এর পরের ইতিহাস আরও চমকপ্রদ, আরও অচিন্ত্যনীয়। কিন্তু তার ভিতর খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে যাবেন, কিন্তু এরকম কৌতুকজনক বড়-কিছু একটা পাবেন না। আমি একেবারে কিছু পাইনি। শুধু খুন আর লড়াই। নৃশংস আর বীভৎস। আমি তাই বাকিটা সংক্ষেপেই বলি– নিতান্ত যারা ছোটগল্প পড়ার পরও শুধোন, তার পর কী হল? তাঁদের জন্য।
সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় শত্রুর শেষ রাখতে নেই বলে ফাঁসুড়ে পাঠিয়ে ফররুখসিয়ারকে খুন করালেন। এক বছরের ভিতরই ধরা পড়ল রফি-উদ-দরজাতের যক্ষ্মা। সে বছর যেতে না যেতেই তিনি মারা গেলেন। মারা যাওয়ার পূর্বে তিনি তার বড় ভাই রফি-উল-দৌলাকে সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে গেলেন। তিনিও ওই বৎসরই মারা গেলেন। তার পর বাদশা হলেন মুহম্মদ শাহ বাদশাহ। তিনি প্রায় ত্রিশ বৎসর রাজত্ব করেন। ইতোমধ্যে সৈয়দ ভ্রাতাদের দুর্দিন ঘনিয়ে এল। একজন আততায়ীর ছুরিকাঘাতে নিহত হলেন, অন্যজন বন্দি অবস্থায় বিষপ্রয়োগবশত।
বস্তুত এ যুগের ইতিহাস পড়লে বার বার স্মরণে আসে :
রাজত্ব-বধূরে যে-ই করে আলিঙ্গন।
তীক্ষ্ণধার অসি পরে সে দেয় চুম্বন!
একটি অনমিত নাম : বনবিহারী মুখোপাধ্যায়
স্বর্গীয় লিখতে গিয়েই কলম থেমে গেল; এমনকি ক্ষণজন্মা, পুরুষসিংহ বনবিহারী মুখোপাধ্যায় পরলোক গমন করেছেন– এটা লিখতেও বাধো-বাধো ঠেকছে, কারণ বনবিহারী স্বর্গ, পরলোক, আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না।
বনবিহারীর পূর্ণাঙ্গ জীবনী লেখা প্রায় অসম্ভব, কারণ চাকরিজীবনে তাকে বাধ্য হয়ে আজ পাকশী, কাল মৈমনসিং, পরশু বগুড়া করতে হয়েছে এবং অসময়ে বেকসুর বদলি হলেও তিনি হয়তো প্রতিবাদ জানাতেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনও মেহেরবানি চাইতেন না। বনবিহারী এ জীবনে কারও কাছ থেকে কোনও ফেবার চাননি, এবং ভগবানের কাছ থেকে অতি অবশ্য, নিশ্চয়ই না। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি সর্বপ্রথম কোথায় যান জানিনে, কিন্তু তার পরই চলে যান দেরাদুনে। সেখানে বেশ কয়েক বৎসর একটানা হোটেলে বাস করার পর হঠাৎ চলে যান বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, আন্দামান। স্বেচ্ছায় এবং অতিশয় প্রসন্ন চিত্তে। বলা বাহুল্য, সেখানে রোমান্সের সন্ধানে যাননি। কাব্যে, সাহিত্যে তিনি কতখানি রোমান্টিসিজম বরদাস্ত করতেন বলা কঠিন, কিন্তু সংসার-জীবনে তিনি রোমান্টিসিজমের পিছনে দেখতে পেতেন, make belief, সত্য থেকে আত্মগোপন, একেপিজম এবং ভণ্ডামি এবং এর সবকটাকেই তিনি অত্যন্ত কুটিকুটিল নয়নে তিরস্কার জানাতেন। তার পর হঠাৎ একদিন তিনি আবার ভারতে ফিরে এলেন। বৃদ্ধ বয়সে তার বাসস্থান পরিবর্তন আমাকে বড় পীড়া দিত। তাই তাঁকে অনুরোধ জানালুম, তিনি যেন দয়া করে আমার সঙ্গে বসবাস করেন। উত্তম হোক মধ্যম হোক, আমি মোগলাই, বিলিতি কিছু কিছু রাধতে পারি; সে সময়ে আমার বাসস্থানটি ছিল প্রশস্ত ও নির্জনে– শুশানের কাছে অবস্থিত। আমার নিজস্ব বই তো ছিলই, তদুপরি তার পরিচিত একটি লাইব্রেরি কাছেই ছিল। অবশ্য সর্বপ্রধান প্রলোভন ছিলেন তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা শ্ৰীযুত বিনোদবিহারী মুখুয্যে। তাঁর বাসাও নিকটে। এই ভাইটিকে বনবিহারী আপন হাতে মানুষ করেন এবং সে যেন ধর্ম, ঈশ্বর, পরকাল, উপাসনা ইত্যাদি সর্বপ্রকার সংস্কার থেকে মুক্ত থাকে সে জন্য কোনও ব্যবস্থার ত্রুটি করেননি। বিনোদবিহারীর ডাকনাম নন্তু। বনবিহারী তাকে ডাকতেন নাস্তিক বা নাস্তে। আমার বাড়িতে এসে বাস করলে তিনি যে তাঁর নাস্তেকে অক্লেশে দু বেলা দেখতে পাবেন সেইটেতে বিশেষ জোর দিয়ে আমি আমার চিঠিতে নিবেদন জানিয়েছিলুম। বিনোদবিহারী প্রায় দশ বত্সর পূর্বে তাঁর চোখের জ্যোতি সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেন; তাই তাঁর পক্ষে অগ্রজ সন্নিধানে যাওয়া কঠিন ছিল।
আমি ক্ষীণ আশা নিয়েই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলুম, কারণ আমি তাঁর কৃতবিদ্য, বিত্তশালী, পিতৃভক্ত পুত্রকে উত্তমরূপেই চিনি। তাঁর শত কাতর অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি পুত্রের গৃহে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে রাজি হননি। আমার আশা ছিল, আমি তাঁর কেউ নই, তিনি জানতেন যে আমি ধর্মে, সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী একটি আস্ত জড়ভরত হওয়া সত্ত্বেও তাকে অবিচল ভক্তি করি, এবং দাসের মতো সেবা করব; বিশ্বসংসার নিয়ে তার যত রকমের সমালোচনা, ব্যঙ্গবিদ্রূপ আমি সহাস্য বদনে শুনেছি এবং শুনব এবং তর্কযুদ্ধ করার মতো লোকের অভাব হলে আমাকে দিয়েও কিছুটা কাজ চলবে– তিনি জানতেন, আমার জীবন কেটেছে তুলনাত্মক ধর্ম চর্চায়।
তিনি এলেন না সত্য, কিন্তু আমাকে একটি অতিশয় প্রীতিপূর্ণ (তিনি সেন্টিমেন্টের আতিশয্য এতই অপছন্দ করতেন যে, সেফসাইডে থাকার জন্য সেটা বাক্যে, পত্রে সর্বত্র বর্জন করতেন) পত্র লিখে জানালেন, তোমার নিমন্ত্রণ মনে রইল, সময় হলেই আসব।
আমার ক্ষোভ-শোকের অন্ত নেই যে তার সময় আর হল না। মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিই, আমি কে যে তিনি আমার সেবা গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করতেন।
শেষদিন পর্যন্ত, এতসব ঘোরাঘুরির মাঝখানেও সর্বত্র তাকে সঙ্গ দিয়েছেন তাঁর ভ্রাতা শ্ৰীযুক্ত বন্ধুবিহারী। বনবিহারীর অধিকাংশ লেখাই ছাপাখানা পর্যন্ত পৌঁছত না। প্রকাশিত হলে ফাইলে রাখতেন না, নিতান্ত অন্তরঙ্গ বন্ধুকেও বলতেন না, অমুক কাগজে আমার লেখা বেরিয়েছে, পড়ে দেখ। তাঁর পরিপকু যৌবনে কিন্তু তিনি আমাদের মতো বালকদের প্রতি সদয় ছিলেন। সম্পূর্ণ, অসম্পূর্ণ বহু লেখা তিনি সোৎসাহে আমাদের পড়ে শুনিয়েছেন।