ইটি আসলে কথকতা। অতএব তাবৎ বক্তব্য ছন্দে দিলে রসভঙ্গ হয়।
যুবক বেতস পত্রের ন্যায় কম্প্রমান!
শয়তান হুঙ্কার দিয়ে বলল, আজ থেকে স্বর্গ-মর্ত্য আমার পরিপূর্ণ দখলে এসেছে। তোকে আমি এই তরবারি দিয়ে দুই টুকরো করব। তার পূর্বে আমার স্তব গেয়ে নে।
যুবা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার মরতে কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু আমি মরে গেলে আমার বৃদ্ধ পিতার জন্যে কে অন্ন আহরণ করবে? আমাকে তুমি নিষ্কৃতি দাও।
শয়তান ক্ষণতরে চিন্তা করে বলল, তোমাকে ছাড়তে পারি এক শর্তে। তুমি তোমার পিতাকে হত্যা কর। তা হলে তোমার সমস্যারও সমাধান হয়! শয়তান অট্টহাস্য করে উঠল।
পুত্র আর্ত ক্রন্দন করে বলল, অসম্ভব! সম্পূর্ণ অসম্ভব!
পিতা মোরে জন্ম দিল বাল্যেতে আরাম
কেমনে হইব আমি নেমকহারাম!
নেমকহারাম শুনে শয়তানের ক্রোধ চরমে পৌঁছেছে। কারণ সে একদা আল্লার সঙ্গে নেমকহারামি করেছিল। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে হিত অবশ্য শয়তানের ধারণা অনুযায়ী যেটা হিত– বলল, তা হলে তুমি তোমার ভগিনীকে ধর্ষণ কর।
যুবা এবারে আর কোনও উত্তর দিল না। সে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হল।
কিন্তু শয়তানের এ ব্যবস্থা মনঃপূত হবে কেন? সে চায় যুবাকে দিয়ে পাপ করাতে। তাই অন্য ট্যাকটিক অবলম্বন করে বলল, তোমাকে শেষ মুক্তির উপায় দিচ্ছি। এই নাও, এক পাত্র মদ্য পান কর।
যুবা ভাবে :
মদ্য পান মহা পাপ সর্ব শাস্ত্রে কয়।
এ পাপ করিলে গতি নরকে নিশ্চয়।
যাইব নরকে আমি নাহি কোনও ডর
শয়তানের শর্ত হীন, পাপিষ্ঠ, বর্বর।
অনিচ্ছায় সে করল মদ্য পান। তার পর কাহিনীটি সংক্ষিপ্ত।
মদ্যপান করে পরিপূর্ণ মত্তাবস্থায় পাপপুণ্যজ্ঞানহীন যুবা শয়তানের ওই হীন পাপিষ্ঠ বর্বর কর্ম দুটি করে ফেলল।
কাহিনীটি সর্বত্র বলা চলে না। কিন্তু যে মহাজন এটির কল্পনা করেন তিনি স্পষ্টত কাউকে ছেড়ে কথা বলতে চাননি, কোনও পাপ শেয়ার করতে চাননি। পৈশাচিক বীভৎস রস সৃষ্টি করে সর্বমানবের হৃৎকন্দরে ভগবানের ভয় প্রবেশ করাতে চেয়েছিলেন।
এ তো গেল এক পক্ষ। অন্য পক্ষ কী বলেন, তার অনুসন্ধান আমি বহুকাল ধরে করে আসছি। কারণ আরব তথা অন্যান্য প্রাচ্যভূমিতে এ তথ্য সর্বাদিসম্মত যে, হেন কাহিনী এ পৃথিবীতে নেই যার বিপরীত গাথাও নির্মিত হয়নি। সেটিও পেয়েছি।
কিছুকাল পূর্বে টুরিজম-প্রসার সংস্থার আমি সদস্য হয়ে যাই আমার একমাত্র গুণ যে, কোনও দেশই আমাকে দীর্ঘকাল সহ্য করতে পারে না বলে আমি সে-দেশ থেকে সংক্ষেপে বিতাড়িত হই, ফলে আমার বহু দেশবাস, বহু দেশদর্শন হয়। এসব দেশের দেওয়ানি আদালতে দেউলেদের যে লিস্ট টাঙানো থাকে তার প্রত্যেকটিতে আমার নাম পাবেন। যদি কোনওটিতে না পান তবে বুঝে নেবেন সে দেশে আমি নাম ভাঁড়িয়েছিলুম। বস্তুত আমি কোনও দেশের, কি স্বদেশের কি বিদেশের, কারও কাছে অঋণী থেকে মরতে চাইনে।
সেই টুরিজম সংস্থার এক মিটিং-এ জনৈক সজ্জন সভারম্ভেই বলেন, ভদ্রমহোদয় ও মহিলাগণ, কর্মসূচি আরম্ভ করার পূর্বেই আমার একটি বক্তব্য নিবেদন করি।
প্রবাদ আছে, মুরগি-ঘরে যদি শ্যাল ঢুকতে দাও, তবে সকালবেলার মমূলেটটির আশা ত্যাগ করেই কর। তাই যদি দেশ থেকে মদ্যপান একদম ঝেটিয়ে বের করে দাও, তবে ইউরোপীয় টুরিস্টের আশা কর না; সে মমূলেটটি আমাদের প্লেট থেকে অন্তর্ধান করবে। অতএব, আপনারা এবং আপনাদের সরকার স্থির করুন, আপনারা টুরিজম্ চান, না দেশকে মদ্যহীন করতে চান। আমার কাছে দুই-ই বরাবর।
ভারি স্পষ্ট বক্তা। ওদিকে মুরুব্বিদের অনেকেই গান্ধীটুপি পরিহিত। এটাও চান ওটাও চান, কিন্তু কী করে উলঙ্গ ভাষায় বলেন, মদটা না হয় থাক। ওঁদের মতলব, এমন এক অভিনব কৌশল বের করা, যার প্রসাদে আণ্ডা না ভেঙেও মমলেট বানানো যায়! অতএব এসব ক্ষেত্রে যা উইদাউট ফেল করা হয় তাই সাব্যস্ত হল। পোস্টপোন কর।
মিটিঙের শেষে আমাদের জন্য লাঞ্চের ব্যবস্থা ছিল। আমি শঙ্কিত হয়ে পালাবার চেষ্টা করেছিলুম। সরকারি পয়সায় লাঞ্চকে আমি লাঞ্ছনা নাম দিয়েছিলুম। ওদের ডিনারকে অনেকে সাপার বলতেন। আমি বলতুম suffer : সংক্ষেপে দুপুরে লাঞ্ছনা, রাত্রে suffer.
আমার অবস্থা দেখে সেই স্পষ্টভাষী বক্তা আমাকে সন্তর্পণে গাধা-বোটের মতো টেনে টেনে করিডরে রব করে দে ছুট ভদ্রতা বাঁচিয়ে। সেই হোটেলেই তাঁর কামরা ছিল। সেখানে বসে আমার হাতে মেনু এগিয়ে দিলেন। উক্তৃষ্ট আহারাদি এল। তার পূর্বে জিন এল, বিয়ার এল। তিনি খেলেন সামান্যই।
বললেন, যতসব আদিখ্যেতা। কোনও জিনিসে একটা ক্লিয়ার পলিসি নেই। বিশ্বসুন্দু লোক মদ খেয়ে রাস্তায় গড়াগড়ি দিক, এটা কেউই চায় না। ফ্রান্সের মতো অ্যালকহলিজম একটা সমস্যারূপে দেখা দিক, সেটাও কেউ চায় না। অথচ ইংরেজ তথা তাবৎ ইউরোপীয়রা বিজনেস পাকাঁপাকি করে দুপুরবেলা বারে দাঁড়িয়ে।
আমাকে বললেন, শুনেছি আপনি সাহিত্যিক। একটা ওই মতিফের (ধরনের) গল্প শুনবেন?
আমি বললুম আলবত, একশোবার।
হরপার্বতী সাইক জানেন? অর্থাৎ তাদের নিয়ে জনসাধারণের গল্প? তারা যে একে অন্যের সঙ্গে বাজি ধরেন?
এটা তারই একটা।
হরপার্বতী শূন্যমার্গে উড়ে যাচ্ছেন। আকাশ থেকে দেখতে পেলেন ঝাঁকে ঝাঁকে পুণ্যার্থী গঙ্গাস্নান করছে। পার্বতী তাই দেখে মৃদুহাস্য করলেন।