শিব বললেন, কী হল?
পার্বতী খিলখিল করে হেসে বললেন, এবারে তোমার নরকের পথ বন্ধ হল। বিষ্ণু বহুকাল ধরে যমের ওই পশ্চিমের বাড়িটা চাইছিলেন সেটা পেয়ে যাবেন। বেচারি যম! জানো, যমের সহোদর উকিল-ডাক্তারদের পসার কমে গেলে তাদের কী অবস্থা হয়?
পসার কমবে কেন? শিব শিবনেত্র হয়ে শুধোবেন।
কৌতুকে হাসিলা উমা কটাক্ষে লক্ষিয়া হর পানে। বললেন, কে আর যাবে নরকে? দেখছ। না, তামাম দুনিয়ার লোক হদ্দমুদ্দ হয়ে গঙ্গাস্নান করছে। সবাই হবে নিষ্পাপ। নরকে যাবে। কে? তোমাকে বলিনি পই পই করে ওই গঙ্গাটাকে তাড়াও। আমার হোস্টটি গল্প থামিয়ে শুধালেন, জানেন বোধহয়, গঙ্গা হলেন পার্বতীর সতীন!
গঙ্গা তরঙ্গিনী, শিবের শিরোমণি।
হোস্ট বললেন, শিব এই গঙ্গাস্নানের কথা শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে বসলেন, কিন্তু তার পূর্বেই
হর প্রতি প্রিয়ভাবে কন হৈমবতী,
বৎসরের ফলাফল থাক, পশুপতি!
যমের রাজত্ব যাবে এইটুকু জানি
অমৃত-রেশন-শপও স্বর্গ নেবে মানি।
ভেজাল না হয় শুরু এই লাগে ভয়
স্বর্গের হাউসিং লাগি চিন্ত মহাশয়।
থুড়ি! আর কথকতা নয়। আমার হোস্ট এ-পদ্ধতি অবলম্বন করেননি।
শিব কল্কেটা রথের স্টারগার্ড-এ (আকাশে মাড়-এর পরিবর্তে আকছারই নক্ষত্র চূর্ণ উড়ে এসে রথটা ধূলিময় করে বলে ওটা স্টারগার্ড) কল্কেটা ঠুকে ঠুকে সাফ করতে করতে বললেন, কিছু ভয় নেই ডার্লিং। যারা স্নান করছে তারা এর পুণ্যফলে বিশ্বাস করে না।
পার্বতী তাজ্জব মেনে বললেন, সে কী! তাবৎ পুরাণে যে পষ্ট লেখা রয়েছে। এখন তো ছাপাও হচ্ছে, বেতারেও প্রচার হয়, যে-পণ্ডিত নেহরু
শিব তখনও ইন্ডিয়ার উপরে। ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া আইনের কথা ভেবে তাড়াতাড়ি বললেন, আমার কথা বিশ্বাস কর, আমি প্রমাণ করতে পারি।
যথারীতি দুজনাতে বাজি ধরা হল– সুর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের ভিতর শিব প্রমাণ করবেন, গঙ্গাস্নান যারা করে তারা মা-গঙ্গার কল্যাণে নিষ্পাপ হল বলে বিশ্বাস করে না।
অতি প্রত্যুষে বাজির চুক্তিমতো পার্বতী রাজরাজেশ্বরীর মহিমাময় সজ্জা পরে কিন্তু অতিশয় বিষণ্ণ বদনে বসলেন গঙ্গাতীরে। আর তার কোলে মাথা রেখে লম্বা হয়ে শুয়ে রইলেন শিবঠাকুর– তাঁর সর্বাঙ্গে গলিত কুষ্ঠ!
গঙ্গাস্নান সেরে উঠে এ দৃশ্য দেখে প্রথম ব্রাহ্মণ অবাক। কৌতূহল দমন না করতে পেরে দরদী কণ্ঠে শুধাল, মা, এ কী ব্যাপার!
নিখুঁত ক্ষুদ্র দুটি নাসারন্ধ্র দিয়ে উষ্ণতম দীর্ঘশ্বাস ফেলে পার্বতী বললেন, বাবা, আমার কপাল। দেখতেই তো পাচ্ছেন, আমার স্বামীর অবস্থা। তবে ভগবানের দয়ায় এক গণক্তারের সঙ্গে দেখা। সে তার হাত দেখে বলেছে, কোনও নিষ্পাপ পুরুষ তাকে স্পর্শ করা মাত্রই তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন।
ব্রাহ্মণ কাঁচুমাচু হয়ে হ্যাঁ মা, তা মা, বলে বাং মাছটির মতো মোচড় মেরে হাওয়া।
পার্বতী তো বজ্রাহত। লোকটা এইমাত্র গঙ্গাস্নান করে নিষ্পাপ হয়ে মা গঙ্গার কোল থেকে বেরিয়ে এল। তার মুখেও দয়ামায়ার চিহ্ন। তবে কি তবে কি গঙ্গাস্নানে তার বিশ্বস—! শিব মৃদুহাস্য করলেন।
কিছুক্ষণ পরেই আরেক স্নান-সমাপ্ত দ্বিজ। কথোপকথন পূর্ববৎ। বাং মাছের মোচড়টিও তদ্বৎ। পার্বতী দিশেহারা। ভোলানাথ আস্যদেশ বিস্তীর্ণ করলেন।
চলল যেন প্রসেশন। পার্বতীর গলা থেকে একই রেকর্ড বেজে চলল। ফল একই। ধূর্জটি গণ্ডা দুই হাই তুলে পদ্মনাভ স্মরণে এনে ঘুমিয়ে পড়লেন। দেবসমাজে এই হল ঘুমের বড়ি সনেরি।
করে করে বেলা দ্বিপ্রহর। ভেঙে গেছে প্রভাতের হাট, কোলাহল থেমে গেছে, জনপদঘাট পান্থহীন। গঙ্গাতীরও ভূতনাথের শ্মশানসম নির্জন।
অপরাহ্ন। পার্বতীর ক্লান্তি এসে গেছে। বললেন, নন্দীকে ডাকো, বাড়ি যাই। আমি হার মানলুম।
শিব বললেন, সন্ধ্যা অবধি থাকার কথা। তাই হবে।
এ তো কলকাতা নয় যে বাবুরা হাওয়া খেতে সন্ধেবেলা গঙ্গাতীরে আসবেন। কাগ-কোকিলও সেখানে আর নেই।
এমন সময় ক্ষীণ কনে দেখার মিলোয় মিলোয় আলোতে দূর থেকে দেখা গেল এক ইয়ার-গোছ নটবর। ডান হাত দিয়ে তুড়ি দিতে দিতে গান গাইছে, লে লে সাকি, ভর দে পেয়ালা। বা বগলে হাফ-পাট। বদনটি তার প্রফুল্ল। আপন মনে গান গাইতে গাইতে এদিক পানেই আসছে।
আসন্ন সন্ধ্যায় নির্জন গঙ্গাতীরে অপরূপ সুন্দরী দেখে সে থমকে দাঁড়াল। আপন মনে মাইরি বলতে না বলতে হঠাৎ তার চোখ গেল সিঁথির সিঁদুরের দিকে। মাতাল যে কখন আচম্বিতে অকারণ পুলকে নেচে ওঠে, আর কখন যে সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ লজ্জা পেয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যায় সেটা পাকা শুড়ির গুঁড়িও আগেভাগে বলতে পারে না। এবং মাতালের পুলক এবং কুণ্ঠা দুই-ই তখন পৌঁছয় চরমে, হাফাহফি সন্ধিসুলের বেনের পথই যদি সে নেবে তবে তো সে নর্মাল! বোতলে পয়সা বরবাদ করবে কেন?
মাতালের কৌতূহল হল। তদুপরি সঙ্গে সঙ্গে তার ধর্মবুদ্ধিও জাগ্রত হল। মেয়েটাকে সাবধান করে দেওয়া উচিত। এই ভরসন্ধেবেলায়–
কুণ্ঠায় যেন আপন পাঞ্জাবির ভিতর মায় পা দুখানা, সর্বশরীর লুকিয়ে নিয়ে বলল, মা, এই অবেলায়, আপনি এখানে, জানেন না, কী বলব, কিন্তু কেন?
পার্বতী মাতাল দেখে প্রথমটার সঙ্কুচিত হয়ে ঘাড়টা একটু ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন। মাতাল কিন্তু মাটির দিকে তাকিয়ে রইল ঠায় দাঁড়িয়ে। কী আর করেন জগন্মাতা পার্বতী? আর বলাও তো যায় না, মাতাল! কখন রঙ বদলায়।