃঢ়ভূমির ওপর নির্মাণ করলেন। এমনকি নিওরসিসের পুনরাবৃত্তি প্রমাদ থেকেও আপনার ধারাবাহিক প্রামাণ্যবিন্যাস সম্পূর্ণ মুক্ত।

মাটিলডে ম্লান হাসি হেসে বললেন, নিওরসিস, অনুভূতির রোগ। তার হৃভূমি আমাদের হৃৎপিণ্ডে, স্মৃতিশাস্ত্র মস্তিষ্ক রাজ্যের নাগরিক।

তার পর ভেবে বললেন, সেখানেও যে হৃৎপিণ্ডের নিপীড়ন একেবারে পৌঁছায় না তা নয়। সেখানেও কিছুটা ইদে ফিস্ এসে গিয়ে মস্তিষ্ককে নতুন কিছু করতে দেয় না। অর্থাৎ আমি সেই স্মৃতিশাস্ত্রে স্ত্রীজাতি থেকে বেরিয়ে গিয়ে কোনও নতুন কিছুর সন্ধানে লাগতে পারিনে। এই বিষয়ে অত্যন্ত কাঁচা বই বেরুলেও, ওটাতে যে কোনও তত্ত্ব নেই জেনেশুনেও সেইটেই পড়ি। দেখি তার বক্তব্য কোথায় কোথায় আমার সিদ্ধান্তের সঙ্গে ক্লিক্ করছে, যার কোথায় কোথায় করছে না। এতে করে কোন নবীন জ্ঞান সঞ্চয় হয়, কোন চরম মোক্ষপ্রাপ্তি! আর ওদিকে পড়ে রইল জ্ঞান-বিজ্ঞান ভুবনের নবাবিষ্কৃত খনির নব নব মণি-ভাণ্ডার– অবহেলা অনাদরে। ঠাকুরমাকে এনে দিলুম বড়দিনের নতুন স্কার্ট, জ্যাকেট, বনেট, জুতো। ঠাকুরমা মুখ গুঁজে রইলেন তাঁর স্ত্রী-ধনের সারাটোগা সিন্দুকের ভিতর। সেনিলিটি, ভীমরতি, ইদে ফিকস্।

চলুন– আইমার প্রতি সুবিচার করতে। এমনিতেই না, সেখানে অতি অবশ্য এ-সব কথা তুলবেন না।

আইমার রান্নার বর্ণনা দেব না। সুশীল পাঠক, তোমার আশি বছরের পাক্কা-পাচিকা ঠাকুরমা যদি থাকেন তবে তুমি অনায়াসে বুঝে যাবে, এঁরা মিন-নোটিশে, দ্বিপ্রহর রাত্রেও কী ভানুমতির ভোজবাজি দেখাতে পারেন।

এখানে ভোজ আমি ভোজন অর্থেই নিচ্ছি। বিক্রমাদিত্য-মহিষীর ইন্দ্রজালও অবশ্য তাতে রয়েছে। আর আমাদের জনপদ কাহিনীতেও আছে, ভোজরাজদুহিতা কালিদাসকে ভোজ দিয়ে পরিতুষ্ট করতেন।

মে মাসে রাত একটায় রাইনল্যান্ডেও বেশ শীত পড়ে। বেরোবার সময় মাটিলডে জোর করে আমার স্কন্ধে তাঁর হাল্কা ম্যাটলটি চাপিয়ে দিয়েছিলেন।

বারবা রসসার কথা যে আমার মনে ছিল না তা নয়। কিন্তু আমার হোটেল কাছেই।

ভেনুসর্বেকভেক-এ নেমেই সামনে পড়ে কাসলের বোটানিক্যাল গার্ডেনের চক্রাকার পরিখা। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দেখি অসংখ্য কুমুদিনী সৌরভজাল বিস্তার করেছে। চর্তুদিক নিঝঝুম নীরব। আমাদের গ্রামাঞ্চলের চেয়েও নীরব কারণ সেখানে বেওয়ারিশ কুকুর, বনের শেয়াল, দম্ভী মোরগা কেউ না কেউ নিস্তব্ধতা ভাঙবেই। দূরে কাইজার প্লৎসে দু-চারখানা মোটরের আনাগোনা আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু এরা নিরীহ নিদ্রালুর ঘুম ভাঙানোর জন্যই যে মোটরে হর্ন থাকে সেটা এখনও জানতে পারেনি।

বুকের ভিতরটা কীরকম মুচড়ে মুচড়ে উঠছে। আমি কবি নই, আর্টিস্ট নই– আমার হৃদয় স্পর্শকাতর নয়, কিন্তু অকালে বিনাদোষে হৃতযৌবনা, কিংবা আমার ছোট বোনের সখী তরুণী মাধুরীর থানকাপড়, কিংবা রবীন্দ্রনাথের বিধবা মল্লিকা একমাত্র রুগ্‌ণ সন্তানকে জলে বিসর্জন দিয়ে মকবাহিনীর কাছ থেকে লব্ধস্বাস্থ্য সন্তানকে ফিরে পাবার আশায় কঙ্কণ-বলয়হীন হাত দুখানি বাড়িয়ে যখন দেখে— দেখে সব মিথ্যা, সব বঞ্চনা– এসব দেখলে কিংবা কবি দেখালে আমার মতো মূঢ় জড়ভরতও চট করে দৈনন্দিন জীবনে ফিরে যেতে পারে না।

আমি কি ভালোবাসিনি?– আমার মতো অপদার্থ ক্ষণতরে ভালোবাসা পেয়েও ছিল– পথের ভুলে অপদার্থের প্রাণের কূলে বসন্তপবন হঠাৎ কখন এসে যায়, আর যাবার সময় ছেড়ে যায় তার অঞ্চল থেকে গ্রীষ্মের খরতাপ, রৌদ্রদাহ, তৃষ্ণাবাণ। ইচ্ছা করেই। কিন্তু সেকথা থাক। খ্রিস্টের বদনাম ছিল, তিনি মদ্যপ, তিনি নর্তকীকে সাহচর্য দেন। তিনি সব দেখেই বলেছিলেন, কাউকে বিচার করতে যেও না। পয়গম্বর বলেছেন, তোমার সবচেয়ে বড় দুশমন তোমার দুই কাঁধের মাঝখানে–অর্থাৎ তুমি নিজে। তবে কে তোমার প্রতি অবিচার করেছে সে অনুসন্ধানে আপন জান্ পানি কর কেন?

এর ভিতরকার জলন্ত বহ্নিশিখা এঁর মুখ আর হাত দু-খানিই পুড়িয়ে ফেলল কেন? ওই দুটিই মানুষের ভিতরকার মানুষকে প্রকাশ দেয়– সুখ-দুঃখ, আশা-নৈরাশ্য, তার জন্ম-মৃত্যু। বিশেষ করে মানুষের হাত দু-খানি প্রকাশ করে তার পরিবারের ঐতিহ্যগত স্পর্শকাতরতা, চিন্তাশীলতা কিংবা সে দুটি রসে রসে ভরা। মূঢ় জনের হাত দু-খানি কচ্ছপের খোলের মতো।

ইনি কি জানতেন, যখন তার বন্ধুর থিসিস তিনি টাইপ করে দিচ্ছিলেন যে, প্রত্যেকটি হরপে ঠোকা দেবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার আপন কফিন-বাক্সের ডালায় স্বহস্তে একটি একটি পেরেক পুঁতছেন।

স্বামী-সোহাগিনী কার্লোটা পাগলিনীর মতো ছুটে এলেন সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের কাছে প্যারিসে, তার পর গেলেন তার ভাশুর প্রবল প্রতাপান্বিত অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সম্রাটের কাছে পায়ে পড়লেন তাঁদের, তোমরাই আমার স্বামীকে পাঠিয়েছিলে মেকসিকোর সম্রাট করে। আমাকে সামান্য একমুঠো সৈন্য দাও। আমি তাকে বাঁচাতে পারব।

ওদিকে স্বামী মাকসিমিলিয়ান প্রহর গুনছেন কার্লোটার প্রত্যাবর্তন কিংবা অবধারিত মৃত্যুর জন্য। দ্বিতীয়টাই হল। খোয়ারেসের আদেশে তাঁকে দাঁড়াতে হল বন্দুকধারী সৈন্যদের সামনে। এমপেরর মার্কসিমিলিয়ান ক্ষাত্রধর্মের শেষ আভিজাত্যের প্রতীক– মৃত্যুবেদিতে দাঁড়াবার পূর্বে বন্দুকধারীদের প্রত্যেককে তিনি একটি একটি করে সোনার মোহর দিলেন।

সব খবর কার্লোটা পেলেন, প্যারিস-ভিয়েনায় ছুটোছুটির মাঝখানে। তার মাথার ভিতর কী যেন একটা ঘটে গেল। তার চোখে দেখা দিল এক অদ্ভুত দ্যুতি যার দিকে কেউই তাকাতে পারত না। পারলে তার সম্মুখ থেকে পালাত।

তার পর দীর্ঘ ষাট বৎসর ধরে তিনি কথা বলতেন ওপারের লোকের সঙ্গে। আর বার বার ফিরে আসতেন ওই এক কথায়; তাঁর স্বামীকে বলতেন, মাল, মাল, সব দোষ আমারই। আমারই সব দোষ।

আমি বিমূঢ়ের মতো কিছুতেই ভেবে পাইনে মানুষের দোষ কোথায়, তার পাপই-বা কী পুণ্যই-বা কী?

কী সদাশিব, শান্ত এই বন্ শহর। কিন্তু তাই কি? চেস্টনাট গাছের ঘন পাতা থেকে ঝরে পড়ল আমার হাতের উপর এক ফোঁটা হিমিকা। কার এ অশ্রু? আমি জানি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে খুব কম মেয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসত– আদৌ আসত কি না জানিনে– তাই ছাত্রেরা প্রণয় জমাত বন্-বালাদের সঙ্গে। তার পর টার্ম শেষ হতেই অনেকেই চলে যেত ভিন্ন ইউনিভার্সিতে। তাই এ-প্রেমের নাম সেমেস্টার-লিবে বা এক টার্মের প্রণয়। কারও কারও প্রেম অবশ্য অপেক্ষাকৃত দীর্ঘস্থায়ী হত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবাই আপন আপন অধ্যয়ন সমাপন করে উড়ে চলে যেত এদিক-ওদিক। আর পড়ে রইত বন্-বালাদল তাদের অশ্রুজল নিয়ে।

বন্-এর আপন তরুণদলই এ পরিস্থিতির সঙ্গে সুপরিচিত।

আমার একটি ঘটনা মনে পড়ল। আমার এক বান্ধবীকে রাত্রিবেলা বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ঘরমুখো রওনা হয়ে কয়েক পা এগিয়েছি এমন সময় শুনতে পেলুম বান্ধবী একতলার দিকে ডাকছে তার ঘুমন্ত ভাইকে নিচের সদর দরজা খুলে দেবার জন্য। আমার উল্টো দিক থেকে আমার দিকে এগিয়ে আসছে একটি তরুণ। সে ভেবেছে মেয়েটি বুঝি আমাকে ডাকছে, আর আমি সাড়া না দিয়ে চলে যাচ্ছি। আমাকে পাস করার সময় মিনতি-ভরা মৃদুকণ্ঠে বলল, এত কঠিন হৃদয় হবেন না, য়ুঙার হার (ইয়াং জেন্টলম্যান)।

সে রাত্রে বন্-এর গলিঘুচি বেয়ে বেয়ে অনেক ঘোরাঘুরি করেছিলুম। মনটা বড় অশান্ত। ভোরের দিকে হঠাৎ রোদের একজন পুলিশ আমার সামনে দাঁড়িয়ে বুটের হিলে হিলে ক্লিক করে সেলুট দিল। আমি বললুম গুটন্ আবৃন্ট।

পুলিশ বলল, গুড মর্নিং বলাই কালোপযোগী হবে। ভোর হতে চলেছে।

তার পর গলা নামিয়ে বলল, এই নিয়ে আপনাকে তিনবার ক্রস করলুম। ইস্ট ভাস লো? এনিথিং রং?

এ শহরের পুলিশও দরদী। আমি বললুম, না, অনেক ধন্যবাদ।

বলল, এরকম ছন্নের মতো একা একা রাতভর ঘোরাঘুরি করে কী লাভ? চল, ওই বেঞ্চিটায় বসে আমার সঙ্গে একটা সিগারেট খাবে।

আমি নিজের প্যাকেট বের করলুম। আমার সিগারেট নিতে খুব সহজে রাজি হল না।

বলল, তুমি ভ্যাগাবন্ড নও, রাস্তাও হারাওনি, এবং চুরিতে যদি হাতেখড়ি হয়ে থাকে তবে সে অতি সম্প্রতি। আমি তোমাকে কিছুটা চিনি। কয়েক বছর আগে যখন এখানে ছাত্র ছিলে তখন আমার বিটেই তোমার বাসা ছিল। তার পর কিছুদিন তোমাকে না দেখতে পেয়ে বুঝলুম আর পাঁচটা ফেৎলেস টমাটোর মতো (জর্মনরা কেন টমাটোকে fathless বলে, জানিনে) পাস করে দেশে চলে গেছে। কিন্তু জানো, তোমাকে সে পর্যায়ে ফেলা যায় না। বিশ্বাস করবে না, তুমিই পয়লা বিদেশি যে পরীক্ষা পাস করার পর চলে গিয়ে আবার ফিরে এসেছ। কিছু মনে করো না, আমি বড় খোলাখুলি কথা বলি। হ্যাঁ, তোমার সেই প্ল্যাটিনাম ব্লন্ড বান্ধবী গেল কোথায়? তোমাদের দুজনার চুল ছিল এই শহরের দুই এস্ট্রিম। সবাই তাকাত।

আমি বললুম, ও! মার্লেনে? সে বিয়ে করে ফ্রিজিয়ান দ্বীপে চলে গেছে।

তাই বুঝি ছন্নের মতো?

আমি ধীরে ধীরে বললুম, না, আজ একটি মেয়ের জীবনকাহিনী শুনে বড় দুঃখ হল। মন শান্ত হচ্ছিল না।

বলল, সরি।

সিগারেট শেষ করে শুপো উঠে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, তোমার পার্সনাল ব্যাপারে আমি টু মারতে চাইনে সে তো স্বতঃসিদ্ধ! তাই শুধু বলি এই বন্ শহরে ক্রাইম এতই কম হয় যে, দুষ্টের দমন অপেক্ষা শিষ্টের পালন করতে হয় আমাদের অর্থাৎ পুলিশের বেশি। আর্তের সাহায্য করতে গিয়ে কিন্তু আমি বার বার দেখেছি, সত্যকার সাহায্য করা অতি কঠিন, প্রায় অসম্ভব। জর্মনে একটা কথা আছে : মমতায় ভরা এই যে মায়ের শরীর, যে তার বাচ্চার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত, সে কি পারে তার মুমূর্ষ শিশুকে তার মরণে সাহায্য করতে? এইটুকু দুধের বাচ্চাকেও মরতে হয় আপন মরণ। যে অজানা পথে যেতে ত্রিশ বছরের জোয়ানও ভয় পায়, আট বছরের শিশুকেও সেই পথে পা দিতে হয়।

কে কার সাহায্য করতে পারে?

পারেন শুধু মা মেরি।

আবার দেখা হবে, য়ুঙার হ্যাঁর, শুধু শুধু মনখারাপ না করে হোটেলে গিয়ে শুয়ে পড়। আর দরকার হলে পুলিশের পুৎসির খবর নিয়ো।

বড় দুশ্চিন্তায় পড়লুম। আমার ছাত্রজীবনের ল্যান্ড-লেডি এখন থাকেন ব্যুকেবুর্গ নামক ছোট্ট শহরে। তার পাশে একটা গ্যারিসন। তিনি এসেছিলেন বলে, এবং আমার খবর জানতেন বলে আমাকে ফোন করলেন, বললেন জরুরি খবর আছে। তাঁকে লাঞ্চে নিমন্ত্রণ করলুম তাঁর প্রিয় আম রাইন রেস্তোরাঁয়। সেখানে গিয়ে দেখি, তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। আমার বিস্ময় প্রকাশ করার পূর্বেই তিনি বললেন, নাৎসিদের গোয়েন্দাগিরি চরমে পৌঁছেছে। এঁদের অনেকেই দূর থেকে সুদ্ধমাত্র ঠোঁটের নড়া থেকে কথা বুঝে নিতে পারে। তাই বাইরেই জরুরি গোপন কথাটা সেরে নিই।

খবরের কাগজে নামগন্ধ নেই, লার্ক-হক জানে না, কিন্তু আমরা গ্যারিসনের কাছে থাকি, আমাদের কাছে ট্রপ মুভমেন্ট লুকানো অসম্ভব। পরশু রাতে প্রায় পঁচিশ হাজার সৈন্য গেছে চে-সুড় এটেন্ সীমান্তে। লড়াই যদি আচমকা লেগে যায়, তবে আপনি ইন্ডিয়ান, অতএব ব্রিটিশ, অতএব শত্রু। নজরবন্দি হয়ে থাকবেন। দেশ থেকে টাকা আসবে না। দুরবস্থার চরম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তাই দেখেছি।

তার সদুপদেশ– না বললেও আমি বুঝলুম ইংরেজ লড়াই হারলে যে তার নিজস্ব আবিষ্কার করা ভাষায় বলে বাহাদুরিকে সাথ হটনা (বীরত্বের সঙ্গে পলায়ন! শোলার পাথর বাটি, ডুববেও ভাসবেও) সেইটি আমার অবলম্বন করা।

বললুম, চলুন, ভিতরে গিয়ে খেতে খেতে চিন্তা করি।

এ-রেস্তোরাঁর সঙ্গে ল্যান্ড-লেডির নিদেন চল্লিশ বছরের পরিচয়। মালিক, ওয়েট্রেস, সবাই উদ্বাহু হয়ে তাকে অভিনন্দন জানাল।

হঠাৎ যদি এখন আমাকে জর্মনি ত্যাগ করতে হয়, তবে তার পূর্বে মাটিলডেকে তার শেষ প্রশ্ন শুধোবার একটা সুযোগ দিতে হয়।

টেলিফোনে তাঁকে লাঞ্চের নিমন্ত্রণ জানালুম আর টাপে-টোপে বোঝালুম, আমার বিশেষ প্রয়োজন।

ফিরে আসতে ফ্রাউ এশ ফিসফিস করে বললেন, কাউন্টারের পিছনে ওই ওয়েট্রেসটিকে লক্ষ করুন। বেচারি পড়েছিল এক পিচেশের পাল্লায়। একটা গরিব ডাক্তারির ছাত্র করে ওর সঙ্গে প্রণয়। মেয়েটি পুরো ছ বছর ওর খরচা যোগায়। কথা ছিল শেষ পরীক্ষার পর সে তাকে বিয়ে করবে। পরীক্ষা পাসের তিন দিন পরে বদমাইশটা এক খানদানি, ধনী মেডিকেল স্টুডেন্টকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে তাকে বিয়ে করেছে।

মেজাজটা তেতো হয়ে গেল। আমি যেসব ঘটনা শুনতে চাইনে সেগুলোই যেন গেস্টাপো ডালকুত্তার মতো আমার পিছনে লেগেছে।

এশ বললেন, কিন্তু ধন্যি মেয়ে! রেস্তোরাঁর এই যে মালিক, সে মেয়েটাকে বড় স্নেহ করে। সে তো রেগে তার উকিল ভাইকে ফোন করে বলল, লাগাও দু-দুটো মোকদ্দমা একটা ফৌজদারি, একটা দেওয়ানি। ব্যাটাকে আমি জেলে পচাব, আর ব্যাটার ডাক্তারি লাইসেন্স দিয়ে টয়লেট পেপার বানাব। কিন্তু ওই যে বললুম, ধন্যি মেয়ে, কিছুতেই রাজি হল না কড়ে আঙুলটি পর্যন্ত তুলতে। কী আকাট, কী আকাট মেয়েগুলো!

আমি কিছু না বলে বিরাট এক পিস কাঁচের দেওয়ালের ভিতর দিয়ে মাটিলডের জন্য পথ চেয়ে রইলুম। দেখা পাওয়া মাত্র বাইরে গিয়ে তাকে সবকথা বললুম।

মাটিলডে কিছুমাত্র আশ্চর্য না হয়ে বললেন, আমি অনেককিছু আজ সকালবেলা একচেঞ্জে গিয়েই জানতে পেরেছি। আমরা সবকিছুই জানতে পাই। এমনকি, বার্লিনস্থ ফ্রান্সের রাজদূত মঁসিয়ো ফ্রাঁসোয়া পঁসে পর্যন্ত কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়েছেন।

আমাকে একটু ভাবতে সময় দিন।

খাওয়ার পর হোফ গার্ডেনে বেড়াতে বেড়াতে স্থির হল, কাল সকালের গাড়িতে আমি প্যারিস চলে যাব। ফাড়াটা কেটে গেলে আমি ফের বন চলে আসব। নইলে সে তখন দেখা যাবে।

ফ্রাই এশকে আমরা মনসটার গির্জে অবধি পৌঁছে দিলুম। আচার-নিষ্ঠ রমণী পথে আমার মঙ্গলের জন্য একটা বাড়তি মোমবাতি কিনলেন– মা মেরির পদপ্রান্তে জ্বালাবেন বলে।

মাটিলডেকে একসচেঞ্জে পৌঁছে দিয়ে বললুম, আপনার সঙ্গে ডিনার খাব। কটায় আসব?

পাঁচটার পরে যে কোনও সময়।

হিটলারের ওপর পিত্তিটা চটে গেল। একটা নিরীহ বঙ্গসন্তানকে তার ছুটিটা আরামসে কাটাতে দেয় না। কিন্তু গোস্সাটা অবিমিশ্র নয়। একটা অস্ট্রিয়ান ভ্যাগাবন্ড, যুদ্ধে ছিল মাত্র করপরেল, সে কি না আমাদের দুশমন মহামান্য ইংলন্ডেশ্বর– যার রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না, (অবশ্য ফরাসিরা বলে, ইংরেজকে ভারতীয়দের সঙ্গে অন্ধকারে ছেড়ে দিতে স্বয়ং ব দিয়ো –করুণাময় সৃষ্টিকর্তাও সাহস পান না) এবং তাঁর সবৃ কনজারভেটিভ পুষ্টিকে প্রায় চার বছর ধরে তুর্কি নাচন নাচাচ্ছে, এ-সুসমাচারটি কানে এলেই মনে হয়, ইটিকে লিপিবন্ধ করার জন্য নয়া নয়া মথি মার্কের প্রয়োজন।

অপরাহ্নের এই মধুর আলোতে কার না শরীর অলস আবেশে ভরে যায়। কাইজার পাৎসের ফোয়ারের উপর ক্ষণে ক্ষণে রামধনু লাগছে। পাশে, সেই ১৯৩০ থেকে পরিচয়ের বুড়ো উইলি দিশি-বিদেশি খবরের কাগজ বেচছে। জর্মন কায়দায় সে দি টাইমস-কে টে টিমেস উচ্চারণ করত বলে আমরা কৌতুক অনুভব করতুম। কাছে এসে কানে কানে বলল, সব বিদেশি কাগজ বাজেয়াপ্ত। একটা বাজে কাগজ কী করে এসে গেছে, সক্কলের দৃষ্টি এড়িয়ে। আমার মেয়ে পড়ে বলল, প্যারিস লন্ডনে ধুন্দুমার। বলে পুট করে আমার পকেটে ঢুকিয়ে দিল কাগজখানা।

নাহ্! এখন পড়ে কী হবে? তার চেয়ে তাকিয়ে থাকব চেনাট সারির দিকে, নাকে আসবে বোটানিকসের সুগন্ধ, কানে আসবে পপেলস্ডফের এভিনিউর কাচ্চাবাচ্চাদের খেলাধুলার শব্দ, কিংবা কারও খোলা জানালা দিয়ে পিয়ানো প্র্যাকটিস। কিংবা

পা দুটো লম্বা করে একটা বেঞ্চিতে হেলান দিয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে নিয়েছি।

সামনে মাটিলডে। আপিস থেকে বাড়ি আসা-যাওয়ার পথ তার এইটেই। বললেন, কী স্বপ্ন দেখছিলেন?

আমি বললুম, সেই যে চীনা দার্শনিক বলেছিলেন, স্বপ্নে দেখলুম আমি প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছি। জেগে উঠে চিন্তায় পড়লুম, এই যে আমি ভাবছি আমি মানুষ, সে কি তবে প্রজাপতির স্বপ্ন? প্রজাপতি স্বপ্ন দেখছে, সে মানুষ হয়ে সোনালি রোদে রুপালি ঝরনার কাছে বসে চা খাচ্ছে।

মাটিলডে বললেন, স্বপ্নে যদি কিছু একটা হবেই, তবে প্রজাপতিটা লক্ষ্মীছাড়া মানুষ হতে যাবে কেন? বরঞ্চ রুপালি ঝরনা হলেই পারে। কত না পাহাড়, কত না সবুজ মাঠ, কত না পাইনবন পেরিয়ে সে হবে প্রশস্ত নদী, তার বুকের উপর দিয়ে ভেসে যাবে নলরাজের রাজহংস, ভরা পালে উড়ে যাবে ময়ূরপঙ্খী, তার বুকে কখনও উঠবে ঝড়ঝঞ্ঝা, কখনও প্রতিবিম্বিত হবে পূর্ণ চন্দ্র। সর্বশেষে সে পাবে তার চরম মোক্ষ পরমা শান্তি-সমুদ্রের সঙ্গে আপন সত্তা মিলিয়ে দিয়ে।

আমি বললুম, অন্তত মানুষ এই স্বপ্নই দেখেছে : নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ –আসলে সেটা কবি রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন।

উত্তর মেঘ ও যক্ষের স্বপ্ন।

কিছু উত্তর না দিয়ে মনে মনে বললুম, হায় সৃষ্টিকর্তা, প্রেমের ঠাকুর! কোথায় না এ-রমণী এসব কথা বলবে তার দয়িতের সঙ্গে, আর কোথায় সে এসব বলছে আমার মতো কলাগাছকে। ওমর খৈয়াম তাই পৃথিবীর উপর থুথু ফেলতে চেয়েছিলেন।

মাটিলডে কী খবর জানতে চান, সেটা আমি মোটামুটি অনুমান করতে পেরেছি, কিন্তু হায়, আমি তো তাঁকে এমন কিছু বলতে পারব না, যা শুনে তাঁর বেদনাভার লাঘব হবে। তাই তিনি সেটা না শুধালেই আমি শান্তি পাই। কিন্তু আমি যদি তাঁকে শুধোবার সুযোগ না দিই, তবে কি সেটা আমার পক্ষে অন্যায় হবে না? কাল যাচ্ছি প্যারিস। যদি সত্যি লড়াই লেগে যায়, তবে আমাদের দুজনাতে পুনরায় দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত।

যা হয় হবে, আমি তাকে সে সুযোগ দেব।

ব্যালকনিতে লম্বমান হয়েছি দুখানা ডেক চেয়ারে। বললুম, দুজনার ভালোবাসা যদি কোনও কমন ইনটারেস্টের চতুর্দিকে গড়ে ওঠে, তবে সেটা হয় বড় প্রাণবন্ত, মধুর ও দীর্ঘস্থায়ী। ব্রাউনিং আর মিসেস ব্রাউনিং দুজনা একে অন্যের মধ্যে মিশে যেতেন কবিতায় কবিতায়। এমনকি, শুষ্ক বিজ্ঞানও দুজন মানুষকে একই রসের বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আপনার কথা যখনই ভাবি, তখনই মনে পড়ে প্রফেসর ও মাদাম কুরির কথা।

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর তিনি বললেন, আপনার এ কথাটি কালিদাসও বলে গেছেন। গৃহিণী, সচিব ইত্যাদি–অতখানি আশা আমি কখনও করিনি। এবং আমি আমাদের প্রণয়ের প্রথমদিন থেকেই জানতুম, ডিগ্রি পাওয়ার পরই তিনি চলে যাবেন আপন দেশে–না, দাঁড়ান, জানলুম কিছুদিন পরে। সংস্কৃত পড়াবার সময় তিনি মহাভারত থেকেও কিছুটা বেছে নেন। তাতে ছিল কচ ও দেবযানীর উপাখ্যান। আপনি ভাববেন না, তিনি কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে ওই উপাখ্যানটিই আমার জন্য বেছে নিয়েছিলেন। তা হলে হয়তো তাঁর প্রতি অবিচার করা হবে। কিন্তু কী জানি, কে জানে–।

হঠাৎ যেন দিশে পেয়ে বললেন, দেখুন, কাল আপনাকে কথাটা বলেছিলুম, সেটা আবার, আরও জোর দিয়ে বলি, আমি নিওটিক, আমার মন যখন কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছয়, তখন মনে হয়, সেইটেই ধ্রুব। আবার পরে দেখি, সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

হঠাৎ হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বিকৃত কণ্ঠে বললেন, শুধু এই দশ বছরের যন্ত্রণা মিথ্যা নয়।

ক্ষীণ চন্দ্রালোকে দেখি দু হাতের ফাঁক দিয়ে বয়ে বেরুচ্ছে চোখের জল। কত বৎসরের চাপা কান্না, কে জানে? এর পূর্বেও তিনি তার বেদনার উল্লেখ করেছেন, কিন্তু চোখ দুটি ছলছল করতেও দেখিনি। আর এ যে-ধারা নেমে এসেছে, এ তো কোনও পরিণত বয়স্কা রমণীর কান্না নয়, এ যে অবুঝ শিশুর কান্নার মতো। ইনি যখন শাস্ত্রালোচনা করেন তখন মনে হয়, ইনি আমার পিতার বয়সী, দৈনন্দিন আচরণে মনে হয়, ইনি আমার বড়দিদির বয়সী। আর এখন? এখন দেখি তিনি কাঁদছেন আমাদের পরিবারের সবচেয়ে ছোট, আমার অভিমানিনী ছোট বোনের মতো। সে কোনও যুক্তি-তর্ক শোনে না, কোনও সান্ত্বনা মানে না। যেন সে এই বিশ্বসংসারে একেবারে একা– তার সঙ্গী শুধু তার চোখের জল।

কী আছে বলার, কী যায় লেখা?

কিন্তু তাঁর আত্মসংযম অসাধারণ। বছরের পর বছর চোখের জল চেপে রাখার ফলে শুকিয়ে গেছে তার মুখ আর হাত দুখানা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তাঁর জীবনে এই তাঁর প্রথম ভেঙেপড়া।

তার কান্নার ভিতর দিয়ে তিনি শুধু একটি অনুযোগ প্রকাশ করেছিলেন। ডিগ্রি লাভের কয়েকদিন পরই তাঁর বন্ধু দেশে ফিরে যান। বন স্টেশনে তিনি তাকে বিদায় দেন।

তার পর তার কাছ থেকে একখানা চিঠি না, একখানা পোল্টকার্ড না, একটি ছত্র মাত্র না। নববর্ষে, জন্মদিনেও না। সেই যে বন স্টেশন থেকে তিনি বিলীন হলেন, তার পর তিনি বেঁচে আছেন কি না, সেকথাও মাটিলডে জানেন না। মাটিলডে তাঁকে দুখানা চিঠি লিখেছিলেন।

আমি জানতুম, এইবারে আমার অগ্নিপরীক্ষা আসবে, কিন্তু পূর্বেই বলেছি, আমি স্থির করেছিলুম, আমি প্যারিস পালিয়ে গিয়ে সেটা এড়াব না।

এপারে ওপারে যে পারই হোক, হয়ে যাক।

যে প্রশ্ন তিনি বার বার শুধোতে গিয়ে আশা-আকাঙ্ক্ষার দ্বন্দ্বে শুধোতে পারেননি, আমি নিজের থেকেই তার উত্তর দিলুম।

ধীরে ধীরে বললুম, আমি ডা, কাণেকে চিনি। চিনি বললে ভুল বলা হবে। সামাজিক অনুষ্ঠানে লৌকিকতার দু-চারটি কথা হয়েছে মাত্র।

এবারে আমারও কড়া একটা কিছু খাওয়ার প্রয়োজন হয়েছে। তারই ছল করে ঘরের ভিতরে চলে গেলুম। ইনি এটা সয়ে নিন।

ফিরে এলে মাটিলডে শুধোলেন, বরোদা তো ছোট শহর; উনি নিশ্চয়ই জানেন, আপনিও বনের ছাত্র ছিলেন। সে নিয়ে কোনও কথাবার্তা হয়নি?

না, আমি চেষ্টা করেছিলুম, কিন্তু উনি কোনও কৌতূহলই দেখালেন না। তবে আপনি নিশ্চয় জানেন, উনি কথা বলেন অত্যন্ত কম।

মাটিলডে এক ঝটকায় খাড়া হয়ে বসলেন। প্রথমটায় বিস্ময়ে যেন বাক্যহারা। কী বললেন আপনি! পারঙ কথা বলেন কম! আমার সঙ্গে তো অনর্গল কথা বলতেন!

মনে পড়ল আমার বন্ধু সোহরাব ওয়াডিয়ার মন্তব্য। পাণ্ডুরঙ শঙ্কর কাণে সম্বন্ধে। বললুম, যখন দেখলুম তার কৌতূহল অত্যন্ত কম, তখন আমিও তার সম্বন্ধে কোনও খবর নিইনি। তৎসত্ত্বেও তাঁর কথা উঠলে আমার এক বন্ধু বলেছিলেন, আপনজনের মাঝখানে– ওই যে আপনি বললেন– উনি অনর্গল কথা বলেন।

মনে হল, মাটিলডে যেন খানিকটা সান্ত্বনা পেলেন। তাতে আশ্চর্য হবার কী? কবি রুমির দিকে তাঁর গুরু রাস্তায় তাকে ক্রস করার সময় একবার মাত্র একটুখানি স্মিতহাস্য করেছিলেন। সেইটুকুর অনুপ্রেরণায়ই তিনি রচলেন তার মহাকাব্য।

এইবারে আমার শেষ বক্তব্যটুকু বলার সময় এসেছে।

আমি বললুম, মাটিলডে, ডা. কাণের কী করা উচিত ছিল না-ছিল সে জানেন বিধি। হয়তো আপনাকে যাবার পূর্বে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে গেলে ভালো হত, হয়তো না করে ভালোই করেছেন। আপনি যদি নিওরটিকই হয়ে গিয়ে থাকেন আমার কিন্তু বিশ্বাস হয় না– তা হলে উনি যাই করতেন না কেন, আপনি ভাবতেন, তার উল্টোটা ভালো হত।

কিন্তু সেটা আসল কথা নয়। আসল কথা এই : কাণে বরোদার রাজপ্রাসাদের গোপন-বিভাগে কাজ করেন। সেখানকার আইন অনেকটা ফরেন অফিসের মতো। জানেন তো, বিদেশিনীকে বিয়ে করাও ওদের মানা। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সে-অনুমতিও তারা দেয়– ওদের সিনিকাল বিশ্বাস, বরঞ্চ মানুষ তার স্ত্রীর কাছ থেকে জিনিস গোপন রাখতে পারে, প্রণয়িনীর কাছ থেকে কিছুতেই নয়; এই তো সেদিন গোয়েবলসের মতো প্রতাপশালী মন্ত্রীও এই ধরনের ব্যাপারে হিটলার কর্তৃক লাঞ্ছিত হয়েছেন। নেটিভ স্টেট মাত্রই চক্রান্তের চাণক্যালয়– আর রাজপ্রাসাদ! সেখানে পরস্পরবিরোধী একাধিক গোপন বিভাগ একে অন্যের বিরুদ্ধে সর্বক্ষণ চক্রান্ত-কর্মে মত্ত। আপনার সঙ্গে পত্রালাপ ধরা পড়তই একদিন না একদিন, এবং তাঁর শত্রুপক্ষ যে সেটা কীভাবে কাজে লাগাত তার কল্পনাও আমি করতে পারিনে। কাণেকে বৃহৎ সংসার পুষতে হয়– তিনিই একমাত্র উপার্জনক্ষম।

দাঁড়িয়ে বললুম, এইবারে উঠি। কাল প্রভাতে প্যারিস গমন। হিটলার আমার সব প্রোগ্রাম তছনছ করে দিয়েছেন। সবাইকে আজ রাত্রেই চিঠি লিখে জানাতে হবে। তার ওপর প্যাকিং রয়েছে।

মাটিলডে যেন চিরকালের মতো দাঁড়ালেন। আমার কাঁধের উপর হাত রেখে প্রায়ান্ধকারে আমার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইলেন। আমার মনে হল, আমি যেন তার চোখে একটুখানি জ্যোতি দেখতে পেয়েছিলুম। সত্য জানেন অন্তর্যামী।

কিন্তু মিথ্যে বলেছিলুম আমি মাটিলডেকে। অন্তর্যামী যেন ক্ষমা করেন। আমি কাণের সাফাই গাইনি। আমি চেয়েছিলুম, মাটিলডের বুকের রক্ত দিয়ে গড়া তার বল্লভ যেন ধূলিতলে লুণ্ঠিত না হয়। মাটিলডের জীবন তারই ওপর নির্ভর করছে।

প্যারিসে পৌঁছনো মাত্রই শুনি, চেক সীমান্ত সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছে। হিটলার সৈন্য অপসারণ করেছেন। আমি আমার জাহাজের প্রিয়ার অনুসন্ধানে বেরোলুম না। কারণ, বনে থাকতেই তাঁর রোদনভরা প্রথম চিঠি পাই, আমি এখানে বাঁচব কী করে? এ যে বড় হৃদয়হীন জায়গা। তুমি এখানে চলে এসো না, ডার্লিং।

ভ্যাগ্যিস আমি যাইনি। দু দিন পরে দুসরা চিঠি কাল সহকর্মীদের সঙ্গে গ্রামাঞ্চলে বেড়াতে গিয়েছিলুম। ভেরি ইনটারেসটিং! মনে হচ্ছে এখানে তিন বছর কাটাতে পারব। সাদা চিঠির কাগজে সাদা কালিতে লেখা প্রিয়ার প্রাঞ্জল বাণীটি বুঝতে আমার লহমা-ভর সময়ও লাগেনি। বস্তুত প্রথম চিঠি থেকেই সেটা আমার বুঝে নেওয়া উচিত ছিল। যে বলে, প্যারিস হৃদয়হীন, সে নিশ্চয়ই সেখানে পৌঁছনো মাত্রই পড়ি-মরি হয়ে, উদোম হিয়া নিয়ে হিয়ার সন্ধানে বেরিয়েছিল। ধন্য আমি, এহেন উদারহৃদয়ার সঙ্গে আমার হার্দিক পরিচয় হয়েছিল। ইনি কাণে গোত্রের নন; নিঃশব্দে, নীরবে মহাশূন্যে লীন হন না। প্যারিস ধন্য। মার্কিন প্রবাদ আছে, পুণ্যশীল মার্কিন মাত্রই মৃত্যুর পর জন্ম নেয় প্যারিসে।

আম্মো বেকার দিন কাটাইনি, কারণ, আমার যে কোনও কাজ নেই। করে করে তিন দিনের জায়গায় কেটে গেল দু মাস। সর্বনাশ! প্যারিস বড়ই সহৃদয়, কিন্তু দরাজ-দিল নয়। কিপটেমি শিখতে হলে প্যারিসের খাঁটি বাসিন্দাদের সঙ্গে এক সপ্তাহ বসাই যথেষ্ট। শেষটায় রু্য দা সমরারের ইন্ডিয়া ক্লাবে জাতভাইদের সর্বনাশ করে তাদের তহবিল তছরুপ করে বিজয়গর্বে বন ফিরে এলুম। একদা নেপোলিয়ন যেরকম প্যারিস থেকে বেরিয়ে হেলায় কলোন-বন্ জয় করেছিলেন।

মাটিলডেকে আমার ওপর বেশি চাপ দিতে হল না। আমি সুড়সুড় করে তাঁর ফ্ল্যাটেই ঢুকলাম।

রবিবারে একসঙ্গে গির্জেয় গেলুম।

আইমা দেখি কাণের কাছ থেকে বেশ দু-চারটে ইন্ডিয়ান ডিশ বানাতে শিখে নিয়েছিলেন। আর মাত্র তিন দিন বাকি। ভেনিস বন্দরে জাহাজ ধরে বোম্বাই পাড়ি দেব। ট্রাভেল আপিসে ভেনিস অবধি ট্রেনের টিকিট কেটে বাড়ি ফিরে দেখি ধুন্দুমার। গলা-কাটা মুরগির মতো দুই রমণী এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছেন।

সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য! কাণে রাজপ্রাসাদের ঠিকানা দিয়ে মাটিলডেকে কেবল করেছেন, ভারতীয় ডাক্তারের উপদেশে তিনি কঠিন রোগে আক্রান্ত তার ছেলেকে ইউরোপ পাঠাচ্ছেন। মাটিলডে তার দেখভাল করতে পারবেন কি না, যেন কেবল করে জানান।

মাটিলডের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। ইতোমধ্যে তিনি কেবুলের জবাব তো দিয়েছেনই, এখন বসে গেছেন আরেকটা কেবৃলের মুসাবিদা করতে। আর আমাকে প্রশ্ন, ছেলেটার বয়স কত, কী ব্যামো হতে পারে, সে নিরামিষাশী কি না, এবং সবচেয়ে বড় প্রশ্ন সে নামবে কোন বন্দরে? তিনি সেখানে উপস্থিত থাকতে চান, নইলে তাকে দেখবে কে? মুসাবিদা বন্ধ করে ফোন করেন কখনও বা ট্রাভেল আপিসকে কখনও-বা তার দপ্তরকে পাওনা ছুটির মজুরির জন্য। হঠাৎ সবকিছু বন্ধ করে লেগে যান প্যাক করতে হয় যাবেন মার্সেই, নয় রোম। সেখান থেকে ইটালিয়ান যে কোনও বন্দরে পৌঁছানো যায় ঘণ্টা কয়েকের ভিতর। নইলে এখান থেকে খবর পেয়ে তিনি ইটালিয়ান বন্দরে পৌঁছতে না পৌঁছতে জাহাজ হয়তো ভিড়ে যাবে সেখানে; ট্রাভেল দফতর অভয় দেয়, তিনি মানেন না। ইতোমধ্যে তারা পিয়ন মারফত পাঠিয়ে দিয়েছে, বোম্বাই-ভূমধ্যসাগরের তাবৎ জাহাজ কোম্পানির টাইমটেবল। আমি সেগুলো অধ্যয়ন করতে লেগে গেলুম গভীর মনোযোগ সহকারে।

তাঁর দ্বিতীয় কেবল যাওয়ার পর মাটিলডের মনে জাগল আরেক ঝুড়ি বাস্তব-অবাস্তব প্রশ্ন। তৃতীয় মুসাবিদায় তিনি বসে যান।

হাত নিঙড়াতে নিঙড়াতে পায়চারি করেন আর বলেন, মাইন গট, মাইন গট হে ভগবান, হে ভগবান!

হঠাৎ ছুটে এলেন আমার কাছে। মুখ থেকে শেষ রক্তবিন্দু অন্তর্ধান করেছে। আর্তকণ্ঠে শুধালেন, হঠাৎ যদি যুদ্ধ লেগে যায়, তবে কী হবে? আমি শান্ত কণ্ঠে বললুম, নিরপেক্ষ সুইটজারল্যান্ডে চলে যাবেন। সেখানে চিকিৎসার কোনও ত্রুটি হবে না। যক্ষ্মা হলে যে সেখানেই যেতে হবে সেকথা আর তুললুম না। শুধু বললুম, বরোদার কেবল মহারাজার অজান্তে আসতে পারে না; আপনি তার সাহায্য পাবেন। জর্মন পররাষ্ট্র দফতর বরোদার মহারাজকে প্রচুর সম্মান করে। তিনি আশ্বস্ত হলেন।

গভীর রাত অবধি পাশের ঘরে তাঁর মৃদু পায়চারি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লুম।

দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যাবেলা আমাকে বললেন, তিনি মনস্থির করেছেন, আমার সঙ্গে পরের দিন ভেনিস যাবেন।

ট্রেনে উঠেই তিনি হঠাৎ অত্যন্ত শান্ত হয়ে গেলেন। ভেনিস না পৌঁছনো পর্যন্ত এখন আর কিছু করার নেই।

গভীর রাত্রে স্লিপিং কোচের ক্ষীণালোকে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি কী প্রশান্ত মমতাময় তাঁর মুখচ্ছবি! খানিকক্ষণ পরই ইটালিতে ঢুকব– যে দেশের মাদোন্না-মাতৃমূর্তি সর্ব বিশ্বে সমাদৃত হয়। আমার মনে হল আমার এই মাটিলডের মুখে যে মাদোন্নার ছবি ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে এ ক-দিন ধরে প্রহরে প্রহরে, সে তো যে কোনও গির্জার দেবিকে উজ্জ্বল করে দিতে পারে। এ রমণী গর্ভে সন্তান না ধরেও মা-জননী মাদোন্নাদের ভিতর শাশ্বত আসন পেল।

কেন পাবে না? জাতকে আছে, একদা নিদারুণ দুর্ভিক্ষের সময় এক ভিখারিণী নগরপ্রান্তে খর্জুরবৃক্ষের অন্তরালে শিশুসন্তান প্রসব করে পৈশাচিক ক্ষুধার উৎপীড়নে গ্রাস করতে যাচ্ছিল তাকে। তারই পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন এক বন্ধ্যা শ্ৰেষ্ঠিনী, সন্তান কামনা করে মহাকালের মন্দিরে পূজা দিতে। মাতৃস্নেহাতুরা অনুনয় করে নবজাতককে কিনতে চাইলেন। পিশাচিনী অট্টহাস্য করে উত্তর দেয়, তার ক্ষুধা মুহূর্তমাত্র অপেক্ষা করতে পারবে না। বরনারী বললেন, তবে তিষ্ঠ; এই যে আমার বন্ধ্যাবক্ষের সুপুষ্ট স্তন, অকর্মণ্য নিষ্ফল এ স্তন কোনও শিশুকে দুগ্ধ যোগাতে পারেনি– এটা আমি খর্জুরপত্র দ্বারা কর্তন করে তোমাকে দেব। তোমার ক্ষুধা নিবৃত্ত হবে। পাগলিনী আবার অট্টহাস্যে বলল, তুমি জানো না, আপন হাতে আপন মাংস কর্তন করাতে কি অসহ্য বেদনা, তাই বলছ। রমণী বাক্যব্যয় না করে কর্তন আরম্ভ করতে না করতেই দরদর বেগে নির্গত হল সেই বন্ধ্যা স্তন থেকে রক্তের বদলে অফুরন্ত মাতৃদুগ্ধ। ভিখারিণী-শিশু উভয়েই সে দুগ্ধ পান করে পরিতৃপ্ত হল। অলৌকিক অবিশ্বাস্য এ ঘটনার কথা শুনে তথাগতের শিষ্যরা তিনজনকেই নিয়ে এলেন তার সামনে। অমিতাভ সানন্দে বললেন, মাতৃস্নেহ অলৌকিক ক্রিয়া উৎপাদনে সক্ষম।

বঞ্চিতা মাটিলডের মুখে দিব্য জ্যোতি দেখা দেবে না কেন?

.

ভেনিস বন্দরে জাহাজের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে মাটিলডে আমার হাত ধরে বার বার অনুরোধ করলেন, আমি যেন বোম্বাই পৌঁছেই কেবল করি, ছেলেটি কবে কোন জাহাজে ইউরোপ পৌঁছচ্ছে। তার চোখে জল, কিন্তু তাতে আনন্দের রেশও ছিল।

বোম্বাই পৌঁছে খবর নিয়ে জানলুম, ছেলেটি চলে গেছে। মাটিলডেকে পাকা খবর জানিয়ে দিলুম।

বরোদায় পৌঁছবার মাসখানেক পরে বন্ধু ওয়াডিয়া– তাঁকে এসব কিছুই বলিনি– কথায় কথায় বললেন, কাণের ছেলেটি কখন যে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে কেউ টের পায়নি। খাটের উপর একখানা চিরকুট পাওয়া যায়। অসুস্থ শরীর নিয়ে সে চিরজীবন কারও বোঝা হয়ে থাকতে চায়নি।

আমার মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোয়নি। হা হতভাগ্য! তুমি জানতেও পারলে না, স্বয়ং মা মেরি তোমার জন্য বন্দরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন।

আর মাটিলডে!

দ্বিজ

এই গত শারদীয়া বেতার জগতে কোষ্ঠীবিচার নামক একটি কথিকা এ-অধম নিবেদন করে। বিবরণটি ছিল সত্য ঘটনা অবলম্বনে বর্ণিত। তৎসত্ত্বেও আমার এক দোস্ত সেটি পড়ে কিঞ্চিৎ অপ্রসন্ন হন। আমি সবিনয় বললুম, ব্রাদার, এটা বরহ জলজ্যান্ত ঘটেছিল; আমাকে দুষছ কেন? তিনি বললেন, তুমি সেটি রসস্বরূপে প্রকাশ করতে চেয়েছ; সেক্ষেত্রে সত্যি-মিথ্যের কোনও অজুহাত নেই। একদম খাঁটি কথা। তাই এবারে কিন্তু যেটি নিবেদন করব সেটি পড়ে তিনি প্রসন্ন হবেন, এমত আশা করি, আর আপনারা পাঁচজন তো আছেনই! এই সুবাদে আরেকটি সামান্য বক্তব্য আমার আছে। হিন্দু-মুসলমান বাঙালি-অবাঙালি কাউকেই আমি বেদনা দিতে চাইনে। দিলে সেটা অজানিত এবং তার জন্যে এইবেলাই বে-কৈফিয়ত মাফ চেয়ে নিচ্ছি। কিন্তু আমার বক্তব্য দুষ্টবুদ্ধিজনিত ভ্রমাত্মক সপ্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত সেটি সংহরণ করতে আমি অক্ষম– এটা গুরুর আদেশ।

এদানির কিছু লোক আবার আমার কাছ থেকে প্রাচীন দিনের শান্তিনিকেতন সম্বন্ধে ভালোমন্দ শুনতে চান। আমি তাঁদের লুক্কায়িত বক্তব্যটিও বিলক্ষণ মালুম করতে পেরেছি; সেটি এই, যা বুড়োচ্ছ, দুদিন বাদেই ভীমরতি ধরবে এবং তখন হয়ে দাঁড়াবে একটি চৌকস লিটারারি বোর; যদ্যবধি দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে সওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ তোমার আপন কথা ধানাই-পানাই না করে আশ্রমের কথা কও, গুরুদেবের কথা কও ইত্যাদি।

তাই সই। দেশকাল ঠিক ঠিক রাখব। পাত্র ভিন্ন নামে ভিন্ন বেশে আত্মপ্রকাশ করবেন।

১৯২০/২১ সালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে কলেজ কোর্স খোলেন। ওই সময় গাঁধীজি সরকারি স্কুল-কলেজের পড়ুয়াদের গোলামি-তালিম বর্জন করতে আহ্বান জানান। ফলে ভারতের সর্বপ্রদেশ থেকে যেসব মেধাবী ছিল, গাঁধীজির বাণী গ্রহণ করল তারা, জমায়েত হল শান্তিনিকেতনে। আর এলেন কয়েকটি খাজা মাল, যারা বছরের পর বছর পৌনঃপুনিক দশমিকের পাইকিরি হিসাবে বেধড়ক ফেল মেরে যাচ্ছিলেন। অবশ্য এঁদের একজন বলেছিলেন, ওইস অ্যানসার বুক লিখেছিলুম, স্যার, যে এগজামিনার বলল এনকোর। তাইতে ফের একই পরীক্ষা দিতে হল। এঁদের মধ্যে আমার মতো গুণ্ডাপ্রকৃতির দু-চারটি কাবেল সন্তান ছিলেন।

ইতোমধ্যে এলেন বিশ্বনাথ তিরুমল রাও অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনম্ থেকে। একে নিয়ে যখন দু দলে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল তখন ধরা পড়ল ইনি বরের পিসি, কনের মাসি। অর্থাৎ ইনি যেমন অনেকটা ইন্দ্রনাথের মতো অন্ধকার রাস্তায় স্যাডিস্ট ক্লাস-টিচারের মাথায় হঠাৎ কম্বল ফেলে তাকে কয়েক ঘা বসিয়ে বাড়ি থেকে হাওয়া হয়ে এখানে চলে আসেন, ঠিক তেমনি কলাভবনে প্রবেশ করার পর দেখা গেল, তিনি একই হাতে পাঁচটা তুলি নাচাতে পারেন– যাদুকররা যেমন পাঁচটা বল নাচায়। স্কেচে ওস্তাদ, ফিনিশে তালেবর।

তদুপরি আরেকটি অতিশয় আশ্রমপ্রিয় সদগুণ তার ছিল, যার প্রসাদাৎ তিনি সর্বত্রই ককে পেতেন। উচ্চতায় যদ্যপি পাঁচ ফুট দুই, কিন্তু পেশিগুলো যেন মানওয়ারি জাহাজের দড়া দিয়ে তৈরি, এবং ফুটবল-চৌকস। বীরভূমের কাকরময় গ্রাউন্ডে ডজন খানেক আছাড় খেয়ে সর্বাঙ্গে রক্তলাঞ্ছন আঁকার পরও তিনি বুলেটবেগে ছুট লাগাতে কসুর করতেন না এবং হাসিমুখে। বিচক্ষণ জন সে হাসিতে নষ্টামির গোপন চিহ্ন দেখতে পেত।

আমাদের দোস্তি প্রথমদিন থেকেই। নাম যখন শুধালুম সেটা দ্রুতগতিতে দায়সারার মতো বলে নিয়ে জানাল, ওটা ভোলা নাম। আমার ডাকনাম চিন্নি। তোমার?

সীতু।

পরবর্তী যুগে চিন্নি, ওরফে মি. রাও, স্বৰ্গত শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে দিল্লিতে কাজ করে। তার ভুলে ভর্তি অনর্গল বাঙলা কথার তুবড়িবাজি রাশভারী শ্যামাপ্রসাদের মুখেও কৌতুকহাস্য এনে দিত এবং বিশেষ করে ওই কারণেই তিনি চিন্নিকে মাত্রাধিক স্নেহ করতেন। চিনি উত্তম ইংরেজি বলতে পারত, কিন্তু তার বক্তব্য, দিল্লির মন্ত্রণালয়ই হোক আর ভুবনডাঙার ঝুরঝুরে চায়ের দোকানই হোক, সে তার শান্তিনিকেতনে শেখা বাঙলা ছাড়বে কেন? স্বয়ং গুরুদেবের সঙ্গে সে বাঙলায় কথা কইত নির্ভয়ে চারটিখানি কথা নয়, এবং শ্যামাপ্রসাদ এই তত্ত্বটি আবিষ্কার করে, চিন্নির ডজন ডজন ভুল-ভর্তি বাঙলা সম্বন্ধে বলতেন, রাও কিন্তু তার বাঙলা প্রতিদিন ইমপ্রুভ করে যাচ্ছে। অর্থাৎ ভুল বাড়ছে!

শ্যামাপ্রসাদ মন্ত্রিত্ব রিজাইন দিলে পরে চিন্নিও তার জুতো থেকে দিল্লির ধুলো ঝেড়ে ফেলে মাদ্রাজ চলে যায়। সেখান থেকে ইউনেস্কোর আহ্বানে তাইল্যান্ড কলম্বো, জিনিভা, ওয়াশিংটন, বাগদাদে কীর্তিজাল বিস্তার করে।

সে যে দড়মালে তৈরি সেটা আশ্রমে তার আঠারো বছর বয়সেই ধরা পড়ে। সেখানে স্কুলের ছেলেরা দু বেলা উপাসনা করে, প্রস্তাব হল আমাদেরও করতে হবে। চিনি উচ্চকণ্ঠে জানিয়ে দিল সে নাস্তিক। ফৈসালা করার জন্য আমাদের মিটিং বসল। প্রিন্সিপাল মেসেজ পাঠালেন, তিনি চান, আমরা যেন উপাসনা করি। চিন্নি বলল, স্কুলের ছেলেদের বাপ-মা উপাসনার কথা জেনেশুনেই বাচ্চাদের এখানে পাঠিয়েছেন। আমাদের অধিকাংশই এসেছি তাদের অমতে (একথাটা খুবই খাঁটি; আমাদের গার্জেনদের অধিকাংশই ছিলেন সরকারি চাকুরে; তাঁরা অসহযোগ আন্দোলনে সায় দেন কী প্রকারে? আমার পিতাকে তো ইংরেজ রীতিমতো ভয় দেখায়)। আমরা সাবালক; আমি নাস্তিক। চিন্নি পার্লামেন্টেরেনও বটে– তার দোস্ত মসোজিকে চ্যালেঞ্জ করে বলল, তুমি তো ক্রিশ্চান; তোমার সর্ব প্রার্থনা পাঠাতে হয় প্রভু যিশুর মাধ্যমে। আশ্রমের উপাসনায় যোগ দেবে কী করে? আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুই তো মিয়া ভাই (মুসলমান)! পাঁচবেকৎ নেমাজ করিস (করব বলে বাবার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে এসেছিলুম)। সভাপতির দিকে তাকিয়ে বলল, ওর ঘাড়ে আরও দুটো চাপানো কি ধর্মসম্মত? ইত্যাদি, ইত্যাদি। রেভারেন্ড অ্যানড্রজ আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন সভাকে রাজি করাতে। পাদ্রিসাহেবের যাবতীয় স্কিল, তদুপরি তাঁর সরল আন্তরিকতা, তিনি সবকিছু প্রয়োগ করে খুব সুন্দর বক্তৃতা দেন। কিন্তু ভোটে চিন্নিপন্থিরা কয়েকটি ভোটে জিতে গেল। তখন সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব পাস হল, গুরুদেব যা আদেশ দেবেন তাই হবে। অ্যানদ্ভুজ সাহেবকেই আমরা দূত করে পাঠালুম।

গুরুদেব মাত্র একটি শব্দ উচ্চারণ করেন– না।

এই গেল চিন্নির পরিচয়।

ইতোমধ্যে আরেকটি ছেলে এল অন্ধ থেকে। মাধব রাও। সে-ও চমৎকার ফুটবল খেলে।

***

রাজ রাজমহেন্দ্ৰবরাম নগর– অর্থাৎ রাজমনড্রির শ্ৰীযুত জগন্নাথ রাও চিন্নির বন্ধু। তিনি চিন্নিদের বাড়ির ছেলের মতো। শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ব্রাহ্মছাত্র অন্ধ্রদেশের শ্রীযুক্ত চালাময় গুরুদেবের প্রচুর কবিতা গল্প উপন্যাস এবং বিশেষ করে তাঁর ধর্ম সম্বন্ধীয় রচনা অনবদ্য তেলেগুতে অনুবাদ করেন। জগন্নাথ রাও সেগুলো পড়ে আকণ্ঠ রবীন্দ্রভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। চিন্নির আশ্ৰমাগমনের ফলে তাঁর আশ্রমদর্শনের সদিচ্ছা প্রবলতর হল। চিন্নিকে আকস্মিক আনন্দদানের উদ্দেশ্যে তাকে কোনওপ্রকারের নোটিশ না দিয়ে শুধু চিন্নির পিতামাতাকে জানিয়ে এক শুভপ্রাতে রওনা দিলেন কলকাতা অভিমুখে।

কলকাতায় উঠলেন বড়বাজার অঞ্চলে এক অন্ধ মেসে। সেখানে শুধোলেন, শান্তিনিকেতন কী প্রকারে যেতে হয়? কেউ কিছু জানে না বলে টাইমটেবল জোগাড় করা হল– সেখানেও শান্তিনিকেতনের সন্ধান নেই। তখন একজন বলল, কাছেই তো পোয়েটের বাড়ি; সেখানে গেলেই জানা যাবে। শ্ৰীযুত জগন্নাথ রাও তাই করলেন। সেখানে দেখেন বিশ্বভারতী পাবলিকেশন্স দফতর খোলা বটে, কিন্তু লোকজন কেউ নেই। শেষটায় একটি ছোকরা কেরানিকে আবিষ্কার করা হলে সে বলল, হাওড়া থেকে যেতে হয়, সে কখনও ওখানে যায়নি। যারা যাওয়া-আসা করেন, তারা সবাই গেছেন শোনে। শান্তিনিকেতনের কে এক মিস্টার রাও সেই ভোরে হাসপাতালে মারা গেছেন।

জগন্নাথ রাও ত্রিভুবন অন্ধকার দেখলেন। সম্বিতে ফিরে আর্তকণ্ঠে শুধোলেন, কে? ছোকরাটি বলল, বড়ই দুঃখের বিষয়। মিস্টার রাও আশ্রমের হয়ে ফুটবল খেলতে যান শিউড়িতে। সেখানে খেলাতে জোর চোট লাগার ফলে তারা হার্নিয়া স্ট্রেনগুলেটেড় হয়ে যায়। অ্যান্ড্রজ সাহেব এখানকার হাসপাতালকে জরুরি চিঠি লিখে লোকজনসহ তাঁকে পাঠান কাল রাত্রে। সবই করা হয়েছিল, কিন্তু তাকে বাঁচানো গেল না।

জগন্নাথ রাও টলতে টলতে বেরিয়ে এলেন। চিনি ওয়ালটেয়ারে আরেকবার এই রকম খেলার মাঠে বেহুঁশ হয়।

রাস্তা থেকে আবার ফিরে গেলেন ছোকরাটির কাছে। শুধোলেন, তার বাড়িতে তার পাঠানো হয়েছে? ছোকরাটি বলল সে জানে না।

জগন্নাথ রাও মেসে ফিরে এসে শয্যা নিলেন। দেশবাসীরা পরামর্শ করে তাঁর কথামতো চিন্নির বাড়িতে তার পাঠালেন দুঃসংবাদটা জানিয়ে।

জগন্নাথ রাওয়ের কোনওই ইচ্ছা আর রইল না শান্তিনিকেতন যাবার, কিন্তু তিনি পরিবারের বন্ধু এখন এতদূর কলকাতা অবধি এসে যদি সবিস্তার খবর নেবার জন্য সেখানে না যান তবে সবাই দুঃখিত হবেন।

নিতান্ত কর্তব্যের পীড়নে জগন্নাথ রাও হাওড়া গিয়ে, বোলপুরের ট্রেন ধরলেন।

বিকেলের দিকে যখন আশ্রমে পৌঁছলেন তখন গেস্ট হাউসে হিতলাল (বর্তমান কালোর দোকানের কালোর পিতা) ভিন্ন কেউ ছিল না–হিতলাল ইংরেজি জানে না। জগন্নাথ বিছানাপত্র সেখানে রেখে বেরুলেন কলাভবনের সন্ধানে। চিনি তাঁকে কলাভবনের ঠিকানা দিয়ে চিঠি লিখত।

সে কলাভবন বাড়ি আর নেই। তবে তার ভিতটা এখনও দেখতে পাওয়া যায়, গুরুদেবের দেহলী বাড়ির কাছে, বোলপুর যাবার রাস্তার পাশে।

কলাভবন সে সময়টায় নির্জন থাকে। নিচের তলায় কাউকে না পেয়ে তিনি সিঁড়ি দিয়ে ল্যান্ডিঙে পৌঁছে সেখান থেকে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখেন—

আমি যাচ্ছিলুম বোলপুর নস্যি কিনতে; হঠাৎ শুনি, সেই অবেলায় কলাভবনে শোরগোল, স্পস্ট চিনতে পেলুম আর্টিস্ট রমেন চক্রবর্তীর গম্ভীর গলা। কিন্তু আর্ত কন্ঠে… তুমি যাও, শিগগির যাও, জল নিয়ে এস। আমি ততক্ষণে দেখছি–

তিন লক্ষে সেখানে পৌঁছে দেখি, চিন্নি দেহলী বাড়ির দিকে কালবোশেখী বেগে ছুটেছে। আমি সেদিকে খেয়াল না করে সিঁড়ি বেয়ে মাঝখানে উঠে দেখি কে একজন লোক দু-পা ইয়া ফাঁক আর দু-হাত ইয়া লম্বা করে ধূলি-শয়নে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। জোয়ারের সমুদ্র বেলাতটকে মড়া ফিরিয়ে দিলে সে যেরকম শুয়ে থাকে। ঠোঁটদুটো তার কাঁপছে, আর বিড়বিড় করে বলছে, চিন্নি, চিন্নি! চক্রবর্তী বললেন, সে আবার কী? তিনি বিশ্বনাথ রাওয়ের ডাকনাম জানতেন না। আমি বুঝিয়ে বললুম। চক্রবর্তী বললেন, দেখো তো সৈয়দ, ডাক্তার এসেছে কি না, বিকেলে তো মাঝে-সাঝে আসে। আমি বললুম, দেখি, মনে তো হচ্ছে ভিরমি কেটে যাচ্ছে।

খানিকক্ষণ পরে ফিরে এসে দেখি, ওদের কেউই আর সেখানে নেই।

চিন্নি ভালো অভিনয় করতে জানে। রাত্রে তার ঘরে সে দেখাল জগন্নাথ রাও সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে হঠাৎ তাকে দেখে সে আর চক্রবর্তী তখন সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন– থমকে গিয়ে কাঁপতে লাগলেন। দু হাত দু দিকে দুটো হাঁটুর সঙ্গে একতালৈ মৃগী রুগির মতো কাঁপতে কাঁপতে ধপাস। চিন্নি বলল, অবশ্য আমার মুখেও জগন্নাথ বিস্ময় দেখতে পেয়েই ভয় পেয়েছিল আরও বেশি। ভাগ্যিস রমেনবাবু সঙ্গে ছিলেন! আমাকে ওই আবছায়া আলোতে একলা-একলি দেখতে পেলে তার কোনও সন্দেহ থাকত না যে, আমার ভূত কলাভবনের মায়া কাটাতে না পেরে সন্ধ্যার নির্জনে সেখানে আবার এসেছে।

হঠাৎ দেখি জগন্নাথ রাওয়ের মুখ এক্কেবারে রক্তহীন, মাছের পেটের মতো পাঁশুটে হয়ে গিয়েছে। কাঁপতে কাঁপতে যা বললেন তা শুনে রমেনবাবুর মতো ঠাণ্ডা মাথা স্থিরবুদ্ধির লোক পর্যন্ত অচল দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এতক্ষণে জগন্নাথের খেয়াল গেছে যে, তিনি চিন্নির বাপ-মাকে তার করে জানিয়ে বসে আছেন যে, চিন্নি নেই।

আমি তেড়ে বললুম, আপনি তো আচ্ছা– নেভার মাইন্ড!–রাও তো আপনাদের দেশে প্রত্যেক সেকেন্ড ইডিয়ম।

জগন্নাথ বার বার বলেন, চিন্নি তো আমায় জানায়নি যে আরেকজন অন্ধ্রবাসী এসেছে। তার ওপর ফুটবল, তার পর পেটে

রমেনবাবু গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ওহে! এতক্ষণ তো খুব রগড় করলে! শোন, ব্যাপারটা সিরিয়াস! অ্যান্ড্রজ সাহেবের কাছে যাও। আর কারও টেলিগ্রাম বাপ-মা বিশ্বাস না-ও করতে পারেন। গুরুদেব তো বার্লিনে!

সাহেব মোটেই চটলেন না। নাস্তিক চিন্নির জন্য খাঁটি খ্রিস্টান ছ পাতা লম্বা তার করলেন সব বুঝিয়ে। আর আমি চিন্নিকে তাঁর সামনেই বললুম, এবার প্রার্থনা করোগে, বাড়িতে যেন ভালো-মন্দ কিছু একটা না হয়। দুই অন্ধ ভাইজ্যাগ বাগের ট্রেন ধরলেন।

চিন্নি ফোককে ছুটি মেরে হপ্তা তিনেক পরে ফিরল। আমরা শুধালুম, কী, আপন ছেরাদ্দ সাপটাবার মতো ঠিক সময়ে পৌঁছেছিলি তো? হুঁকোটা লে, খুলে ক!

চিন্নি বলল, টেলিগ্রাম পৌঁছেছিল দেরিতে। ইতোমধ্যে দাদাকে আনানো হয়েছে মাদ্রাজ থেকে। বাড়িতে কান্নাকাটি সে আর কি বলতে অবশ্য আমার শোনা কথা। যেদিন তার পৌঁছল সেদিন বামুন এসেছে শ্রাদ্ধের ব্যবস্থা করতে। আর ট্র্যাজেডিটা দেখ, বাড়িসুদ্ধ সবাই শোকে এমনি বিকল যে, কে একজন তারটা সই করে নিয়ে একপাশে রেখে দিয়েছে, ঘণ্টা দুই কেউ খোলেনি, ভেবেছে, কী আর হবে কন্ডলেন্স্ টেস্। খুলেছিল শেষটায় আমার ছোট ভাই। সে-ও নাকি প্রায় ওই জগন্নাথ রাওয়ের মতো পাঙাশ মেরে রাম ইডিয়টের মতো গা-গা ডাক ছেড়েছিল। বাকিরা ভাবল, আবার কে মরল? তার পর কেউ বিশ্বাস করে না তারটাকে, যদিও সবাই করতে চায়। অ্যানড্রজ সাহেব এত বিখ্যাত লোক, তিনি আমাদের চিন্নিটার জন্য ইত্যাদি…।

শেষটায় বিশ্বাস করেছিলেন বটে, কিন্তু আমি না পৌঁছানো পর্যন্ত কারও কারও মনের ধোকা কাটেনি।

রাত্রে ছাতের উপর পাশাপাশি শুয়ে আছি দুজনাতে। আমি বললুম, চিন্নি, ঘুমুলি?

না।

আর তোর মা?

বিশ্বাস করবিনে, সেটা ভারি ইনট্রেটিং। জগন্নাথ রাওয়ের তার পৌঁছানোর পর থেকেই মায়ের মুখে শুধু এক বুলি, কিছুতেই হতে পারে না। আমার ছেলে নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। এই তো বছরের পয়লা দিনে আমি গণকার ঠাকুরকে ফি-বছরের মতো এবারও সবকটা ছেলের কোষ্ঠী দেখিয়েছি। তিনি এবারও বলেছেন, চিন্নির সামনে ফড়াটি পর্যন্ত নেই।

চিন্নি বলল, যখন পুরুতঠাকুর শ্রদ্ধের ব্যবস্থা করতে এসেছে তখনও তার মুখে ওই এক বুলি, কী হবে এসব ব্যবস্থা করে? গণকার বলেছে, এ বছরে চিন্নির জ্বর-জ্বালাটি পর্যন্ত নেই।

কে তাঁর সঙ্গে কথাকাটাকাটি করে বোঝাবে চিনি নেই?

আর শ্রাদ্ধে যা টাকা খরচা হওয়ার কথা ছিল সেটা মা দিয়েছে গণৎকারকে।

নটরাজনের একলব্যত্ব

বর্ষা নামার সঙ্গে সঙ্গেই পদ্মার উপর দিয়ে পুরবৈয়া বায়ু বইতে আরম্ভ করে না। সে হাওয়া আসে দিন আষ্টেক পরে। কিন্তু তখনই সাড়া পড়ে যায় বন্দরে বন্দরে মাঝি-মহল্লায়। হালের বলদ, পালের গরু বিক্রি করে তারা তখন কেনে নৌকোর পাল। পুরনো পালে জোড়াতালি দিয়ে যেখানে চলে যাওয়ার আশা, সেখানে চলে কাঁথার উঁচ আর মোটা সুতো। তার পর আসবে ঝোড়ো বেগে পুব হাওয়া। দেখ তো না দেখ, নারায়ণগঞ্জ নৌকো পৌঁছে যায় রাজশাহী। বিশ্বাস করবেন না, স্রোতের উজানে, তর তর করে।

আমিও বসে আছি হাল ধরে, পাল তুলে হাওয়া এই এল বলে। নোঙর নিইনি। এই শেষ যাত্রায় যেতে হয় এক ঝটকায়। কোথাও থামবার হুকুম নেই।

নাতি ডাবাটি এগিয়ে দিয়ে বলল দাদু, তামুক খাও।

হাওয়ার আশায় বসে থাকার প্রতিটি মুহূর্ত আনন্দ-আবেশে ভরে যায়।

নাতি বলল, দাদু, সারাজীবন ধরে পদ্মার উজান-ভাটা করলে। কত লোকের সঙ্গেই না তোমার দোস্তি হল। বাড়িতে থেকে খেত-খামার করে দোকানপাট চালালে তো অতশত লোকের সঙ্গে তোমার ভাবসাব হত না– আর বিদেশিই বা কিছু কম। কঁহা কঁহা মুলুকের রঙবেরঙের চিড়িয়া। আমারে কও, তাদের কথা।

আমি পদ্মা নদীর মাঝি নই। কিন্তু আমার জীবনধারা বয়ে গেছে পদ্মার চেয়েও দেশদেশান্তরে। কত না অদ্ভুত অদ্ভুত পরিস্থিতি, কত না বিচিত্র চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। এখন পাল তুলে ওপারে যাবার মুখে ভাবছি, এঁদের কারও কারও সঙ্গে আপনাদেরও পরিচয় করিয়ে দিই। কারণ এদের সম্বন্ধে অন্য কেউ যে মাথা ঘামাবে সে আশা আমার কম– প্রচলিতার্থে এঁরা দেশের কুতুবমিনার নন। অথচ আমার বিশ্বাস এঁরা যদি সত্যই এমৃবিশাস হতেন তবে আজ আমার মতো অখ্যাত জনের কাঁধে এঁদের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবার ভার পড়ত না, আর পড়লেও সেটা আমি গ্রহণ করতুম না। কারণ এদের আমি ভালোবেসেছিলুম এঁরা লাওৎসের চেলা বলে। তারই উপদেশমতো এঁরা জীবনের মধ্য-পথ অবলম্বন করেছিলেন। পাঁচজনের সঙ্গে মিলেমিশে, আপন প্রতিভা যতদূর সম্ভব চাপা রেখে গোপনে গোপনে তার পরিপূর্ণ বিকাশ দেবার চেষ্টা করেছেন। বাধা পড়লে পড়াই দিতেন মোক্ষম, কিন্তু সর্বক্ষণ এঁদের চরিত্রে একটা বৈরাগ্য ভাব থাকত বলে মনে মনে বলতেন, হলে হল, না হলে নেই।

কিন্তু আমাকে একটু সাবধানে, নাম-পরিচয় ঢেকে চেপে লিখতে হবে। পূর্বেই ইঙ্গিত দিয়েছি এরা জীবন-সভাস্থলে প্রধান অতিথির আসনে বসে ফুলের মালা পরতে চাননি, তাই পাঠক সহজেই বুঝে যাবেন, কারও লেখাতেও তারা হ্যাঁমলেট, রঘুপতি হতে চান না– আমার নাতিপরিচিত লেখাতেও না।

মনে করুন তার নাম নটরাজন। তার পিতা ছিলেন পদস্থ সরকারি কর্মচারী, আশা করেছিলেন ছেলেও তাঁর মতো চারটে পাস দিয়ে একদিন তারই মতো বড় চাকরি করবে। অন্যায্য আশা করেননি, কারণ নটরাজন ক্লাসের পয়লা নম্বরি না হলেও প্রোমোশন পেত অক্লেশে, আর একটা বিষয়ে স্কুলের ভিতরে-বাইরে সবাইকে ছাড়িয়ে যেত অবহেলে। ছবি আঁকাতে। তার অঞ্চলে এখনও দেওয়ালে রঙিন ছবি আঁকার (মুরাল) রেওয়াজ আছে। তারই ওস্তাদ পটুয়ারা স্বীকার করতেন, নটরাজনের চতুর্দশ পুরুষে যদিও কেউ কখনও ছবি আঁকেননি– তাঁরা খানদানি, পটুয়া হতে যাবেন কোন দুঃখে– এ ছেলে যেন জন্মেছে তুলি হাতে নিয়ে। শুধু তাই না– প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে এদেশে যখন হরেকরকম রঙের অভাব চরমে পৌঁছেছে তখন নটরাজন দেশের কাদামাটি কাঁকর পাথর ফুলপাতা থেকে বানাতে আরম্ভ করল নানা রকমের রঙ। এটা ঠিক আর্টিস্টের কাজ নয়– এর খানিকটে কেমিস্ট্রি, বাকিটা ক্রাফটসম্যানশিপ। পটুয়ারা নটরাজনকে প্রায় কোলে তুলে নিলেন। তখন তার বয়েস বারো-তেরো।

রবিবর্মা তার অঞ্চলেরই লোক। ওঁর ছবি কিন্তু নটরাজনকে বিশেষ বিচলিত করেনি। হঠাৎ একদিন সে দেখতে পেল নন্দলালের একখানা ছবি। জঘন্য রিপ্রডাকশন রেজিস্ট্রেশন এতই টালমাটাল যে মনে হয় প্রিন্টার তিনটি বোতল টেনে তিনটে রঙ নিয়ে নেচেছে।

নটরাজন কিন্তু প্রথম ধাক্কায় স্তম্ভিত। দ্বিতীয় দর্শনে রোমাঞ্চিত। মধ্য রজনী অবধি সে ছবিটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।

নটরাজন ছিল অসাধারণ পিতৃভক্ত। তার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে পিতা কী আশা পোষণ করেন সে তা জানত। কী করে তাকে বলে যে সে তার গুরুর সন্ধান পেয়ে গিয়েছে; সর্বস্ব ত্যাগ করে তাঁর পদপ্রান্তে তাকে যেতেই হবে। তদুপরি কোথায় মালাবার আর কোথায় শান্তিনিকেতন!

পিতাই লক্ষ করলেন তার বিষণ্ণ ভাব। পিতাপুত্রে সখ্য ছিল– দূরত্ব নয়। সব শুনে বললেন, বাধা পথে যে চলে না তার কপালে দুঃখ অনেক। কিন্তু আপন পথ খুঁজে নেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার দুঃখ আরও বেশি। তোমার ওপর আমার আশীর্বাদ রইল।

অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম যুগ। যারা গোলামি-তালিম চায় না, তারা যাবে কোথায়? বিশ্বকবি কবিগুরু যেন বিধির আদেশে ঠিক ওই শুভলগ্নেই শান্তিনিকেতনে তাদের জন্য নীড় নির্মাণ করেছিলেন– যত্র বিশ্ব ভবত্যেক নীড়ম্। দূর সিন্ধু, মালাবার, গুজরাত, মহারাষ্ট্র, আসাম থেকে ছেলেমেয়ে আসতে লাগল– দলে দলে নয়, একটি-দুটি করে।

যারা এল তাদের মধ্যে দু-চারটি ছিল লেখাপড়ায় বিদ্যেসাগর, বাপ-মা-খ্যাদানো বিশ্ববকাটে। বিশ্বভারতীই তো বিশ্ববকাটেদের উপযুক্ত স্থান, ওই ছিল তাদের দৃঢ় বিশ্বাস। আসলে এরা ছিল কোনও কৌশলে স্কুল থেকে নাম কাটানোর তালে। অসহযোগের সহযোগিতায় তারা সে কর্মটি করল নিশান উড়িয়ে দামামা বাজিয়ে।

বলা বাহুল্য আমি ছিলুম এই দলের।

হিন্দি-উর্দুতে বলে পাঁচো উঙলিয়া ঘিমে আর গর্দন ডেগমে অর্থাৎ পাঁচ আঙুল ঘিয়ে আর গর্দানটাও হাঁড়ায় ঢুকিয়ে ভোজন। আমরা যে ভূমানন্দ– ভূমা, বিশ্বপ্রেম, অমৃতের পুত্র এসব কথা তখন ছিল আমাদের ডালভাত– আমাদের মধুরতর স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি, এখানে এসে দেখি সে-অমৃত উপচে পড়ছে। সে যুগে বিশ্বভারতীর প্রথম নীতি ছিল, আমি অক্ষরে অক্ষরে তুলে দিচ্ছি : The system of examination will have no place in Visvabharati, nor will there be any conferring of degrees.!!

বঙ্কিম চাটুয্যের কল্পনাশক্তি বড়ই দুর্বল। তিনি রচেছিলেন,

ছাত্রজীবন ছিল সুখের জীবন
যদি না থাকিত এগজামিনেশন।

বিশ্বভারতী বঙ্কিমের সে স্বপ্ন মূর্তমান করেছিল।

এবং ধর্মত ন্যায্যত প্রাক্তনীতির পিঠ পিঠ আসে : যেখানে পরীক্ষা নেই সেখানে ক্লাসে উপস্থিত হওয়া না-হওয়া ছাত্রের ইচ্ছাধীন। অতএব রেজিস্ট্রি নেই, রোল-কল্ নেই!

আমাদের অভাব ছিল মাত্র একটি উৎকৃষ্ট নিকৃষ্ট যা-ই হোক– চায়ের দোকান। তাই ছিল ঘরে ঘরে স্টোভ আর চায়ের সরঞ্জাম।

সত্যকুটিরের বারান্দায় মোড়ার উপর বসে শুনছি ভিতরে স্টোভের শব্দ। কেনগরের মণি গাঙ্গুলি চা বানাচ্ছে। সামনে, গৌরপ্রাঙ্গণ পেরিয়ে, লাইব্রেরির বারান্দায় ঈষৎ প্রাণচাঞ্চল্য আরম্ভ হয়েছে। বৈতালিকের মূলগায়েন শ্রীযুক্ত অনাদি দস্তিদার (পরবর্তী যুগে খ্যাতিপ্রাপ্ত রবীন্দ্রসঙ্গীতজ্ঞ) ও দোহারদের ফুলু রায় গান বাছাই করছেন। পূজনীয় বিধু-ক্ষিতি-হরি একটু পরেই আসবেন।

তখনকার দিনে প্রথা ছিল, যারা গত চব্বিশ ঘণ্টার ভিতর এই প্রথম আশ্রমে এসেছে তারা ভোরের বৈতালিকে উপস্থিত হত। আমাদের দলটা গুঁড়ি গুডিদের তুলনায় ছিল সংখ্যালঘু। অবশ্য আমরা দম্ভভরে গুরুদেবকেই উদ্ধৃত করে বলতুম, The rose which is single need not envy the thorns which are many. কিন্তু তক্কে তক্কে থাকতুম, দল বাড়াবার জন্য।

হঠাৎ চোখ পড়ল নয়া মালের দিকে। দুর থেকে মনে হল চেহারাটা ভালোই ভালোমানুষ। জানালা দিয়ে ভিতরের গাঙ্গুলিকে বললুম, এসেছে রে। গাঙ্গুলি এক ঝলক তাকিয়ে নিয়ে গান ধরল,

শুনে তোমার মুখের বাণী
আসবে ছুটে বনের প্রাণী—

অর্থাৎ বিশ্বভারতীর ডাক শুনে বনের প্রাণীরা এসে জুটেছে!

ইনিই হলেন আমাদের নটরাজন।

দুপুরবেলা খাওয়ার পর তাকে গিয়ে শুধালুম, টেনিস খেলতে জানো? বড়ই গাইয়া– মাস ছয় পূর্বে আম্মা ছিলুম, এবং বললে পেত্যয় যাবেন না, এখনও আছি– হকচকিয়ে ইয়েস ইয়েস, নো নো, ইয়েস ইয়েস বলল। র‍্যাকেট নেই? কুছ পরোয়া ভি নেই, আমারটা দোবখন। এর পর ভাব হবে না কেন?

তবে লাভ হল না। কলাভবনের ছাত্র। আমাদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয় কম। তবে দেখলুম, বাউণ্ডুলে স্বভাব ধরে। যখন-তখন স্কেচবই নিয়ে খোয়াইডাঙার ভিতর ডুব মারে। সঁওতাল গ্রাম থেকে ডিম কিনে এনে গোপনে যে সেদ্ধ করে খাওয়া যায় আশ্রম তখনও নিরামিষাশী– সেটা ওকে শিখিয়ে দিলুম। সে তো নিত্যি নিত্যি খোয়াই পেরিয়ে সাঁওতাল গাঁয়ে যায় তার পক্ষে ডিম জোগাড় করা সহজ।

কিন্তু ওই গোবেচারাপারা ছোঁড়াটা পেটে যে কত এলেম ধরে সেটা অন্তত আমার কাছে ধরা পড়ল অল্পদিনের ভিতর। আমাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে অনেকক্ষণ অবধি এদিক থেকে, ওদিক থেকে, এগিয়ে পিছিয়ে পর্যবেক্ষণ করে তুলল দুটি ফটো। পরে প্রিন্ট দেখে আমার চক্ষুস্থির। এ যে, বাবা, প্রফেশনালেরও বাড়া! এবং আজ আমি হুনুরের দেবতা বিশ্বকর্মাকে সাক্ষী মেনে বলছি, পরবর্তী যুগে কি বার্লিন কি লন্ডন কেউই টেকনিক্যালি আমার এমন পারফেক্ট ছবি তুলতে পারেনি এবং স্মরণ রাখবেন, নটরাজনের না ছিল কৃত্রিম আলো বা স্টুডিয়ো।

এর পর যা দেখলুম সে আরও অবিশ্বাস্য। নটরাজনের অন্যতম গুরুর প্রথম মেয়ের বিয়ে। কোথায় গয়না গড়ানো যাবে সেই নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। স্বল্পভাষী নটরাজন অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ শোনার পর বলল, আমাকে মালমশলা দিন। আমি করে দিচ্ছি। সবাই অবাক; তুমি শিখলে কোথায়? বলল, শিখিনি, দেখেছি কী করে বানাতে হয়। নন্দলাল চিরকালই অ্যাডভেঞ্চার-একত্সপেরিমেন্টের কলম্বাস দিলেন হুকুম, ঝুলে পড়।

বিশ্বকর্মাই জানেন স্যাকরার যন্ত্রপাতি কোত্থেকে সে জোগাড় করল, কী কৌশলে কাজ সমাধা করল। গয়না দেখে কে কী বলেছিলেন সেটা না বলে শুধু সবিনয় নিবেদন করি, হিন্দু বিয়েতে বরপক্ষ আকছারই সহিষ্ণুতায় যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আসেন না– তারা পর্যন্ত পঞ্চমুখে গয়নার প্রশংসা করেছিলেন।

নটরাজনের অন্যান্য গুণ উপস্থিত আর উল্লেখ করছি না। তার পরবর্তী ঘটনা বোঝার জন্য একটি গুণকীর্তন করি। এস্তেক বর্ণপরিচয় স্পর্শ না করে শুধু কান দিয়ে সে শিখেছিল অদ্ভুত সড়গড় চলতি বাঙলা। আমাকে শুধু গোড়ার দিকে একদিন শুধিয়েছিল, বাঙলার কি কোনও স্ট্যান্ডার্ড উচ্চারণ নেই? উচ্চারণে উচ্চারণে যে আসমান-জমিন ফারাক? কোনটা শিখি?।

শান্তিনিকেতনে তখন ছিল নিরঙ্কুশ বাঙাল রাজত্ব। পাঁচটা বাঁদরের বদলে পাস্টা বাদর হামেশাই ঝোঁপঝাড় থেকে বেরিয়ে পড়ার বদলে বেড়িয়ে পরত, অবিড়াম ঝড়ঝড় বাড়ি-ধাড়ার মাঝখানে। আমি নটরাজনকে বললুম আর যা কর কর, দোহাই আল্লার, আমার উচ্চারণ নকল করিনি। আমি বাঙালস্য বাঙাল– খাজা বাঙাল। আর করিসনি শুরুদেবের। তার ভাষা, তার উচ্চারণ তাঁর মুখেই শোভা পায়। করবি তো কর তোর গুরু নন্দলালের উচ্চারণ। বাঙলায় এম.এ. পাস ধুরন্ধররাও ওরকম সরল লৈতি বাঙলা বলতে পারে না।

তার পর ঝাড়া বিশটি বছর আমাদের দুজনাতে দেখাসাক্ষাৎ হয়নি, চিঠি-পত্রও না। এই বিশ বৎসরের ভিতর বাঙলা দেশে থাকলে পৌষমেলায় কখনও-সখনও শান্তিনিকেতন গিয়েছি। ওর সাক্ষাৎ পাইনি। সত্যি বলতে কি, ওর কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলুম। শুধু কেউ কখনও অচলিত গান

জগপতি হে
সংশয় তিমির মাঝে
না হেরি গতি হে

গাইলে মনে পড়ত নটরাজন ওর সুরটা বড় দরদভরা করুণ সুরে বাঁশিতে বাজাত।

১৯৪৭ সাল। স্বরাজ যখন পাকা ফলটির মতো পড়ি পড়ি করছে, ওই সময়ে আমি একদিন বাঙ্গালোরের এক রেস্তোরাঁয় বসে কফি খাচ্ছি। দেখি, তিনটি প্রাণী ঢুকে এককোণে আসন নিল। একজন চীনা কিংবা জাপানি ছোট্টখাট্টো একমুঠো মেয়ে, দ্বিতীয়া সুডৌলা তরুণী–খুব সম্ভবত তামিল– এবং সঙ্গে এ কে? নটরাজন! চেহারা রত্তিভর বদলায়নি। শুধু কপালটি আরও চওড়া হয়েছে, চুলে বোধহয় অতি সামান্য একটু পাক ধরেছে। আমার চেহারা বদলে গেছে আগাপাশতলা কিন্তু আর্টিস্ট নটরাজনকে ফাঁকি দিতে হলে প্লস্টিক সার্জারি করাতে হয়, এবং চোখদুটো আই-ব্যাঙ্কে জমা দিতে হয়। নটরাজন আমাকে দেখামাত্র উঠে এসে আমাকে তার টেবিলে নিয়ে গিয়ে মহিলাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। তামিলটি লেডি ডাক্তার, বিধবা, প্র্যাকটিস করেন, এবং জাপানিটি তাঁর স্ত্রী। শুধালাম, তুমি আবার জাপান গিয়েছিলে নাকি? সেই মুখচোরা নটরাজন মুখচোরাই রয়ে গেছে। বলল, অনেক বছর কাটিয়েছি।

সেদিন আর বেশি কথাবার্তা হল না। শুধু বলল, শহরের তিন মাইল দূরে ফাঁকা জায়গায় সেরামিকের ছোটখাটো কারখানা করেছে, বাড়িও। আমাকে শনিবার দিন উইক-এন্ড করতে সেখানে নিয়ে যাবে। আমার ঠিকানাটা টুকে নিল।

এস্থলে বলে রাখা কর্তব্য বিবেচনা করি, আমি কুমোরের হাঁড়িকুড়ি থেকে আরম্ভ করে সেরামিক, পর্সেলিন, গ্লেজড পটারি, ফাইয়াস এসবের কিছুই জানিনে। শুধু এইটুকু জানি যে স্টোনওয়েয়ার পাথরের জিনিস নয়– সেটা আমরা যাকে তামচিনি বলি, মেয়েরা যেসব বোয়ামে আচার-টাচার রাখেন। এটা উল্লেখ করার প্রয়োজন হল এই কারণে যে, সেই সন্ধ্যায় এক বন্ধুকে নটরাজনের কথা তুলতে তিনি বললেন, সেরামিক বাবদে ও যা জানে না, সেটা জানার কোনও প্রয়োজন নেই। বিগেস্ট একত্সপার্ট ইন দি ইস্ট। এখানকার সরকারি সেরামিক ফ্যাক্টরির বড় কর্তা।

শনির সন্ধ্যায় নটরাজন আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেল। তার বউ একটিমাত্র কথা না বলৈ যা যত্ন-আত্তি করল সেটা দেখে বুঝলুম কেন চীন-জাপানে প্রবাদ প্রচলিত আছে চীনা খাদ্য আর জাপানি স্ত্রী স্বর্গ-সুখ; চীনা স্ত্রী আর জাপানি খাদ্য– নরক ভোগ। জাপানি স্ত্রীজাতির মতো কর্মঠ, শান্ত, সেবাপরায়ণ রমণী নাকি ইহসংসারে নেই।

আহারাদির পর নটরাজনের স্ত্রী বললেন, দুই বন্ধুতে কথাবার্তা বলুন।

নানা কথা হওয়ার পর আমি বললুম, জাপানের কথা কও।

নটরাজন সে রাত্রে কিছুটা বলেছিল, পরে আরও সবিস্তার।

বলল, শান্তিনিকেতন ছাড়ার পর আমার ধারণা হল যে, আর্টসের চেয়ে ক্রাফটুসেই আমার হাত খোলে বেশি।

আমি বললুম, সে আর বলতে! সেই যে, গয়না বানিয়েছিলে!

বলল, সেকথা আর তুলো না। হাত ছিল তখন বড়ড় কাঁচা। তা সে যাক্। নানা ক্রাফ্ট শিখলুম অনেক জায়গায়। শেষটায় চোখ পড়ল পর্সেলিনের দিকে। সামান্য কিছুটা শেখার পরই বুঝলুম, এ একটা মারাত্মক ব্যাপার, একটা নতুন জগৎ, এর সাধনায় আস্ত একটা জীবন কেটে যায়। মেলা কেতাবপত্র ঘেঁটে আবিষ্কার করলুম যে, যদিও চীন এই কর্মে একদা সর্বশ্রেষ্ঠ ছিল, ড্রেসডেনও একদা অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিল, এখন কিন্তু জাপান এর রাজা।

ঘটি-বাটি বিক্রি করে চলে গেলুম জাপান।

টোকিয়ো পৌঁছনোর কয়েকদিন পরেই দেখি আমার ল্যান্ডলেডি চীনামাটি নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। তার কাছ থেকে খবর পেলুম, পর্সেলিন অর্থাৎ চীনামাটির বাসনকোসন, কাপ-সসার বানানো এদেশে কুটিরশিল্পও বটে। সে কী করে হয়! যে মাটি দিয়ে পর্সেলিন তৈরি হয় তার থেকে বালু আর অন্যান্য খাদ সরাবার জন্য ব্যাপক বিস্তৃত ব্যবস্থা করতে হয় অনেকখানি জায়গা নিয়ে আমি এখানে, বাঙালোরে এসে করেছি, কিন্তু ঠিক ওত্রাচ্ছে না, এখানকার মাটি ভালো নয়– খরচাও বিস্তর। ল্যান্ডলেডি বলল, বাজারে রেডিমেট কাদা বিক্রি হয়। আমি ল্যান্ডলেডিকে বললুম, সে না হয় হল, কিন্তু পোড়াবে (fire করবে) যে, তার জন্যে কিলন ফারনেস্ (পাঁজা) পাবে কোথায়?

আমি বাধা দিয়ে নটরাজনকে বললুম, আমাদের কুমোররা—

বলল, হায়, হায়! ওই টেম্পারেচারে মাটির হাঁড়িকুড়ি হয়। গ্লেজড পটারির– এদেশের সব বস্তুই তাইজন্য আরও টেম্পারেচার তুলতে হয়, আর কমসে কম দু হাজার ফারেনহাইট না হলে–

আমি বললুম, থাক, থাক্। ওসব অমি বুঝব না।

বলল, হ্যাঁ, সেই ভালো। তার পর খবর নিয়ে ন্যাজেমডো অবধি ওকিবহাল হয়ে গেলাম। নিজের চাই শুধু একটা পটারস হুইলকুমোরের চাক। বাজার থেকে রেডিমেড কাদা এনে তাতে চড়িয়ে বানাবে যা খুশি। সেগুলো ভেজা থাকতে থাকতেই তার উপর আঁকবে ছবি নিজস্ব আপন অনুপ্রেরণায়, এবং একই ছবি দুসরা সেটে আবার নকল করবে না, যেরকম খাস পেন্টাররা একই ছবি দু দুবার আঁকেন না। ছবি আঁকা শেষ হয়ে গেলে সেগুলো ঠেলায় করে নিয়ে যাবে কিওলার কাছে। বহু লোকের কাছ থেকে একরাশ জমা হলে তবে সে ফায়ার করবে, নইলে খর্চায় পোষায় না। তবে মোটামুটি বলে দেয় কবে এলে তোমার মাল তৈরি পাবে। মাল খালাসির সময় দেবে তার মজুরি। তার পর তুমি তোমার মাল পর্সেলিনের দোকানে দিয়ে আসতে পারো তারা বিক্রি করে তাদের কমিশন নেবে কিংবা তুমি ঠেলা ভাড়া করে তার উপর মাল সাজিয়ে ফেরি করে বেড়াতে পারো।

আমি বললুম ব্যবস্থাটা উত্তম বলতে হবে। তার পর?

জিনিসটা যে এত সরল-সহজ করে এনেছে জাপানিরা সেটা আমি জানতুম না। সেইদিনই সবকিছু জোগাড় করে লেগে গেলুম কাজে। টেকনিকেল দুটো-একটা সামান্য জিনিস ল্যান্ড লেডির করার ধরন থেকে অনায়াসে শিখে নিলুম। আর এ ব্যাপারে তো এই আমার পয়লা হাতেখড়ি নয়। আর কাপ, পটে আঁকার মতো ছবির বিষয়বস্তু নিয়েও আমার কোনও দুর্ভাবনা ছিল না।

মাল যখন সমুচা তৈরি হল, তখন কিছুটা দিলুম দোকানে; আর ঠেলা নিয়ে ফেরি করতে কার না শখ যায়?

ভারতীয় বলে সর্বত্রই পেলুম অকৃপণ সৌজন্য ও সাহায্য। তুমি জানো কি না জানিনে, এ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এক ভবঘুরে জাপানি না জানি কী করে ভাসতে ভাসতে পৌঁছয় তোমাদের ঢাকা শহরে। ভাবতেই কীরকম মজা লাগে– দুনিয়ার সব জায়গা ছেড়ে ঢাকা। তবে ওই চিরসবুজের দেশ– আমারও দেখা আছে– তাকে এমনি মুগ্ধ করল যে, সে সেখানে একটা সাবানের কারখানা খুলল এবং শেষটায় একটি হিন্দু মেয়েকে বিয়েও করল। বাপ-মাকে দেখাবার জন্য একবার নিয়ে গেল তার বউকে জাপানে। বুদ্ধের দেশের মেয়ে জাপানে এসেছে খবরটা দেশময় ছড়িয়ে পড়ল মুখে মুখে। সেই অজ পাড়াগাঁ রাতারাতি হয়ে গেল জাপানের তীর্থভূমি। হাজার হাজার নরনারী লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল সেখানে কন্যার দর্শনাভিলাষে। ভাবো, মেয়েটার অবস্থা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকে বসতে হল পদ্মাসনে, আর নতন্ত্র জাপানিদের লাইন তাকে প্রণাম করে পাদ্যঅর্থ দিয়ে নিজেদের ধন্য মনে করল।

আমি বললুম মহিলাটি ঢাকায় ফিরে তাঁর জাপান-অভিজ্ঞতা বাঙলায় লেখেন, বড় সবিনয় ভাষায়। আমি পড়েছি। সে তো এলাহি ব্যাপার হয়েছিল।

হবে না? আমার আমলে আমাদের রাসবিহারীবাবু ছিলেন জাপানিদের সাক্ষাৎ দেবতা। ভারতবর্ষ থেকে জাপানে যে কেউ আসুক না কেন– এমনকি ইংরেজও তার কাগজপত্র যেত ওঁর কাছে। তিনি না বললে পত্রপাঠ আগন্তুকের জাপান ত্যাগ ছিল অনিবার্য। আর গুরুদেবের কাছ থেকে কেউ চিঠি নিয়ে এলে রাসবিহারীবাবু তাকে সমাজের সর্বোচ্চদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতেন। বৈশাখী পূর্ণিমায় বুদ্ধের জন্মদিনে তার বাড়ি থেকে প্রসাদ বিতরণ হত– কিউ দাঁড়াত মাইল দুয়েক লম্বা। সিঙাড়া না আমাদের দেশের কী একটা খাবার জাপানিদের কাছে রোমান্টিক এবং হোলি।

আমি অবশ্য পারতপক্ষে মাতৃভূমির পরিচয় দিতুম না।

তবু বিক্রি হতে লাগল প্রচুর। তার কারণ সরল। পাত্রের গায়ে অজানা ডিজাইন, নবীন ছবি– তা সে ভালো হোক আর মন্দই হোক– সক্কলেরই চিত্ত-চাঞ্চল্য এনে দেয়। তারই ফলে আমি পরমানন্দে দিন কাটাতে লাগলুম। ফেরি-টেরি আর করিনে– নিতান্ত দু মাসে ছ মাসে এক-আধ দিন রোমাসের জন্য। করে করে দু বছর কেটে গেল।

একদিন ওই ঠেলা গাছের ছায়ায় দাঁড় করিয়ে আমি জিরোচ্ছি, এমন সময় এক থুরথুরে অতিবৃদ্ধ জাপানি খানদানি সামুরাই অন্তত আমার তাই মনে হল– থমকে দাঁড়ালেন ঠেলার সামনে। কিন্তু এর মুখে দেখি তীব্র বিরক্তি। পুরু পরকলার ভিতর দিয়ে ক্ষণে তাকান আমার দিকে, ক্ষণে ঠেলার মালের দিকে। জাপানিরা অসহ্য রকমের অসম্ভব দ্র; অসন্তুষ্টি কিছুতেই প্রকাশ করতে চায় না। এর কিন্তু ধৈর্যের বাধ যেন টুটে গেল। বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, এসব কী? এসব কী করেছ? যাও, যাও, ওস্তাদ ওসিমার কাছে। তোমাকে আর কেউ বাঁচাতে পারবে না। তার পর আমাকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বললেন, এরকম সুরেলা গলা নিয়ে কি বিশ্রী বেসুরা গান!

আমি বাড়িতে এসে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লুম। সত্যিই তো, আমি এ দু বছরে নতুন শিখেছি কী? কাদা কী করে তৈরি করতে হয়, কিলন কী করে জ্বালাতে হয়– অন্যসব বাদ দিচ্ছি–কিছুই তো শিখিনি। দেশে ফিরলে ওগুলো আমায় করে দেবে কে? আর বাসনকোসনের শেপে, ছবিতে নিশ্চয়ই মারাত্মক ত্রুটি আছে, নইলে রাস্তার বুড়ো ওরকম খাপ্পা হল কেন?

চিন্তা করতে করতে মনে পড়ল শান্তিনিকেতন মন্দিরে গুরুদেবের একটা সারমনের কথা। সোনার পাত্রে সত্য লুকানো রয়েছে– সবাই পাত্র দেখে মুগ্ধ, ভিতরে হাত দিয়ে খোঁজে না, সত্য কোথায়। আমার হয়েছে তাই। এখানে কাঁচা পয়সা কামিয়ে আমি অবহেলা করেছি সেরামিকের নিগূঢ় তত্ত্ব।

কিন্তু আর না।

ওস্তাদ ওসিমা সম্বন্ধে খবর নিয়ে কিন্তু বিশেষ ভরসা পেলুম না। তিনি বাস করেন এক অজ পাড়াগাঁয়ে, এবং গত দশ বছর ধরে কোনও শাগরেদ নিতে রাজি হননি। তবে সবাই একবাক্যে বললেন, ওরকম গুণী এখন তো কেউ নেই-ই; সেরামিকের ইতিহাসেও কমই জন্মেছেন।

যা হয় হবে কুল-কপালে। সব জিনিসপত্র বিক্রি দিয়ে, একফালি বিছানা আর একটি সুটকেস নিয়ে পৌঁছলুম সেই গায়ে, খুঁজে বের করলুম ওস্তাদের বাড়ি।

জাপানি ভাষা কিন্তু আমি বাঙলার মতো সুদু কান দিয়ে শিখিনি। প্রথম দিন থেকে রীতিমতো ব্যাকরণ অভিধান নিয়ে তোমরা যেরকম আশ্রমে শাস্ত্রীমশায়ের কাছে সংস্কৃত

আমি বললুম, থাক, থাক্।

ওস্তাদের ঘরে ঢুকে, মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে তাঁকে প্রণাম করে অতিশয় বিনয়, ততোধিক বশ্যতা প্রকাশ করে তাঁর শিষ্য হওয়ার ভিক্ষা চাইলুম।

যেন বোমা ফাটল : বেরিয়ে যাও এক্ষুণি, বেরোও এখান থেকে।

আমি ভয়ে ভয়ে এসেছিলুম সত্যি, কিন্তু এরকম পদাঘাত প্রত্যাশা করিনি।

আরম্ভ করলুম কাকুতিমিনতি, সুদূর ইন্ডিয়া থেকে এসেছি, আমি হত্যে দেব ইত্যাদি। আর শুধু মাটিতে মাথা ঠেকাই।

অনেকক্ষণ পর তিনি অতিশয় শান্ত সংযত কণ্ঠে বললেন, আমি কী করি না করি সেকথা কাউকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন বোধ করিনে। তবু তোমাকে বলছি– বিদেশি বলে। আমার কাছে লোক এসে দু-চার মাস তালিম নিয়ে পালিয়ে গিয়ে রটায় তারা আমার শিষ্য। কিছুই তারা শেখেনি– আর আমার নাম ভাঙিয়ে খায়। তাই আমি প্রতিজ্ঞা করেছি আর কোনও শিষ্য নেব না।

আমি বললুম, নটরাজন, বরোদার ওস্তাদ গাওয়াইয়া ফইয়াজ খানও হুবহু ঠিক একই কারণে তাঁর জীবনের শেষের দিকে আর কোনও চেলা নিতেন না।

নটরাজন বলল, ওদের দোষ দিইনে, কিন্তু আমার দিকটাও তো দেখতে হবে। আমি আমার ওস্তাদকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলুম, আমি ওরকম কোনও কুমতলব নিয়ে আসিনি। তিনি অটল অচল, নির্বাক।

কী আর করি! বারান্দায় গিয়ে বসে রইলুম বিছানাটার উপর দেয়ালে হেলান দিয়ে আমি নাছোড়বান্দা, জীবনমরণ আমার পণ।

ঘণ্টাখানেক পর ওস্তাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় চলে গেলেন আমাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। আমি এক লফে ঘরের ভিতর ঢুকে তার চাকরকে খুঁজে বের করে বললুম, দাদা, এখন তুমিই আমার একমাত্র ভরসা। তুমি আমায় সাহায্য কর। সে আগেই শুরুর সঙ্গে আমার বাক্যালাপ শুনেছিল। তাকে বখশিশের লোভও দেখালুম। তার অনুমতি নিয়ে ওস্তাদের সবকখানা ঘরে লাগালুম ঝট, ঝাড়াই-পোঁছাই, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তন্ন তন্ন করে। গামলার জল পাল্টালুম, রঙতুলি গুছিয়ে রাখলুম, জামা-কিমোনো ভাঁজ করলুম, বিছানা দুরুস্ত করলুম। তার পর ফের বারান্দায়, বিছানার উপর। ওস্তাদ ঘন্টাখানেক পরে ফিরে এসে দরজার সামনে এক লহমার তরে একটু থমকে দাঁড়ালেন। কিন্তু নির্বাক। এবার চাকরকে চায়ের হুকুম দিলেন। আমি আড়াল থেকে লক্ষ করলুম। ঘন্টাখানেক পরে খেয়ে শুতে গেলেন। আমি গাঁয়ের যে একটিমাত্র খাবারের দোকান ছিল সেখানে শুটকি-ভাত খেয়ে এলুম। ওস্তাদ ঘুম থেকে উঠে চায়ের জন্য হাঁক দিতেই আমি রান্নাঘর থেকে চায়ের সরঞ্জাম এনে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে চা তৈরি করে কাপ এগিয়ে দিলুম। তিনি তখন আমার দিকে পিছন ফিরিয়ে ভেজা পাত্রে ছবি আঁকছিলেন। পেয়ালা হাতে নিয়েই ঘাড় ফিরিয়ে একবার কুটি-কুটিল নয়নে আমার দিকে তাকালেন। কিন্তু নির্বাক। এর পর আমি রঙ গুলে দিতে লাগলুম। যাই বল, যাই কও– আমিও আটিস্ট। কখন কোন রঙের দরকার হবে আগের থেকেই বুঝতে পারি। তাকে অপেক্ষা করতে হয় না। তিনি নির্বাক।

সে রাত্রে আমি বারান্দাতেই ঘুমিয়েছিলুম। কিন্তু ওই এক রাত্রিই।

ভোর থেকেই লেগে গেলুম চাকরের কাজে। তার পরের দিন। ফের পরের দিন। চাকরটা এখন আর তার ঘরেই ঢাকে না। তিনি নির্বাক।

আমি দু বেলা হোটেলে গিয়ে শুটকি-ভাত খাই, আর রাত্রে চাকরের পাশে শুই।

বিশ্বাস করবে না, এই করে করে প্রায় একমাস গেল। তিনি নির্বাক।

মাসখানেক পরে একরাত্রে আমি আমার ইচ্ছা, আর কিছুতেই দমন করতে পারলুম না। যা দেখেছি সেইটে কাজে লাগাবার অদম্য কামনা আমার ঘুম তাড়িয়ে দিয়েছে। অতি চুপিসাড়ে ওস্তাদের পটার্স হুইলের পাশে বসে একটা জাম-বাটি তৈরি করতে লাগলুম তন্ময় হয়ে। হঠাৎ পিঠের উপর একটা বিরাশি সিক্কার কিল আর হুঙ্কার।

কোন গর্দভ তোমাকে শিখিয়েছে ওরকমধারা বাটি ধরতে? কোন মর্কট তোমাকে শিখিয়েছে ওরকম আঙুল চালাতে? প্রত্যেকটি জিনিস ভুল। যেন ইচ্ছে করে যেখানে যে ভুলটি করার সেটা মেহন্নত করে করে শিখেছ। হটো ইহাসে!

গুরু প্রথম নিজে করলেন। কী বলব ভাই, তাঁর দশটি আঙুল যেন দশটি নর্তকী। প্রত্যেকটির ফাংশান যেন ভিন্ন ভিন্ন, নাচে আপন আপন নাচ। তার পর আমাকে বসিয়ে আমার হাতে হাত ধরে শুরু করলেন গোড়ার থেকে। আর শুধু বলেন, হা আমার অদৃষ্ট, এসব গলদ মেরামত করতে করতেই তো লেগে যাবে পাঁচটি বচ্ছর!

এই আমার প্রথম পাঠ। ভোর অবধি চলেছিল।

সকালবেলা চা খেতে খেতে শান্ত কণ্ঠে বললেন, ভুল প্র্যাকটিস যে কী মারাত্মক হতে পারে তার কল্পনাও তোমার নেই। তোমার ঘর ঝাট দেওয়া, রঙ গোলা থেকে আমি অনুমান করেছিলাম তোমার হাত আছে, কিন্তু অসম্ভব খারাপ রেওয়াজ করে করে তার যে সর্বনাশ করে বসে আছ সেটা জানলে প্রথমদিনই পুলিশ ডেকে তোমাকে তাড়িয়ে দিতুম। এখন দেখি, কী করা যায়। এ-ও আমার এক নতুন শিক্ষা! তোমাকে নেব দুই শর্তে। প্রথম, আমি অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত তুমি তোমার কাজ জনসাধারণকে দেখাতে পারবে না। দ্বিতীয়, আমি অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত তুমি শিক্ষা ক্ষান্ত দিয়ে পালাতে পারবে না।

আমি বুদ্ধের নামে শপথ করলুম।

তার পর, ভাই আরম্ভ হল আমার পিঠের উপর ব্লাদা চালানো। একই কাজ একশো বার করিয়েও তিনি তৃপ্ত হন না–আর মোস্ট এলিমেন্টারি টাস। সঙ্গীতের উপমা দিয়ে বলতে পারি, এ যেন স্রেফ সা রে গা মা পা ধা নি সা সা নি ধা পা মা গা রে সা। সা রে গা মা পা ধা নি–

আমি বললুম, বোমা পড়ে জাপানি!

নটরাজন অবাক হয়ে বলল, সে আবার কী? আমি বললুম সিলেটে গত যুদ্ধে প্রথম জাপানি বোমা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম্য কবি রচেন,

সা রে গা মা পা ধা নি
বোমা পড়ে জাপানি
বোমার মধ্যে কালো সাপ
বিটিশে কয় বাপ রে বাপ!

নটরাজন বলল, আমার অবস্থা তখন ব্রিটিশের চেয়েও খারাপ। তারা তো পালিয়ে বেঁচেছিল, আমার যে পালাবারও উপায় নেই। তবে শুরু এখন বাঙ্ময়। চা খেতে খেতে, বেড়াতে যেতে যেতে ফাইয়াস-পর্সেলিনের গুহ্যতম তত্ত্ব বোঝাতেন, কিন্তু রেওয়াজের বেলা সেই প্রাণঘাতী সা রে গা মা।

পাক্কা দেড়টি বছর পরে পেলুম দ্বিতীয় পাঠ!

ইতোমধ্যে দেখি, এ-দেশের ব্যাপারটাই আলাদা! অনেকদিন একটানা পাত্র গড়ে তার উপর ছবি এঁকে যখন এক উঁই তৈরি হল তখন গুরু কিনে সেগুলো ঢুকিয়ে করলেন ফায়ারিং। ইতোমধ্যে পটারির সমঝদারদের কাছে নিমন্ত্রণ গেছে, অমুক দিন অমুকটার সময় তাঁর পটারির প্রদর্শনী। ঢাউস ঢাউস মোটর চড়ে, গ্রাম্যপথ সচকিত করে এলেন লক্ষপতিরা। তাঁরা চা খেলেন। সার্ভ করলুম। সবাই ভাবলেন আমি বিদেশি চাকর। একজন একটু কৌতূহল দেখিয়েছিলেন, গুরু সেটা অঙ্কুরেই বিনাশ করলেন। তার পর ওঁদের সামনেই কিলন থেকে পটারি বের করা হল। পাঁচশো থেকে আরম্ভ করে, এক এক সেট দুহাজার তিন হাজার টাকায় সব– সব বিক্রি হয়ে গেল। দেশে, বিলেতে মানুষ যেরকম ছবি, মূর্তি কিনে নিয়ে আপন কলেশন বানায়।

তার পর আস্তে আস্তে অনুমতি পেলুম পাত্রের গায়ে ছবি আঁকবার। পুরো এক বছর ধরে পাত্র গড়ি, ছবি আঁকি কিন্তু কিনে ঢোকবার অনুমতি পাইনে। ভেঙে ফেলতে হয় সব। সে কী গব্বযন্ত্রণা!

এমন সময় এল শুরুর আরেকটা প্রদর্শনী। আমি গোপনে গুরুর উঁইয়ের সঙ্গে আমার একটা কাপ এক কোণে রেখে দিলুম। ডিজাইন দিয়েছিলম পারশিয়ান। আমাদের দেশে তো সেরামিকের ঐতিহ্য নেই, আর পারশিয়ান ডিজাইন জাপানে প্রায় অজানা।

চায়ের পর কিলন খোলার সময় প্রায় একই সময়ে সকলের দৃষ্টি পড়ে গেল আমার কাপটার ওপর। আমি আশা করেছিলুম, ওটা আমি গোপনে সরিয়ে নিতে পারব। আমি তখন ছোঁ মেরে সেটা সরিয়ে করলুম পলায়ন। ওঁদের ভিতর তখন আরম্ভ হয়ে গিয়েছে আমার কাপ নিয়ে নিলাম। গুরু বসবার ঘরে এসে আমাকে ডাকলেন। আমি এসে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে তার পায়ের কাছে কাপটি রাখলুম। তখন তারা বুঝলেন, এটা কার কাজ। গুরু স্মিতহাস্যে ওঁদের সবকিছু বয়ান করে বললেন, শিগগিরই ওর আপন প্রদর্শনী হবে। আপনারা কে কী চান অর্ডার দিয়ে যান।

ওরা চলে গেলে আমি সব বুঝিয়ে গুরুর কাছে মাফ চাইলুম। তিনি প্রসন্ন বদনে বললেন, দু-চার মাসের ভিতর এমনিতেই হত। তোমাকে কিছু বলিনি।

আমি কাজে লেগে গেলুম। গুরু আপন কাজ বন্ধ করে দিয়ে পই পই করে তদারকি করলেন আমার প্রত্যেকটি পদক্ষেপ বা অঙ্গুলিচালনা।

নিমন্ত্রণপত্র বেরুল তাঁর নামে। আমার প্রথম প্রদর্শনী। গুরু বললেন, তোমার একটা ফটো ছেপে দাও চিঠিতে।

নটরাজন বলল, দাঁড়াও, সে চিঠির একটা কপি বোধহয় বউয়ের কাছে আছে। তাঁকে স্মরণ করা হলে তিনি নিয়ে এলেন একটা অ্যালবাম্। তাতে মেলা প্রেস-কাটিংস। নটরাজনের প্রদর্শনীর রিভিউ। নিমন্ত্রণপত্রে তাজ্জব হয়ে দেখি ফটোতে নটরাজনের মাথায় খাস পাঠান পাগড়ি! আমি বললুম এ কী? বলল, ভাই, জাপানিরা ওই পাগড়িটাই চেনে। ওটা হলেই ইন্ডিয়ান!

আমি শুধালুম, তার পর?

প্রদর্শনী হল। গুরু ময়ূরটার মতো প্যাখম তুলে ঘোরাঘুরি করলেন। বেবাক্ মাল বিক্রি হয়ে গেল। কড়া কড়া টাকা পেলুম। কাগজে কাগজে রিভিউ বেরোল।

নটরাজনের স্ত্রী বললেন, তিনি জাপানের অন্যতম সেরা আর্টিস্ট বলে স্বীকৃত হলেন।

নটরাজন বলল, সেসব পরে হবে। আমার মস্তকে কিন্তু সাত দিন পরে সাক্ষাৎ বজ্রাঘাত। চাঁদের আলোতে ঝরনাতলায় চুকচুক করে সাকে খেতে খেতে গুরু বললেন, এইবারে বৎস, তোমার ছুটি। টোকিওতে গিয়ে আপন পসরা মেলো।

আমি আর্তকণ্ঠে বললুম, গুরুদেব, আমার যে কিছুই শেখা হয়নি।

গুরু বললেন, বৎস শেখার তো শেষ নেই। কিন্তু গুরুর কাছ থেকে তালিম নেবার একটা শেষ থাকে। তোমাদের স্কুল-কলেজেও তো শেষ উপাধি দিয়ে বিদায় দেয়। তখন কি আর গুরু শোনে তোমার মিনতি যে, তোমার কিছুই শেখা হয়নি? আমি যেসব হুনর পুরুষানুক্রমে পেয়েছি তার প্রত্যেকটি তোমাকে শিখিয়েছি। এবারে আরম্ভ করো সাধনা।

আমার সব অনুনয়-বিনয় ব্যর্থ হল। বললেন, মাঝে মাঝে এসো; তোমার কাজ দেখে আলোচনা করব। নির্দেশ দেব না, আলোচনা করব।

আমি পরের দিন আমার সঞ্চয়ের সব অর্থ গুরুর পদপ্রান্তে রাখলুম– গুরুদক্ষিণা। তিনি একটি কড়িও স্পর্শ করলেন না। অনেক চেষ্টা দিলুম। আবার তিনি নির্বাক! সেই প্রথমদিনের মতো।

বেশ খানিকক্ষণ কী যেন একটা ভেবে নিয়ে নটরাজন বলল, এঁর সঙ্গে কিন্তু একটা সাইড-ড্রামাও আছে।

সেটা কী?

মুচকি হেসে বলল, তাঁর কন্যার—

মিসেস উঠে বললেন, আমি চললুম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া।

নটরাজন বলল, তার কন্যার পাণিগ্রহণের অনুমতি চাইলুম।

আমি বললুম, সে কী! এর তো কিছু বলনি!

বললুম তো, সে অন্য নাট্য। আরেক দিন বলব।

গুরু কী বললেন?

দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন। বললেন, আমার দুর্ভাবনার অন্ত ছিল না যে আমার গুণী মেয়ে কোন আনাড়ির হাতে পড়ে, যে সেরামিকের রস জানে না। তোমরা দুজনাতে আমার ঘরানা বাঁচিয়ে রাখবে, সমৃদ্ধ করবে। আমার স্ত্রী সত্যি ভালো কাজ করতে পারে।

***

পরের দিন শুধালুম, দেশে ফিরে কী করলে?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানতুম এদেশে অলঙ্ বাধাবিঘ্ন। কাদা-কিলুনের কথা বাদ দাও, আমার হ্যান্ডপেন্টেড অরিজিনাল জিনিস পাঁচশো-হাজার টাকা দিয়ে কিনবে কে? এদেশে তো এসব কেউ জানে না– ভাববে আমি পাগল, একটা টি-সেটের জন্য পাঁচশো টাকা চাইছি। এদেশে জাপানি ক্রোকারি আসে মেশিনে তৈরি মাস্-প্রোডাকশন্। আমার তো প্রতি মাসে অন্তত সাতশো, হাজার টাকা চাই। জাপানে প্রতি মাসে পাঁচ-সাত হাজারও কামিয়েছি।

আমি বললুম, এ কী ট্র্যাজেডি! যা শিখলে তার সাধনা করতে পেলে না?

হেসে বলল, আমি কি পয়লা না শেষ? বিদেশ থেকে উত্তম সায়ান্স শিখে এসে কত পণ্ডিত উপযুক্ত যন্ত্রপাতির অভাবে এদেশে শুকিয়ে মরে! আর যারা ছবি আঁকে? তাদেরই-বা কজনের অন্ন জোটে? তাই একটা চাকরি নিয়েছি– দেখি, অবসর সময়ে যদি কিছু

আমি উৎসাহের সঙ্গে বললুম, তোমার চাকরিটা তো ভালো। তোমাদের সেরামিক ফ্যাক্টরি শুনেছি, ভারতের সর্বোত্তম। সবচেয়ে বেশি টেম্পারেচার তুলতে পারো তোমাদের কিনে।

অট্টহাস্য করে নটরাজন বলল, ইনসুলেটার! ইনসুলেটার! লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি! টেলিগ্রাফের খুঁটির মাথায় সাদা মুণ্ডুটা দেখেছ? আমরা বানাই সেই মাল। অষ্টপ্রহর তাই বানিয়েও বাজারের খাই মেটাতে পারিনে। কোম্পানির ওতেই লাভ, ওতেই মুনাফা। আর দয়া করে ভুলো না, হরেক রকম ইনসুলেটর সেরামিক পর্যায়েই পড়ে! হা-হা হা-হা, যেমন দেয়ালে যে রঙ লাগায় সে-ও পেন্টার, অবন ঠাকুরও পেন্টার।

ইনসুলেটার হে, ইনসুলেটার!!

পুচ্ছ (প্র) দর্শন

কুকুর মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে– এ তথ্য কিছু নতুন নয়। কিন্তু কুকুরের কাটা লেজের অবশিষ্ট চার আঙুল পরিমাণ একটা ছ ফুট লম্বা তাগড়া জোয়ানকে বাঁচিয়েছে এটা অবিশ্বাস্য। কিন্তু যে-ব্যক্তি এ ঘটনাটির বর্ণনা আমাকে দেন, তিনি অনেকের কাছেই সুপরিচিত এবং তারা সকলেই সানন্দে শপথ করতে প্রস্তুত হবে যে, শ্ৰীযুত বিনায়ক রাও শিবরাম মসোজিকে কেউ কখনও মিথ্যা-ভাষণ করতে শোনেননি।

আমার শুধু ক্ষোভ যে, বিনায়ক রাও যখন আমাকে প্রাগুক্ত ঘটনার সঙ্গে বিজড়িত তাঁর হিমালয় ভ্রমণ বর্ণন করে যান, তখন আমার সুদূর কল্পনাদৃষ্টি দিকচক্রবালে এতটুকু আভাস দেখতে পায়নি যে, আমার মতো নগণ্যজনও একদিন বাঙলা সাহিত্যের সংস্পর্শে আসবে; নইলে সেদিন আমি সাতিশয় শ্রদ্ধা ও যত্নসহকারে বিনায়ক রাওয়ের ভ্রমণকাহিনীটি সবিস্তার লিখে রাখতুম। কারণ আমাদের পরিচিত জন নিত্য নিত্য মানসসরোবর দর্শনে যায় না; তা-ও পিঠে মাত্র একটি হ্যাঁভারস্যাক নিয়ে। পরবর্তী যুগে আমাকে এক মারাঠা দম্পতি বলেন যে, মানসসরোবরে (না মানস সরোবরে তাই আমি জানিনে) যাবার পথে ডাকাতের ভয় আছে বলে তাঁরা সঙ্গে সেপাইশান্ত্রি নিয়ে যান।

বিনায়ক রাও শ্ৰীযুত নন্দলালের শিষ্য এবং শিক্ষাশেষে তিনি গুরু নন্দলালের সহকর্মীরূপে কলাভবনে সহকারী অধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করেন। নন্দলাল যেরকম দেব-দেবীর ছবি আঁকতেন, বিনায়ক রাও তেমনি ভারতীয় দৃষ্টিবিন্দু থেকে ভারতীয় বাতাবরণে, ভারতীয় বেশভূষায় মান্না মা-মেরির একাধিক ছবি এঁকে দেশে-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেন। ইউরোপীয় চিত্রকরদের মান্না দেখে দেখে আমরা ভুলে গিয়েছিলুম যে, মা-মেরি প্যালেস্টাইন-বালা এবং প্যালেস্টাইন প্রাচ্যভূমি। বিনায়ক রাওয়ের একখানি উৎকৃষ্ট মান্না কিছুদিন পূর্বেও এলগিন রোডের একটি গির্জার শোভাবর্ধন করত।

তিনি যে চিত্রকর ছিলেন, তার উল্লেখ করছি আমি অন্য কারণে। আর্টিস্ট মাত্রেরই অন্যতম প্রধান গুণ যে, তারা কোনও বস্তু প্রাণী বা নৈসর্গিক দৃশ্য দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলো (ক্যারেকটারিস্টিক) লক্ষ করেন এবং ঠিক সেইগুলো মাত্র কয়েকটি আঁচড়ে প্রকাশ করতেই আমাদের কাছে রূপায়িত বিষয়বস্তু প্রাণবন্ত হয়ে ধরা দেয়। ভ্রমণ-কাহিনী বর্ণনার সময় বিনায়ক রাও দৃশ্যের পর দৃশ্য মাত্র কয়েকটি ক্যারেকটারিস্টিক শব্দের দ্বারা প্রকাশ করতেন, আর সঙ্গে সঙ্গে আমি হিমালয়ের গিরি-পর্বত-তুষার-ঝঞ্ঝা চট্টি-কাফেলা সব যেন স্পষ্ট চোখের সামনে দেখতে পেতুম। সেটা এখানে এখন আমার পক্ষে ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব। কারণ আমি কোনও অর্থেই আর্টিস্ট নই।

বিনায়ক রাওয়ের গভীর বন্ধুত্ব ছিল এক জাপানি ভদ্রলোকের সঙ্গে নাম খুব সম্ভব ছিল– এতকাল পরে আমার সঠিক মনে নেই- হাসেগাওয়া। পাঁচ ফুটের বেশি দৈর্ঘ্য হয় কি না হয়, কিন্তু তার প্রত্যেকটি পেশি ছিল যেন ইস্পাতের স্প্রিং দিয়ে তৈরি। প্রায় কিছু না খেয়েই কাটাতে পারতেন দিনের পর দিন এবং বীরভূমের ১১০ ডিগ্রিতেও তাঁর মুখে কোনও ভাবের পরিবর্তন দেখা যেত না। বিনায়ক রাওয়ের সঙ্গে তার আরেকটা বিষয়ে ছিল হুবহু মিল, দুজনাই অত্যন্ত স্বল্পভাষী। হাসেগাওয়াই প্রস্তাব করেন মানসসরোবরে যাওয়ার।

আমার আজ মনে নেই, কোন এক সীমান্তে গিয়ে ওই পুণ্যসরোবরে যাবার জন্য পারমিট নিতে হয়। বিনায়ক রাও আমাকে বললেন, সব সরকারই বিদেশিদের ডরায়, ভাবে ওরা গুপ্তচর, কী মতলব নিয়ে এসেছে, কে জানে। ওসব জায়গায় তো যায় মাত্র দু ধরনের লোক। তীর্থযাত্রী, আর যেটুকু সামান্য ব্যবসা-বাণিজ্য আছে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারবারি লোক– ওরা যায় ক্যারাভান বা কাফেলার দল বানিয়ে। আমি খ্রিস্টান, হাসেগাওয়া বৌদ্ধ; মানসসরোবর আমাদের কারওরই তীর্থ হতে পারে না। তবু ফর্মে লিখে দিলুম তীর্থযাত্রী, নইলে পারমিট অসম্ভব। হাসেগাওয়া বললেন, আমরা গা-ঢাকা দিয়ে রইব, যতদিন না পারমিট পাই, পাছে আমাদের স্বরূপ না ধরা পড়ে। ইতোমধ্যে তোমাকে মাউন্টেনিয়ারিং বা পাহাড় চড়ার আর্টে তালিম দেব।  বিনায়ক রাও বললেন, আমি তো মনে মনে হাসলুম। হাসেগাওয়ার তুলনায় আমি তো রীতিমতো পায়লওয়ান। আমি পাহাড় চড়ি চড় চড় করে– ও আবার আমায় শেখাবে কী? কিন্তু ভুল ভাঙল প্রথমদিনই। পাশেই ছিল একটা ছোটখাটো পাহাড়। সেইটে দিয়েই হল আমার প্র্যাকটিস শুরু। হাসেগাওয়া আমাকে পই পই করে বার বার বললেন, কনে-বউটির মতো চলি চলি পা পা করে ওঠো, নইলে আখেরে পস্তাবে। আমি মনে মনে বললুম, দুত্তোর তোর পা পা। চড় চড় চড় করে উঠতে লাগলুম চড়াই বেয়ে বাঘের শব্দ পেলে বাঁদর যে-ধরনে সোদরবনে সুন্দরী গাছ চড়ে। উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু মশাই, ঘণ্টাদুই পরে দেখি অবস্থা সঙ্গিন। আর যে এক কদমও পা চলে না। ভিরমি যাবার উপক্রম। সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় আমি বসে পড়লুম একটা পাথরের উপর। ঘন্টাটাক পরে হাসেগাওয়া আমাকে পাস্ করলেন, আমার দিকে তাকিয়ে একটু মৃদু হেসে। তিনি চূড়ায় উঠলেন। আমি বসে বসে দেখলুম। নেমে এলেন। বিশ্বাস করবেন না, সৈয়দসাহেব, আমার আত্মাভিমানে লাগল জোর চোট।

আমি বললুম, দাক্ষিণাত্যের তিরু আন্নামলাইয়ের রমণ মহর্ষির নাম শুনেছ নিশ্চয়ই। তিনি অরুণাচল পাহাড়ের উপর কাটান চল্লিশ না পঞ্চাশ বছর কিংবা ততোধিক। পাহাড়টা কিছু মারাত্মক উঁচু নয় কিন্তু ঝড়ে-বাদলায়, গরমে-ঠাণ্ডায়, কখনও-বা অত্যন্ত অসুস্থ দুর্বল শরীর নিয়ে তাঁকে দিনে অন্তত একবার করে ওঠানামা করতে হত। এক পুণ্যশীলা গ্রামের মেয়ে তার জন্য প্রতিদিন খাবার নিয়ে আসত পাহাড়ের তলায়, যেখানে আজকের দিনের আশ্রম। তিনিও আমাদের ওই চলি চলি পা পা-র উপদেশ দিয়েছেন, খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে। তার পর বল।

বিনায়ক রাও বললেন, পরদিন আরেকটা পাহাড়ে চেষ্টা দিলুম। সব জেনেশুনেও আমার কিন্তু ওই কনে-চাল কিছুতেই রপ্ত হচ্ছিল না। আর হাসেগাওয়া প্রতিদিন আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে পাস্ করতেন ও জিততেন লজ্জাকর মার্জিন রেখে।

আমরা দিনের পর দিন প্রহর গুনছি–পারমিট আর আসে না, ওদিকে আমরা জনমানবহীন পাহাড়গুলো চড়ছি আর ভাবছি, আত্মগোপন করেছি উত্তমরূপেই। কিন্তু ইতোমধ্যে সিজন যে বেশ এগিয়ে গিয়েছে, আর বেশি দেরি হলে তো বরফ পড়তে আরম্ভ করবে।

শেষটায় এক বড়কর্তার কাছে ডাক পড়ল। তার প্রাসাদে উঠে দেখি, ইয়া আল্লা। তার সেই উঁচু টিলার স্ট্যান্ডের উপর খাড়া জোরদার টেলিস্কোপ। আমরা যখন অস্ট্রিচ পাখির মতো বালুতে মাথা গুঁজে আত্মগোপনের আত্মপ্রসাদ অনুভব করছি, ইনি তখন প্রতিদিন নির্ঝঞ্ঝাটে আমাদের প্রতিটি পাহাড় ওঠা পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং কৌতূহলী হয়ে আমাদের সম্বন্ধে সর্বসংবাদ সংগ্রহ করেছেন। বেশ রসিয়ে রসিয়ে আদ্যোপান্ত বললেন। আমাদের মুখ শুকিয়ে গেল– ইস্তেক যে-জাপানি বদন অনুভূতি প্রকাশে সম্পূর্ণ অনভ্যস্ত ও অনিচ্ছুক সেটিও কিঞ্চিৎ বিকৃত হল।

কিন্তু বৃথাই আতঙ্ক; আমরা খামোখাই ঘামের ফোঁটায় কুমির দেখছিলুম। আমাদের অদৃষ্ট সুপ্রসন্ন। বড়কর্তা সর্বসংবাদ শুনে আমাদের অভিযানাকাঙ্ক্ষা প্রসন্নতর দৃষ্টিতে আশীর্বাদ করেছেন। কারণ, আমরা ধর্ম বা অর্থ কোনওটাই সঞ্চয় করতে যাচ্ছি না– আমরা আসলে তীর্থযাত্রী নই, আর ব্যবসায়ী তো নই-ই। তবে তখনও জানতুম না, আরেকটু হলেই অনিচ্ছায়, অন্তত আমার, মোক্ষ লাভটা হয়ে যেত।

অমি বললুম, ধর্ম, অর্থ, মোক্ষ তিনটের তো জমা-খরচ হল আর কাম?

মসোজি বললেন, রাম, রাম। ওর মতো রিটান আমি কোনও মঠ, কোনও মনাস্টেরিতে দেখিনি।

তার পর বিনায়ক রাও আমার চোখের সামনে একটার পর একটা ছবি এঁকে যেতে লাগলেন। কত না বনস্পতি, অজানা-অচেনা বিহঙ্গের সঙ্গে প্রথম পরিচয়, আন্দোলিত উপত্যকার উপর ক্রোশের পর ক্রোশব্যাপী দোদুল্যমান ফুলের বন্যা, পার্বত্য-নদী, জলপ্রপাত, অভ্রংলেহী পর্বত, পাতালস্পর্শী অন্ধকূপ, সংকটময় গিরি-সংকট, পান্থশালা, চট্ট, পার্বত্য শ্রমণদের জিহ্বানিমণপূর্বক তৎসঙ্গে ঘন ঘন বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠদ্বয় আন্দোলন দ্বারা অভিবাদন, দুর্গন্ধময় স্নেহজাতীয় পদার্থসহ চা-পানের নিমন্ত্রণসহ অতিথি সৎকার। আরও এতসব বিজাতীয় বস্তু ও কল্পনাতীত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছিলেন যে, সেগুলোর নির্ঘণ্ট মাত্র দিতে হলে প্রচুর অবকাশ ও প্রচুরতর পরিশ্রমের প্রয়োজন। য়েতি বা এমিনেবল স্নোম্যান সম্বন্ধে যেসব কাহিনী বর্ণন করেছিলেন শুধু সেগুলো শিকের হাঁড়িতে সযত্নে তুলে রেখেছি : অম্মদেশীয় সম্পাদক ও প্রকাশকদের শেষশয্যায় সেগুলো তাদের রসিয়ে রসিয়ে শুনিয়ে শুনিয়ে তাদের শেষ যাত্রাটি বিভীষিকাময় করে দেবার জন্যে।

বিনায়ক রাও বললেন, ক্রমে ক্রমে আমরা লক্ষ করলুম, পাহাড় থেকে নেমে আসছে সবাই, উপরের দিকে যাচ্ছে না কেউই। চটির পর চটি দেখি হয় জনমানবহীন দরজা খা-খা করছে কিংবা তালাবন্ধ– সমস্ত শীতকাল এখানে তো আর কেউ আসবে না।

আমরা চড়াইয়ের দিকে শেষ কাফেলাও মিস করেছি।

কিন্তু হাসেগাওয়ার ওই একটি মহৎ সদণ্ডণ যে, কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার অত্যন্ত প্রয়োজন না হওয়ার পূর্বে তিনি ওই নিয়ে মাথা ঘামান না।

আমরা যতই উপরের দিকে উঠছি, ততই রাস্তা এবং চট্ট জনবিরল হতে লাগল। শেষটায় আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা চলার পরও কাউকে নেমে আসতে দেখি না— ওঠার তো প্রশ্নই ওঠে না। তখন দেখি এক পরিত্যক্ত চট্টর সামনে একজন সাধু বসে আছেন। সন্ধ্যা হয়-হয়। মোক্ষম শীত পড়েছে কিন্তু সাধুজি কৌপিনসার। সর্বাঙ্গে ভস্মও মাখেননি কিংবা অন্য কোনও ব্যবস্থারও প্রয়োজনবোধ করেননি। অথচ দেহটির দিকে তাকালে মনে হয়, এইমাত্র প্রচুর তেল ডলাইমলাই করে স্নান সেরে উঠেছেন– গা বেয়ে যেন তখনও তেল ঝরছে। আমাদের সঙ্গে চাপাতি ও শুকনো তরকারি ছিল। সাধুজিকে তার থেকে হিস্যে দিলুম। তিনি কোনওপ্রকারের বাক্যালাপ না করে খেলেন। আমরাও কোনও প্রশ্ন শুধালুম না। পরের দিন ভোরবেলা দেখি, তিনি তখনও সেখানে ঠায় বসে। আমরা তাঁকে প্রণাম করে রাস্তায় নামবার সময় মনে হল এই যেন সর্বপ্রথম তার চোখে ভাবের পরিবর্তন দেখা গেল– সে পরিবর্তনে যেন আমাদের প্রতি আশীর্বাদ রয়েছে। রাস্তায় নামার পর হাসেগাওয়া বলল, আমার দুশ্চিন্তা গেছে। আমাদের যখন উনি চড়াইয়ের পথে যেতে বারণ করলেন না, তখন মনে হচ্ছে, আমাদের যাত্রা সফল হবে।

হিমালয়ের অন্যতম এই রহস্যের সমাধান এখনও হয়নি। এইসব একাধিক সন্ন্যাসী সমস্ত শীতকালটা এসব জায়গায় কাটান কী করে? পাঁচ-সাত হাত বরফ এখানে তো জমেই– সেখানে না আগুন, না কোনওপ্রকারের খাদ্য। এক চট্টিওলা আমাকে পরে বলেছিল, বরফের তলায় নাকি একরকমের লতা গজায়। তারই রস নাকি এদের খাদ্য, বস্ত্র, আগুন– সব।

আর হাসেগাওয়া তুলে যাচ্ছে, একটার পর একটা ছবি। এই গিরি অভিযানে বেরুবার তার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য– যত পারে, যতরকমের হয়, ফটোগ্রাফ তোলা। দাঁড়ান, আপনাকে বইখানা দেখাই।

বিনায়ক রাও নিয়ে এলেন ঢাউস এক ফটোগ্রাফের বই। মলাটের উপরকার ছবি দেখেই আমার বুঝতে বাকি রইল না যে, এই বই জাপানি। জর্মনরাও বোধহয় এরকম প্রিন্ট করতে পারে না। কে বলবে এগুলো ব্লক থেকে তৈরি! মনে হয় কন্টাক্ট প্রিন্ট!

বিনায়ক রাও বললেন, জাপানে ফিরে গিয়ে হাসেগাওয়া তার তোলা ছবির একটি প্রদর্শনী দেখান। সে-দেশের রসিক-বেরসিক সর্বসম্মতিক্রমে এই সঞ্চয়ন ফটোগ্রাফির প্রথম বিশেষ পুরস্কার পায়।

ছবি বোঝাবার জন্য এ-বইয়ে টেক্সট অত্যল্প। আমার বড় বাসনা ছিল বইখানা যেন ভারতের বাজারেও জাপানিরা ছাড়ে। কিন্তু ঠিক তখনই মার্কিন হিরোশিমার উপর এটম বোমা ফেলছে। পরবর্তীকালে আমি আবার কঁহা কঁহা মুলুকে চলে গেলুম।

এ-বইখানা আনাতে কিন্তু আমার অসুবিধা সৃষ্ট হল। বিনায়ক রাও বই আনার পর আর বর্ণনা দেন না। শুধু বলেন, এর পর আমরা এখানে এলুম বলে দেখান একটা ফটো, ফের দেখান আরেকটা অনবদ্য ছবি। কিন্তু এখন আমি সেসব ছবির সাহায্য বিনা তাদের যাত্রাপথের গাম্ভীর্য, মাধুর্য, বিস্ময়, সংকট, চিত্র-বৰ্ণন করি কী প্রকারে! পাঠক, তুমি নিরাশ হলে আমি নিরুপায়।

বিনায়ক রাও, হাসেগাওয়া তোমার ও আমার পরম সৌভাগ্য যে, ওঁরা দুজনা পথিমধ্যে একটি কাফেলা পেয়ে গেলেন এবং অবিশ্বাস্য, সেটা যাচ্ছে উপরের দিকে। এদের ভিতর আছে তীর্থযাত্রী ও অল্পবিত্ত ব্যবসায়ী। এই শেষ কাফেলা। নানা কারণে এদের বড় বেশি দেরি হয়ে গিয়েছে বলে ব্যবসায়ীদের মনে শঙ্কা, বরফ-নামার পূর্বে এঁরা পাহাড় থেকে নামতে পারবেন কি না। তীর্থযাত্রীদের মনে কিন্তু কোনওপ্রকারের দুশ্চিন্তা নেই। এ ধরনের তীর্থদর্শনে যারা বেরোয়, তারা ঘরবাড়ির মোহ, প্রাণের মায়া সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়েই সম্মুখপানে পা ফেলে। পথিমধ্যে মৃত্যু, মানসে মৃত্যু, গৃহ-প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত যেখানেই মৃত্যু হোক না কেন, তারা আশ্রয় পাবেন ধূর্জটির নিবিড় জটার মাঝখানে– যে-জটা হিমালয়ের চূড়ায় সৃষ্টির প্রথম প্রভাত থেকে চিরজাজ্বল্যমান।

আর কাফেলার ওইসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করলে মনে হয়, কী বিচিত্র দ্বন্দ্বময় পরস্পরবিরোধী কার্যকলাপ এদের জীবনে। যে প্রাণরক্ষার জন্য এরা দুটি মুঠি অন্ন উপার্জন করতে এসেছে এখানে, সেই প্রাণ তারা রিস্ক করছে প্রতিদিন, প্রতি বৎসর। হুবহু সার্কাসের স্টান্ট খেলাড়িদের মতো প্রাণধারণের জন্য যারা প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলে প্রতি সন্ধ্যায়!

তা সে যাক্। এ লেখাটি এখন সংক্ষিপ্ত করি। কারণ, হিমালয়ের বর্ণনাই যখন দিতে পারছিনে, তখন হিমালয় নিয়ে কাহিনী বলা শিবহীন দক্ষযজ্ঞ এবং যদ্যপি হিন্দু পুরাণের সঙ্গে পরিচয় আমার ঘনিষ্ঠ নয়, তবু এটুকু জানি, সে প্রলয়কাণ্ড ঘটেছিল এই হিমালয়েই– দক্ষালয়ে।

আমি অরসিক। হঠাৎ শুধালুম, বিনায়ক রাও! তোমরা খেতে কী?

শেষের দিকে পথে যেতে যেতে– পথ বললুম বটে কিন্তু আমি আপনারা পথ বলতে যেটা বোঝেন, সেটাকে অপমান করতে চাইনে– আমার শ্যেনদৃষ্টি থাকত কিসের ওপর জানেন? শকুনি, শকুনি– আমি তখন সাক্ষাৎ শকুনি। শকুনি যেমন নির্মল নীলাকাশে ওড়ার সময়ও তাকিয়ে থাকে নিচে ভাগাড়ের দিকে, আমিও তাকিয়ে থাকতুম নিচের দিকে। কোথাও যদি ভারবাহী য়া পশুর এক চাবড়া গোবর পেয়ে যাই। সে-ঘুঁটেতে আগুন ধরিয়ে ধুয়োর ভিতর নাড়াচাড়া করি, চেপে ধরি, দু হাত দিয়ে চড়চাপড় মেরে তৈরি করা এবড়ো-থেবড়ো রুটি– গুজরাতিতে যাকে বলে রোটলা, কাবুলি নানের চেয়েও তিন ডবল পুরু। কিন্তু সেই উঁশা রুটিই মনে হত সাক্ষাৎ অমৃত– ওলড টেস্টামেন্টের বিধিদত্ত মান্না, যার স্বাদ আজও ইহুদিকুল ভুলতে পারেনি।

বিনায়ক রাও বললেন, পঙ্গুও ঈশ্বরপ্রসাদাৎ গিরি লঙ্ন করে– এটা মানসে পৌঁছে জন্মের মতো উপলব্ধি করলুম। হাসেগাওয়ার দর্শনই ঠিক পঙ্গু বাধ্য হয়েই এগোয় অতি ধীরে-মন্থরে, তাই শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যায় মানসসরোবরে। পঙ্গুর কাছে যা বিধিদত্ত, সুস্থ মানুষকে সেটা শিখতে হয় পরিশ্রম করে। *

[* চেকোশ্লোভাকিয়ার পাহাড়-পর্বত হিমালয়ের তুলনায় নগণ্য। সেখানে পাহাড় চড়তে গিয়ে শ্রীযুক্ত মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের যে অভিজ্ঞতা হয় সেটি এস্থলে তুলে দেবার লোভ সম্বরণ করতে পারলুম না।

মিরেক (একজন পাহাড়-বন-বিভাগের চৌকিদারকে) শুধোল, আচ্ছা, আপনি এত আস্তে চলছেন কেন?

প্রশ্ন শুনে চৌকিদার হো হো করে খুব খানিকটা হেসে নিলেন। তার পর বললেন- শুনুন। বহু বছর, চল্লিশেরও উপর, বনের পথে, পাহাড়ে রাস্তায় নানান গতিতে হেঁটেছি। কখনও জোরে কখনও ধীরে। আপনাদের মতো আগে হাঁটতুম, আরও জোরে হাঁটতুম। লাফিয়ে ঝাফিয়ে পাহাড়ে উঠে তার পর হাঁপাতুম। হাত-পা ছড়িয়ে ঘাসের উপর শুয়ে জিরিয়ে নিতুম, তারপর আবার চলতুম। কাজের তাগিদে কখনও সারাদিন হাঁটতে হয়েছে, কখনও সারারাত। কিন্তু এই যে এখনকার আমার চলার গতি দেখছেন, এ হচ্ছে বহুদিনের বহু সাধনার পর আবিষ্কৃত। এ গতিতে চললে কখনও ক্লান্তি আসবে না শরীরে। যত দূর-দূরান্তরে বনান্তরে যান না কেন, যাত্রার শুরুতে যেমন শরীর তাজা তেমনিই থাকবে। চরণিক, প্রথম (বেঙ্গল) সংস্করণ, পৃ. ১১৩/১৪।]

বিনায়ক রাও ভেবে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, সরোবরে স্নান করেছিলুম। আমার জীবনের মহামূল্যবান অভিজ্ঞতার ভিতর এটা আমার চিরকাল মনে থাকবে।

সর্বাঙ্গ জুড়িয়ে গেল না? পুণ্যস্নান তো বটে।

বিনায়ক রাও শিউরে উঠলেন, বাপরে বাপ! জলে দিয়েছি ঝাঁপ আর সঙ্গে সঙ্গে মেরেছি পারের দিকে লাফ। সেদিন আকাশ ছিল পরিষ্কার। দ্বিপ্রহরের সেই উগ্র রৌদ্রে আমি ঘণ্টাদুয়েক ছুটোছুটি করেছিলুম শরীরটাকে গরম করার জন্যে। ছুটেছি পাগলের মতো দু-হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পা-দুটো ছুঁড়ে ছুঁড়ে আছাড় মেরে মেরে। তার পর ক্লান্ত হয়ে থামতে বাধ্য হয়েছি। ফাঁসির লাশের মতো জিভ বেরিয়ে গিয়েছে হাঁপাতে হাঁপাতে। ফের ছুটতে হয়েছে গা গরম করার জন্য। গা আর কিছুতেই গরম হয় না। সে কী যন্ত্রণাভোগ!

আমি বললুম, শুনেছি, গত যুদ্ধে যেসব অ্যার পাইলট শীতকালে ইংলিশ-চ্যানেলের জলে পড়েছে, তাদের কেউই কুড়ি মিনিটের বেশি বাঁচেনি।

বিনায়ক রাও বললেন, লোকে বলে, অগ্নিপরীক্ষা? আমি বলি শীতের পরীক্ষা।

হ্যাঁ, আফ্রিকাবাসীরাও বলে– Heat hurts, cold kills.

বিনায়ক রাও বললেন, হাসেগাওয়া প্রাণভরে ছবি তুললেন। তার পর প্রত্যাবর্তন। অন্য পথ দিয়ে।

চলেছি তো চলেছি; তার পর এল আমাদের কঠিনতম সংকট। আমাদের একটা গিরিসংকট পেরুতে হবে। এবং এটা পৃথিবীর অন্যতম সর্বোচ্চ গিরিসংকট। সমুদ্রতট থেকে বারো হাজার ফুট উঁচুতে না বাইশ হাজার আমার মনে নেই। এবং একটুখানি যাওয়ার পরই আরম্ভ হয় চড়াইয়ের পর চড়াই। ক্যারাভানের এক ব্যবসায়ী আমাকে বলেছিল, যেসব তীর্থযাত্রী মারা যায়, তাদের অধিকাংশই মরে এইখানে।

ক্রমেই বাতাসের অক্সিজেন কমে আসছিল। অতিকষ্টে আমরা ধীরে ধীরে এগুচ্ছি। এমন সময় চোখে পড়ল একটা লোক অকাতরে ঘুমুচ্ছে পথের একপাশে। কাছে এসে বুঝলুম, মৃতদেহ! এবং সম্পূর্ণ অবিকৃত মৃতদেহ। এ বছরে মরেছে, না গেল বছরে বুঝতে পারলুম না। কারণ, আমি শুনেছিলুম, উপরে-নিচে বরফ থাকে বলে মড়া পচে না।

এর পর আরও কয়েকটা। আমি মাত্র একবার একজনের মুখের দিকে তাকিয়েছিলুম, আহা! সে কী শান্ত, প্রশান্ত, নিশ্চিন্ত মুখচ্ছবি। মায়ের কোলে ঘুমিয়ে-পড়া শিশুর মুখেও আমি এরকম আনন্দভরা আত্মসমর্পণের ছবি দেখিনি।

ইতোমধ্যে আমার দৃষ্টি গেল অন্যদিকে। দেখি, আমাদের দলের একজন বৃদ্ধ তীর্থযাত্রী অনেকখানি পিছিয়ে পড়েছে। কারও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ পর্যন্ত নেই। আমি জানতুম, এবং হাসেগাওয়াও আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, এখানে বলবান যুবা পুত্রও হাত বাড়িয়ে মাতাকে পর্যন্ত সাহায্য করতে পারে না। কারও শরীরে একবিন্দু উদ্বৃত্ত শক্তি নেই যে, সে সেটা অন্যের উপকারে লাগাবে। সামান্য দুটি কথা বলে যে সাহস দেবে সে শক্তিও তখন মানুষের থাকে না। আমার মনে হল, হালকা একটি পালক দিয়েও যদি কেউ আমাকে ঠোনা দেয় আমি হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাব।

আমি খুব ভালো করেই জানতুম, কাফেলা কারও জন্য অপেক্ষা করে না, করলে সমস্ত কাফেলা মরবে। আমাদের যে করেই হোক সন্ধ্যা নাগাদ সামনের আশ্রয়স্থলে পৌঁছুতে হবে।

এমনিতেই আমাদের প্রত্যেকেরই ছিল শম্বুকগতি। আমি সেটাও কমিয়ে দিলুম ওই বৃদ্ধকে সঙ্গ দিতে। হাসেগাওয়া বুঝতে পেরেছে। আমার দিকে রহস্যভরা নয়নে সে তাকাল। আমি ইঙ্গিতে জানালুম, সে যেন তার গতি শ্লথ না করে।

এস্থলে আমি সামান্য একটি তথ্যের উল্লেখ না করলে কর্তব্যবিচ্যুতি হবে।

বিনায়ক রাওয়ের মতো পরদুঃখকাতর মানুষ আমি এ জীবনে কমই দেখেছি, এবং একেবারেই দেখিনি পরোপকার গোপন রাখতে তাঁর মতো কৃতসংকল্পজন। প্রভু যিশুর আদেশ, তোমার বাঁ হাত যেন না জানতে পারে তোমার ডান হাত কী দান করল। এরকম অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে আমি কোনও খ্রিস্টান অখ্রিস্টান– কাউকে দেখিনি। কাফেলার বৃদ্ধের প্রতি তাঁর দরদ গোপন রাখতে পারলে তিনি নিশ্চয়ই তাই করতেন– এ সত্য আমি কুরান স্পর্শ করে বলতে রাজি আছি। কিন্তু এটা গোপন রাখলে তাঁর মূল বক্তব্য একেবারেই বিকলাঙ্গ হয়ে যেত বলে তিনি যতটা নিতান্তই না বললে নয়, সেইটুকুই বলেছিলেন।

বিনায়ক রাও সেদিনের স্মরণে একটুখানি শ্বাস ফেলে বললেন– বৃদ্ধকে আমি বলব কী– স্পষ্ট দেখতে পেলুম, সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে যেন কাফেলা থেকে সে বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে। এই যে আমি তার তুলনায় শক্তিশালী, আমারই থেকে থেকে মনে সন্দেহ হচ্ছিল, আমিই কি পৌঁছতে পারব গন্তব্যস্থলে? তখন হৃদয়ঙ্গম করলুম, এখানে এ-সংকট থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য শারীরিক বলের প্রয়োজন আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন মানসিক বলের। এবং এ বৃদ্ধের সেটা যেন আর নেই। তীর্থদর্শন হয়ে যাওয়ার পর ফেরার মুখে অনেকেই সেটা হারিয়ে ফেলে– কারণ তখন তো সামনের দিকে আর কোনও উদ্দেশ্য নেই, আর কোনও চরম কাম্য বস্তু নেই। ফিরে তো যেতে হবে আবার সেই সংসারে, তার দিনযাপনের প্রাণ-ধারণের গ্লানির ভিতর।

আমার মনে হচ্ছিল আমি নিজে যেন সন্তরণে অক্ষম, আরেক সন্তরণে অক্ষম জনকে সাহায্য করার নিষ্ফল প্রচেষ্টা করছি। তবু বললুম, আরেকটুখানি পরেই উত্রাই। চলুন। এই সামান্য কটি শব্দ বলতে গিয়েই যেন আমার দম বন্ধ হয়ে এল।

বুড়ো আমার দিকে তার ঘোলাটে চোখ তুলে তাকিয়ে হঠাৎ কী যেন দেখতে পেল। অতি কষ্টে ধীরে ধীরে বলল, বাবু, তোমার বোতল থেকে একটু শরাব।

বিনায়ক রাও বললেন, আমি জীবনে কখনও শরাব স্পর্শ করিনি; আমার বুকের পকেটে ছিল চ্যাপ্টা বোতলে জল।

কোনও গতিকে বললুম, জল। বুড়ো বিশ্বাস করে না। কাতর নয়নে তাকায়।

আস্তে অতি আস্তে বুড়ো এগোচ্ছে ওই শরাবের আশায়।

এইভাবে খানিকক্ষণ চলল। হঠাৎ বুঝি বুড়ো লক্ষ করেছে কাফেলা একেবারেই অন্তর্ধান করেছে। কাঁপতে কাঁপতে বুড়ো বলল, জিরো। আমি শুষ্ককণ্ঠে যতখানি পারি চেঁচিয়ে বললুম, না না! আমি জানি এ জিরোনোর অর্থ কী। এই বসে পড়ার অর্থ, সে আর উঠে দাঁড়াবে না। তার মনে হবে এই তো পরমা শান্তি আরাম, আরাম। আর শেষ নিদ্রায় ঢলে পড়বে।

বুড়ো তার শেষ ক-টি কথা বলল যার অর্থ, এক ঢোক শরাব পেলে সে হয়তো সংকট পেরুতে পারবে। আমার দিকে হাত বাড়াল। আমি আর কী করি? দিলুম বোতল। সে টলতে টলতে বসে পড়ল। এ কী সর্বনাশ! তার পর বোতল মুখে দিয়ে যখন দেখল সত্যি জল, তখন আমার দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে কাৎ হয়ে শুয়ে পড়ল।

এই শরাবের আশাতেই সে এতক্ষণ আমার সঙ্গে সঙ্গে কোনও গতিকে এসেছে। এবারে শেষ আশা বিলীন হতে সে ঢলে পড়ল।

***

চলেছি তো চলেছি। কতক্ষণ চলার পর উত্রাই আরম্ভ হয়েছিল, কখন যে উপত্যকায় নেমেছি সেগুলো আমার চৈতন্যসত্তা যেন গ্রহণ করেনি।

সম্বিতে এলুম হঠাৎ বরফপাতের সঙ্গে সঙ্গে। অতি হালকা চাদরের মতো কী যেন নেমে এল। তবু সম্মুখপানে খানিকটা দেখা যায়। ঈষৎ দ্রুততর গতিতে চলতে আরম্ভ করলুম। কয়েক মিনিট পরেই বরফপাত থেমে গেল। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললুম। তার পর সামনের দিকে তাকিয়ে ভয়ে আতঙ্কে আমি হৃদয়ঙ্গম করলুম, একটুখানি বেশি আগেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বসেছি।

সামনে উপত্যকা, এবং এইমাত্র যে বরফপাত হয়ে গেল তারই কল্যাণে মুছে গেছে কাফেলার পদচিহ্ন। এবং সংকটটাকে যেন তার বীভৎসতম রূপ দেবার জন্য সামনে, ধীরে ধীরে, নেমে আসছে কুয়াশার জাল দিনের আলো ম্লান হয়ে গেছে।

তারই ভিতর দিয়ে লক্ষ করলুম, আরেকটু সামনে একটা পাথরের টিলা। সেখানে পৌঁছে আমাকে যেতে হবে হয় বাঁয়ে নয় ডাইনে। কিন্তু মনস্থির করি কী প্রকারে? বরফের উপর যে কোনও চিহ্নই নেই। তবু আমার মনে যেটুকু দিক্-বিদিক জ্ঞান ছিল সেটা পরিষ্কার বললে, যেতে হবে বাঁ দিকে।

এমন সময় হঠাৎ কুয়াশার ভিতর যেন একটু ছিদ্র হল, এবং তার ভিতর দিয়ে এক মুহূর্তের তরে, যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল, দেখি একটা কুকুরের ইঞ্চিতিনেক লেজ, বো করে ডান দিকে মোড় নিল, কুকুরটাকে কিন্তু দেখতে পেলুম না।

আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, কুকুর! কোথাকার কুকুর? কুকুরের কথা তো এতক্ষণ কিছু বলনি!

ও। সত্যি ভুলে গিয়েছিলুম। ওই কুকুরটা থাকত একটা চট্টিতে। আমরা সে চড়িতে, বৃষ্টির জন্য আটকা পড়ে, দিন তিনেক ছিলুম। ওই সময় আমি ওটাকে সামান্য এটা-সেটা দিয়েছি। সে চট্টি ছাড়ার খানিকক্ষণ পরে দেখি, তিনি আমার পিছু নিয়েছেন। বিস্তর হাই-হুই করে পাথর ছুঁড়েও তাকে চট্টিতে ফেরত পাঠাতে পারলুম না।

আমি বললুম, এই তো সেই জায়গা যেখানে যুধিষ্ঠিরের সারমেয় তাঁকে ত্যাগ করতে চায়নি।

মসোজি বললেন, এসব কেন, কোনও কুকুরেরই লেজ কাটা উচিত নয়; তবু কে যেন বেচারির বাচ্চা বয়সে তার লেজ কেটে দিয়েছিল। আমি দেখতে পেলুম সেই টুকরোটুকু, যেটুকু অবশিষ্ট ছিল। এবং সেটা মোড় নিল ডানদিকে।

আমার অভিজ্ঞতা, আমার পর্যবেক্ষণ, আমার বিচারশক্তি সব-সব আমাকে চিৎকার করে বলছিল, বাঁ দিকে বাঁ দিকে মোড় নাও আর অতি স্পষ্ট যদিও অতিশয় ক্ষণতরে আমি দেখলুম, কুকুরটার লেজ মোড় নিল ডান দিকে।

আমি নিজের বুদ্ধিবৃত্তির চেয়ে কুকুরটার লেজকেই বিশ্বাস করলুম বেশি।

কুকুরটাকে কিন্তু তখনকার মতো আর দেখতে পেলুম না।

ঘণ্টাটাক পরে চডিতে পৌঁছলুম। হাসেগাওয়া বললেন, আমি বুড়োর জন্য অপেক্ষা করার পর থেকেই কুকুরটা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছিল। শেষটায় সে অদৃশ্য হয়ে যায়।

আমি শুধালুম, আর বাঁ দিকে মোড় নিলে কী হত? প্রশ্নটা জিগ্যেস করেই বুঝলুম আমি একটা ইডিয়ট।

বিনায়ক হেসে বললেন, তা হলে আপনি আপনার বন্ধু বিনায়ককে আর—

আমি বললুম, ষাট ষাট।*

[* বিনায়ক রাও আমাকে তার মানস-গমন কাহিনি বহু বৎসর পূর্বে বলেছিলেন। এখন কেতাবপত্র ঘেঁটে লুপহোলগুলো যে পূর্ণ করা যেত না তা নয়, কিন্তু আমার কেমন যেন মনে হল এই খাপছাড়া খাপছাড়া অসম্পূর্ণ পাঠটাই সত্যের নিকটতর থাকবে।

শ্ৰীযুত গাঙ্গুলির পাহাড় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা একটু আগেই ফুটনোটে উল্লেখ করেছি। মোরাভিয়ার পাহাড় তেমন কিছু উঁচু নয়, কিন্তু বরফের ঝড়ে কিংবা নিছক ক্লান্তিবশত পর্যটকের মরণবরণ একই পদ্ধতিতে হয়। গাঙ্গুলিমশাই লিখেছেন :

সেবারে দুটি স্লোভাক ছেলে প্রায়েটের চুড়োয় এসে হাজির হল। তখন খুব বরফ পড়ছে। (সেখানকার) কাফিখানায় একচুল জায়গা নেই– যত রাজ্যের শি-চালক সেখানে এসে জমেছে। এই দুই স্লোভাক ছেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দু পেয়ালা গরম দুধ খেয়ে বেরিয়ে গেল। কোথায় যাচ্ছ জিগ্যেস করায় তারা জবাব দিল– চের্ভেনে সেডলো।

বরফ পড়লেও দিনটা মোটামুটি পরিষ্কার ছিল। কিন্তু ছেলে দুটি বেরিয়ে যাবার খানিক পরেই হঠাৎ কুয়াশা এসে চারিদিক ছেয়ে ফেলল। তার পর এই কুয়াশা কাটল না, ছেলে দুটিও ফিরে এল না। এদিকে অন্ধকার নেমে এল আর তারই সঙ্গে ঘন তুষারপাত শুরু হয়ে গেল। কাফিখানার মালিক উদ্বিগ্ন হয়ে বিদেশি ছেলে দুটিকে খোঁজবার জন্যে কয়েকজনকে পাঠালেন। তারা শি নিয়ে কোমরে টর্চ বেঁধে বেরিয়ে পড়ল। কিন্তু রাত্রের অন্ধকারে ওই ঘন তুষারপাতের মধ্যে যাবে কোথায়? যাবেই-বা কী করে? বিশেষ কিছু লাভ হল না। তারা ফিরে এল। কিন্তু ছেলে দুটি আর ফিরল না।

পরদিন সকালবেলা বরফের উপর রোদ পড়ে যখন চারিদিক ঝলমল করে উঠল, তখন দেখা গেল রাতভোর এত বরফ পড়েছে যে ছেলে দুটি যদি কোথাও মরেও পড়ে গিয়ে থাকে তাদের দেহ খুঁজে বার করবার কোনো উপায় নেই। আশপাশের যত কুটির যত গ্রাম আছে সব জায়গা থেকে যখন খবর এল যে ছেলে দুটি কোথাও পৌঁছয়নি তখন বোঝা গেল এই অঞ্চলের বরফের মধ্যে তাদের সমাধি হয়েছে।

সারা শীতকাল ছেলে দুটি তাদের অজানা সমাধির মধ্যে রইল শুয়ে। তার পর যখন প্রথম বসন্তের হাওয়ায় বরফ গলতে আরম্ভ করল তখন তাদের অবিকৃত দেহ আবিষ্কার হয় এই জঙ্গলের মধ্যে। আশেপাশে অনেকগুলি আধপোড়া দেশলাই-এর কাঠি ছড়ানো। বরফের মধ্যে পথ হারিয়ে যাওয়ার এই হচ্ছে বিপদ। ঠাণ্ডায় জমে যাওয়ার মতো হলে যে ক্লান্তি আসে সে বড় ভয়ানক ক্লান্তি। দু-চারটে দেশলাই জ্বেলে কি তাকে ঠেকিয়ে রাখা যায়? দেহ মন চোখ সমস্ত ঘুমে জড়িয়ে আসে। হঠাৎ শীতের অনুভূতি আর থাকে না। মনে হয় বরফেরই কম্বল জড়িয়ে শুয়ে পড়ি। তখন মনে হয় জেগে থাকার চেষ্টা করার মধ্যেই যত অস্বস্তি, যত কষ্ট! ঘুমিয়ে পড়াই হচ্ছে আরাম! তার পর একবার সেই ঘুমের কোলে কেউ ঢলে পড়লে, সে ঘুম আর ভাঙে না। বরফের মধ্যে মৃত্যুকে ঠিক জীবনের অবসান বলা যায় না– এ যেন এক গভীর সুষুপ্তি।]

প্রেমের প্রথম ভাগ

সর্বপ্রথমই করজোড়ে নিবেদন, এ অধম মরালিটি-ইমমরালিটি কোনওকিছুই প্রচারের জন্য এই ফরাসি হ্যান্ডবুক ফর বিগিনার্স ইন ল লিখতে বসেনি। অবশ্য স্বীকার করি, আমি প্রাচীনপন্থী কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বলে নিই– যাতে করে আমার প্রতি অবিচার না হয়– মডার্ন কবিতা, ঐতিহাসিক উপন্যাস, ট্রাম-বাস পোড়ানো, পেট-কাটা ব্লাউজ ইত্যাদির বিরুদ্ধে না আছে আমার কোনও অভিযোগ, না চাই আমি দেশের জনসাধারণকে তন্মধ্যে আমি নিজেও আছি– খ্রিস্ট-বুদ্ধ রূপে দেখতে। বিশেষত ঐতিহাসিক উপন্যাস। জনসাধারণে রটে গেছে, আমি নাকি ওই বস্তুর শত্রু। এটা আমার প্রতি বেদরদ জুলুম। প্রথমত, জনপ্রিয় কোনও জিনিস, অভ্যাস বা আদর্শের শত্রু হতে আমি কিছুতেই সম্মত হইনে। দ্বিতীয়ত, ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখতে গেলে পথে যেসব খানাখন্দ পড়ে, সেগুলোর প্রতি লেখকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমি তো ওঁদের সেবা করে নিজেকে ধন্য মনে করেছি। বস্তুত আমি নিজেই একখানা লিখব বলে স্থির করেছি। তবে নিশ্চয়ই জানি অধুনা যেগুলো জনপ্রিয় তার চেয়ে আমার বই অনেক নিরেস হবে; ভরসা এই, দালদাই বাজারে বেশি বিক্রি হয়, আমারটার কাটতি সেই কারণেই হবে অধিকতর।

তবে আমার এ ফরাসি হ্যান্ডবুক লেখার সময় ইতিহাসের শরণ নেব অল্পই। যদিও আমার মনে হয়, পেট-কাটা বা টপ-লেসের নিন্দায় যখন হরিশ মুখুজ্যেরা কলরব করে ওঠেন তখন আধুনিকাঁদের উচিত একটুখানি ইতিহাসের পাতা উল্টোনো, কিংবা ইতিহাসের বাস্তব নিদর্শনভূমি মিউজিয়মে গমন। জাতকে আছে, একটি জেদি রমণী বসন্তোৎসবে যাবার সময় একটি বিশেষ রকমের দুর্লভ ফুল কামনা করে তার স্বামীকে রাজার বাগানে চুরি করতে পাঠায়। ধরা পড়ে বেচারা যখন শূলে চড়েছে তখন সে তার নিষ্ঠুর অকালমৃত্যুর জন্য রোদন করেনি। সে উচ্চকণ্ঠে শোক প্রকাশ করছিল এই বলে, আমি মরছি তার জন্য আমার দুঃখ নেই, প্রিয়ে; আমার ক্ষোভ, তুমি আমার প্রিয় পুষ্পপ্রসাধন করে যে বসন্তোৎসবে যেতে পারলে না তার জন্য।

তা হলে সপ্রমাণ হল, তথাগতের যুগেও রমণী ফ্যাশানের জন্য এমন ফুলও কামনা করতেন, যেটা শুধু রাজবাড়িতেই পাওয়া যেত, এবং সেটা জোগাড় করার দুঃসাহসিক অভিযানের ফলস্বরূপ তিনি বিধবা হতেও রাজি ছিলেন। এবং শুধু তাই নয়, সে-যুগের স্বামীসম্প্রদায় অতিশয় দার-নিষ্ঠ ছিলেন। প্রিয়ার মনোরঞ্জনাৰ্থে হেলায় প্রাণ বিসর্জন দিতেন। এই দৃষ্টান্ত কি এ-যুগের যুবক-সম্প্রদায়কে আত্মোৎসর্গের স্বর্গীয় পন্থা অবলম্বনে উদ্বুদ্ধ করবে না?

অবশ্য পাঠক বলতে পারেন এ ধরনের ঘটনা সাতিশয় বিরল।

সাতিশয় বিরলই যদি হবে তবে আমাদের কবিগুরু ওই ধরনের উদাহরণই জাতক থেকে। নেবেন কেন?

–বালক কিশোর,
উত্তীয় তাহার নাম, ব্যর্থ প্রেমে মোর
উন্মত্ত অধীর। সে আমার অনুনয়ে
তব চুরি-অপবাদ নিজস্কন্ধে লয়ে
দিয়েছে আপন প্রাণ।

এবং যেন এ কবিতাতেই প্রোপাগান্ডা কর্ম নিঃশেষ হল না বলে কবি বৃদ্ধ বয়সে ওই বিষয় নিয়ে আরও মনোরঞ্জক, আরও চিত্তচাঞ্চল্যকর গীতি নৃত্য-নাট্য শ্যামা রচনা করলেন।

এস্থলে উল্লেখ করা প্রয়োজন বোধ করি যে, আমার যতদূর মনে পড়ছে মূল জাতকে গল্পটি একটু অন্যরকমের। আমার স্মৃতিশক্তি হয়তো আমাকে ঠকাচ্ছে, কিন্তু আমার যেন মনে পড়ছে, উত্তীয়কে কোনওকিছু না বলেই তাকে শ্যামা নগরপালের কাছে পাঠায়। তাকে আগের থেকেই শ্যামা বলে রেখেছিল, কিংবা উত্তীয়েরই হাত দিয়ে চিঠি লিখে তাকে জানায়, পত্রবাহককে শূলে চড়াও; বজ্রসেনকে মুক্তি দাও। এবং বোধহয় ঘুষের টাকাও কিছু ছিল, আর সেটাও উত্তীয় তার আপন ভাণ্ডার থেকেই দিয়েছিল তাবৎ ঘটনার কোনওকিছুই না জেনেশুনেই। আবার মাফ চাইছি, ভুল হতে পারে, শ্যামা বোধহয় উত্তীয়কে বলে তুমি এই চিঠি ও অর্থ– সেটা শ্যামার কিংবা উত্তীয়ের নগরপালকে দিয়ে এলে আমি একান্ত তোমারই হব।

পাঠক স্বপ্নেও ভাববেন না, আমি শ্যামা বা পুষ্পবিলাসিনীর কার্যকলাপ সম্মতির চোখে দেখছি। আধুনিকাঁদের অধঃপাতগমনের অহেতুক অভিযোগ কানে এলে আমার এসব দৃষ্টান্ত মনে আসে, এই মাত্র।

তবে এ নিয়ে ভাববার আছে।

যে কালে মুরুব্বিরা মেয়ের বিয়ে ঠিক করে দিতেন, সে সময় ভিন্ন ভিন্ন পরিবারের মুরুব্বিদের ভিতর ভালো বর পাওয়ার জন্য যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হত না তা নয়। বস্তুত যে কনের সঙ্গে লোভনীয় বরের বিয়ের কথাবার্তা এগিয়ে গেছে তার বিরুদ্ধে নাকি উড়ো চিঠি পর্যন্ত যেত তৃতীয় কন্যাপক্ষ থেকে। আশ্চর্য হবার কিছু নেই। সংগ্রামে আবার নীতি কী! এবং কিছুমাত্র নতুন তত্ত্ব নয় যে, কুরু-পাণ্ডবরা কুরুক্ষেত্র সংগ্রামে যে নীতি অবলম্বন করেছিলেন সে নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়ে গিয়েছে।

কিন্তু এ যুগে, বিশেষ করে কলকাতা এবং অন্যান্য বড় শহরে অনেক মেয়েকেই বাধ্য হয়ে বরের সন্ধানে বেরুতে হয়। এবং বররাও বেরোন কন্যার সন্ধানে। ফলে বিত্তশালী, রূপবতী বা উচ্চশিক্ষিতা যার যেমন অভিরুচি কনের জন্য ছোকরাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা লেগে যায়, এবং উল্টোটাও হয়। বোধহয় সুলেখক সুবোধ ঘোষের গল্পেই পড়েছি, তিনটি মেয়ে তিনটি ফুলের তোড়া নিয়ে পাল্লা দেয় এক শাসালো বরকে স্টেশনে সি-অফ করতে গিয়ে।

এসব বিয়ে যে দেখামাত্রই দুম্ করে স্থির হয় না সে কথা বলা বাহুল্য। কিঞ্চিৎ পূর্বরাগ, প্রেম বা প্রেমের অভিনয়ের প্রয়োজন হয়। কোনও কোনও স্থলে এটাকে কোর্টশিপও বলা হয়। আমাদের দেশে একদা গান্ধর্ব-বিবাহের প্রচলন ছিল। সে বিবাহ হত বিবাহের পূর্বেকার প্রণয়ের ভিত্তিতে।

কিন্তু এদেশে এখনও প্রণয়ের কোনও কোড় নির্মিত হয়নি, অর্থাৎ যুবক-যুবতীতে কতখানি প্রণয় হওয়ার পর ছেলে কিংবা মেয়ে আশা করতে পারে যে এবারে অন্য পক্ষ তাকে বিয়ে করতে প্রস্তুত, এবং তখন যদি সে হঠাৎ তাকে ত্যাগ করে অন্য কাউকে ভালোবাসতে আরম্ভ করে তবে সমাজে তার নিন্দা হয়। ইউরোপে মোটামুটি দুটো ধাপ আছে। দু-জনাতে প্রণয় হওয়ার ফলে যদি ছেলেটা মেয়েটিকে ফরাসিতে আমি, জর্মনে ফ্রয়েভিন (গার্লফ্রেন্ডের চেয়ে এটাকে ঘনিষ্ঠতর বলে ধরা হয়) বলে উল্লেখ করে তার তখনও মোটামুটি বিয়ের দায়িত্ব আসে না। এটা প্রথম ধাপ। কিন্তু ফরাসিতে ফিয়াসে– জর্মনে ওই একই শব্দ বা ফেরট ব্যবহৃত হয়– পর্যায়ে পৌঁছলে সেটাকে দ্বিতীয় ধাপ বলা হয়। এবং সে সময় যদি যুবক তাকে এনগেজমেন্ট আংটি দেয় (অর্থাৎ মেয়েটি তখন বাগদত্তা হল যদিও অর্থটা কিছু ভিন্ন) তবে সেটা বিয়ের প্রতিশ্রুতি বলেই ধরা হয়। তার পর সে বিয়ে করতে না চাইলে অনেক স্থলে মেয়েটি আদালতে প্রতিজ্ঞা বা চুক্তিভঙ্গের মোকদ্দমা করে খেসারতি চাইতে পারে। সমাজে বদনাম তো হয়ই। মহাভারতে রুক্মিণী বাগদত্তা ছিলেন বলে পরে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বিয়ে করলে শ্রীকৃষ্ণের শত্রুপক্ষ তাঁর নিন্দা করে।

এদেশে প্রণয়ের কোনও স্তরেই বোধহয় এরকম আংটি দেবার রেওয়াজ প্রচলিত হয়নি। তবে প্রণয় ঘনীভূত হওয়ার পর (কতটা ঘনীভূত এবং তার চিহ্ন কী, সেটা বলা কঠিন) যদি কোনও পক্ষ অকারণে রণে ভঙ্গ দেয়, তবে তার যে বদনাম হয় সেটা সুনিশ্চিত। ইউরোপেও যে মেয়ে অকারণে একাধিক প্রণয়ীকে পরপর ত্যাগ করে সে জিট এই বদনামটি পায়।

নিছক প্রেমের জন্য প্রেম বিয়ে করার উদ্দেশ্য কারওরই নেই– এটা বোধহয় এদেশে বিরল। ইউরোপে মোটেই বিরল নয়। ছাত্র, ছাত্রী, মেয়ে কেরানি, ছোকরা অ্যাসিসটেন্টের ভিতর এ-জাতীয় প্রেম আকছারই হয়। এ-জাতীয় প্রণয়ের ফলে যদি কোনও কুমারী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে যায় তবে কোনও কোনও স্থলে সে যুবকের বিরুদ্ধে খেসারতির মোকদ্দমা আনতে পারে। আমি যতদূর জানি, বিয়ে করতে বাধ্য করাতে পারে না–তবে রাশাতে বোধ হয় সন্তানটি অন্তত পিতার নামটা আইনত পায়, অর্থাৎ জারজরূপে ঘৃণার পাত্র হয় না। ইউরোপে যদি যুবা প্রমাণ করতে পারে যে, মেয়েটার একাধিক প্রণয়ী ছিল তবে তাকে বা অন্য কাউকে কোনও খেসারত দিতে হয় না। এক বলশেভিক আমাকে বলেন, এক্ষেত্রে রাশায় সব কজনাকে খেসারতি ভাগাভাগি করে দিতে হয়।

তবে ইউরোপের মেয়েরা যুগ যুগ ধরে প্রেমের মারফতে বিয়ে করেছে বলে অনেক কিছু জানে, এবং আর পাঁচজন বিচক্ষণ বান্ধবীদের কাছ থেকে উপদেশও পায়।

এদেশের তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে আমার যোগসূত্র নেই। তবে আমার সবসময়েই মনে হয়েছে আমাদের মেয়েরা বড় অসহায়।

***

সিরিয়স প্রবন্ধ লিখব বলে আমার আদৌ ইচ্ছা ছিল না। আমি প্রণয়, বিবাহ, লাভ ফর লাভ সেক্ ইত্যাদি সম্বন্ধে ফরাসিদের দু-একটি মতামত লিখতে যাচ্ছিলুম মাত্র। এ বাবদে ফরাসিদের অধিকারই যে সবচেয়ে বেশি, সেকথা বিশ্বজন মেনে নিয়েছে। লোকে বলে অবাধ অবৈধ প্রেম নাকি ওই দেশেই সবচেয়ে বেশি। আমি কিছু বলতে নারাজ, তবে একটা কথা জানি। ডিভোর্স বা লগ্নচ্ছেদ ফরাসিরা নেকনজরে দেখে না। পারিবারিক শান্তি ও শিশুদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তারা বড়ই সচেতন। স্বামী-স্ত্রী দুজনাই কিঞ্চিৎ অসংযমী হলে ফরাসি সমাজ সয়ে নেয়, কিন্তু তারা একে অন্যকে ডিভোর্স করতে চাইলে সমাজ অসন্তুষ্ট হয়।

ইউরোপের উন্নত দেশগুলো যে স্থলে গিয়ে পৌঁছেছে আমরাও একদিন সেখানে গিয়ে পৌঁছব, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। (অবশ্য তার অর্থ এ নয় যে, আমি ইউরোপের প্রেম তথা বিবাহ পদ্ধতির নিন্দা করছি। বস্তুত বাইরের অন্য সভ্যতা অন্য ঐতিহ্যের মানুষ হয়ে আমার পক্ষে ইউরোপীয় সভ্যতা বিচার করতে যাওয়াটা খুব যুক্তিসঙ্গত নয়। যারা আমার চেয়ে বহু ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃত সত্য দেখতে পান তারাই বোধহয় অনাসক্তভাবে আপন দেশ ও বিদেশ সম্বন্ধে মতামত প্রকাশ করবার অধিকার ধরেন)। এদেশের ঐতিহ্য তাকে প্রেম বিবাহ প্রভৃতি ব্যাপারে অন্য প্যাটার্ন বানাতে শেখাবে- এই আমার বিশ্বাস।

***

যে ফরাসি যুবতী কয়েকটি তরুণীকে হাসিঠাট্টার ভিতর দিয়ে সদুপদেশ দিচ্ছিলেন তার কথাগুলো শুনে আমি আমোদ অনুভব করছিলুম। তরুণীদের ভাবভঙ্গি-কথাবার্তা থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল তারা যুবতীটিকে প্রেমের ভুবনে রীতিমতো সাকসেসফুল বা বিজয়িনী বলে মনে করছিলেন। তিনি খাচ্ছিলেন কন্যা ও চেসার, অতি ধীরে মন্থরে। অর্থাৎ সামান্য কয়েক ফোঁটা কন্যা পান করে সঙ্গে সঙ্গে অন্য গেলাস থেকে এক ঢোক জল। এই জল কন্যাককে chase করে নিয়ে যায় বলে একে বলে চেসার। যুবতীটি যে পান বাবদে শুধু সমঝদার তাই নয়, আমার মনে হল তিনি এ বাবদে পরিপূর্ণ আত্মকর্তৃত্বও বজায় রাখেন।

লম্বা হোল্ডারে সিগারেট ধরিয়ে ঊর্ধ্বপানে ধুয়োর একসারি চক্কর চালান করে বললেন, লেয়ো ব্লুমের কেতাবখানা মন দিয়ে পড়। বিবাহ সম্বন্ধে তিনি অনেক খাঁটি কথা বলেছেন। রুম একদা ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং তিনি তার বইয়ে বলেন, প্রেম, যৌনজীবন সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ যুবক-যুবতীর বিবাহ সাধারণত তাদের জীবনে দীর্ঘকালব্যাপী দাম্পত্য সুখশান্তি দিতে পারে না। উচিত, উভয় পক্ষেরই এ-সব বিষয়ে কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার পর বিয়ে করা। বলা বাহুল্য, এ বই প্রকাশিত হলে ইংলন্ডের অনেকেই এটাকে শকিং গর্হিত বলে নিন্দা করেছিলেন।

সুন্দরীটি ব্লুমের মূল বক্তব্য প্রাঞ্জল ভাষায় পেশ করে বললেন, দেখ, আমি নিজে বিশ্বাস করি, নারী-পুরুষ দুই যুযুধান শক্তি, একে অন্যের শত্রু

একটি তরুণী কফির ঢোক গিলতে গিয়ে মারাত্মক বিষম খেয়ে বলল, আপনি এ কী কথা বলছেন! কবি দুর্গা এখনও আপনার কথা ভুলতে পারেননি– আপনি তাকে বিদায় দেওয়ার পরও। এখনও তার মুখে ওই এক মন্ত্র : আপনার মতো প্রাণ-মন, সর্বহৃদয়, সর্বস্ব দিয়ে এরকম আত্মহারা হয়ে কেউ কখনও ভালোবাসতে পারেনি।

যুবতী স্মিত হাস্যভরা চোখে তরুণীর দিকে তাকিয়ে বললেন, বেচারি আঁদ্রে! তোমার এখনও অনেক-কিছু শেখবার বাকি আছে। আমি আর্টিস্ট। আমি যা-ই করি না কেন, সেটাকে পরিপূর্ণতার চরমে পৌঁছিয়ে দিয়ে করি। যখনই ভালোবেসেছি, আত্মহারা হয়েই ভালোবেসেছি। কিন্তু, ডার্লিং, ইহুদিও কি তার ব্যবসা আহার নিদ্রা ত্যাগ করে আত্মহারা হয়ে ভালোবাসে না? তাই বলে সে কি তার মুনাফার কথা ভুলে যায়। যে ব্যবসাকে সে আপন প্রিয়ার চেয়েও বেশি ভালোবাসে তাকে সে অকাতরে বিসর্জন দেয় না, যদি দেখে সেটা দেউলে হয়ে যাওয়ার উপক্রম।

তাই বলছিলুম, পুরুষ রমণীর শত্রু। যে কোনও পুরুষ আমাকে আত্মহারা হয়ে ভালোবাসলেও একদিন সে আমাকে অকাতরে বিসর্জন দিতে পারে আমি যে রকম সিয়ো দুর্গাকে দিয়েছিলুম। অবশ্য আমি স্যাডিস্ট নই, তাই তাকে ড্রপ করার সময় যতদূর সম্ভব মোলায়েমভাবে সেটা সম্পাদন করি– তদুপরি বলা তো যায় না, কখন কাকে আবার প্রয়োজন হয়।

আরেকটি তরুণী বলল, কিন্তু দান্তে–?

মাদাম বললেন, ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি– যদিও ওঁর কাব্য আমার প্রেমপত্রে কাজে লেগেছে। ওই ধরনের মানুষ আমি দেখিনি। তবে এইটুকু বলতে পারি, যারা কারও বিরহে বা মৃত্যুতে দীর্ঘদিন ধরে আপসা-আপসি করে সেটা শুধু তাদের আত্মম্ভরিতা। নিজের কাছে স্বীকার করতে চায় না যে, এইবারে তার অন্য ব্যবসা ফাঁদা উচিত। মনস্তত্ত্বে ওদের বলা হয় ম্যাজোকিস্ট নিজেকে নিজে কষ্ট দিয়ে সুখ পায়। ওই যে রকম অনেক সর্বত্যাগী অনাহারে থেকে সুখ পান! তোমার-আমার স্বাস্থ্য আছে, ক্ষুধা আছে, আমরা নর্মে। খাদ্য যখন রয়েছে তখন উপোস করব কোন্ দুঃখে?

তবে কি একনিষ্ঠ প্রেম বলে কিছুই নেই?

কী উৎপাত! কে বলল নেই? নিশ্চয়ই আছে। যখন যাকে ভালোবাসবে তখন তার প্রতি একনিষ্ঠ হবে, আঁদ্রের ভাষায় আত্মহারা হবে। একাধিকজনের সঙ্গেও অক্লেশে একনিষ্ঠ হওয়া যায়। ওই তো আমার এক বন্ধু ছিলেন লিয়োতে। সেখানে মাঝে মাঝে উইক-এন্ড করতে যেতুম। চমৎকার কথাবার্তা বলতে জানেন। বাড়িটিও সুন্দর। প্যারিসে প্রতি বৃহস্পতিবারে আমার ফ্ল্যাটে আসতেন আরেক বন্ধু। উনি বিবাহিত। অন্য সময় সুযোগ। পেতেন না। তা ছাড়া চাকরির উন্নতির জন্য অফিসের এক বৃদ্ধ কর্তার সঙ্গে তাঁর মোটরে মাঝে মাঝে বেরুতে হত। তিনি আবার ভয়ানক ভীতু। যদি কেউ দেখে ফেলে! তাই রাত্রে মোটরে করে শহর থেকে দূরে যেতে হয় তাঁর সঙ্গে। এদের প্রত্যেককে যদি একনিষ্ঠভাবে না ভালোবাসি তবে ওই যে বললুম পুরুষ মাত্রই শত্রু– সে শত্রু ধরে ফেলবে না আমার ভারসেটাইলিটি– বহুমুখী প্রতিভা? শুনেছি, এবং বিশ্বস্তসূত্রেই, যে রসরাজ কবি, যোদ্ধা, ঔপন্যাসিক, শাসনকর্তা দাদৃজিয়ে একসঙ্গে একগণ্ডা সুন্দরীর সঙ্গে একনিষ্ঠ প্রেমের উচ্চাঙ্গ সাধনা করেছেন, তিনি একই সময়ে চারজনকে যে চার সিরিজ প্রেমপত্র লিখেছেন, তার প্রত্যেকটি অতিশয় অরিজিনাল মাধুর্যময় কবিত্বপূর্ণ কোনও সিরিজের সঙ্গে কোনও সিরিজের সাদৃশ্য নেই। প্রত্যেকটি বল্ল আপন সিরিজ পেয়ে ধন্য হয়েছেন।

তার পর আরেক তরুণীর দিকে তাকিয়ে বললেন, সুজান, তুমি এ লাইন ছেড়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেল। পল আর মার্সেল তোমাকে একই সময়ে ভালোবাসত; আর তুমি মাত্র দুটোকে সামলাতে পারলে না? হায়! প্যারিস কোথায় এসে পৌঁছচ্ছে? আর ডার্লিং সুজান, তুমি নাকি জানতেও না, পল্ আর মার্সেল উভয়েরই তখন আরেক প্রস্থ প্রিয়া ছিল!

স্যুজান তাজ্জব মেনে বলল, তাই নাকি। মঁ দিয়ো!

নানেৎ বলল, ডিভাইড অ্যান্ড রুল? দ্বিধা করে সিধা রাখ?

মাদাম বললেন, ও! তা কেন? মেনাজ্ আ ত্রোয় (menage a trois = management by three) যদিও এখন ফ্রান্সে একটু আউট অব ডেট– তবু তিনজনে মিলেমিশে থাকাটা তো ট্রায়েল পেতে পারে, কিন্তু সবসময়েই মনে রাখতে হবে শান্তিভঙ্গ যেন না হয়, নো স্ক্যান্ডাল, প্লিজ! আর ডুয়েল, খুন, আত্মহত্যা এগুলো তো বর্বরতার চরম ভুল বললুম, বর্বরদের ভিতর এসব অপ্রিয় ঘটনা প্রায় কখনওই ঘটে না। এগুলো ঘটলে মনের অশান্তি খানিকটে হয় বটে, কিন্তু তার চেয়ে মারাত্মক বদনাম ছড়ায় ভবিষ্যতের বিয়ের বাজারে। অবশ্য এমন কোনও বদনাম নেই যেটা আস্তে আস্তে মুছে ফেলা যায় না। এবং কোনও কোনও স্থলে একাধিক পুরুষ আকৃষ্ট হয় ফাম্ ফাতা (fatal woman) বিপজ্জনক রমণীর প্রতি।

ইনি তাদেরই একজন কি না সেটা জানবার কৌতূহল আমার পক্ষে স্বাভাবিক।

ইতোমধ্যে তার কন্যা শেষ হয়ে গিয়েছে দেখে গুটিতিনেক তরুণী একসঙ্গে ওয়েটারকে ডাকল। যুবতী রাজ-রাজেশ্বরীর মতো বাঁ হাতখানা দিয়ে যেন বাতাসের একাংশ দু টুকরো করে অসম্মতি জানালেন, বললেন, সুইট অব ইউ, কিন্তু জানো তো আমার সোনার খনিতে এখন ডবল শিফটে কাজ চলছে। দ্বিতীয় শিফটটায় আমি অবশ্য অনেকখানি সাহায্য করি। এমনিতেই আমি একগাদা টাকার কুমিরকে চিনতুম, এখন আমার মারি (স্বামী) প্রতি রাত্রেই দু-একটি নয়া নয়া বাঘ-ভালুক শিকার করছেন আমাকে তাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে।–তোমরা বরঞ্চ শ্যামপেন খাও।

তরুণীদের একাধিকজন আনমনা হয়ে ভাবল, তাদের জীবনে এ সুদিন আসবে কবে?

হঠাৎ যেন বিজয়িনীর একটি গভীর তত্ত্বকথা মনে পড়ল। গম্ভীর হয়ে বললেন, কিন্তু, যাদুরা, একটি কথা মনের ভিতর ভালো করে গেঁথে নিয়ো। ব্লুম এটা বলেননি। সর্বপ্রেমের চরম গতি যখন পতিলাভ তখন সে-পথে নামবার আগে একটি মোক্ষম তত্ত্ব ভুললে চলবে না। ব্লুম বলেছেন, প্রথম ইদিক-উদিক প্রেম এবং ফ্যাকটুস অব্ লাইফ সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার পর, ইংরেজিতে পুরুষের বেলা যাকে বলা হয় বুনো ভুট্টা বপন সেইটে হয়ে গেলে পর বিয়ে করবে। তা হলে একে অন্যের প্রতি সহিষ্ণুতা হবে অনেক বেশি, একে অন্যকে সাহায্য করতে পারবে অনেক বেশি দাম্পত্যজীবন তাই হবে দীর্ঘকালব্যাপী ও মধুর। ব্লুমের উদ্দেশ্য অতিশয় মহৎ এ-বিষয়ে কেউ সন্দেহ করবে না। অমি তো নিশ্চয়ই করব না, কারণ তিনি অতিশয় নীতিবাগীশ

কোরাস উঠল তাবৎ তরুণী কণ্ঠে, কী বললেন, মাদাম?

কণামাত্র বিচলিত না হয়ে মহিলাটি ধীরেসুস্থে আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করে বললেন, কট্টর নীতিবাগীশ, ধর্মভীরু, আচারনিষ্ঠ এবং ছিন্নভিন্ন উদ্দেশ্যহীন ফরাসিসমাজকে নৈতিক দৃঢ়ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ব্যগ্র। তিনি ইহুদি, এবং অনেকেই যেরকম তার ইহুদি-ভ্রাতা ফ্রয়েটকে ভুল বোঝে, এর বেলাও তাই হয়েছে। আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি এবং জানি, তিনি নীতি, মরালিটিতে অতিশয় আস্থাবান। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন, প্রাচীন নীতি পরিবর্তন করে বরং বলব সেটা পরিপূর্ণভাবে কার্যকরী ও কল্যাণময়ী করে সম্পূর্ণতর করে তোলবার জন্য নবীন নীতির প্রয়োজন। তিনি সেইটে প্রবর্তন করতে চান। কিন্তু এই নবীন নীতি প্রবর্তন করতে পারি শুধু আমরা ফরাসিরাই। যেরকম আমরাই সর্বপ্রথম ফরাসিবিদ্রোহ করে সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা প্রবর্তন করি। ইউরোপের অন্যান্য দেশ, এমনকি জর্মনিরও লাগবে এ নীতি গ্রহণ করতে অন্তত একশো বছর। তারা তো এখনও গণতন্ত্রটাই রপ্ত করতে পারেনি। আর যেসব দেশ ধর্ম উৎপাদন করেছে যেমন প্যালেস্টাইন, আরবদেশ, ইন্ডিয়া, এরা এ নীতি কখনও গ্রহণ করতে পারবে না, আর যদি করে তবে তাদের সর্বনাশ হবে।

আমি মনে মনে সম্পূর্ণ সায় দিলুম। এবং যোগ দিলুম, হয়তো চীন পারবে।

কিন্তু একটা প্র্যাকটিকাল উপদেশ আমি দিই। বিয়ের পূর্বের সর্ব অভিজ্ঞতা যেন বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে হয়। তার প্রথম কারণ তারা প্রবীণতর, পকৃতর। তাদের কাছে শুধু প্রণয় নয়, জীবনের মূল্যবান আরও অনেক-কিছু শেখা যায়। কিন্তু খবরদার আহামুকের মতো ককখনও তাকে বলবে না, তোমার বউকে ডিভোর্স করে আমাকে বিয়ে কর। এক্সপেরিমেন্টের ইঁদুরকে আকাট মূর্খও বিয়ে করে না।

আরেকটা কারণ বললে তোমাদের তরুণ-হৃদয়ে হয়তো একটু বাজবে।

ওই বিবাহিতদেরই দু পয়সা রেস্ত থাকে। বনে-বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে আর স্রেফ হাওয়া খেয়ে খেয়ে জীবনের কোনও অভিজ্ঞতাই সঞ্চয় হয় না। সেটা হয় জনসমাজে। ক্লাব, রেস্তোরাঁ, অপূরা, জুয়োর কাসিনো, রেস্, রিভিয়েরা, সুইজারল্যান্ড ভ্রমণ, এগুলো না করলে, না চষলে কোনও এলেমই হয় না, যেটা তোমার ভবিষ্যৎ স্বামী ও দাম্পত্যজীবনে কাজে লাগবে।

আরেকটা সুবিধে, বলা তো যায় না, তিনি যদি মাত্রা সামলাতে না পেরে তোমাকে বিয়ে করতে চেয়ে বসেন, তুমি তখন অতিশয় ব্রীড়া সহকারে বলতে পারবে, আমি চাইনে যে আপনার স্ত্রীকে ডিভোর্স করে আপনি একটি পরিবার নষ্ট করুন।

এবং শেষ সুবিধে, যেদিন তুমি কেটে পড়তে চাইবে, সেদিন স্বচ্ছন্দে বলতে পারবে, আমারও তো সংসার পাততে হবে, আমারও তো সমাজের প্রটেকশন দরকার, তার পর ব্লাশ করে বলবে, আমিও তো, আমিও তো মা হতে চাই।

কী বলব পাঠক, সে যা অনবদ্য অভিনয় করলেন সেই বিবাহিতা যুবতীটি– আহা যেন ষোল বছরের তরুণীটি, ভাজা মাছটি উন্টে খেতে জানেন না। ধন্য নটরানি প্যারিস, ধন্য তোমার অভিনয়, ধন্য তোমার নব মরালিটি! সাধে কি লোক বার বার বলে, সি প্যারিস অ্যান্ড ডাই। প্যারিস দেখার পর পৃথিবীতে দেখবার মতো আর তো কিছু থাকে না।

তবে আমার অনুরোধ, অন্যান্য বহু বস্তু নির্মাণ করার সময় ফ্রান্সে আইনত যেমন ছাপ মারতে হয়, নট ফর একত্সপোর্ট–বিদেশে চালান নিষিদ্ধ, এই নব মরালিটির উপরও যেন তেমনি ছাপটি সযত্নে মারা হয়।

তবে আমি এটি আমদানি করলুম কেন? বুঝিয়ে বলি। বিদগ্ধা যুবতীটি যা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলেছিলেন আমি তার সহস্রাংশের একাংশও বলিনি। আমি শুধু সেটুকুই বলেছি, যেটুকু আপনার জানা থাকলে যদি কখনও প্যারিসের ওই নব মরালিটিটি এদেশে চোরাবাজার দিয়ে বা স্মাগড় হয়ে চলে আসে তবে যেন তৎক্ষণাৎ সেটি চিনতে পারেন।

চার্লি চ্যাপলিন এই কর্মটি করেছিলেন। অনেকেই তার মিশিয়ে ভেদু ছবি দেখেছেন। চ্যাপলিনের পূর্বেও তার সময়ে ইউরোপের কোনও কোনও দার্শনিক সাড়ম্বর প্রচার করেন, জীবনসংগ্রামে বেঁচে থাকার জন্য মানুষ যেন সর্বাস্ত্র প্রয়োগ করে সর্ব প্রতিদ্বন্দ্বীকে অর দ্য কঁবা–দরকার হলে খতম করে দেয়। সেই হাস্যাস্পদ দর্শনের বেকুব চরম পরিণতি প্রমাণ করার জন্য চ্যাপলিন দেখান কীভাবে একজন লোক একটার পর একটা ধনী প্রাপ্তবয়স্কা রমণীকে বিয়ে করে তাকে সুকৌশলে খুন করে অর্থ সঞ্চয় করতে থাকে। কিন্তু খুনের কৌশলটি ছবিতে দেখাননি।

আমিও বিদগ্ধা প্যারিসিনীর আসল অস্ত্রটির রহস্য সযত্নে গোপন রেখেছি।

বুড়ো-বুড়ি

চিঠি নাকি, বাবাজি আজান?

বিলক্ষণ, মসিয়ো… প্যারিস থেকে এসেছে।

চিঠিখানি যে খুদ প্যারিস থেকে এসেছে তাই নিয়ে সাদা-দিল্ বাবাজি আজানের চিত্তে রীতিমতো দেমাক।… কিন্তু আমার না। কে যেন আমায় বলে দিচ্ছিল, এই যে অ্যা জাহ্ন রুশো সরণির প্যারিসিনী বলা নেই কওয়া নেই, সাত সকালে হঠাৎ আমার টেবিলের উপর এসে অবতীর্ণ হলেন, ইনি আমার পুরো দিনটারই সর্বনাশ করবেন। ঠিক। ভুল করিনি; বিশ্বেস না হয় দেখুন :

আমার একটু উপকার করতে হবে, দোস্ত। তোকে একদিনের তরে তোর ময়দা-কল বন্ধ করে সঙ্গে সঙ্গে এইগুইয়ের যেতে হবে… এইগুইয়ের বড় গগ্রাম, তোর ওখান থেকে পাঁচ ছ কোশ কিছু না, বেড়াতে বেড়াতে পৌঁছে যাবি। পৌঁছে অনাথাশ্রমের খোঁজ নিবি। আশ্রমের ঠিক পরের বাড়িটা একটু নিচু, জানালা-খড়খড়ি ছাই-রঙা, বাড়ির পিছনভাগে একটুখানি বাগান। কড়া না নেড়েই ঢুকে পড়বি– দরজা হামেহাল খোলা থাকে আর ঘরে ঢুকেই আচ্ছা জোরসে চেঁচিয়ে বলবি, সজ্জনদের পেন্নাম জানাই! অমি মরিসের বন্ধু… তখন দেখতে পাবি একমুঠো সাইজের ছোট্ট একজোড়া বুড়ো-বুড়ি, ওহ! সে কী বুড়ো! বুড়ো, তার চেয়েও বুড়ো, আদ্যিকালের বুড়ো-বুড়ি তাদের বিরাট আরামকেদারার গর্ত থেকে তোর দিকে হাত তুলে ধরবেন, আর তুই তখন তাদের আমার হয়ে আলিঙ্গন করবি, চুমো খাবি, তোর সর্বহৃদয় দিয়ে, যেন ওঁরা তোরই। তার পর সবাই মিলে গাল-গল্প আরম্ভ হবে; ওঁনারা সুদু আমার সম্বন্ধেই কথা কইবেন, আর কিছুটি না, সুদু আমার কথা; হাজার হাজার আবোল তাবোল বকে যাবেন, তুই কিন্তু হাসবিনি… হাসবিনি কিন্তু বুঝেছিস?… এরা আমার ঠাকুদ্দা, ঠাকুমা, ওঁদের আগাপাশতলা প্রাণ একমাত্র আমি এবং আমাকে দশ বছর হল দেখেননি… দশ বছর– দীর্ঘকাল! কিন্তু কী করি বল! আমি– প্যারিস আমাকে জাবড়ে ধরে আছে; ওঁদের? ওঁদের আটকে রেখেছে বুড়ো বয়স… এদের যা বয়স, আমাকে দেখবার জন্য রওনা হলে পথিমধ্যে চালানি মালের মতো টুকরো টুকরো হয়ে যাবেন… কিন্তু আমার কপাল ভালো, তুই তো ভাই, হোথায় আছিস, বেরাদর আমার, ময়দাকলের মালিক তোকে আদর-প্যার করে বেচারি বুড়ো-বুড়িরা আনন্দ পাবে, যেন আমারই এ্যাটুখানিকে চুমো-চামা খাচ্ছে.. আমি অনেকবার আমাদের কথা ওঁদের বলেছি, এবং আমাদের গভীর বন্ধুত্ব সম্বন্ধেও, যেটি কি না…

জাহান্নামে যাক বন্ধুত্ব! ঠিক আজকের সকালটাতেই আবহাওয়াটি হয়েছে চমৎকার, কিন্তু বাউণ্ডুলের মতো যত্র-তত্র চর্কিবাজি খাওয়ার মতো আদপেই নয়। একে তো বইছে জোর হাওয়া, তদুপরি রৌদ্রটিও চড়চড়ে কড়া–প্রভাস অঞ্চলের খাঁটি দিন যাকে বলে। আমি ঠিক করে বসেছিলুম, দুটি পাহাড়ের ঢিপির মধ্যিখানে শুয়ে শুয়ে সমস্ত দিনটা কাটিয়ে দেব হুবহু একটি গিরগিটির মতো, সূর্যালোক পান করতে করতে আর পাইনগাছের মর্মরগান শুনতে শুনতে– এমন সময় এল ওই লক্ষ্মীছাড়া চিঠিটা… কিন্তু করা যায় কী কও? মিটা বন্ধ করলুম অভিসম্পাত দিতে দিতে, চাবিটা রেখে দিলুম বেড়ালটার আসা-যাওয়ার ছোট্ট গর্তটার ভিতর। লাঠিটা, পাইপটি ব্যস্, নাবলুম রাস্তায়।

বেলা প্রায় দুটোর সময় পৌঁছলুম এইগুইয়েরে। গা-টা খাঁ খাঁ করছে, সবাই খেত-খামারে। ধুলোয় ঢাকা এলমগাছে ঝিল্লি ঝি ঝি করছে যেন নির্জন খোলামাঠের মধ্যিখানে। অবশ্য সরকারি বাড়িটার সামনের চত্বরে একটা গাধা রোদ পোয়াচ্ছিল বটে, আর গির্জের সামনের ফোয়ারায় একপাল পায়রাও ছিল, কিন্তু অনাথাশ্রমটি দেখিয়ে দেবার মতো কেউই ছিল না। কিন্তু কপাল ভালো, হঠাৎ আমার সামনে যেন পরীর মতো আত্মপ্রকাশ করল এক বুড়ি। ঘরের সামনের এক কোণে উবু হয়ে বসে চরকা কাটছিল। শুধালুম তাকে। আর পরীটিরও ছিল দৈবীশক্তি। কড়ে আঙুলটি তুলে দেখাতে না-দেখাতে তৎক্ষণাৎ চোখের সামনে যেন মন্ত্রবলে আমারই সামনে দাঁড়িয়ে উঠল অনাথাশ্রমটি!… বিরাট, ভারিক্কি, কালো কুঠিবাড়ি। বেশ দেমাকের সঙ্গে তার দেউড়ির উপরের পাঁশুটে লাল রঙের প্রাচীন দিনের ক্রুশ–চতুর্দিকে আবার দু ছত্তর লাতিনও দেখিয়ে দিচ্ছে। ওই বাড়িটার পাশেই দেখতে পেলুম আরেকটি ছোট্ট বাড়ি। ছাইরঙের খড়খড়ি, পিছনে ছোট্ট বাগানটি… তদ্দণ্ডেই চিনে গেলুম, কড়া না নেড়েই ঢুকে পড়লুম।

আমার বাকি জীবন ধরে আমি সেই দীর্ঘ করিডরটি দেখব; মন্দ-মধুর ঠাণ্ডা, শান্ত-প্রশান্ত, দেয়ালগুলো গোলাপি রঙের, খড়খড়ির ভিতর দিয়ে দেখি বাগানটি যেন স্বচ্ছ রৌদ্রালোকে অল্প অল্প কাঁপছে, আর সার্সিগুলোর উপর ফুলপাতায় জড়ানো বেহালার ছবি আঁকা। আমার মনে হল আমি সেদে যুগের প্রাচীন সম্রান্ত দরবারখানায় পৌঁছে গিয়েছি।… করিডরের শেষপ্রান্তে, ডানদিকে, আধ-ভেজানো দরজার ভিতর দিয়ে আসছে দেয়ালঘড়ির টিক-টাক শব্দ, আর একটি শিশু স্কুলের বাচ্চার গলার শব্দে প্রতি শব্দে থেমে থেমে পড়ছে : তখন…সেন্ট…ইরেনে…চিকা…র…করে…বললেন…আমি…প্রভুর…যেন… গম..শস্য… আমাকে…ময়দা…হতে…হয়ে …ওই…সব…পশুদের…দাঁতের…পিষণে…। আমি ধীরে ধীরে মৃদু পদে সেই দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে ভিতরের দিকে তাকালুম।

শান্ত, অর্ধ দিবালোকে, ছোট্ট একটি কামরার ভিতর, গভীর একটা আরাম কেদারার ভিতর ঘুমুচ্ছেন এক অতি বৃদ্ধ। গোলাপি ছোট্ট দুটি গাল, আঙুলের ডগা অবধি সর্বশরীরের চামড়া কোঁচকানো, মুখ খোলা, হাত দুটি দুজানুর উপর পাতা। তাঁর পায়ের কাছে নীল পোশাক পরা ছোট্ট একটি মেয়ে মাথায় নাদের মতো টুপি, অনাথাশ্রমের মেয়েদের পোশাক পরা– সাধ্বী ইরেনের জীবনী পড়ছে– বইখানা আকারে তার চাইতেও বড়। এই অলৌকিক পুরাণপাঠ যেন সমস্ত বাড়িটার ওপর ক্রিয়া চালিয়েছে। বৃদ্ধ ঘুমুচ্ছেন তাঁর আরামকেদারায়, মাছিগুলো ছাতে, ক্যানারি পাখিগুলো এই হোথায় জানালার উপরে তাদের খাঁচায়। প্রকাণ্ড দেয়ালঘড়িটা নাক ডাকাচ্ছে– টি, টাক, টিক্ টা। সমস্ত ঘরটাতে কেউই জেগে নেই–সুন্দুমাত্র খড়খড়ির ভিতর যে একফালি সাদা সোজা আলো এসে পড়েছে তার ভিতর ভর্তি জীবন্ত রশ্মি-কণা– তারা নাচছে তাদের পরমাণু নৃত্যের চক্রাকারের ওয়ালট… এই ঘরজোড়া তন্দ্রালসের মাঝখানে সেই মেয়েটি গম্ভীর কণ্ঠে পড়ে যাচ্ছে : সঙ্গে… সঙ্গে… দুটো… সিংহ… লাফ… দিয়ে… পড়ল… তার… উপর… এবং তাঁকে… উদর… সাৎ.. করে… ফেলল… ঠিক ওই মুহূর্তেই আমি ঘরে ঢুকলুম। স্বয়ং সেন্ট ইরেনের সিংহদুটোও ওই সময়ে সে-ঘরে ঢুকলে এতখানি বিহ্বলতার স্তম্ভন সৃষ্টি করতে পারত না। সে-যেন রীতিমতো নাটকীয় আচমকা আবির্ভাব! বাচ্চাটা ডুকরে উঠল, বিরাট কেতাবখানা পড়ে গেল, ক্যানারিপাখিগুলো জেগে উঠল, দেয়ালঘড়িটা ঢং ঢং করে উঠল, বুড়ো প্রায় লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন– একেবারে হকচকিয়ে গেছেন– আর আমিও কেমন যেন বোকা বনে গিয়ে চৌকাঠে থমকে গিয়ে বেশ একটু জোর গলায় বলে উঠলুম : সুপ্রভাত, সজ্জনগণ! আমি মরিসের বন্ধু!

আহা! আপনারা যদি তখন তাঁকে দেখতে পেতেন– যদি দেখতে পেতেন, বেচারি বুড়োকে দেখতে পেতেন! দুই বাহু প্রসারিত করে আমাকে আলিঙ্গন করতে, আমার হাত দুখানা ধরে ঝাঁকুনি দিতে এগিয়ে এলেন, আর ঘরময় উত্তেজিত হয়ে ছুটোছুটি লাগিয়ে শুধু বলন,

হে দয়াময়, হে দয়াময়!…

তার মুখের সব কোচকানো চামড়া হাসিতে ভরে উঠেছে। আর তোতলাচ্ছেন,

আ মসিয়ো… আ মসিয়ো…

তার পর কামরার শেষ প্রান্তে ডাক দিতে দিতে গেলেন :

মামেৎ!

একটা দরজা খুলে গেল। করিডরে যেন একটা ইঁদুরের পায়ের শব্দ শোনা গেল… ওই যে মামেৎ! ওই একফোঁটা বুড়ি– কী যে সুন্দর দেখাচ্ছিল– মাথায় গিঁট বাঁধানো বনেট, পরনে কারমেলিট নাদের ফিকে বাদামি রঙের পোশাক, হাতে নকশাকাটা রুমাল আমাকে সেই প্রাচীনদিনের কায়দায় অভিনন্দন জানাবার জন্যে…ওঁদের দেখলেই কিন্তু বুকটা দরদে ভরে আসে, দুজনারই চেহারা একই রকমের! বুড়োর মাথার চুল বদলে দিয়ে বুড়ির বনে তাঁর মাথায় পরিয়ে দিলে তাকেও মামেৎ নাম দেওয়া যেত!… শুধু সত্যিকার মামেকে নিশ্চয়ই তাঁর জীবনে চোখের জল ফেলতে হয়েছে অনেক বেশি, আর তার সর্বাঙ্গের চামড়া কুঁকড়ে গিয়েছে আরও বেশি। বুড়োর মতো ওঁরও সঙ্গে অনাথাশ্রমের একটি ছোট্ট মেয়ে, পরনে অন্য মেয়েটার মতোই পোশাক, বুড়ির সঙ্গে সর্বক্ষণ থাকে, কখনও তাঁর সঙ্গ ছাড়ে না– অনাথাশ্রমে আশ্রয়প্রাপ্ত দুটি বাচ্চা মেয়ে এই দুই

বুড়ো-বুড়িকে যেন আশ্রয় দিয়ে রক্ষণ করছে– এর চেয়ে হৃদয়স্পর্শী যেন আর কিছুই। কল্পনা করা যায় না।

ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বুড়ি আমাকে গভীর সম্মান-অভিবাদন জানাতে আরম্ভ করছিলেন, কিন্তু বুড়ো একটি শব্দ দিয়েই তার সসম্মান-অভিবাদন কেটে দু-টুকরো করে ফেললেন :

এ তো মরিসের বন্ধু…

সঙ্গে সঙ্গে বুড়ি কাঁপতে লাগলেন, কেঁদে ফেললেন, রুমালখানা হারিয়ে ফেললেন, মুখ রাঙা হয়ে গেল, টকটকে লাল, বুড়োর চেয়েও বেশি লাল… হায়, বুড়ো-বুড়ি! এঁদের সর্ব শিরায় আছে মাত্র একটি ফোঁটা রক্ত, আর সামান্যতম অনুভূতির পরশ লাগলেই সেই ফোঁটাটি মুখে এসে পৌঁছে যায়।

শিগগির, শিগগির চেয়ার নিয়ে এস… বুড়ি তার বাচ্চাটিকে বললেন।

জানালাটা খুলে দাও– বুড়ো তার বাচ্চাটিকে হুকুম দিলেন।

তার পর দুজনাতে আমার দু বাহু ধরে খুট খুট করে হেঁটে নিয়ে চললেন জানালার কাছে। সেটা পুরো খুলে দেওয়া হয়েছে যাতে করে ওঁরা আমাকে আরও ভালো করে দেখতে পান। আমরা এগিয়ে গেলুম আরামকেদারার কাছে। আমি বসলুম তাঁদের দুজনার মাঝখানে চেয়ারে। মেয়ে দুটি আমাদের পিছনে। তার পর আরম্ভ হল সওয়াল :

কী রকম আছে সে? কী করে সে? এখানে আসে না কেন? সুখে আছে তো?…

এটা, ওটা, সেটা–কত শত কথা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

আর আমি? তারা আমার বন্ধুবাবদে যেসব প্রশ্ন শুধোচ্ছিলেন সেগুলোর উত্তর আমার সর্বশ্রেষ্ঠ সাধ্যমতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তো দিলুমই– যেগুলো জানা ছিল; আর যেগুলো জানা ছিল না সেগুলো নির্লজ্জভাবে বানিয়ে বানিয়ে। আর বিশেষভাবে অবশ্যই কিছুতেই স্বীকার করলুম না যে, তার ঘরের জানালাগুলো ঠিকমতো বন্ধ হয় কি না সেটা যে আমি লক্ষ করিনি, কিংবা তার ঘরের দেয়ালের কাগজগুলো কোন রঙের!

তার ঘরের দেয়ালের কাগজগুলো কোন রঙের?… নীল রঙের ঠাকুমা, হালকা নীল– আসমানি রঙের ফুলের মালার ছবি আঁকা।…

–তাই না? বুড়ি একবারে গদগদ। তার পর স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, সোনার চাঁদ ছেলেটি!

বুড়ো সোৎসাহে যোগ দিলেন, সোনার চাঁদ ছেলে।

আর আমি যতক্ষণ কথা বলছিলুম, তারা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে ক্ষণে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাচ্ছিলেন, ক্ষণে সামান্য স্মিতহাস্য করছিলেন, ক্ষণে চোখে চোখে ঠার মারছিলেন, ক্ষণে একে অন্যকে ঠিক ঠিক বুঝতে পারার ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন কিংবা বুড়ো আমার একটু কাছে এসে আমায় বলেন,

আরেকটু জোরে কও… ভালো করে শুনতে পায় না ও।

আর উনিও, আরেকটু চেঁচিয়ে লক্ষ্মীটি!… উনি সবকথা ভালো করে শুনতে পান না…

আমি তখন গলাটা একটু চড়াই; দুজনাই তখন একটুখানি স্মিতহাস্যে আমাকে ধন্যবাদ জানান। আর তাঁদের সেই হালকা ফিকে স্মিতহাস্যভরা দৃষ্টি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে তারা যেন আমার চোখের নিভৃততম গভীরে খুঁজে দেখবার চেষ্টা করেন তাঁদের মরিসের ছবি; আর আমার হৃদয়ও যেন আমার বন্ধুর ছবি তাঁদের চোখে দেখে একেবারে গলে যায়– আবছা-আবছা, ঘোমটা-ঢাকা। ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, যেন অনেক দূরের থেকে, কুয়াশার ভিতর দিয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসছে।

***

হঠাৎ বুড়ো তাঁর আরামকেদারার গভীর থেকে হকচকিয়ে উঠলেন :

আমার কী মনে পড়ল, মামেৎ.. সে বোধহয় এখনও দুপুরের খাবার খায়নি!

আর মামেৎ আর্ত হয়ে শূন্যে তুলে দিয়েছেন হাত দু খানা :

এখনও খায়নি!… হে দয়াময়, হে ভগবান!

আমি ভাবলুম, এখনও বুঝি মরিসের কথাই হচ্ছে; তাই তাঁদের বললুম যে, তাঁদের যাদু মরিস দুপুর হতে না হতেই খানার টেবিলে বসে যায় তার চেয়ে দেরি সে কস্মিনকালেও করে না। কিন্তু না, এবারে উঠেছে আমার কথা। আর আমি যখন স্বীকার করলুম যে আমি তখনও খাইনি, তখন যে ধুন্দুমার আরম্ভ হল সেটা সত্যি দেখবার মতো।

শিগগির শিগগির নিয়ে এস। ছুরি-কাঁটা সব– ও বাচ্চারা! টেবিলটা ঘরের মধ্যিখানে নিয়ে এস। রবারের টেবিলক্লথ, ফুলেল নকশাদার বাসন-প্লেটগুলো! আর অত হাসাহাসি না করলেও আমাদের চলবে, বুঝলে! আর জলদি, জলদি প্লিজ!

আমার মনে কণামাত্র সন্দেহ নেই, তারা জলদি জলদিই করেছিল! তিনখানা পেলেট ভাঙতে যতখানি সময় লাগার কথা তার পূর্বেই টেবিল, খাবার-দাবার, সব তৈরি।

সামান্য একটু ভালো-মন্দ নাশতা বই আর কিছু নয়–আমাকে টেবিলের দিকে নিয়ে যেতে যেতে মামেৎ বললেন। শুধু তোমাকে একলা-একলিই খেতে হবে। আমরা? আমরা সকালবেলাই খেয়ে নিয়েছি।

বেচারা বুড়ো-বুড়ি! যে কোনও সময়েই ওঁদের শুধোও না কেন, ওঁদের সবসময়েই ওই এক উত্তর, তাঁরা সকাল সকালই খেয়ে নিয়েছেন।

মামেতের দেওয়া নাশতা– দুধ, খেজুর আর একখানা আস্ত পাই; ওই দিয়ে কিন্তু মামে আর তার ক্যানারিপাখিগুলোর নিদেন আটদিনের খাওয়া-দাওয়া চলে যায়… তাই ভাবো দিকিনি, আমি একাই তাবৎ মালের শেষ কণাটুকু খেয়ে ফেললুম!… আর টেবিলের চতুর্দিকে সে কী কেলেঙ্কারি! ক্ষুদে দুই নীলাম্বরী একে অন্যকে কনুইয়ের গুতো মেরে ফিসূফিস্ করছিল, আর খাঁচার ভিতরে ক্যানারিগুলোর ভাব, যেন মনে মনে বলছে, দেখেছ! এ কেমন ভদ্রলোক। গোটা পাইটাই খেয়ে ফেলল!

কথাটা সত্যি। আমি প্রায় সমস্তটাই বেখেয়ালে খেয়ে ফেলেছি– কারণ আমি তখন ওই শান্ত শীতল ঘরটার চতুর্দিকে তাকিয়ে দেখছি সেখানে কেমন যেন প্রাচীন দিনের সৌরভ ভাসছিল… বিশেষ করে দুটি ছোট্ট খাট থেকে আমি আমার চোখ কিছুতেই ফেরাতে পারছিলুম না। প্রায় যেন ছোট্ট দুটি শিশুদের দোলনা। আমি কল্পনা করতে লাগলুম সকালে, অতি ভোরে বুড়ো-বুড়ি ঝালর-লাগানো পর্দাঘেরা খাটের গভীরে শুয়ে। ভোর তিনটে বাজল। ওইটেই সব বুড়ো-বুড়ির জেগে ওঠার সময়।

– ঘুমুচ্ছ, মামেৎ?

–না গো।

–কী বল, মরিস ছেলেটি বড় লক্ষ্মী না।

–সে আর বলতে, বড় লক্ষ্মী ছেলে!

আর সুদ্ধমাত্র একটির পাশে আরেকটি, বুড়ো-বুড়ির ছোট্ট দুটি খাট দেখে আমি ওদের দুজনার মধ্যে পুরোপুরি একটি কথাবার্তা কল্পনা করে নিলুম…

ইতোমধ্যে ঘরের অন্যপ্রান্তে, আলমারির সামনে একটা ভীষণ নাটকের অভিনয় চলছিল। ব্যাপারটা হয়েছে কী, ওই আলমারির সবচেয়ে উপরের থাকে রয়েছে এক বোয়াম লিক্যোর-ব্রান্ডিতে মজানো চেরি। এটা দশ বৎসর ধরে মরিসের জন্য অপেক্ষা করছে। এখন সেটাকে নামাতে হবে যাতে করে আমি এটার উন্মোচন-পর্ব সমাধা করতে পারি। মামেতের সর্ব অনুনয় উপেক্ষা করে বুড়ো স্বয়ং লেগে গেছেন সেটাকে পাওয়ার প্রচেষ্টায়। ভয়ে আড়ষ্ট বউ—আর উনি একটা চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে চেষ্টা করছেন সেটাকে পাড়তে… পাঠক, যেখানে আছ সেখান থেকেই ছবিটি দেখতে পাবে: বুড়ো কাঁপছেন, ঝুলে পড়ে লম্বা হবার চেষ্টা করছেন, ক্ষুদে নীলাম্বরী মেয়ে দুটি চেয়ারটাকে জাবড়ে ধরে আছে। পিছনে মামেৎ হাঁপাচ্ছেন– হাত দুটি দুদিকে মেলে ধরেছেন, আর এসব-কিছুর উপর ভাসছে মৃদু সুগন্ধি নেবুর সৌরভ খোলা আলমারির ভিতর থেকে, থাকে থাকে সাজানো কাপড়ের উঁই থেকে।

অবশেষে, অশেষ মেহন্নতের পর, সেই সুপ্রসিদ্ধ বোয়ামটি আলমারি থেকে বের করা হল, আর তার সঙ্গে টোলে টোলে ভর্তি একটি রুপোর মগ-পারা গেলাস মরিস যখন ছোট্ট ছিল সেই আমলের। গেলাসটি চেরি দিয়ে আমার জন্য কানায় কানায় ভর্তি করা হল; মরিস এই চেরি খেতে কতই না ভালোবাসত! চেরি আর ব্রান্ডি ভরতে ভরতে বুড়ো খুশ-খানা-সমঝদারের মতো আমার কানে কানে বললেন :

-বুঝলে হে, তোমার কপাল ভালোই বলতে হবে, হ্যাঁ, তোমার কথাই কইছি, এখন যা খাবে… আমার গিন্নিই এটি তৈরি করেছেন… খাসা জিনিস খাবে এখন।

হায়রে কপাল! ওঁর গিন্নি এটি তৈরি করেছেন সত্যি, কিন্তু চিনি দিতে গেছেন বেবাক ভুলে! তা আর কী করা যায় বলো! বুড়ো বয়সে কি আর মানুষের সবকিছু মনে থাকে! বেচারি মামে আমার, সত্যি বলতে কি তোমার চেরিগুলো অখাদ্যের একশেষ; হলে কী হয়, আমি চোখের পাতাটি পর্যন্ত না নাড়িয়ে তলানি অবধি সাফ করে দিলুম।

***

খাওয়া শেষ হওয়ার পর আমি উঠে দাঁড়ালুম ওঁদের কাছ থেকে বিদায় নেবার জন্য। ওঁরা অবশ্যি সত্যই খুশি হতেন যদি আমি আরও কিছুক্ষণ থাকতুম, যাতে করে ওঁরা লক্ষ্মী ছেলে মরিস সম্বন্ধে আরও কথা বলতে পারেন, কিন্তু বেলা তখন ঢলে পড়েছে, মিলটাও দূরে– বিদায় নিতেই হয়।

আমার সঙ্গে সঙ্গে বুড়োও উঠে দাঁড়িয়েছিলেন।

–মামেৎ, আমার কোটটা!… আমি ওকে চতুর অবধি পৌঁছে দিয়ে আসি।

সত্যি বলতে কি, মামেৎ মনে মনে দ্বিধা বোধ করছিলেন, বেশ একটু শীত পড়েছে, এ সময় আমাকে চত্বর অবধি পৌঁছে দেওয়াটা ঠিক হবে কি না; কিন্তু সেটা মুখের ভাবে প্রকাশ করলেন না। শুধু শুনতে পেলুম, ঝিনুকের বোতামওলা, সোনালি নস্যি রঙের চমৎকার ফ্র-কোটটি পরিয়ে দিতে দিতে লক্ষ্মী ঠাকুরমাটি কর্তাকে নিচু গলায় শুধোলেন,

তোমার ফিরতে দেরি হবে না তো? কেমন?

বুড়ো একটু দুষ্টুমির মুচকি হাসি হেসে বললেন,

–হেঁ, হেঁ!…কী জানি…হয় তো বা…*[* যৌবনে যে ফুর্তিফার্তি করতে গিয়ে আর পাঁচজনের মতো মাঝে-মধ্যে দেরিতে বাড়িতে ফিরতেন, মামেৎ বকাঝকা করতেন, এটাতে ঠাট্টা করে তারই ইঙ্গিত।]

একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসলেন, ওঁদের হাসতে দেখে বাচ্চা দুটি হাসল, আর খাঁচার কোণে বসে ক্যানারি দুটোও তাদের আপন ঢঙে হাসল… নিতান্ত তোমাকেই বলছি, পাঠক, আমার মনে সন্দ হয়, ওই চেরি-ব্রান্ডির গন্ধে ওরা সবাই বোধহয় একটুখানি বে-এক্তেয়ার হয়ে গিয়েছিলেন।

ঠাকুরদা আর আমি যখন রাস্তায় নামলুম তখন অন্ধকার হব-হব। একটু দূরের থেকে পিছনে পিছনে নীলপোশাকি ছোট্ট মেয়েটি আসছিল ওঁকে ফেরার সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসবার জন্য বুড়ো ওকে দেখতেও পাননি। তিনি সগর্বে আমার বাহু ধরে চলছিলেন যেন কতই না শক্তসমর্থ মদ্দা জোয়ান। মামে ভরপুর হাসিমুখে দোরে দাঁড়িয়ে এসব দেখছিলেন, আর আমাদের দিকে তাকিয়ে এমনভাবে খুশিতে মাথা নাড়ছিলেন যেন ভাবখানা এই যা-ই বলো, যা-ই কও, আমার বুড়া এখনও তো দিব্য চলাফেরা করতে পারে।*[*আলস্ দোদের শব্দে শব্দে অনুবাদ।]

.মদ্যপন্থা ওরফে মধ্যপন্থা

মদ্যপান ভালো না মন্দ সে নিয়ে ইউরোপে কখনও কোনও আলোচনা হয় না–যেমন তাস খেলা ভালো না মন্দ সে-নিয়েও কোনও তর্কাতর্কি হয় না। কিন্তু একথা সবাই স্বীকার করেন। যে মাত্রাধিক মদ্যপান গহিত এবং অত্যন্ত বিপজ্জনক যেরকম তাস খেলাতে মাত্রাধিক বাজি রেখে, অর্থাৎ সেটাকে নিছক জুয়ো খেলায় পরিণত করে সর্বস্ব খুইয়ে দেওয়া নিশ্চয়ই অনুচিত।

এ দুটো ব্যসন যে আমি একসঙ্গে উত্থাপন করলুম সেটা কিছু এলোপাতাড়ি নয়। কুরান শরিফে এ-দুটিকে একসঙ্গে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এ দুটির উৎপত্তিস্থল স্বয়ং শয়তান। তৎসত্ত্বেও ইদানীং পূর্ব পাকিস্তানের একখানি দৈনিকে আলোচনা হচ্ছে, মাত্রা মেনে, অতিশয় সাবধানে কিংবা স্বাস্থ্যলাভের জন্য সামান্য মদ্যপান করা শাস্ত্রসম্মত কি না? এ বিষয়ে উকৃষ্ট আলোচনার জন্য যতখানি মুসলিম শাস্ত্রজ্ঞান থাকা উচিত আমার সেটি নেই। এবং শাস্ত্র ছাড়া লোকাঁচার, দেশাচার নামক প্রতিষ্ঠান আছে। উভয় বাঙলার এই দুটি আচারে মদ্যপান নিন্দিত। বরঞ্চ পশ্চিম বাংলার কোনও কোনও জায়গায় তাড়ির প্রচলন আছে– পুব বাঙলায় সেটাও নেই, অন্তত আমার চোখে পড়েনি।

মোদ্দা কথা এই যে, ভারতবর্ষের শিক্ষিত সমাজে এবং অধিকাংশ অশিক্ষিত সমাজে মদ্যপান নিয়ে যে আলোচনা হয় সেটা নীতির দৃষ্টিবিন্দু থেকে, অ্যাজ এ প্রিন্সিপল। অর্থাৎ হিন্দুর কাছে গোমাংস যেমন আত্যন্তিকভাবে বর্জনীয় অতি সামান্য অংশ খাওয়াও মহাপাপ-মুসলমানের কাছে শূকরমাংসও সেইরূপ। তাই এদেশে মদ্যপান ঠিক সেইরকমই বর্জন করতে হবে কি না সেই প্রশ্নটা মাঝে মাঝে ওঠে।

ইতোমধ্যে ঔষধের মাধ্যমে অনেকেই সেটা প্রতিদিন পান করছেন– জানা-অজানায়। বেশিরভাগ টনিকেই পনেরো, সতেরো পার্সেন্ট অ্যালকোহল থাকে। একটি তরুণ অ্যালকোহলের তত্ত্ব না জেনে আমাকে এক বোতল টনিক দিয়ে বলল, অত্যুকৃষ্ট টনিক, স্যর! খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মাথাটা চিম চিম করে, শরীরে বেশ ফুর্তির উদয় হয়। আমি মনে মনে বললুম, বটে! ফুর্তিটা টনিকের ওষুধ থেকে না ওই ১৭ পার্সেন্ট মদ থেকে সেটা তো জানো না বৎস! অর্থাৎ পুচ্ছটি উত্তোলন করে–ইত্যাদি। কারণ টনিকবর্জিত ১৭ পার্সেন্ট অ্যালকোহল সমন্বিত যে কোনও মদ্য পান করলেই মাথাটা চিম চিম করে শরীরে বেশ ফুর্তির উদয় হয়।

ভলতেয়ারের একটি আপ্তবাক্য এত বেশি সুস্বাদু, এত বেশিবার মনে পড়ে যে সেটা আবার বললে পাঠক যেন বিরক্ত না হন। ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের যখন অতি সামান্য কিছুটা ইউরোপে পৌঁছেছে তখন একশ্রেণির কুসংস্কারবাদী বলতে আরম্ভ করল, ভারতবাসীরা মন্ত্রের জোরে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। ওই সময় এদেরই একজন ভলতেয়ারকে শুধোয়, মন্ত্রোচ্চারণ করে একপাল ভেড়া মেরে ফেলা যায় কি না? ভলতেয়ার একটু বাকা হেসে বললেন, নিশ্চয়ই। তবে যাতে কোনও গোলমাল না হয় তার জন্য আগের থেকে পালটাকে বেশ করে সেঁকো খাইয়ে দিয়ো।

এই হচ্ছে আসল তত্ত্ব কথা– সেঁকোটাই সত্য; মন্ত্রটা থাকলে ভালো, না থাকলে নেই।

ঠিক তেমনি ওই যে টনিকের কথা একটু আগে বললুম, তার ওই ১৭ পার্সেন্টটাই সত্য; বাকি যেসব ওষুধ-বিষুধ আছে সেগুলো থাকলে ভালো– ইত্যাদি।

ঠিক তেমনি ছেলে বাড়িতে নিজের চেষ্টায় পরিশ্রম করে যেটুকু শেখে সেইটেই সেঁকো, সেইটেই ১৭ পার্সেন্ট অ্যালকোহল। তারই জোরে ছেলে পরীক্ষা পাস করে– আমরা মাস্টাররা ক্লাসে যা পড়াই সেটা মন্ত্রোচ্চারণের মতো; থাকলে ভালো, না থাকলে নেই।

এই যে দেশটা চলছে সেটা জনসাধারণের শুভ বা অশুভ বুদ্ধি দ্বারা সরকার যেটা আছে, সেটা মন্ত্রোচ্চারণের মতো। এবং আজকাল তো আকছারই সেই মন্ত্রোচ্চারণও ভুলে ভুলে ভর্তি। থাক আর না। বৃদ্ধ বয়সে জেলে গিয়ে শহিদ হতে চাইনে!

ইউরোপীয়রা টনিকের অবান্তর মন্ত্রোচ্চারণ অর্থাৎ ওষুধটা বাদ দিয়ে শুধু অ্যালকোহলটাই খায়, তবে ১৭ পার্সেন্টের মতো কড়া করে নয়। কেউ খায় স্টাউট, কেউ খায় পোর্ট।

প্রাচ্যে ইহুদি, ক্যাথলিক ও পারসিদের ধর্মানুষ্ঠানেও কিঞ্চিৎ মদ্যের প্রয়োজন হয় বটে, কিন্তু যাজক সম্প্রদায়ের সকলেই অত্যধিক মদ্যপানের বিরুদ্ধে প্রচারকার্য করে থাকেন।

গল্পচ্ছলে প্রচলিত আছে :
দ্বিপ্রহর রাত্রে এক ধার্মিক যুবক
নিদ্রা যায়; ওই তার একমাত্র শখ।
একমাত্র সুখ তার ওই নিদ্রা বটে,
–পিতা তার বৃদ্ধ অতি, কখন কী ঘটে।
ভগিনীটি বড় হল, বিয়ে দেওয়া চাই
দিবারাত্রি খাটে, আহা, গোনে কড়ি পাই।
যৌবনের লোলচর্ম হল অস্থি-সার
নিদ্রাতেই ভোলে তাই নির্দয় সংসার ॥

আপনারা তো আর কেচ্ছা সাহিত্য পড়েন না। হায়, আপনারা জানেন না, আপনারা কী নিধি হারালেন! বিদ্যাসুন্দর পড়ে যখন আনন্দ পান, তখন কেচ্ছা সাহিত্যে নিশ্চয়ই পাবেন।

আমার নিজের বিশ্বাস, কেচ্ছা সাহিত্যের অনুপ্রেরণাতেই বিদ্যাসুন্দরের সৃষ্টি। তা সে যাক।

এবারে কেচ্ছাটাই শুনুন :

এই কেচ্ছা শোনে যেবা এই কেচ্ছা পড়ে
উত্তম চাইল পাবে রেশনে না লড়ে।
বারো আনা দরে পাবে কিলোর ইলিশ।
সরিষার তেল পাবে না সয়ে গর্দিশ।
দেড়টি টাকায় কিলো শোনো পুণ্যবান
খুশিতে ভরপুর হবে জমিন আসমান।

এ সংসারে যে মেলা পাপ মেলা দুঃখ সে বিষয়ে কারও মনে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এগুলো আসে কোথা থেকে? সেমিতি– অর্থাৎ ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলিম গুরুরা বলেন, শয়তান মানুষকে কুপথে নিয়ে গিয়ে পাপ-দুঃখের সৃষ্টি করে। পক্ষান্তরে ভারতীয় তিনটি ধর্মেরই বিশ্বাস পূর্বজন্মের অর্জিত পাপপুণ্যের দরুন এ জন্যেও সুখ-দুঃখ দেখা দেয়– কাজেই হিন্দুধর্মে শয়তানের প্রয়োজন নেই। একদা কিন্তু এই হিন্দুধর্মেও শয়তান জাতীয় একটি অস্তিত্বের আবির্ভাব হয়ে উপযুক্ত প্র্যাকটিসের অভাবে লোপ পায়।

নল-দময়ন্তীর উপাখ্যান যদিও মহাভারতে স্থান পেয়েছে তবু আমার বিশ্বাস মূল গল্পটি বৈদিক যুগেও প্রচলিত ছিল। গ্রিক দেবতা প্রমিথিয়ুস চোঙা বা নলের ভিতর করে আগুন চুরি করেন; নলরাজও ইন্ধন প্রজ্বলনে সুচতুর ছিলেন। স্বয়ং দেবতারা প্রমিথিয়ুসের শত্রুতা করেন। নলের শত্রুতা করে স্বয়ং দেবতারা দময়ন্তীর স্বয়ংবরে উপস্থিত হন– নলকে তাঁর বল্পভা থেকে বঞ্চিত করার জন্যে।

এই নলের শরীরে পাপ কলিরূপে প্রবেশ করেন। এই কলিই আর্যধর্মে শয়তানের অপজিট নাম্বার। মনে করুন সেই শয়তান বা কলি ওই নিদ্রিত যুবকটির সামনে দিল দেখা :

হঠাৎ দেখিল মর্দ সম্মুখে শয়তান
নিদ্রা তার সঙ্গে সঙ্গে হৈল খানখান।
শয়তানের হাতে হেরে ভীষণ তরবার।
আকাশ-পাতাল জুড়ে ফলাটা বিস্তার।
ত্রিনয়ন, কণ্ঠে তার নৃমুণ্ডের মালা
জিহ্বা তার রক্তময় যেন অগ্নি ঢালা।

ইটি আসলে কথকতা। অতএব তাবৎ বক্তব্য ছন্দে দিলে রসভঙ্গ হয়।

যুবক বেতস পত্রের ন্যায় কম্প্রমান!

শয়তান হুঙ্কার দিয়ে বলল, আজ থেকে স্বর্গ-মর্ত্য আমার পরিপূর্ণ দখলে এসেছে। তোকে আমি এই তরবারি দিয়ে দুই টুকরো করব। তার পূর্বে আমার স্তব গেয়ে নে।

যুবা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার মরতে কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু আমি মরে গেলে আমার বৃদ্ধ পিতার জন্যে কে অন্ন আহরণ করবে? আমাকে তুমি নিষ্কৃতি দাও।

শয়তান ক্ষণতরে চিন্তা করে বলল, তোমাকে ছাড়তে পারি এক শর্তে। তুমি তোমার পিতাকে হত্যা কর। তা হলে তোমার সমস্যারও সমাধান হয়! শয়তান অট্টহাস্য করে উঠল।

পুত্র আর্ত ক্রন্দন করে বলল, অসম্ভব! সম্পূর্ণ অসম্ভব!

পিতা মোরে জন্ম দিল বাল্যেতে আরাম
কেমনে হইব আমি নেমকহারাম!

নেমকহারাম শুনে শয়তানের ক্রোধ চরমে পৌঁছেছে। কারণ সে একদা আল্লার সঙ্গে নেমকহারামি করেছিল। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে হিত অবশ্য শয়তানের ধারণা অনুযায়ী যেটা হিত– বলল, তা হলে তুমি তোমার ভগিনীকে ধর্ষণ কর।

যুবা এবারে আর কোনও উত্তর দিল না। সে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হল।

কিন্তু শয়তানের এ ব্যবস্থা মনঃপূত হবে কেন? সে চায় যুবাকে দিয়ে পাপ করাতে। তাই অন্য ট্যাকটিক অবলম্বন করে বলল, তোমাকে শেষ মুক্তির উপায় দিচ্ছি। এই নাও, এক পাত্র মদ্য পান কর।

যুবা ভাবে :

মদ্য পান মহা পাপ সর্ব শাস্ত্রে কয়।
এ পাপ করিলে গতি নরকে নিশ্চয়।
যাইব নরকে আমি নাহি কোনও ডর
শয়তানের শর্ত হীন, পাপিষ্ঠ, বর্বর।

অনিচ্ছায় সে করল মদ্য পান। তার পর কাহিনীটি সংক্ষিপ্ত।

মদ্যপান করে পরিপূর্ণ মত্তাবস্থায় পাপপুণ্যজ্ঞানহীন যুবা শয়তানের ওই হীন পাপিষ্ঠ বর্বর কর্ম দুটি করে ফেলল।

কাহিনীটি সর্বত্র বলা চলে না। কিন্তু যে মহাজন এটির কল্পনা করেন তিনি স্পষ্টত কাউকে ছেড়ে কথা বলতে চাননি, কোনও পাপ শেয়ার করতে চাননি। পৈশাচিক বীভৎস রস সৃষ্টি করে সর্বমানবের হৃৎকন্দরে ভগবানের ভয় প্রবেশ করাতে চেয়েছিলেন।

এ তো গেল এক পক্ষ। অন্য পক্ষ কী বলেন, তার অনুসন্ধান আমি বহুকাল ধরে করে আসছি। কারণ আরব তথা অন্যান্য প্রাচ্যভূমিতে এ তথ্য সর্বাদিসম্মত যে, হেন কাহিনী এ পৃথিবীতে নেই যার বিপরীত গাথাও নির্মিত হয়নি। সেটিও পেয়েছি।

কিছুকাল পূর্বে টুরিজম-প্রসার সংস্থার আমি সদস্য হয়ে যাই আমার একমাত্র গুণ যে, কোনও দেশই আমাকে দীর্ঘকাল সহ্য করতে পারে না বলে আমি সে-দেশ থেকে সংক্ষেপে বিতাড়িত হই, ফলে আমার বহু দেশবাস, বহু দেশদর্শন হয়। এসব দেশের দেওয়ানি আদালতে দেউলেদের যে লিস্ট টাঙানো থাকে তার প্রত্যেকটিতে আমার নাম পাবেন। যদি কোনওটিতে না পান তবে বুঝে নেবেন সে দেশে আমি নাম ভাঁড়িয়েছিলুম। বস্তুত আমি কোনও দেশের, কি স্বদেশের কি বিদেশের, কারও কাছে অঋণী থেকে মরতে চাইনে।

সেই টুরিজম সংস্থার এক মিটিং-এ জনৈক সজ্জন সভারম্ভেই বলেন, ভদ্রমহোদয় ও মহিলাগণ, কর্মসূচি আরম্ভ করার পূর্বেই আমার একটি বক্তব্য নিবেদন করি।

প্রবাদ আছে, মুরগি-ঘরে যদি শ্যাল ঢুকতে দাও, তবে সকালবেলার মমূলেটটির আশা ত্যাগ করেই কর। তাই যদি দেশ থেকে মদ্যপান একদম ঝেটিয়ে বের করে দাও, তবে ইউরোপীয় টুরিস্টের আশা কর না; সে মমূলেটটি আমাদের প্লেট থেকে অন্তর্ধান করবে। অতএব, আপনারা এবং আপনাদের সরকার স্থির করুন, আপনারা টুরিজম্ চান, না দেশকে মদ্যহীন করতে চান। আমার কাছে দুই-ই বরাবর।

ভারি স্পষ্ট বক্তা। ওদিকে মুরুব্বিদের অনেকেই গান্ধীটুপি পরিহিত। এটাও চান ওটাও চান, কিন্তু কী করে উলঙ্গ ভাষায় বলেন, মদটা না হয় থাক। ওঁদের মতলব, এমন এক অভিনব কৌশল বের করা, যার প্রসাদে আণ্ডা না ভেঙেও মমলেট বানানো যায়! অতএব এসব ক্ষেত্রে যা উইদাউট ফেল করা হয় তাই সাব্যস্ত হল। পোস্টপোন কর।

মিটিঙের শেষে আমাদের জন্য লাঞ্চের ব্যবস্থা ছিল। আমি শঙ্কিত হয়ে পালাবার চেষ্টা করেছিলুম। সরকারি পয়সায় লাঞ্চকে আমি লাঞ্ছনা নাম দিয়েছিলুম। ওদের ডিনারকে অনেকে সাপার বলতেন। আমি বলতুম suffer : সংক্ষেপে দুপুরে লাঞ্ছনা, রাত্রে suffer.

আমার অবস্থা দেখে সেই স্পষ্টভাষী বক্তা আমাকে সন্তর্পণে গাধা-বোটের মতো টেনে টেনে করিডরে রব করে দে ছুট ভদ্রতা বাঁচিয়ে। সেই হোটেলেই তাঁর কামরা ছিল। সেখানে বসে আমার হাতে মেনু এগিয়ে দিলেন। উক্তৃষ্ট আহারাদি এল। তার পূর্বে জিন এল, বিয়ার এল। তিনি খেলেন সামান্যই।

বললেন, যতসব আদিখ্যেতা। কোনও জিনিসে একটা ক্লিয়ার পলিসি নেই। বিশ্বসুন্দু লোক মদ খেয়ে রাস্তায় গড়াগড়ি দিক, এটা কেউই চায় না। ফ্রান্সের মতো অ্যালকহলিজম একটা সমস্যারূপে দেখা দিক, সেটাও কেউ চায় না। অথচ ইংরেজ তথা তাবৎ ইউরোপীয়রা বিজনেস পাকাঁপাকি করে দুপুরবেলা বারে দাঁড়িয়ে।

আমাকে বললেন, শুনেছি আপনি সাহিত্যিক। একটা ওই মতিফের (ধরনের) গল্প শুনবেন?

আমি বললুম আলবত, একশোবার।

হরপার্বতী সাইক জানেন? অর্থাৎ তাদের নিয়ে জনসাধারণের গল্প? তারা যে একে অন্যের সঙ্গে বাজি ধরেন?

এটা তারই একটা।

হরপার্বতী শূন্যমার্গে উড়ে যাচ্ছেন। আকাশ থেকে দেখতে পেলেন ঝাঁকে ঝাঁকে পুণ্যার্থী গঙ্গাস্নান করছে। পার্বতী তাই দেখে মৃদুহাস্য করলেন।

শিব বললেন, কী হল?

পার্বতী খিলখিল করে হেসে বললেন, এবারে তোমার নরকের পথ বন্ধ হল। বিষ্ণু বহুকাল ধরে যমের ওই পশ্চিমের বাড়িটা চাইছিলেন সেটা পেয়ে যাবেন। বেচারি যম! জানো, যমের সহোদর উকিল-ডাক্তারদের পসার কমে গেলে তাদের কী অবস্থা হয়?

পসার কমবে কেন? শিব শিবনেত্র হয়ে শুধোবেন।

কৌতুকে হাসিলা উমা কটাক্ষে লক্ষিয়া হর পানে। বললেন, কে আর যাবে নরকে? দেখছ। না, তামাম দুনিয়ার লোক হদ্দমুদ্দ হয়ে গঙ্গাস্নান করছে। সবাই হবে নিষ্পাপ। নরকে যাবে। কে? তোমাকে বলিনি পই পই করে ওই গঙ্গাটাকে তাড়াও। আমার হোস্টটি গল্প থামিয়ে শুধালেন, জানেন বোধহয়, গঙ্গা হলেন পার্বতীর সতীন!

গঙ্গা তরঙ্গিনী, শিবের শিরোমণি।

হোস্ট বললেন, শিব এই গঙ্গাস্নানের কথা শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে বসলেন, কিন্তু তার পূর্বেই

হর প্রতি প্রিয়ভাবে কন হৈমবতী,
বৎসরের ফলাফল থাক, পশুপতি!
যমের রাজত্ব যাবে এইটুকু জানি
অমৃত-রেশন-শপও স্বর্গ নেবে মানি।
ভেজাল না হয় শুরু এই লাগে ভয়
স্বর্গের হাউসিং লাগি চিন্ত মহাশয়।

থুড়ি! আর কথকতা নয়। আমার হোস্ট এ-পদ্ধতি অবলম্বন করেননি।

শিব কল্কেটা রথের স্টারগার্ড-এ (আকাশে মাড়-এর পরিবর্তে আকছারই নক্ষত্র চূর্ণ উড়ে এসে রথটা ধূলিময় করে বলে ওটা স্টারগার্ড) কল্কেটা ঠুকে ঠুকে সাফ করতে করতে বললেন, কিছু ভয় নেই ডার্লিং। যারা স্নান করছে তারা এর পুণ্যফলে বিশ্বাস করে না।

পার্বতী তাজ্জব মেনে বললেন, সে কী! তাবৎ পুরাণে যে পষ্ট লেখা রয়েছে। এখন তো ছাপাও হচ্ছে, বেতারেও প্রচার হয়, যে-পণ্ডিত নেহরু

শিব তখনও ইন্ডিয়ার উপরে। ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া আইনের কথা ভেবে তাড়াতাড়ি বললেন, আমার কথা বিশ্বাস কর, আমি প্রমাণ করতে পারি।

যথারীতি দুজনাতে বাজি ধরা হল– সুর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের ভিতর শিব প্রমাণ করবেন, গঙ্গাস্নান যারা করে তারা মা-গঙ্গার কল্যাণে নিষ্পাপ হল বলে বিশ্বাস করে না।

অতি প্রত্যুষে বাজির চুক্তিমতো পার্বতী রাজরাজেশ্বরীর মহিমাময় সজ্জা পরে কিন্তু অতিশয় বিষণ্ণ বদনে বসলেন গঙ্গাতীরে। আর তার কোলে মাথা রেখে লম্বা হয়ে শুয়ে রইলেন শিবঠাকুর– তাঁর সর্বাঙ্গে গলিত কুষ্ঠ!

গঙ্গাস্নান সেরে উঠে এ দৃশ্য দেখে প্রথম ব্রাহ্মণ অবাক। কৌতূহল দমন না করতে পেরে দরদী কণ্ঠে শুধাল, মা, এ কী ব্যাপার!

নিখুঁত ক্ষুদ্র দুটি নাসারন্ধ্র দিয়ে উষ্ণতম দীর্ঘশ্বাস ফেলে পার্বতী বললেন, বাবা, আমার কপাল। দেখতেই তো পাচ্ছেন, আমার স্বামীর অবস্থা। তবে ভগবানের দয়ায় এক গণক্তারের সঙ্গে দেখা। সে তার হাত দেখে বলেছে, কোনও নিষ্পাপ পুরুষ তাকে স্পর্শ করা মাত্রই তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন।

ব্রাহ্মণ কাঁচুমাচু হয়ে হ্যাঁ মা, তা মা, বলে বাং মাছটির মতো মোচড় মেরে হাওয়া।

পার্বতী তো বজ্রাহত। লোকটা এইমাত্র গঙ্গাস্নান করে নিষ্পাপ হয়ে মা গঙ্গার কোল থেকে বেরিয়ে এল। তার মুখেও দয়ামায়ার চিহ্ন। তবে কি তবে কি গঙ্গাস্নানে তার বিশ্বস—! শিব মৃদুহাস্য করলেন।

কিছুক্ষণ পরেই আরেক স্নান-সমাপ্ত দ্বিজ। কথোপকথন পূর্ববৎ। বাং মাছের মোচড়টিও তদ্বৎ। পার্বতী দিশেহারা। ভোলানাথ আস্যদেশ বিস্তীর্ণ করলেন।

চলল যেন প্রসেশন। পার্বতীর গলা থেকে একই রেকর্ড বেজে চলল। ফল একই। ধূর্জটি গণ্ডা দুই হাই তুলে পদ্মনাভ স্মরণে এনে ঘুমিয়ে পড়লেন। দেবসমাজে এই হল ঘুমের বড়ি সনেরি।

করে করে বেলা দ্বিপ্রহর। ভেঙে গেছে প্রভাতের হাট, কোলাহল থেমে গেছে, জনপদঘাট পান্থহীন। গঙ্গাতীরও ভূতনাথের শ্মশানসম নির্জন।

অপরাহ্ন। পার্বতীর ক্লান্তি এসে গেছে। বললেন, নন্দীকে ডাকো, বাড়ি যাই। আমি হার মানলুম।

শিব বললেন, সন্ধ্যা অবধি থাকার কথা। তাই হবে।

এ তো কলকাতা নয় যে বাবুরা হাওয়া খেতে সন্ধেবেলা গঙ্গাতীরে আসবেন। কাগ-কোকিলও সেখানে আর নেই।

এমন সময় ক্ষীণ কনে দেখার মিলোয় মিলোয় আলোতে দূর থেকে দেখা গেল এক ইয়ার-গোছ নটবর। ডান হাত দিয়ে তুড়ি দিতে দিতে গান গাইছে, লে লে সাকি, ভর দে পেয়ালা। বা বগলে হাফ-পাট। বদনটি তার প্রফুল্ল। আপন মনে গান গাইতে গাইতে এদিক পানেই আসছে।

আসন্ন সন্ধ্যায় নির্জন গঙ্গাতীরে অপরূপ সুন্দরী দেখে সে থমকে দাঁড়াল। আপন মনে মাইরি বলতে না বলতে হঠাৎ তার চোখ গেল সিঁথির সিঁদুরের দিকে। মাতাল যে কখন আচম্বিতে অকারণ পুলকে নেচে ওঠে, আর কখন যে সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ লজ্জা পেয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যায় সেটা পাকা শুড়ির গুঁড়িও আগেভাগে বলতে পারে না। এবং মাতালের পুলক এবং কুণ্ঠা দুই-ই তখন পৌঁছয় চরমে, হাফাহফি সন্ধিসুলের বেনের পথই যদি সে নেবে তবে তো সে নর্মাল! বোতলে পয়সা বরবাদ করবে কেন?

মাতালের কৌতূহল হল। তদুপরি সঙ্গে সঙ্গে তার ধর্মবুদ্ধিও জাগ্রত হল। মেয়েটাকে সাবধান করে দেওয়া উচিত। এই ভরসন্ধেবেলায়–

কুণ্ঠায় যেন আপন পাঞ্জাবির ভিতর মায় পা দুখানা, সর্বশরীর লুকিয়ে নিয়ে বলল, মা, এই অবেলায়, আপনি এখানে, জানেন না, কী বলব, কিন্তু কেন?

পার্বতী মাতাল দেখে প্রথমটার সঙ্কুচিত হয়ে ঘাড়টা একটু ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন। মাতাল কিন্তু মাটির দিকে তাকিয়ে রইল ঠায় দাঁড়িয়ে। কী আর করেন জগন্মাতা পার্বতী? আর বলাও তো যায় না, মাতাল! কখন রঙ বদলায়।

থেমে থেমে বললেন, তার হ্রস্ব কাহিনী হ্রস্বতর নির্যাসরূপে।

সঙ্গে সঙ্গে মাতালের মুখে উৎসাহ আর আনন্দের দ্যুতি। হাসিও চাপতে পারে না।

কোনও গতিকে বলল, হায় রে হায়, এই সামান্য বিষয় নিয়ে মা, তোমার দুর্ভাবনা! তুমি এক লহমা বসো তো মা শান্ত হয়ে।

তার পর বলল, চতুর্দিকে কিন্তু চোর-চোট্টার পাল। হেঁ হেঁ মা, কিছু মনে কর না, ওই যে রইল বোতলটা তার উপর আধখানা চোখ রেখ।

বিড়বিড় করে আপন মনে বলল, এই মাঘের শীতের ভরসন্ধেবেলা চানটা না করিয়ে ছাড়লে না। মহামূল্যবান নেশাটাও মেরে যাবে দড়কচ্ছা। তা আর কী করা যায়?

ঝপ করে গঙ্গায় এক ডুব মেরে উপরে উঠে খপ করে ধরল শিবের ঠ্যাঙখানা।

বত্রিশ নয় যেন চৌষট্টিখানা দাঁত বের করে বলল, হল মা-জননী? এই সামান্য জিনিসটের জন্যে তুমি এতখানি ব্যাকুল হয়ে গিয়েছিল? ছিঃ মা, তোমার বিশ্বাস বড় কম!

মাঝ গাঙের দিকে তাকিয়ে বলল, ওইটে কি তোমাদের নৌকো? কে যেন ডাকছে? আমি তা হলে আসি। আমার আবার বেতো শরীর। পেন্নাম হই মা, বাবাজি সেরে তো উঠল– এবারে একটু ইয়ে মানে সাবধানে।

লাঞ্চ শেষ হয়ে এসেছে। সোফায় বসে সিগার ধরিয়ে হোস্ট বললেন, দেশ বোন-ড্রাই হোক কিংবা উচ্ছন্নে যাক– আমার কিচ্ছুটি বলার নেই। কিন্তু দু-একটা মাতাল না থাকলে ডেয়ারিং কাজ করবে কে?

আমারও নিজের কিচ্ছুটি বলার নেই। আমি দু পক্ষেরই বক্তব্য নিবেদন করলুম মাত্র।

আমি পক্ষ নেবই-বা কেন? এক পক্ষ বলছেন আমাকে ড্রাই করে ছাড়বেন, অন্য পক্ষ বলছেন, আমাকে ভিজিয়ে দেবেন। দু পক্ষেই দারুণ লড়াই।

দুটো কুকুর যদি একটুকরো হাড়ি নিয়ে লড়াই করে, হাড্ডিটা তো তখন কোনও পক্ষে যোগ দিয়ে লড়াই করে না।

শ্রীচরণেষু

কতকগুলি খেলা প্রায় সব দেশের ছেলেমেয়েরাই খেলে। যেমন মনে কর, কানামাছি কিংবা লুকোচুরি। আবার মনে কর সাঁতার কাটা; সাহারার মরুভূমিতে, কিংবা মনে কর খুব বড় শহরে, যেখানে নদী-পুকুর নেই, সেখানে যে সাঁতার কাটাটা খুব চালু হতে পারে না, সেটা অনায়াসেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। জল আছে অথচ সাতার কাটাটা লোকে খুব পছন্দ করে না, তা-ও হয়। শীতকালে ইউরোপের সব নদী-পুকুর জমে বরফ হয়ে যায় না, তবু সেই পাথর-ফাটা শীতে কেউ পারতপক্ষে জলে নামতে চায় না সাঁতারের তো কথাই ওঠে না।

খেলাধুলো তাই নির্ভর করে অনেকটা দেশের আবহাওয়ার ওপর। কিছু না কিছু জল প্রায় সব দেশেই আছে, তাই কাগজ বা পাতার ভেলা সবাই জলে ভাসায়। কিন্তু যে দেশে ঝমাঝ-ঝম্ বৃষ্টি নেমে আঙিনা ভরে গিয়ে চতুর্দিকে জল থৈ-থৈ করে না, সে দেশের ছেলে-মেয়েরা আর দাওয়ায় বসে আঙিনার পুকুরে কাগজের ভেলা ভাসাবে কী করে? অথচ ভেলা-ভাসানোর মতো আনন্দ কম খেলাতেই আছে। রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বুড়ো বয়সে ছেলেবেলার কথা ভেবে গান রচেছেন :

পাতার ভেলা ভাসাই নীরে
পিছন পানে চাইনে ফিরে।

আর ছেলেমেয়েদের জন্য শিশু ভোলানাথের এ কবিতাটি তোমরা নিশ্চয় জানো :

দেখছ না কি নীল মেঘে আজ
আকাশ অন্ধকার?
সাত-সমুদ্র তেরো-নদী।
আজকে হব পার।
নাই গোবিন্দ, নাই মুকুন্দ,
নাইকো হরিশ খোঁড়া–
তাই ভাবি যে কাকে আমি
করব আমার ঘোড়া।
কাগজ ছিঁড়ে এনেছি এই
বাবার খাতা থেকে,
নৌকো দে-না বানিয়ে– অমনি
দিস, মা, ছবি এঁকে।
রাগ করবেন বাবা বুঝি।
দিল্লি থেকে ফিরে?
ততক্ষণ যে চলে যাব
সাত-সমুদ্র-তীরে।

ভারি চমৎকার কবিতা! কিন্তু বাকিটা আর বললুম না। যাদের পড়া নেই, তারা যেন শিশু ভোলানাথখানা খোলে, এই হচ্ছে আমার মতলব।

তা সে কথা যাক। বলছিলুম কি, আবহাওয়ার ওপর খেলাধুলো অনেকটা নির্ক্স করে। আমাদের দেশ জলে ভর্তি, বিশেষ করে পুব বাঙলা, তাই আমাদের খেলাধুলো জমে ওঠে জলের ভিতরে-বাইরে। তেমনি শীতের দেশে বরফ পড়ে বিস্তর, আর তাই নিয়ে ছেলেদের খেলাধুলোর অন্ত থাকে না। ধুলো বলা অবশ্যি ভুল হল, কারণ বরফে যখন মাঠ-ঘাট, হাট-বাট সবকিছু ছেয়ে যায়, তখন তামাম দেশে একরত্তি ধুলোর সন্ধান আর পাওয়া যায় না।

কাবুলে যখন ছিলুম, তখন জানালা দিয়ে দেখতুম, ছেলেমেয়েরা সকাল থেকে পেঁজা বরফের গুড়ো হাতে নিয়ে ঢেলা পাকিয়ে একে-ওকে ছুঁড়ে মারছে, সে ঢিল ছোঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে চট করে সরে যাবার চেষ্টা করছে। যদি তাগমাফিক লেগে গেল তবে তুমি ওস্তাদ ছেলে, হাতের নিশান ভালো, হয়তো একদিন ভালো বোলার হতে পারবে। আর না লাগলেও তা নিয়ে ভাবনা করা চলবে না, কারণ ততক্ষণে হয়তো তোমার কানে এসে ধাই করে লেগেছে। আর কারও ছুঁড়ে মারা গোলা। কানের ভিতর খানিকটা বরফের গুঁড়ো ঢুকে গিয়ে কানের ভিতরকার গরমে গলতে আরম্ভ করেছে। ভারি অস্বস্তি বোধ হয় তখন মনে হয় যেন কেউ সুড়সুড়ি দিচ্ছে। তখন খেলা বন্ধ করে কান সাফ করার জন্য দাঁড়াতে হয়। আর ছোঁড়াছুড়ির মধ্যিখানে ও রমধারা দাঁড়ানো মানেই আর পাঁচজনের তাগ হওয়া। মাথা নিচু করে যতক্ষণ তুমি কান সাফ করছ, ততক্ষণে এ-দিক, ও-দিক, চতুর্দিক থেকে গোটা দশেক গোলাও খেয়ে ফেলেছ।

তা বয়েই গেল। বরফের গোলা যত জোরেই গায়ে এসে লাগুক না কেন, তাতে করে চোট লাগে না। গায়ে লাগার সঙ্গে সঙ্গেই গোলা চুরমার হয়ে যায়। কিছুটা বরফের গুঁড়ো অবশ্যি জামা-কাপড়ে লেগে থাকে। তা সেটা হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেললেই হয়–না হলে গরম জামাকাপড়ের ওম লেগে খানিকক্ষণ বাদে বরফ গলে গিয়ে কাপড় ভিজিয়ে দেবে।

বরফ জমলেই এ খেলা জমে উঠত। আর আমি কাজকর্ম ধামাচাপা দিয়ে জানালার কাছে। গিয়ে বসতুম।

এ খেলায় সত্যিকার ওস্তাদ ছিল একটি সাত-আট বছরের ছেলে। খেলার মধ্যিখানে সে এমনি চর্কিবাজির মতো ঘুরত যে তার গায়ে গোলা ছেড়ে কার সাধ্যি। আর আমাদের দেশের পাকা লেঠেলের মতো সে একাই জন আষ্টেককে অনায়াসে কাবু করে ফেলত। ভারি মিষ্টি চেহারা, পাকা আপেলের মতো টুকটুকে দুটি গাল, নীল চোখ, আর সেই দু চোখে যেন দুনিয়ার যত দুষ্টুমি বাসা বেঁধে বসে আছে। নাম ইউসুফ, পাশের বাড়িতে থাকে, আর তার বাপ আমাদের কলেজের কেরানি। আমাকে পথে পেলে সেলাম করে কিন্তু সসম্ভ্রম সেলামের সময়ও চোখের দিকে তাকালে মনে হত ছেলেটা কোনও এক নতুন দুষ্টুমির তালে আছে। যদি জিগ্যেস করতুম, কীরকম আছিস? তা হলে একগাল হেসে কী একটা বলত, যার কোনও মানে হয় না। কিন্তু সেই হাসির ফাঁকে ফাঁকেও আমি স্পষ্ট দেখতে পেতুম কোনও একটা দুষ্টুমির সুযোগ পেলে সে আমাকেও ছাড়বে না।

সে-ই একদিন বাড়ি বয়ে এসে সোৎসাহে খবর দিয়ে গেল, আমি তাদের স্কুলে বদলি হয়ে এসেছি। তার চোখে-মুখে হাসি আর খুশি। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, আমি তার চোখে যেটি লক্ষ করলুম সেটি হচ্ছে এইবার আসুন স্যর, আপনাতে আমাতে এক হাত হয়ে যাবে। আমি যে খুব ভয় পেলুম তা নয়, কারণ ছেলেবেলায় আমিও কম দুষ্ট ছিলাম না।

ওদের স্কুল বড় অদ্ভুত। পাঁচ-ছ বছরের ছেলেদের ক্লাস ওয়ান থেকে আই-এ ক্লাসের ছেলেরা একই বাড়িতে পড়ে। তাই সেটাকে পাঠশালা বলতে পার, হাইস্কুল বলতে পার, আর কলেজ বললেও বাধবে না। আমি বদলি হলুম কলেজ বিভাগে– ফাস্ট আর সেকেন্ড ইয়ারের ছেলেদের ইংরেজি পড়াবার জন্য। এ দু ক্লাস পড়িয়ে আমার হাতে মেলা সময় পড়ে থাকত বলে একদিন প্রিন্সিপাল অনুরোধ করলেন, আমি যদি ম্যাট্রিক ক্লাসের ছেলেদেরও ইংরেজি পড়াই তবে বড় উপকার হয়। আমি খানিকটে ভেবে নিয়ে বললুম, তার চেয়ে আমাকে বরঞ্চ ক্লাস ওয়ানে পড়াতে দিন। আসছে বছর ওদের সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও প্রোমোশন দেবেন– অর্থাৎ আমি টু-তে পড়াব, তার পরের বছর থ্রিতে। এই করে করে যাদের কলেজে টেনে নিয়ে আসতে পারব তাদের ইংরেজিজ্ঞান থেকে বুঝতে পারব আমি ভালো পড়াতে পারি কি না। প্রিন্সিপাল তো কিছুতেই মানেন না; বলেন, সে কী কথা! আপনি পড়াবেন ক্লাস ওয়ানে! আমার প্রস্তাবটার তত্ত্ব বুঝতে তাঁর বেশ খানিকটা সময় লাগল। কাবুলি প্রিন্সিপালের বুদ্ধি থাক, গুরুজনদের নিন্দে করতে নেই।

ওদিকে ক্লাস ওয়ানে হৈ হৈ রৈ রৈ। কলেজ বিভাগের অধ্যাপক আসছেন ক্লাস ওয়ানে পড়াতে!

আমার তখন আদপেই মনে ছিল না ইউসুফ ক্লাস ওয়ানে পড়ে। প্রথমদিন ক্লাসে ঢুকতেই দেখি, সে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সবাইকে কী যেন বোঝাচ্ছে। অনুমান করলুম, প্রতিবেশী হিসেবে সে আমার সম্বন্ধে যেটুকু জানে সেটুকু সকলকে সগর্বে সদম্ভে জানিয়ে দিচ্ছে। আমার চাকর আবদুর রহমানের সঙ্গে ইউসুফের আলাপ-পরিচয় ছিল। আর আবদুর রহমান ভাবত তার মনিবের মাথায় একটুখানি ছিট আছে। আবদুর রহমান যদি সেই সুখবরটি ইউসুফকে দিয়ে থাকে, আর সে যদি ক্লাসের সবাইকে সেই কথাটি জানিয়ে দেয়, তবেই হয়েছে!

ক্লাসে মাস্টার ঢুকলেই কাবুলের ছেলেরা মিলিটারি কায়দায় সেলুট দেয়– আফগানিস্তান মিলিটারি দেশ। আমি ক্লাসে ঢুকতেই ইউসুফ তড়াক করে সুপারি গাছের মতো খাড়া হয়ে মিলিটারি সেলুটের হুকুম হাঁকল। তার পর খুশিতে ডগমগ হয়ে আপন সিটে গিয়ে বসল।

পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই ইউসুফ উঠে দাঁড়াল। বাইরে যেতে পারি, স্যর? আমি বললুম যা, কিন্তু দেখ, আমি বাইরে যাওয়া-যাওয়ি জিনিসটা মোটেই পছন্দ করিনে। যাবি আর আসবি। নিশ্চয় স্যর। বলে আরেকটা মিলিটারি সেলুট ঠুকে বেরিয়ে গেল।

এক মিনিট যেতে না যেতে ইউসুফ ফিরে এল। তাই তো, ছেলেটা তা হলে অতটা দুষ্টু নয়। কিন্তু আরও তিন মিনিট যেতে না যেতে আমার ভুল ভাঙল। ইউসুফের পাশের ছেলেটা পড়ার মাঝখানে হঠাৎ চেঁচিয়ে বলল, স্যর, আমার পকেট ভিজে গিয়েছে এই ইউসুফটা আমার পকেটে বরফের ঢেলা রেখেছিল। ইউসুফ আরও চেঁচিয়ে বলল, না স্যর, আমি রাখিনি। ছেলেটা আরও চেঁচিয়ে বলল, আলবাত তুই রেখেছিস।

ইউসুফ বলল, তোর ডান পকেট ভেজা, আমি তো বাঁ দিকে বসে আছি। ছেলেটা বলল, তুই না হলে বরফ আনল কে? তুই তো এক্ষুনি বেরিয়ে গিয়েছিলি।

হট্টগোলের ভিতর আমি যে তাবৎ তর্কাতর্কি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিলুম তা নয় কিন্তু কথা কাটাকাটিটা মোটের ওপর এইরকম ধারায়ই চলেছিল। বিশেষ করে শেষের যুক্তিটা আমার মনের ওপর বেশ জোর দাগ কাটল। ইউসুফ না হলে বরফের ঢেলা আনল কে? আর বরফ তো আগের থেকে ঘরে এনে জমিয়ে রাখা যায় না– গলে যায়।

রাগের ভান করে কড়া হুকুম দিলুম, ইউসুফ, তুই বেঞ্চির উপর দাঁড়া।

ইউসুফ বিন্দুমাত্র আপত্তি না করে তড়াক করে পলটনি কায়দায় বুট দিয়ে খটাস করে শব্দ করে বেঞ্চির উপর দাঁড়িয়ে ফের সেলট দিল। পূর্বেই বলেছি আফগানিস্তান মিলিটারি দেশ ছোট ছেলেরা পর্যন্ত পলটনি জুতা পরে আর হুকুম তামিল করার সময় পলটনি সেলুট ঠোকে।

ভাবলুম ইউসুফ আমাদের দেশের ছেলের মতো বসি, স্যর? বলে অনুনয় করবে। আদপেই না। চাঁদপানা মুখ করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। শেষটায় আমিই হার মানলুম। বললুম, বস্। আর ওরকম করিসনে। ইউসুফ আরেকবার সেলুট জানিয়ে বসে পড়ল।

বাড়ি ফেরার সময় বুঝতে পারলুম, সব দেশের খেলাধুলা যেরকম আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে, দুষ্টুমিটাও ঠিক সেরকম অনেকটা আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে। আমাদের দেশের ছেলেরা বরফের গুঁড়ো পাবে কোথায় যে তাই নিয়ে দুষ্টুমি করবে?

তার পর দু-তিন দিন ইউসুফ ঠাণ্ডা। ভাবলুম প্রথমদিনের সাজাতে হয়তো ইউসুফের আক্কেল হয়ে গিয়েছে। আর জ্বালাতন করবে না।

আমাদের দেশ গরম, তাই ঘরে ঘরে পাখার ব্যবস্থা থাকে। কাবুল ঠাণ্ডা, তাই সেখানে ক্লাসে ক্লাসে আগুন জ্বালাবার ব্যবস্থা। একদিন ক্লাসে ঢুকে দেখি ঘরভর্তি ধুয়ো, আর চিমনির আগুন নিভে গিয়েছে।

ছেলেরা কাশছে আর ইউসুফ পাতলুনের দুই পকেটে হাত পুরে অত্যন্ত বিষণ্ণ নয়নে তাকিয়ে আছে। দেশে টানাপাখার দড়ি ছিঁড়ে গেলে যেরকম চাপরাসির সন্ধানে ছেলে পাঠানো হয় আমি তেমনি বলোম, চাপরাসিকে ডাকো। ইউসুফকে পাঠানো আমার মতলব ছিল না। কিন্তু সে চট করে এক্ষুনি ডাকছি স্যর বলে হুট করে বেরিয়ে গেল। থামাবার ফুরসত পেলুম না।

মিনিট তিনেক পরে এলেন খু প্রিন্সিপাল। মুখে কেমন যেন একটু বিরক্তি। বললেন, আপনি নাকি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন? আমি তো অবাক!

সে কী কথা! আমি আপনাকে ডেকে পাঠাব কেন? আমার দরকার হলে আমি নিজেই তো আপনার কাছে যেতে পারি। আমি তো ডেকে পাঠিয়েছি চাপরাসিকে, আগুন নিভে গিয়েছে বলে। প্রিন্সিপালের মুখ থেকে বিরক্তির ভাব কেটে গিয়ে দেখা গেল রাগ। ইউসুফের দিকে ফিরে বললেন, তবে তুই আমাকে ডাকলি কেন?

ইউসুফ তার ড্যাবড্যাবে চোখ হরিণের মতো করুণ করে বলল, আমি তো শুনলুম, প্রিন্সিপাল সায়েবকে ডেকে নিয়ে আয়। তা কী জানি ওঁর ফারসি আমি ঠিক বুঝতে পারিনি হয়তো। প্রিন্সিপাল ইউসুফকে দুই ধমক দিয়ে চলে গেলেন।

কী ঘড়েল ছেলে রে বাবা! আমি বিদেশি বলে যে খুব ভালো ফারসি বলতে পারিনে তার পুরো সুযোগ নিয়ে সে আমাকে একদফা বোকা বানিয়ে দিল।

ততক্ষণে চাপরাসি এসে আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই আগুন জ্বলতে চায় না। ঘর আরও ধুয়োয় ভরে গিয়েছে। ছেলেরা কাশতে আরম্ভ করেছে, কারও কারও চোখ দিয়ে জল বেরুচ্ছে, আমার তো প্রায় দম বন্ধ হবার উপক্রম। চাপরাসি ততক্ষণে হার মেনে চলে গিয়েছে বুড়ো চাপরাসির সন্ধানে –সে যদি কিছু করতে পারে। ইউসুফ বলল, স্যর, জানালাগুলো খুলে দিই?

আমি বললুম, দাও। দম বন্ধ হয়ে তো আর মারা যেতে পারিনে।

এক মিনিটের মধ্যে হু হু করে ঠাণ্ডা হাওয়া ঘরের ভিতর ঢুকে আমাদের হাড়ে হাড়ে কাঁপন লাগিয়ে দিল। পড়াব কী, আর পড়বেই-বা কে? আমাদের দেশে যেরকম ভয়ঙ্কর গরমের দিনে ক্লাসের পড়ার দিকে মন যায় না, কাবুলে তেমনি দারুণ শীতের মাঝখানে পড়াশোনা করা অসম্ভব। হাতের আঙুল জমে গিয়েছে, কলম ধরতে পারছিনে, বইয়ের পাতা ওল্টানেনা যায় না। ছেলেরা ততক্ষণে আবার আপন আপন দস্তানা পরে নিয়েছে– আর দস্তানা-পরা হাতে লেখা, পাতা ওল্টানো, এসব কাজ আদপেই করা যায় না।

ততক্ষণে বুড়ো চাপরাসি এসেও হার মেনেছে। কিন্তু লোকটা বিচক্ষণ। খানিকক্ষণ চেষ্টা দেওয়ার পর বলল, ধুয়ো উপরের দিকে না উঠে ঘর ভরে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে ধুয়ো বেরোবার চোঙা কেউ বন্ধ করে দিয়েছে।

তদারক করে দেখা গেল বুড়ো ঠিক কথাই বলেছে। চোঙার ভিতরে, উপরের দিকে হাত চালানোতে বেরিয়ে এল একটা ক্যানাস্তারার টিন, ছেঁড়া কম্বল দিয়ে জড়ানো। বোঝা গেল, বেশ যত্নের সঙ্গে, বুদ্ধি খরচ করে চোঙাটি বন্ধ করা হয়েছে, যাতে করে ধুয়ে উপরের দিকে না গিয়ে সমস্ত ক্লাস ভরে দেয়।

আমি হুঙ্কার দিয়ে বললুম, চোঙা বন্ধ করল কে?

সমস্ত ক্লাস এক গলায় বলল, নিশ্চয়ই ইউসুফ। আর কে করতে যাবে?

ইউসুফের দুশমন গোলাম রসুল বলল, আমি যখন ক্লাসে ঢুকি তখন ইউসুফ ছাড়া আর কেউ ক্লাসে ছিল না। নিশ্চয়ই ও করেছে।

ইউসুফ বলল, আমি যখন ক্লাসে ঢুকলুম তখন গোলাম রসুল ছাড়া আর কেউ ক্লাসে ছিল না। নিশ্চয়ই ও করেছে।

গোলাম রসুল চটে গিয়ে বলল, মিথ্যেবাদী।

ইউসুফ মুরুব্বির সুরে বলল, এই, স্যরের সামনে গালমন্দ করিসনে।

কী জ্যাঠা ছেলে রে বাবা! বললুম, তুই এদিকে আয়।

কুইক মার্চে সামনে এসে সেলুট দিল। আমি বললুম, তোকে ভালোরকমের সাজা দেওয়া উচিত। আজকে সমস্ত ক্লাসের পড়া নষ্ট করেছিস। ঢোক গিয়ে টেবিলের তলায়। চুপ করে সেখানে বসে থাকবি, আর কথাটি কয়েছিস কি তোর গলা কেটে ফেলব।

সুড়সুড় করে টেবিলের তলায় গিয়ে ঢুকল।

কাবুলের ক্লাসে মাস্টারমশায়দের টেবিল বিলিতি কায়দায় বানানো হয়। অর্থাৎ তার তিন দিক ঢাকা। শুধু মাস্টার যেদিকে বসেন সেদিকটা খোলা। মনে কর খুব বড় একটা প্যাকিং কেসের ডালাটা খুলে নিয়ে তাই দিয়ে টেবিল বানাও আর খোলা দিকটায় পা ঢুকিয়ে দিয়ে বাক্সটা দিয়ে টেবিলের কাজ চালাও। আমি ঠিক তেমনি ভাবে বসে, আর ইউসুফ চুপ করে ভিতরে। নড়নচড়ন নট কিচ্ছ।

মনে হল ইউসুফের তা নিয়ে কোনও খেদ নেই; কারণ পঞ্চাশ মিনিটের পিরিয়ডের প্রায় আধঘণ্টা সে ধুয়ো, প্রিন্সিপাল, আর চাপরাসি দিয়ে বরবাদ করে দেবার বিমলানন্দ আপন মনে রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করছে।

আমি ছেলেদের পড়াতুম মুখে মুখে। চেঁচিয়ে বলতুম I go, সমস্ত ক্লাস আমার পরে বলত I go, আমি বলতুম We go, ক্লাস বলত We g০, এরমধারা you go, you go, কিন্তু Rahim goes, Karim goes, তার পর হুঙ্কার দিয়ে বলতুম Rahim and Karim go-0-0-0।

ওদিকে ইউসুফ চুপচাপ। জিগ্যেস করলুম– তুই বলছিস না কেন রে! বাক্সের অথবা টেবিলের, যাই বল– ভিতর থেকে ইউসুফের গলা শোনা গেল ও তো আমি জানি। আমি বললুম, বলে যা, সে সমস্ত কনজুগেশনটা ভুল না করে গড় গড় করে আবৃত্তি করে গেল। হু! ছেলেটা শয়তান বটে, কিন্তু পড়াশোনায় ভালো।

ঘণ্টা পড়ল। বললুম, ইউসুফ বেরিয়ে আয়। সুড়ুৎ করে বেরিয়ে এল। বললুম, বল্ আর কখোনও করবিনে। কী যেন একটা বিড়বিড় করে বলল, ঠিক বুঝতে পারলাম না।

ততক্ষণে ক্লাস ডিসমিস করে দিয়েছি বলে সে একটা ছোটাসে ছোটা সেলুট সেরে ডবল মার্চ করে বেরিয়ে গিয়েছে। তখন বুঝতে পারলুম, দুষ্টুমি করবে না এ প্রতিজ্ঞা করতে সে নারাজ, তাই তাড়াতাড়ি কেটে পড়েছে।

রেজিস্টার, বই, খড়ি, ডাস্টার গুছিয়ে নিয়ে যেই দাঁড়াব বলে টেবিলের তলা থেকে পা টেনে আনতে গিয়েছি অমনি দু পা-ই আটকা পড়ে গেল। কী ব্যাপার! ঘাড় নিচু করে দেখি, আমার দু জুতোর দুই ফিতে একসঙ্গে বাঁধা।

কী করে হল? এ তো বড় তাজ্জব! অবশ্যি, বুঝতে সময় লাগল না। আমার অভ্যাস পা দু-খানি একজোড় করে বসার। ইউসুফ তারই সুবিধে নিয়ে অতি আস্তে আস্তে ফিতের গিঠ খুলে দু ফিতে অর্থাৎ দুই জুতো একসঙ্গে বেঁধে দিয়েছে! আর সে এমনি মোলায়েম কায়দায় যে, আমি কিছুই টের পাইনি!

আমি হার মানলুম।

বাড়ি ফেরার পথে দূর থেকে দেখি, বাড়ির দেউড়ির সামনে ইউসুফ আমার চাকর আব্দুর রহমানকে হাত-পা নেড়ে কী সব বোঝাচ্ছে, আর বিরাট-বপু আব্দুর রহমান সর্বাঙ্গ দুলিয়ে হেসে কুটিকুটি। আমাকে দেখেই ইউসুফ চটপট চম্পট।

পরদিন কলেজে যাবার সময় আব্দুর রহমান জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে বলল, একরকম বোতামওলা বুট ফিতেওলা জুতোর চেয়ে ভালো।

আমি চটে গিয়ে বললুম, বস্ বস্, আর জ্যাঠামো করতে হবে না।

Exit mobile version