মোদ্দা কথা এই যে, ভারতবর্ষের শিক্ষিত সমাজে এবং অধিকাংশ অশিক্ষিত সমাজে মদ্যপান নিয়ে যে আলোচনা হয় সেটা নীতির দৃষ্টিবিন্দু থেকে, অ্যাজ এ প্রিন্সিপল। অর্থাৎ হিন্দুর কাছে গোমাংস যেমন আত্যন্তিকভাবে বর্জনীয় অতি সামান্য অংশ খাওয়াও মহাপাপ-মুসলমানের কাছে শূকরমাংসও সেইরূপ। তাই এদেশে মদ্যপান ঠিক সেইরকমই বর্জন করতে হবে কি না সেই প্রশ্নটা মাঝে মাঝে ওঠে।
ইতোমধ্যে ঔষধের মাধ্যমে অনেকেই সেটা প্রতিদিন পান করছেন– জানা-অজানায়। বেশিরভাগ টনিকেই পনেরো, সতেরো পার্সেন্ট অ্যালকোহল থাকে। একটি তরুণ অ্যালকোহলের তত্ত্ব না জেনে আমাকে এক বোতল টনিক দিয়ে বলল, অত্যুকৃষ্ট টনিক, স্যর! খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মাথাটা চিম চিম করে, শরীরে বেশ ফুর্তির উদয় হয়। আমি মনে মনে বললুম, বটে! ফুর্তিটা টনিকের ওষুধ থেকে না ওই ১৭ পার্সেন্ট মদ থেকে সেটা তো জানো না বৎস! অর্থাৎ পুচ্ছটি উত্তোলন করে–ইত্যাদি। কারণ টনিকবর্জিত ১৭ পার্সেন্ট অ্যালকোহল সমন্বিত যে কোনও মদ্য পান করলেই মাথাটা চিম চিম করে শরীরে বেশ ফুর্তির উদয় হয়।
ভলতেয়ারের একটি আপ্তবাক্য এত বেশি সুস্বাদু, এত বেশিবার মনে পড়ে যে সেটা আবার বললে পাঠক যেন বিরক্ত না হন। ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের যখন অতি সামান্য কিছুটা ইউরোপে পৌঁছেছে তখন একশ্রেণির কুসংস্কারবাদী বলতে আরম্ভ করল, ভারতবাসীরা মন্ত্রের জোরে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। ওই সময় এদেরই একজন ভলতেয়ারকে শুধোয়, মন্ত্রোচ্চারণ করে একপাল ভেড়া মেরে ফেলা যায় কি না? ভলতেয়ার একটু বাকা হেসে বললেন, নিশ্চয়ই। তবে যাতে কোনও গোলমাল না হয় তার জন্য আগের থেকে পালটাকে বেশ করে সেঁকো খাইয়ে দিয়ো।
এই হচ্ছে আসল তত্ত্ব কথা– সেঁকোটাই সত্য; মন্ত্রটা থাকলে ভালো, না থাকলে নেই।
ঠিক তেমনি ওই যে টনিকের কথা একটু আগে বললুম, তার ওই ১৭ পার্সেন্টটাই সত্য; বাকি যেসব ওষুধ-বিষুধ আছে সেগুলো থাকলে ভালো– ইত্যাদি।
ঠিক তেমনি ছেলে বাড়িতে নিজের চেষ্টায় পরিশ্রম করে যেটুকু শেখে সেইটেই সেঁকো, সেইটেই ১৭ পার্সেন্ট অ্যালকোহল। তারই জোরে ছেলে পরীক্ষা পাস করে– আমরা মাস্টাররা ক্লাসে যা পড়াই সেটা মন্ত্রোচ্চারণের মতো; থাকলে ভালো, না থাকলে নেই।
এই যে দেশটা চলছে সেটা জনসাধারণের শুভ বা অশুভ বুদ্ধি দ্বারা সরকার যেটা আছে, সেটা মন্ত্রোচ্চারণের মতো। এবং আজকাল তো আকছারই সেই মন্ত্রোচ্চারণও ভুলে ভুলে ভর্তি। থাক আর না। বৃদ্ধ বয়সে জেলে গিয়ে শহিদ হতে চাইনে!
ইউরোপীয়রা টনিকের অবান্তর মন্ত্রোচ্চারণ অর্থাৎ ওষুধটা বাদ দিয়ে শুধু অ্যালকোহলটাই খায়, তবে ১৭ পার্সেন্টের মতো কড়া করে নয়। কেউ খায় স্টাউট, কেউ খায় পোর্ট।
প্রাচ্যে ইহুদি, ক্যাথলিক ও পারসিদের ধর্মানুষ্ঠানেও কিঞ্চিৎ মদ্যের প্রয়োজন হয় বটে, কিন্তু যাজক সম্প্রদায়ের সকলেই অত্যধিক মদ্যপানের বিরুদ্ধে প্রচারকার্য করে থাকেন।
গল্পচ্ছলে প্রচলিত আছে :
দ্বিপ্রহর রাত্রে এক ধার্মিক যুবক
নিদ্রা যায়; ওই তার একমাত্র শখ।
একমাত্র সুখ তার ওই নিদ্রা বটে,
–পিতা তার বৃদ্ধ অতি, কখন কী ঘটে।
ভগিনীটি বড় হল, বিয়ে দেওয়া চাই
দিবারাত্রি খাটে, আহা, গোনে কড়ি পাই।
যৌবনের লোলচর্ম হল অস্থি-সার
নিদ্রাতেই ভোলে তাই নির্দয় সংসার ॥
আপনারা তো আর কেচ্ছা সাহিত্য পড়েন না। হায়, আপনারা জানেন না, আপনারা কী নিধি হারালেন! বিদ্যাসুন্দর পড়ে যখন আনন্দ পান, তখন কেচ্ছা সাহিত্যে নিশ্চয়ই পাবেন।
আমার নিজের বিশ্বাস, কেচ্ছা সাহিত্যের অনুপ্রেরণাতেই বিদ্যাসুন্দরের সৃষ্টি। তা সে যাক।
এবারে কেচ্ছাটাই শুনুন :
এই কেচ্ছা শোনে যেবা এই কেচ্ছা পড়ে
উত্তম চাইল পাবে রেশনে না লড়ে।
বারো আনা দরে পাবে কিলোর ইলিশ।
সরিষার তেল পাবে না সয়ে গর্দিশ।
দেড়টি টাকায় কিলো শোনো পুণ্যবান
খুশিতে ভরপুর হবে জমিন আসমান।
এ সংসারে যে মেলা পাপ মেলা দুঃখ সে বিষয়ে কারও মনে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এগুলো আসে কোথা থেকে? সেমিতি– অর্থাৎ ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলিম গুরুরা বলেন, শয়তান মানুষকে কুপথে নিয়ে গিয়ে পাপ-দুঃখের সৃষ্টি করে। পক্ষান্তরে ভারতীয় তিনটি ধর্মেরই বিশ্বাস পূর্বজন্মের অর্জিত পাপপুণ্যের দরুন এ জন্যেও সুখ-দুঃখ দেখা দেয়– কাজেই হিন্দুধর্মে শয়তানের প্রয়োজন নেই। একদা কিন্তু এই হিন্দুধর্মেও শয়তান জাতীয় একটি অস্তিত্বের আবির্ভাব হয়ে উপযুক্ত প্র্যাকটিসের অভাবে লোপ পায়।
নল-দময়ন্তীর উপাখ্যান যদিও মহাভারতে স্থান পেয়েছে তবু আমার বিশ্বাস মূল গল্পটি বৈদিক যুগেও প্রচলিত ছিল। গ্রিক দেবতা প্রমিথিয়ুস চোঙা বা নলের ভিতর করে আগুন চুরি করেন; নলরাজও ইন্ধন প্রজ্বলনে সুচতুর ছিলেন। স্বয়ং দেবতারা প্রমিথিয়ুসের শত্রুতা করেন। নলের শত্রুতা করে স্বয়ং দেবতারা দময়ন্তীর স্বয়ংবরে উপস্থিত হন– নলকে তাঁর বল্পভা থেকে বঞ্চিত করার জন্যে।
এই নলের শরীরে পাপ কলিরূপে প্রবেশ করেন। এই কলিই আর্যধর্মে শয়তানের অপজিট নাম্বার। মনে করুন সেই শয়তান বা কলি ওই নিদ্রিত যুবকটির সামনে দিল দেখা :
হঠাৎ দেখিল মর্দ সম্মুখে শয়তান
নিদ্রা তার সঙ্গে সঙ্গে হৈল খানখান।
শয়তানের হাতে হেরে ভীষণ তরবার।
আকাশ-পাতাল জুড়ে ফলাটা বিস্তার।
ত্রিনয়ন, কণ্ঠে তার নৃমুণ্ডের মালা
জিহ্বা তার রক্তময় যেন অগ্নি ঢালা।