বাড়ি ফেরার সময় বুঝতে পারলুম, সব দেশের খেলাধুলা যেরকম আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে, দুষ্টুমিটাও ঠিক সেরকম অনেকটা আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে। আমাদের দেশের ছেলেরা বরফের গুঁড়ো পাবে কোথায় যে তাই নিয়ে দুষ্টুমি করবে?
তার পর দু-তিন দিন ইউসুফ ঠাণ্ডা। ভাবলুম প্রথমদিনের সাজাতে হয়তো ইউসুফের আক্কেল হয়ে গিয়েছে। আর জ্বালাতন করবে না।
আমাদের দেশ গরম, তাই ঘরে ঘরে পাখার ব্যবস্থা থাকে। কাবুল ঠাণ্ডা, তাই সেখানে ক্লাসে ক্লাসে আগুন জ্বালাবার ব্যবস্থা। একদিন ক্লাসে ঢুকে দেখি ঘরভর্তি ধুয়ো, আর চিমনির আগুন নিভে গিয়েছে।
ছেলেরা কাশছে আর ইউসুফ পাতলুনের দুই পকেটে হাত পুরে অত্যন্ত বিষণ্ণ নয়নে তাকিয়ে আছে। দেশে টানাপাখার দড়ি ছিঁড়ে গেলে যেরকম চাপরাসির সন্ধানে ছেলে পাঠানো হয় আমি তেমনি বলোম, চাপরাসিকে ডাকো। ইউসুফকে পাঠানো আমার মতলব ছিল না। কিন্তু সে চট করে এক্ষুনি ডাকছি স্যর বলে হুট করে বেরিয়ে গেল। থামাবার ফুরসত পেলুম না।
মিনিট তিনেক পরে এলেন খু প্রিন্সিপাল। মুখে কেমন যেন একটু বিরক্তি। বললেন, আপনি নাকি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন? আমি তো অবাক!
সে কী কথা! আমি আপনাকে ডেকে পাঠাব কেন? আমার দরকার হলে আমি নিজেই তো আপনার কাছে যেতে পারি। আমি তো ডেকে পাঠিয়েছি চাপরাসিকে, আগুন নিভে গিয়েছে বলে। প্রিন্সিপালের মুখ থেকে বিরক্তির ভাব কেটে গিয়ে দেখা গেল রাগ। ইউসুফের দিকে ফিরে বললেন, তবে তুই আমাকে ডাকলি কেন?
ইউসুফ তার ড্যাবড্যাবে চোখ হরিণের মতো করুণ করে বলল, আমি তো শুনলুম, প্রিন্সিপাল সায়েবকে ডেকে নিয়ে আয়। তা কী জানি ওঁর ফারসি আমি ঠিক বুঝতে পারিনি হয়তো। প্রিন্সিপাল ইউসুফকে দুই ধমক দিয়ে চলে গেলেন।
কী ঘড়েল ছেলে রে বাবা! আমি বিদেশি বলে যে খুব ভালো ফারসি বলতে পারিনে তার পুরো সুযোগ নিয়ে সে আমাকে একদফা বোকা বানিয়ে দিল।
ততক্ষণে চাপরাসি এসে আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই আগুন জ্বলতে চায় না। ঘর আরও ধুয়োয় ভরে গিয়েছে। ছেলেরা কাশতে আরম্ভ করেছে, কারও কারও চোখ দিয়ে জল বেরুচ্ছে, আমার তো প্রায় দম বন্ধ হবার উপক্রম। চাপরাসি ততক্ষণে হার মেনে চলে গিয়েছে বুড়ো চাপরাসির সন্ধানে –সে যদি কিছু করতে পারে। ইউসুফ বলল, স্যর, জানালাগুলো খুলে দিই?
আমি বললুম, দাও। দম বন্ধ হয়ে তো আর মারা যেতে পারিনে।
এক মিনিটের মধ্যে হু হু করে ঠাণ্ডা হাওয়া ঘরের ভিতর ঢুকে আমাদের হাড়ে হাড়ে কাঁপন লাগিয়ে দিল। পড়াব কী, আর পড়বেই-বা কে? আমাদের দেশে যেরকম ভয়ঙ্কর গরমের দিনে ক্লাসের পড়ার দিকে মন যায় না, কাবুলে তেমনি দারুণ শীতের মাঝখানে পড়াশোনা করা অসম্ভব। হাতের আঙুল জমে গিয়েছে, কলম ধরতে পারছিনে, বইয়ের পাতা ওল্টানেনা যায় না। ছেলেরা ততক্ষণে আবার আপন আপন দস্তানা পরে নিয়েছে– আর দস্তানা-পরা হাতে লেখা, পাতা ওল্টানো, এসব কাজ আদপেই করা যায় না।
ততক্ষণে বুড়ো চাপরাসি এসেও হার মেনেছে। কিন্তু লোকটা বিচক্ষণ। খানিকক্ষণ চেষ্টা দেওয়ার পর বলল, ধুয়ো উপরের দিকে না উঠে ঘর ভরে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে ধুয়ো বেরোবার চোঙা কেউ বন্ধ করে দিয়েছে।
তদারক করে দেখা গেল বুড়ো ঠিক কথাই বলেছে। চোঙার ভিতরে, উপরের দিকে হাত চালানোতে বেরিয়ে এল একটা ক্যানাস্তারার টিন, ছেঁড়া কম্বল দিয়ে জড়ানো। বোঝা গেল, বেশ যত্নের সঙ্গে, বুদ্ধি খরচ করে চোঙাটি বন্ধ করা হয়েছে, যাতে করে ধুয়ে উপরের দিকে না গিয়ে সমস্ত ক্লাস ভরে দেয়।
আমি হুঙ্কার দিয়ে বললুম, চোঙা বন্ধ করল কে?
সমস্ত ক্লাস এক গলায় বলল, নিশ্চয়ই ইউসুফ। আর কে করতে যাবে?
ইউসুফের দুশমন গোলাম রসুল বলল, আমি যখন ক্লাসে ঢুকি তখন ইউসুফ ছাড়া আর কেউ ক্লাসে ছিল না। নিশ্চয়ই ও করেছে।
ইউসুফ বলল, আমি যখন ক্লাসে ঢুকলুম তখন গোলাম রসুল ছাড়া আর কেউ ক্লাসে ছিল না। নিশ্চয়ই ও করেছে।
গোলাম রসুল চটে গিয়ে বলল, মিথ্যেবাদী।
ইউসুফ মুরুব্বির সুরে বলল, এই, স্যরের সামনে গালমন্দ করিসনে।
কী জ্যাঠা ছেলে রে বাবা! বললুম, তুই এদিকে আয়।
কুইক মার্চে সামনে এসে সেলুট দিল। আমি বললুম, তোকে ভালোরকমের সাজা দেওয়া উচিত। আজকে সমস্ত ক্লাসের পড়া নষ্ট করেছিস। ঢোক গিয়ে টেবিলের তলায়। চুপ করে সেখানে বসে থাকবি, আর কথাটি কয়েছিস কি তোর গলা কেটে ফেলব।
সুড়সুড় করে টেবিলের তলায় গিয়ে ঢুকল।
কাবুলের ক্লাসে মাস্টারমশায়দের টেবিল বিলিতি কায়দায় বানানো হয়। অর্থাৎ তার তিন দিক ঢাকা। শুধু মাস্টার যেদিকে বসেন সেদিকটা খোলা। মনে কর খুব বড় একটা প্যাকিং কেসের ডালাটা খুলে নিয়ে তাই দিয়ে টেবিল বানাও আর খোলা দিকটায় পা ঢুকিয়ে দিয়ে বাক্সটা দিয়ে টেবিলের কাজ চালাও। আমি ঠিক তেমনি ভাবে বসে, আর ইউসুফ চুপ করে ভিতরে। নড়নচড়ন নট কিচ্ছ।
মনে হল ইউসুফের তা নিয়ে কোনও খেদ নেই; কারণ পঞ্চাশ মিনিটের পিরিয়ডের প্রায় আধঘণ্টা সে ধুয়ো, প্রিন্সিপাল, আর চাপরাসি দিয়ে বরবাদ করে দেবার বিমলানন্দ আপন মনে রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করছে।
আমি ছেলেদের পড়াতুম মুখে মুখে। চেঁচিয়ে বলতুম I go, সমস্ত ক্লাস আমার পরে বলত I go, আমি বলতুম We go, ক্লাস বলত We g০, এরমধারা you go, you go, কিন্তু Rahim goes, Karim goes, তার পর হুঙ্কার দিয়ে বলতুম Rahim and Karim go-0-0-0।