এই হুঁশিয়ারি, এই দিব্যিদিলাশা যেন তিলিস্মাৎ-ভানুমতীর কাজ করল।
দূতদের দুজনার দৃষ্টি হঠাৎ গেল সেই দামনে-দানা-ভরা বালকটির দিকে। লাফ দিয়ে পড়ল সেই দুই নরদানব তার উপর। এক ঝটকায় তাকে কাঁধে ফেলে দে-ছুট দে-ছুট দেউড়ির দিকে, দেউড়ি ছাড়িয়ে রাস্তা পেরিয়ে আল্লায় মালুম কোন দিকে! কী যে ঘটল কিছুই বোঝা গেল না। সঙ্গে সঙ্গে উঠল বামাকুলের আর্তনাদ ইয়াল্লা, এরা যে রফি-উদ্-দরজাৎকে নিয়ে গেল রে। ধরো, পাকড়ো ওদের। পাকড়ো পাকড়ো, জানে ন্ পায়, যেতে না পায় যেন! ইয়া রহমান, ইয়া রহিম।
কিন্তু কে ধরে তখন কাকে?
হারেমের মেয়েরা ভাবতেই পারেননি যে, রফি-উশ-শানের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র নাবালক বাচ্চা রফি-উদ্-দরজাকে ধরে এরা চম্পট দেবে। যতক্ষণ এরা জেনানা জঙ্গিলাট হয়ে সার্বভৌম মহম্মদ ইব্রাহিম আর মধ্যম রফি-উদ্-দৌলাকে পঞ্চত্ব, কমসেকম অন্ধত্ব থেকে রক্ষা করেছিলেন, ততক্ষণে, যার নিরাপত্তা সম্বন্ধে কোনও ভয়-ভীতি ছিল না, সেই সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা রফি-উদ্-দরজাৎকে নিয়ে দুশমন উধাও হয়ে গিয়েছে।
আজব সেই লড়াই তাজ্জবভাবে ফৌরন থেমে গেল। দোস্ত-দুশমন কোনও পক্ষের কেউ মারা গেল না, হার মানল না, সন্ধি করল না, ধরা দিল না– আচানক্ সবকুচহ্ বিলকুল ঠাণ্ডা!
সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় দিওয়ান-ই-আম্ থেকে নহবখানা পর্যন্ত পাইচারির বদলে ছুটোছুটি আরম্ভ করেছেন। এঁরা বিস্তর লড়াই লড়েছেন, জীবন এঁদের বহুবার বিপন্ন হয়েছে, কিন্তু এবারে তারা যেরকম ঘেমে-নেয়ে কাঁই হয়ে গেলেন এরকমটা আর কখনও হননি। ক্রোধে, জিঘাংসায় তারা শুধু একে অন্যকে বলছেন, যে-কটা না-মর্দকে তারা পাঠিয়েছিলেন তাদের জ্যান্ত শরীর থেকে চামড়া তোলবার হুকুম দেবেন, নয় ফোঁটা ফোঁটা গরম তেল তাদের ব্রহ্মতালুতে ঢেলে ঢেলে নিধন করবেন।
এমন সময় সেই দুই পাহলোয়ান এসে উপস্থিত শাহজাদা রফি-উদ্-দরজাৎকে সঙ্গে নিয়ে।
শাহজাদা হোক আর ফকিরজাদাই হোক, সে কিন্তু পুঁটুলি পাকিয়ে দু হাত দিয়ে জোরে পাকড়ে আছে পায়রার দানা-ভর্তি তার কোঁচড়। এসব বাদশা-উজিরের ব্যাপার দিল্লি শহরে এখন আছে তো তখন নেই কিন্তু পায়রার দানা কটি পায়রার দানা, শাহজাদা মিয়া রফির কাছে এটা ভয়ঙ্কর সত্য।
ইতোমধ্যে সৈয়দ ভায়ারা হুঙ্কার দিয়ে উঠেছেন, কম্বৎ, না-দা– এ কাকে ধরে এনেছ তোমরা? বাদশা হবেন বড় ভাই, ধরে আনলে ছোটটাকে! তোমাদের জ্যান্ত না পুঁতলে–
সৈয়দদ্বয় তখন নাগরিক, ফৌজদার এমনকি তৈমুরের বংশধর, বাবুর-হুমায়ুনের পুত্র-পৌত্র বাদশাহ-সালামদের ও জান-মালের মালিক। এসব কথা দূত দুটি ভালো করেই জানে। কিন্তু আজকের আঁটার মার তাদের করে দিয়েছে বেপরোয়া। চরম বিরক্তি আর তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, যা পেয়েছেন তাই নিয়ে সন্তুষ্ট হোন। আর আমাদের মারুন আর কাটুন, যা খুশি করুন।
দুই ভাই তাড়াতাড়িতে ব্যাপারটা জানতে পেরে বুঝলেন, এখন আবার নতুন করে পাইক-বরকন্দাজ পাঠিয়ে বড় দুই ভাইয়ের একজনকে তারা ইব্রাহিমের চেয়ে রফি-উদ-দৌলাকে পছন্দ করেছিলেন বেশি– ধরে আনাতে সময় লেগে যাবে বিস্তর। আজকের ভাষায় ততক্ষণ টাইম-বম্ ফেটে যাবে।
একে দিয়েই তা হলে কাজ চালিয়ে নিতে হবে। গত্যন্তর কী?
আর ও নিয়ে মাথা ঘামিয়েই-বা লাভ কী? ইব্রাহিমই হোক আর রফি-উদ্-দৌলাই হোক, যেই হোক, তাকে তো হতে হবে ওঁদের হাতেরই পুতুল। সে পুতুল তার মায়ের গর্ভ-ফ্যাক্টরি থেকে পয়লা চালানে বেরিয়েছে, না তেসরা কিস্তিতে তাতে কীই-বা যায় আসে? ফরাসি সম্রাটের চেয়েও সরল কণ্ঠে তখন তারা বলতে পারতেন, লে তা সে নু ভারতবর্ষ? সে তো আমরা দু ভাই! বাদশাহ যে কোনও গড়-ড্যাম আওরঙ্গজেব-বংশের গর্ভস্রাব।
নবীন রাজার অভিষেকের জন্য দুই ভ্রাতা তাঁর দুদিকে চলেছেন রাজার দুই বাহু ধরে। আল্লা জানেন, কার আদেশে তাঁর দুই বদ্ধমুঠি শিথিল করার ফলে এই এখন পায়রার দানা ঝরঝর করে দিওয়ান-ই-আমের পাথরের মেঝেয় ছড়িয়ে পড়ল।
চতুর্দিকে সৈয়দদের মিত্র ও পরামর্শদাতা আমির-ওমরাহ তাদের মহামূল্যবান কিংখাবের পাগড়ি, শুভ্র মলমলের আঙ্গারাখা, তার ভিতর দিয়ে ফুটে বেরুচ্ছে নিচের সাচ্চা জরির বোনা সদরিয়ার সোনালি আভা, কোমরে কাশ্মিরের সর্বশ্রেষ্ঠ শাল দিয়ে তৈরি কোমরবন্ধ, তার বা দিকে গোঁজা জাতির মতো জামৃদর অস্ত্র, ডাইনে ঝুলছে দিমিশকের তলোয়ার খাপের উপর মুষ্টিতে বিচিত্র মণিমাণিক্যের জড়োয়া কাজ, পরনে সাটিনের পায়জামা, পায়ে জরির কাজ করা শুড়-তোলা সিলিমশাহি। উষ্ণীষে মুক্তোর সিরর্পেচ, বুকে মোতির হার, হাতে হীরের আংটি।
এদের ভিতর দিয়ে চলেছেন বাদশাহজাদা। পরনে নুনময়লা পাজামা, গায়ে মামুলি কুর্তা। ব্যস। পাঁচ লহমা পরে যিনি হবেন দিল্লিশুরো বা জগদীশুরো বা! এ যে জগদীশ্বরের কৌতুকবোধের চূড়ান্ত নিদর্শন।
সৈয়দদের একজন শাহজাদার মাথায় বসিয়ে দিলেন তাঁর আপন পাগড়ি মস্তকাভরণহীন অভিষেক কল্পনাতীত। সেই বিরাট সাইজের পাগড়ি শাহজাদার কানদুটো গিলে ফেলল। অন্য ভ্রাতা তাঁর মুক্তোর সাতলখা হার পরিয়ে দিলেন তাঁর গলায়। ময়লা কুর্তার উপর সে মালা দেখাল ঘোলা জলের উপর রাজহংস!
এবং রফি-উদ্-দরজাৎ এই বেশেই বসলেন– যা-তা সিংহাসনের উপর নয়– আসল ময়ূর-সিংহাসনের উপর। এ-ও আরেক রঙ্গ। কারণ সচরাচর মোগল বাদশারা বসতেন আটপৌরে সিংহাসনের উপর। ফররুখসিয়ারের অভিষেকের বাত্সরিক পরব না অন্য কোনও উপলক্ষে তোষাখানা থেকে আগের দিন ময়ূর-সিংহাসন আনানো হয়েছিল; সেটা তখনও তোষাখানায় ফেরত পাঠানো হয়নি বলে যেন কন্ট্রাস্টটা চরমে পৌঁছনোর জন্য পাজামা-কুর্তা পরে শ্ৰীযুত রফি বসলেন তারই উপর!