বরফ জমলেই এ খেলা জমে উঠত। আর আমি কাজকর্ম ধামাচাপা দিয়ে জানালার কাছে। গিয়ে বসতুম।
এ খেলায় সত্যিকার ওস্তাদ ছিল একটি সাত-আট বছরের ছেলে। খেলার মধ্যিখানে সে এমনি চর্কিবাজির মতো ঘুরত যে তার গায়ে গোলা ছেড়ে কার সাধ্যি। আর আমাদের দেশের পাকা লেঠেলের মতো সে একাই জন আষ্টেককে অনায়াসে কাবু করে ফেলত। ভারি মিষ্টি চেহারা, পাকা আপেলের মতো টুকটুকে দুটি গাল, নীল চোখ, আর সেই দু চোখে যেন দুনিয়ার যত দুষ্টুমি বাসা বেঁধে বসে আছে। নাম ইউসুফ, পাশের বাড়িতে থাকে, আর তার বাপ আমাদের কলেজের কেরানি। আমাকে পথে পেলে সেলাম করে কিন্তু সসম্ভ্রম সেলামের সময়ও চোখের দিকে তাকালে মনে হত ছেলেটা কোনও এক নতুন দুষ্টুমির তালে আছে। যদি জিগ্যেস করতুম, কীরকম আছিস? তা হলে একগাল হেসে কী একটা বলত, যার কোনও মানে হয় না। কিন্তু সেই হাসির ফাঁকে ফাঁকেও আমি স্পষ্ট দেখতে পেতুম কোনও একটা দুষ্টুমির সুযোগ পেলে সে আমাকেও ছাড়বে না।
সে-ই একদিন বাড়ি বয়ে এসে সোৎসাহে খবর দিয়ে গেল, আমি তাদের স্কুলে বদলি হয়ে এসেছি। তার চোখে-মুখে হাসি আর খুশি। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, আমি তার চোখে যেটি লক্ষ করলুম সেটি হচ্ছে এইবার আসুন স্যর, আপনাতে আমাতে এক হাত হয়ে যাবে। আমি যে খুব ভয় পেলুম তা নয়, কারণ ছেলেবেলায় আমিও কম দুষ্ট ছিলাম না।
ওদের স্কুল বড় অদ্ভুত। পাঁচ-ছ বছরের ছেলেদের ক্লাস ওয়ান থেকে আই-এ ক্লাসের ছেলেরা একই বাড়িতে পড়ে। তাই সেটাকে পাঠশালা বলতে পার, হাইস্কুল বলতে পার, আর কলেজ বললেও বাধবে না। আমি বদলি হলুম কলেজ বিভাগে– ফাস্ট আর সেকেন্ড ইয়ারের ছেলেদের ইংরেজি পড়াবার জন্য। এ দু ক্লাস পড়িয়ে আমার হাতে মেলা সময় পড়ে থাকত বলে একদিন প্রিন্সিপাল অনুরোধ করলেন, আমি যদি ম্যাট্রিক ক্লাসের ছেলেদেরও ইংরেজি পড়াই তবে বড় উপকার হয়। আমি খানিকটে ভেবে নিয়ে বললুম, তার চেয়ে আমাকে বরঞ্চ ক্লাস ওয়ানে পড়াতে দিন। আসছে বছর ওদের সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও প্রোমোশন দেবেন– অর্থাৎ আমি টু-তে পড়াব, তার পরের বছর থ্রিতে। এই করে করে যাদের কলেজে টেনে নিয়ে আসতে পারব তাদের ইংরেজিজ্ঞান থেকে বুঝতে পারব আমি ভালো পড়াতে পারি কি না। প্রিন্সিপাল তো কিছুতেই মানেন না; বলেন, সে কী কথা! আপনি পড়াবেন ক্লাস ওয়ানে! আমার প্রস্তাবটার তত্ত্ব বুঝতে তাঁর বেশ খানিকটা সময় লাগল। কাবুলি প্রিন্সিপালের বুদ্ধি থাক, গুরুজনদের নিন্দে করতে নেই।
ওদিকে ক্লাস ওয়ানে হৈ হৈ রৈ রৈ। কলেজ বিভাগের অধ্যাপক আসছেন ক্লাস ওয়ানে পড়াতে!
আমার তখন আদপেই মনে ছিল না ইউসুফ ক্লাস ওয়ানে পড়ে। প্রথমদিন ক্লাসে ঢুকতেই দেখি, সে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সবাইকে কী যেন বোঝাচ্ছে। অনুমান করলুম, প্রতিবেশী হিসেবে সে আমার সম্বন্ধে যেটুকু জানে সেটুকু সকলকে সগর্বে সদম্ভে জানিয়ে দিচ্ছে। আমার চাকর আবদুর রহমানের সঙ্গে ইউসুফের আলাপ-পরিচয় ছিল। আর আবদুর রহমান ভাবত তার মনিবের মাথায় একটুখানি ছিট আছে। আবদুর রহমান যদি সেই সুখবরটি ইউসুফকে দিয়ে থাকে, আর সে যদি ক্লাসের সবাইকে সেই কথাটি জানিয়ে দেয়, তবেই হয়েছে!
ক্লাসে মাস্টার ঢুকলেই কাবুলের ছেলেরা মিলিটারি কায়দায় সেলুট দেয়– আফগানিস্তান মিলিটারি দেশ। আমি ক্লাসে ঢুকতেই ইউসুফ তড়াক করে সুপারি গাছের মতো খাড়া হয়ে মিলিটারি সেলুটের হুকুম হাঁকল। তার পর খুশিতে ডগমগ হয়ে আপন সিটে গিয়ে বসল।
পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই ইউসুফ উঠে দাঁড়াল। বাইরে যেতে পারি, স্যর? আমি বললুম যা, কিন্তু দেখ, আমি বাইরে যাওয়া-যাওয়ি জিনিসটা মোটেই পছন্দ করিনে। যাবি আর আসবি। নিশ্চয় স্যর। বলে আরেকটা মিলিটারি সেলুট ঠুকে বেরিয়ে গেল।
এক মিনিট যেতে না যেতে ইউসুফ ফিরে এল। তাই তো, ছেলেটা তা হলে অতটা দুষ্টু নয়। কিন্তু আরও তিন মিনিট যেতে না যেতে আমার ভুল ভাঙল। ইউসুফের পাশের ছেলেটা পড়ার মাঝখানে হঠাৎ চেঁচিয়ে বলল, স্যর, আমার পকেট ভিজে গিয়েছে এই ইউসুফটা আমার পকেটে বরফের ঢেলা রেখেছিল। ইউসুফ আরও চেঁচিয়ে বলল, না স্যর, আমি রাখিনি। ছেলেটা আরও চেঁচিয়ে বলল, আলবাত তুই রেখেছিস।
ইউসুফ বলল, তোর ডান পকেট ভেজা, আমি তো বাঁ দিকে বসে আছি। ছেলেটা বলল, তুই না হলে বরফ আনল কে? তুই তো এক্ষুনি বেরিয়ে গিয়েছিলি।
হট্টগোলের ভিতর আমি যে তাবৎ তর্কাতর্কি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিলুম তা নয় কিন্তু কথা কাটাকাটিটা মোটের ওপর এইরকম ধারায়ই চলেছিল। বিশেষ করে শেষের যুক্তিটা আমার মনের ওপর বেশ জোর দাগ কাটল। ইউসুফ না হলে বরফের ঢেলা আনল কে? আর বরফ তো আগের থেকে ঘরে এনে জমিয়ে রাখা যায় না– গলে যায়।
রাগের ভান করে কড়া হুকুম দিলুম, ইউসুফ, তুই বেঞ্চির উপর দাঁড়া।
ইউসুফ বিন্দুমাত্র আপত্তি না করে তড়াক করে পলটনি কায়দায় বুট দিয়ে খটাস করে শব্দ করে বেঞ্চির উপর দাঁড়িয়ে ফের সেলট দিল। পূর্বেই বলেছি আফগানিস্তান মিলিটারি দেশ ছোট ছেলেরা পর্যন্ত পলটনি জুতা পরে আর হুকুম তামিল করার সময় পলটনি সেলুট ঠোকে।
ভাবলুম ইউসুফ আমাদের দেশের ছেলের মতো বসি, স্যর? বলে অনুনয় করবে। আদপেই না। চাঁদপানা মুখ করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। শেষটায় আমিই হার মানলুম। বললুম, বস্। আর ওরকম করিসনে। ইউসুফ আরেকবার সেলুট জানিয়ে বসে পড়ল।