অবশ্যই পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, ফররুখসিয়ায়কে হারেমের ভিতর থেকে ধরে আনা গেল, আর এখন এই চ্যাংড়াটাকে কাবু করা যাচ্ছে না?
ব্যাপারটা সরল। ফররুখসিয়ারের হারেমের তুর্কি রমণীরা যে বাদশার সঙ্গে সঙ্গে সর্ব সম্মান হারিয়ে বসেছেন। এরা বাধা দিলে সেপাইরা তাদের ওপর প্রয়োগ করবে পশুবল। এরা জানে দুদিন বাদেই এইসব নিষ্প্রভ, হতজ্যোতি, লুপ্তসম্মান সুন্দরীদের পাঠিয়ে দেওয়া। হবে সোহাগপুরাতে। আল্লা জানেন কোন কারসিক এই পরিত্যক্তা রমণীদের দীনদরিদ্র নির্লজ্জভাবে অবহেলিত শেষ আশ্রয়স্থলকে সোহাগপুরা নাম দিয়েছিল। এরা সেখানে পাবেন সে গ্রাসাচ্ছাদন। তার বীভৎস বর্ণনা থেকে আমি পাঠককে নিষ্কৃতি দিলুম।… কিন্তু যে ইব্রাহিম এখন রাজা হতে চললেন তাঁর মুরুব্বিদের তো ভিন্ন শিরঃপীড়া।
তাই নতুন রাজাকে আনতে গিয়ে দূতদের প্রাণ যায় যায়। মরিয়া হয়ে তাঁর মা, মাসি, জ্যেঠি, খুড়ি এককথায় তাবৎ রমণীরা আরম্ভ করেছেন দূতের গুষ্টিকে বেধড়ক ঠ্যাঙাতে। হেঁড়া জুতো, খোঁচা-খোঁচা খ্যাংরা-খররা হেন বস্তু নেই যা দিয়ে তাঁরা ওদের পেটাতে কসুর করছেন। বেচারিরা খাচ্ছে বেদরদ মার, দু হাত দিয়ে যতখানি পারে সে মার ঠেকাবার চেষ্টা করছে। একখানা কাঠির ঝাটার সপাং করে মুখের উপর মার– সেটা কোন জঙ্গিলাটের কোন অস্ত্রের চেয়ে কম! বেচারিরা এদের গায়ে হাত তোলা দূরে থাক, ঠেলাটি পর্যন্ত দিতে পারে না। কালই তো এরা লালকেল্লার প্রাসাদে গিয়ে আবাস নেবেন। তখন বেচারিদের হালটা হবে কী? খুদ বাদশা সালামতের পিসিকে মেরেছিল ধাক্কা, খুড়িকে মেরেছিল কনুই দিয়ে গুত্তা— বেয়াদবি বেতমিজি তবে আর কাকে বলে! বন্দ কর ব্যাটাদের পিঞ্জরা সেঁ, ঝুলিয়ে রাখো বদমাইশদের লাহোরি দরওয়াজার উপর! সৈয়দ-ভায়ারা কি তখন আর তাদের স্মরণে আনবেন।
এই একতরফা জেনানা আক্রমণ, তথা গৃহনির্মিত সাতিশয় মারাত্মক অস্ত্র-শস্ত্রের দফে দফে বয়ান প্রত্যেক ঐতিহাসিক দিয়েছেন বড়ই প্রেমসে। এই মারপিটের বর্ণনাতে পৌঁছে এ যুগের ঐতিহাসিকরা ভাবেন, তারা যেন বেহেশতে পৌঁছে গেছেন—নড়বার নামটি পর্যন্ত করেন না।
আর আর্তচিৎকার উঠছে সম্মার্জনী-লাঞ্ছিত হতভাগ্যদের দোহাই আল্লার, কসম আল্লার, পয়গম্বর সাক্ষী, আমরা কোনও কুমতলব নিয়ে আসিনি। আমরা এসেছি হুজুরকে তার ন্যায্য তখৃতের উপর বসাতে। কিন্তু অরণ্যে রোদন আর জনারণ্যে রোদনে ফারাক থাকলে জনসমাবেশকে অরণ্য নাম দেওয়া হল কেন?
ওদিকে দুই কিং-মেকার্স বা রাজা নির্মাণের রাজমিস্ত্রি মহা প্রতাপান্বিত শ্ৰীযুত সৈয়দ আব্দুল্লা ও সৈয়দ হুসেন আলি লালকেল্লার দিওয়ান-ই-আম-এর ভিতর বসে আছেন যেন কাঠ-কয়লার আগুনে আঙ্গিঠার উপর। দূতের পর দূত পাঠিয়ে যাচ্ছেন রফি-উশ-শানের হাভেলিতে, কিন্তু সে যেন সিংহের গুহাতে মানুষ পাঠানো। কেউই আর ফিরে আসে না। যে যায়, সে-ই বঁটা-পেটার দয়ে লীন হয়ে যায়, কিংবা রাস্তা দিয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে অগুরু-চন্দনকাঠের ভাষায় বোঝাতে চেষ্টা করে যে, প্রতিটি মুহূর্ত জীবন-মরণ সমস্যা সঙ্কটময় করে তুলছে। ভিতরে একপাল লোক ছুটেছে গুপ্তঘরের সন্ধানে, তাঁদের পিছনে ছুটেছে জেনানা-রেজিমেন্ট পেটিকোট-পল্টন আসমান-ফাটানো চিল্লি-চিৎকার করতে করতে। সর্বপ্রকারের সংগ্রামনভিজ্ঞ আপনাদের সেবক, এই দীন লেখক, তাদের হাতে যেসব মারণাস্ত্র আছে, তাঁদের রণকৌশল, বৃহনির্মাণাদির আর কী বর্ণনা দেবে? বাবুর্চিখানার খুন্তি সাঁড়াশি থেকে আরম্ভ করে সেই মোগল যুগে কত কী থাকত তার বর্ণনা দেব নিরীহ বাঙালি, আমি! মাশাল্লা!
চতুর্দিকে, আকাশে-বাতাসে সেই অভূতপূর্ব উত্তেজনা, দ্রুতগতিতে ধাবমান বহুবিধ নরনারী, চিৎকার আতাঁরব, আল্লার শপথ, রসুলের নামোচ্চারণ, হজরত আলির অনুকম্পার জন্য করুণ ফরিয়াদ, মহরমের দিনের ইমাম হাসান-হুসেনের ঝাণ্ডা নিয়ে কাড়াকাড়ি যেন, এমন সময়
এমন সময় অতি ধীরে ধীরে একটি বালক বালকই বটে, কারণ সে অজাতশত্রু অজাতগুফ– ওই যে হোথা মুদির দোকান দেখা যাচ্ছে, সেখান থেকে ধীরে ধীরে এই হাভেলির সামনে এসে একবারমাত্র সেই হুলস্থুল কাণ্ডের দিকে একটা শান্ত দৃষ্টি ফেলে বাড়িতে ঢুকল। তার পরনে নুনময়লা সুতির পাজামা, তার উপর একটা অতি সাধারণ কুর্তা। মাথায় টুপিটি পর্যন্ত নেই, পায়ে চটি আছে কি না ঠিক ঠাহর হল না। সে কুর্তার সামনের দিকটার (পূর্বোল্লিখিত দামন বা অঞ্চল) দুই খুঁট দুই হাত দিয়ে এগিয়ে ধরে তাতে সামলে রেখেছে পায়রাকে খাওয়াবার দানা। স্পষ্ট বোঝা গেল, এইমাত্র পাড়ার মুদির দোকান থেকে সে বেসাতিটা কিনে এনেছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে তার বুঝতে বিলম্ব হল না যে, হট্টগোলের উৎপাতে পায়রাগুলো উধাও হয়ে গিয়েছে। তখন তার খেয়াল গেল চতুর্দিকে ছুটোছুটি আর চেল্লাচেল্লির দিকে। সে কিন্তু নির্বিকার। আস্তে আস্তে এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করতে লাগল– বাড়িটা যেন চাঁদনি চৌক।
এবারে বাইরে শোনা গেল এক পদস্থ অশ্বারোহীর কটুবাক্য আর তীব্র চিৎকার– ইনি অন্ততপক্ষে ফৌজদারই হবেন। ওরে সব না-মর্দ, বেওকুফ, বেকার নাকম্মার দল। এই এখখুনি বেরিয়ে আয়, কাম খতম করে। নইলে হজরত আলীর ঝাণ্ডার কসম খেয়ে বলছি, তোদের কিয়ামতের শেষ-বিচারের দিন এই লহমাতেই হাজির হবে। আল্লার গজব, আল্লার লানৎ তোদের ওপর, তোদের বা-বাচ্চার ওপর।