থেমে থেমে বললেন, তার হ্রস্ব কাহিনী হ্রস্বতর নির্যাসরূপে।
সঙ্গে সঙ্গে মাতালের মুখে উৎসাহ আর আনন্দের দ্যুতি। হাসিও চাপতে পারে না।
কোনও গতিকে বলল, হায় রে হায়, এই সামান্য বিষয় নিয়ে মা, তোমার দুর্ভাবনা! তুমি এক লহমা বসো তো মা শান্ত হয়ে।
তার পর বলল, চতুর্দিকে কিন্তু চোর-চোট্টার পাল। হেঁ হেঁ মা, কিছু মনে কর না, ওই যে রইল বোতলটা তার উপর আধখানা চোখ রেখ।
বিড়বিড় করে আপন মনে বলল, এই মাঘের শীতের ভরসন্ধেবেলা চানটা না করিয়ে ছাড়লে না। মহামূল্যবান নেশাটাও মেরে যাবে দড়কচ্ছা। তা আর কী করা যায়?
ঝপ করে গঙ্গায় এক ডুব মেরে উপরে উঠে খপ করে ধরল শিবের ঠ্যাঙখানা।
বত্রিশ নয় যেন চৌষট্টিখানা দাঁত বের করে বলল, হল মা-জননী? এই সামান্য জিনিসটের জন্যে তুমি এতখানি ব্যাকুল হয়ে গিয়েছিল? ছিঃ মা, তোমার বিশ্বাস বড় কম!
মাঝ গাঙের দিকে তাকিয়ে বলল, ওইটে কি তোমাদের নৌকো? কে যেন ডাকছে? আমি তা হলে আসি। আমার আবার বেতো শরীর। পেন্নাম হই মা, বাবাজি সেরে তো উঠল– এবারে একটু ইয়ে মানে সাবধানে।
লাঞ্চ শেষ হয়ে এসেছে। সোফায় বসে সিগার ধরিয়ে হোস্ট বললেন, দেশ বোন-ড্রাই হোক কিংবা উচ্ছন্নে যাক– আমার কিচ্ছুটি বলার নেই। কিন্তু দু-একটা মাতাল না থাকলে ডেয়ারিং কাজ করবে কে?
আমারও নিজের কিচ্ছুটি বলার নেই। আমি দু পক্ষেরই বক্তব্য নিবেদন করলুম মাত্র।
আমি পক্ষ নেবই-বা কেন? এক পক্ষ বলছেন আমাকে ড্রাই করে ছাড়বেন, অন্য পক্ষ বলছেন, আমাকে ভিজিয়ে দেবেন। দু পক্ষেই দারুণ লড়াই।
দুটো কুকুর যদি একটুকরো হাড়ি নিয়ে লড়াই করে, হাড্ডিটা তো তখন কোনও পক্ষে যোগ দিয়ে লড়াই করে না।
শ্রীচরণেষু
কতকগুলি খেলা প্রায় সব দেশের ছেলেমেয়েরাই খেলে। যেমন মনে কর, কানামাছি কিংবা লুকোচুরি। আবার মনে কর সাঁতার কাটা; সাহারার মরুভূমিতে, কিংবা মনে কর খুব বড় শহরে, যেখানে নদী-পুকুর নেই, সেখানে যে সাঁতার কাটাটা খুব চালু হতে পারে না, সেটা অনায়াসেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। জল আছে অথচ সাতার কাটাটা লোকে খুব পছন্দ করে না, তা-ও হয়। শীতকালে ইউরোপের সব নদী-পুকুর জমে বরফ হয়ে যায় না, তবু সেই পাথর-ফাটা শীতে কেউ পারতপক্ষে জলে নামতে চায় না সাঁতারের তো কথাই ওঠে না।
খেলাধুলো তাই নির্ভর করে অনেকটা দেশের আবহাওয়ার ওপর। কিছু না কিছু জল প্রায় সব দেশেই আছে, তাই কাগজ বা পাতার ভেলা সবাই জলে ভাসায়। কিন্তু যে দেশে ঝমাঝ-ঝম্ বৃষ্টি নেমে আঙিনা ভরে গিয়ে চতুর্দিকে জল থৈ-থৈ করে না, সে দেশের ছেলে-মেয়েরা আর দাওয়ায় বসে আঙিনার পুকুরে কাগজের ভেলা ভাসাবে কী করে? অথচ ভেলা-ভাসানোর মতো আনন্দ কম খেলাতেই আছে। রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বুড়ো বয়সে ছেলেবেলার কথা ভেবে গান রচেছেন :
পাতার ভেলা ভাসাই নীরে
পিছন পানে চাইনে ফিরে।
আর ছেলেমেয়েদের জন্য শিশু ভোলানাথের এ কবিতাটি তোমরা নিশ্চয় জানো :
দেখছ না কি নীল মেঘে আজ
আকাশ অন্ধকার?
সাত-সমুদ্র তেরো-নদী।
আজকে হব পার।
নাই গোবিন্দ, নাই মুকুন্দ,
নাইকো হরিশ খোঁড়া–
তাই ভাবি যে কাকে আমি
করব আমার ঘোড়া।
কাগজ ছিঁড়ে এনেছি এই
বাবার খাতা থেকে,
নৌকো দে-না বানিয়ে– অমনি
দিস, মা, ছবি এঁকে।
রাগ করবেন বাবা বুঝি।
দিল্লি থেকে ফিরে?
ততক্ষণ যে চলে যাব
সাত-সমুদ্র-তীরে।
ভারি চমৎকার কবিতা! কিন্তু বাকিটা আর বললুম না। যাদের পড়া নেই, তারা যেন শিশু ভোলানাথখানা খোলে, এই হচ্ছে আমার মতলব।
তা সে কথা যাক। বলছিলুম কি, আবহাওয়ার ওপর খেলাধুলো অনেকটা নির্ক্স করে। আমাদের দেশ জলে ভর্তি, বিশেষ করে পুব বাঙলা, তাই আমাদের খেলাধুলো জমে ওঠে জলের ভিতরে-বাইরে। তেমনি শীতের দেশে বরফ পড়ে বিস্তর, আর তাই নিয়ে ছেলেদের খেলাধুলোর অন্ত থাকে না। ধুলো বলা অবশ্যি ভুল হল, কারণ বরফে যখন মাঠ-ঘাট, হাট-বাট সবকিছু ছেয়ে যায়, তখন তামাম দেশে একরত্তি ধুলোর সন্ধান আর পাওয়া যায় না।
কাবুলে যখন ছিলুম, তখন জানালা দিয়ে দেখতুম, ছেলেমেয়েরা সকাল থেকে পেঁজা বরফের গুড়ো হাতে নিয়ে ঢেলা পাকিয়ে একে-ওকে ছুঁড়ে মারছে, সে ঢিল ছোঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে চট করে সরে যাবার চেষ্টা করছে। যদি তাগমাফিক লেগে গেল তবে তুমি ওস্তাদ ছেলে, হাতের নিশান ভালো, হয়তো একদিন ভালো বোলার হতে পারবে। আর না লাগলেও তা নিয়ে ভাবনা করা চলবে না, কারণ ততক্ষণে হয়তো তোমার কানে এসে ধাই করে লেগেছে। আর কারও ছুঁড়ে মারা গোলা। কানের ভিতর খানিকটা বরফের গুঁড়ো ঢুকে গিয়ে কানের ভিতরকার গরমে গলতে আরম্ভ করেছে। ভারি অস্বস্তি বোধ হয় তখন মনে হয় যেন কেউ সুড়সুড়ি দিচ্ছে। তখন খেলা বন্ধ করে কান সাফ করার জন্য দাঁড়াতে হয়। আর ছোঁড়াছুড়ির মধ্যিখানে ও রমধারা দাঁড়ানো মানেই আর পাঁচজনের তাগ হওয়া। মাথা নিচু করে যতক্ষণ তুমি কান সাফ করছ, ততক্ষণে এ-দিক, ও-দিক, চতুর্দিক থেকে গোটা দশেক গোলাও খেয়ে ফেলেছ।
তা বয়েই গেল। বরফের গোলা যত জোরেই গায়ে এসে লাগুক না কেন, তাতে করে চোট লাগে না। গায়ে লাগার সঙ্গে সঙ্গেই গোলা চুরমার হয়ে যায়। কিছুটা বরফের গুঁড়ো অবশ্যি জামা-কাপড়ে লেগে থাকে। তা সেটা হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেললেই হয়–না হলে গরম জামাকাপড়ের ওম লেগে খানিকক্ষণ বাদে বরফ গলে গিয়ে কাপড় ভিজিয়ে দেবে।