এখনও যা-কিছু আছে তাই নিয়ে শ্রীযুত বন্ধুবিহারী প্রামাণিক নিবন্ধ লিখতে পারবেন। কোন লেখা কোন উপলক্ষে লেখা হয়েছিল, কোন ব্যঙ্গচিত্র আঁকবার সময় কাকে তিনি মনে মনে সামনে দাঁড় করিয়েছিলেন, কীভাবে সমাজের কোন গুপ্ত পাপাচার তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, এর বেশিরভাগই একমাত্র তাঁরই জানার কথা। এবং চিকিৎসাশাস্ত্রের এত বড় পণ্ডিত, অধ্যাপক ওই বিষয়ে কখনও কিছু লেখেননি এটা কেমন জানি বিশ্বাস করতে অসুবিধা হয়। আমি নিজে জানি, ছাত্রদের দুই ধরনের ব্যান্ডেজ শিখিয়ে তাদের নাম বলে, দোষগুণ আপন অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ দিয়ে যাচাই করার পর একটা তৃতীয় ব্যান্ডেজ হয়তো শেখালেন। কোনও বুদ্ধিমান ছেলে হয়তো লক্ষ করল এটার নাম তিনি বলেননি; শুধোলে পর বলতেন, ওহ! দ্যাট ওয়ান? ওটা ব্যান্ডেজ আ লা বনবিহারী (তিনি নিজের চেষ্টায় সুন্দর ফরাসি শিখেছিলেন ও উচ্চারণটিও তার চমৎকার ছিল। আমি ফরাসি শিখতে আরম্ভ করেছি জেনে তিনি আমাকে মপাস পড়ে শুনিয়েছিলেন; নতুবা নিতান্ত বাধ্য না হওয়া পর্যন্ত বনবিহারী আপন বৃহৎ-ক্ষুদ্র সর্বকৃতিত্বই লুকিয়ে রাখতেন)।
বনবিহারী সম্বন্ধে প্রামাণিক কিছু লেখা প্রায় অসম্ভব। কারণ প্রায় অসম্ভব শুধুমাত্র তার প্রকাশিত লেখা ও ব্যঙ্গচিত্র জোগাড় করা। বেনামে ছদ্মনামে তো লিখেছেনই, তদুপরি নিজের সৃষ্টির প্রতি তাঁর কোনওপ্রকারের মোহ ছিল না বলে সেগুলোকে তাদের ন্যায্য সম্মান দেবার জন্য তিনি কোনও চেষ্টা তো করতেনই না, উল্টো নিতান্ত অজানা অচেনা কাগজে প্রায়ই বাছাই বাছাই লেখা ছাপিয়ে দিতেন। এবং আমার জানতে সত্যই ইচ্ছে করে, তিনি তার লেখার জন্যে কখনও কোনও দক্ষিণা পেয়েছেন কি না।
উপস্থিত আমি শুধু তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয়ের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ নিবেদন করছি; যদি কোনওদিন তাঁর প্রকাশিত রচনা ও ছবির দশমাংশের এক অংশও জোগাড় করতে পারি তবে তার জীবন-দর্শন সম্বন্ধেও কিছু পেশ করার ভরসা রাখি। অথবা হয়তো তখন দেখব, তাঁর জীবন-দর্শন ছিল যে, মানুষের পক্ষে কোনও প্রকারের শাশ্বত জীবনদর্শনে পৌঁছনো সম্পূর্ণ অসম্ভব, কারণ শাশ্বত বলে কোনও বস্তু, ধারণা বা আদর্শ এ-সংসারে আদপেই নেই।
ভ্যানিটি অব ভ্যানিটিজ অল ইজ ভ্যানিটি বাইবেলের এই আপ্তবাক্য তার মুখ দিয়ে বলাতে আমার বাধছে, কারণ নাটকীয় ভঙ্গিতে কোনও জিনিসই প্রকাশ করাতে তাঁর ঘোর আপত্তি। কারণ এসব ভঙ্গি, স্টাইল, পোজ থেকে উদ্ভূত হয় ধর্মগুরুর দঙ্গল এবং বনবিহারীর সুদৃঢ় ধারণা ছিল যে তাঁদের সম্বন্ধে আমরা যত কম শুনতে পাই ততই ভালো। বলার মতো বিশেষ কিছু তো নেই–হয়তো বলতেন বনবিহারী– তা হলে বলতে গিয়ে অত ধানাইপানাই কেন?
বৃষের মতো স্কন্ধ, আজানুলম্বিত বাহু– এসব শাস্ত্রসম্মত লক্ষণ দিয়ে বিচার করলে বনবিহারী নিশ্চয়ই সুপুরুষের পর্যায়ে পড়তেন না, তৎসত্ত্বেও বলি, বনবিহারীর মতো অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত, তেজন সুপুরুষ আমি দেশ-বিদেশে অতি অল্পই দেখেছি। বাঙালি ফর্সা রঙ পছন্দ করে, কিন্তু বনবিহারীর গৌরবর্ণ আমি অন্য কোনও বাঙালির চর্মে দেখিনি। বলা বাহুল্য যে, সে বর্ণ ইংরেজের ধবলকুষ্ঠ শ্বেত নয়। গৌর হয়েও সে বর্ণে ছিল কৃষ্ণের স্নিগ্ধতা। তপ্তকাঞ্চন তো সে নয়ই, চাঁদের অমিয়াসনে চন্দন বাটিয়াও সে বর্ণ মাজা হয়নি। নদীয়ার গোসাঁইকে আমি দেখিনি, কিন্তু তাঁকে কল্পনায় দেখতে গেলে তার অঙ্গে আমি বনবিহারীর বর্ণ চাপাই। তার চুল ছিল কটা। আমি একদিন তাকে বলেছিলুম, ঋগ্বেদে না কোথায় যেন অগ্নির দাড়িকে রক্তবর্ণ বলা হয়েছে; আপনি দাড়ি রাখলে সেটা ক্রমে ক্রমে রক্তবর্ণ ধারণ করবে। আমার সত্যই মনে হত কেমন যেন এক অলৌকিক প্রক্রিয়ায় কী যেন এক অ্যাটাভিজমের ফলে তিন হাজার বৎসর পর আর্য ঋষি গৌড়দ্বিজের গৃহে আবির্ভাব হয়েছেন। বনবিহারী তার স্বভাবসিদ্ধ তর্কজাল বিস্তার করে পর্যায়ক্রমে, অপ্রমত্ত চিত্তে যে-সিদ্ধান্তটি সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন তার অর্থ : যারা বলে বাঙালির গায়ে কিঞ্চিৎ আর্যরক্ত আছে এটা তাদের ভ্রম– যারা বলে বাঙালি পরিপূর্ণ আর্য তাদের ভ্রমের চেয়েও মারাত্মক দুষ্টবুদ্ধিজাত ভ্রম।
ওই সময়ে আমি রেনার খ্রিস্ট-জীবনী পড়ি অধ্যাপক হিড়জিভাই মরিসের কাছে। প্রথম অধ্যায়েই তিনি লিখেছেন যে তোক মানুষে মানুষে পার্থক্য ঘোচাবার জন্য সর্বাধিক প্রচেষ্টা দিয়েছেন (অর্থাৎ খ্রিস্ট) তাঁর ধমনীতে কোন্ জাতের রক্ত প্রবাহিত সে অনুসন্ধান করতে যাওয়া অনুচিত। বনবিহারী সমস্ত জীবন ধরে বিস্তর অক্লান্ত জিহাদ লড়েছেন, কিন্তু বর্ণবৈষম্য চোখে পড়লেই তিনি নিষ্কাশিত করতেন শাণিততম তরবারি। এস্থলে বলে রাখা ভালো, বনবিহারী তাঁর জিহাদ চালাতেন হৃদয়হীন যুযুধানের মতো। তাই সত্যের অপলাপ না করে অনায়াসে বলতে পারি, তার মতো মিলিটেন্ট নাস্তিক এদেশে তো কখনওই জন্মায়নি, বিদেশেও নিশ্চয়ই মুষ্টিমেয়। পিসফুল কো-এগৃজিস্টেন নীতিটি তিনি আদপেই বরদাস্ত করতে পারতেন না। তিনি ছিলেন হাসপাতালের ভিতরে-বাইরে সর্বত্রই, এবং টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স ডিউটির সার্জন। তাঁর বক্তব্য, তোমার পায়ে হয়েছে গ্যাঙরিন, সেটা আমি কেটে ফেলে দেব। গ্যারিনের সঙ্গে আবার পিসফুল কো-এগৃজিস্টেনস্ কী? কিন্তু পাঠক ভুলে ক্ষণতরেও ভাববেন না, বনবিহারী অসহিষ্ণু ছিলেন। এর চেয়ে বৃহত্তর, হীনতর মিথ্যা ভাষণ কিছুই হতে পারে না। তুমি আস্তিক। তোমার মস্তিষ্ক থেকে আমি সেই অংশ ছুরি দিয়ে কেটে ফেলব। কিন্তু তোমার প্রতি আমি অসহিষ্ণু হব কেন? বস্তুত চিকিত্সক বলে আমার সহিষ্ণুতা অনেক বেশি। তোমার পরিচিত কারও সিফিলিস হলে তুমি শুধু সিফিলিস না, সেই লোকটিকেও বর্জন কর। আমি সিফিলিস দূরীভূত করি, কিন্তু সে হতভাগ্যকে তো দূর দূর করে দূরীভূত করার চিন্তা আমার স্বপ্নেও ঠাই দিই না। প্লেগ এলে তুমি এ শহরের নাগরিকদের বিষবৎ বিবেচনা করে তাদের বর্জন কর; আমি তা করিনে। এবং আমি ব্যক্তিগতভাবে শপথ করতে রাজি আছি এটা তার বাগাস্কালন নয়। কাব্যে আমরা বাক্ ও অর্থের সমন্বয় অনুসন্ধান করি, জীবনে করি বাক ও কর্মের। এ দুটির সমন্বয় বনবিহারীতে প্রকৃতিগত ছিল। বলতে যাচ্ছিলুম বিধিদত্ত, কিন্তু তার আত্মাকে ক্ষুব্ধ করতে চাইনে। আবার ভুল করলুম, তিনি আত্মাকে বিশ্বাস করতেন না, কাজেই হাওয়ার কোমরে রশি বাধার মতোই তাঁর আত্মাকে নিপীড়িত করার সম্ভাবনা!