– ঘুমুচ্ছ, মামেৎ?
–না গো।
–কী বল, মরিস ছেলেটি বড় লক্ষ্মী না।
–সে আর বলতে, বড় লক্ষ্মী ছেলে!
আর সুদ্ধমাত্র একটির পাশে আরেকটি, বুড়ো-বুড়ির ছোট্ট দুটি খাট দেখে আমি ওদের দুজনার মধ্যে পুরোপুরি একটি কথাবার্তা কল্পনা করে নিলুম…
ইতোমধ্যে ঘরের অন্যপ্রান্তে, আলমারির সামনে একটা ভীষণ নাটকের অভিনয় চলছিল। ব্যাপারটা হয়েছে কী, ওই আলমারির সবচেয়ে উপরের থাকে রয়েছে এক বোয়াম লিক্যোর-ব্রান্ডিতে মজানো চেরি। এটা দশ বৎসর ধরে মরিসের জন্য অপেক্ষা করছে। এখন সেটাকে নামাতে হবে যাতে করে আমি এটার উন্মোচন-পর্ব সমাধা করতে পারি। মামেতের সর্ব অনুনয় উপেক্ষা করে বুড়ো স্বয়ং লেগে গেছেন সেটাকে পাওয়ার প্রচেষ্টায়। ভয়ে আড়ষ্ট বউ—আর উনি একটা চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে চেষ্টা করছেন সেটাকে পাড়তে… পাঠক, যেখানে আছ সেখান থেকেই ছবিটি দেখতে পাবে: বুড়ো কাঁপছেন, ঝুলে পড়ে লম্বা হবার চেষ্টা করছেন, ক্ষুদে নীলাম্বরী মেয়ে দুটি চেয়ারটাকে জাবড়ে ধরে আছে। পিছনে মামেৎ হাঁপাচ্ছেন– হাত দুটি দুদিকে মেলে ধরেছেন, আর এসব-কিছুর উপর ভাসছে মৃদু সুগন্ধি নেবুর সৌরভ খোলা আলমারির ভিতর থেকে, থাকে থাকে সাজানো কাপড়ের উঁই থেকে।
অবশেষে, অশেষ মেহন্নতের পর, সেই সুপ্রসিদ্ধ বোয়ামটি আলমারি থেকে বের করা হল, আর তার সঙ্গে টোলে টোলে ভর্তি একটি রুপোর মগ-পারা গেলাস মরিস যখন ছোট্ট ছিল সেই আমলের। গেলাসটি চেরি দিয়ে আমার জন্য কানায় কানায় ভর্তি করা হল; মরিস এই চেরি খেতে কতই না ভালোবাসত! চেরি আর ব্রান্ডি ভরতে ভরতে বুড়ো খুশ-খানা-সমঝদারের মতো আমার কানে কানে বললেন :
-বুঝলে হে, তোমার কপাল ভালোই বলতে হবে, হ্যাঁ, তোমার কথাই কইছি, এখন যা খাবে… আমার গিন্নিই এটি তৈরি করেছেন… খাসা জিনিস খাবে এখন।
হায়রে কপাল! ওঁর গিন্নি এটি তৈরি করেছেন সত্যি, কিন্তু চিনি দিতে গেছেন বেবাক ভুলে! তা আর কী করা যায় বলো! বুড়ো বয়সে কি আর মানুষের সবকিছু মনে থাকে! বেচারি মামে আমার, সত্যি বলতে কি তোমার চেরিগুলো অখাদ্যের একশেষ; হলে কী হয়, আমি চোখের পাতাটি পর্যন্ত না নাড়িয়ে তলানি অবধি সাফ করে দিলুম।
***
খাওয়া শেষ হওয়ার পর আমি উঠে দাঁড়ালুম ওঁদের কাছ থেকে বিদায় নেবার জন্য। ওঁরা অবশ্যি সত্যই খুশি হতেন যদি আমি আরও কিছুক্ষণ থাকতুম, যাতে করে ওঁরা লক্ষ্মী ছেলে মরিস সম্বন্ধে আরও কথা বলতে পারেন, কিন্তু বেলা তখন ঢলে পড়েছে, মিলটাও দূরে– বিদায় নিতেই হয়।
আমার সঙ্গে সঙ্গে বুড়োও উঠে দাঁড়িয়েছিলেন।
–মামেৎ, আমার কোটটা!… আমি ওকে চতুর অবধি পৌঁছে দিয়ে আসি।
সত্যি বলতে কি, মামেৎ মনে মনে দ্বিধা বোধ করছিলেন, বেশ একটু শীত পড়েছে, এ সময় আমাকে চত্বর অবধি পৌঁছে দেওয়াটা ঠিক হবে কি না; কিন্তু সেটা মুখের ভাবে প্রকাশ করলেন না। শুধু শুনতে পেলুম, ঝিনুকের বোতামওলা, সোনালি নস্যি রঙের চমৎকার ফ্র-কোটটি পরিয়ে দিতে দিতে লক্ষ্মী ঠাকুরমাটি কর্তাকে নিচু গলায় শুধোলেন,
তোমার ফিরতে দেরি হবে না তো? কেমন?
বুড়ো একটু দুষ্টুমির মুচকি হাসি হেসে বললেন,
–হেঁ, হেঁ!…কী জানি…হয় তো বা…*[* যৌবনে যে ফুর্তিফার্তি করতে গিয়ে আর পাঁচজনের মতো মাঝে-মধ্যে দেরিতে বাড়িতে ফিরতেন, মামেৎ বকাঝকা করতেন, এটাতে ঠাট্টা করে তারই ইঙ্গিত।]
একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসলেন, ওঁদের হাসতে দেখে বাচ্চা দুটি হাসল, আর খাঁচার কোণে বসে ক্যানারি দুটোও তাদের আপন ঢঙে হাসল… নিতান্ত তোমাকেই বলছি, পাঠক, আমার মনে সন্দ হয়, ওই চেরি-ব্রান্ডির গন্ধে ওরা সবাই বোধহয় একটুখানি বে-এক্তেয়ার হয়ে গিয়েছিলেন।
ঠাকুরদা আর আমি যখন রাস্তায় নামলুম তখন অন্ধকার হব-হব। একটু দূরের থেকে পিছনে পিছনে নীলপোশাকি ছোট্ট মেয়েটি আসছিল ওঁকে ফেরার সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসবার জন্য বুড়ো ওকে দেখতেও পাননি। তিনি সগর্বে আমার বাহু ধরে চলছিলেন যেন কতই না শক্তসমর্থ মদ্দা জোয়ান। মামে ভরপুর হাসিমুখে দোরে দাঁড়িয়ে এসব দেখছিলেন, আর আমাদের দিকে তাকিয়ে এমনভাবে খুশিতে মাথা নাড়ছিলেন যেন ভাবখানা এই যা-ই বলো, যা-ই কও, আমার বুড়া এখনও তো দিব্য চলাফেরা করতে পারে।*[*আলস্ দোদের শব্দে শব্দে অনুবাদ।]
.মদ্যপন্থা ওরফে মধ্যপন্থা
মদ্যপান ভালো না মন্দ সে নিয়ে ইউরোপে কখনও কোনও আলোচনা হয় না–যেমন তাস খেলা ভালো না মন্দ সে-নিয়েও কোনও তর্কাতর্কি হয় না। কিন্তু একথা সবাই স্বীকার করেন। যে মাত্রাধিক মদ্যপান গহিত এবং অত্যন্ত বিপজ্জনক যেরকম তাস খেলাতে মাত্রাধিক বাজি রেখে, অর্থাৎ সেটাকে নিছক জুয়ো খেলায় পরিণত করে সর্বস্ব খুইয়ে দেওয়া নিশ্চয়ই অনুচিত।
এ দুটো ব্যসন যে আমি একসঙ্গে উত্থাপন করলুম সেটা কিছু এলোপাতাড়ি নয়। কুরান শরিফে এ-দুটিকে একসঙ্গে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এ দুটির উৎপত্তিস্থল স্বয়ং শয়তান। তৎসত্ত্বেও ইদানীং পূর্ব পাকিস্তানের একখানি দৈনিকে আলোচনা হচ্ছে, মাত্রা মেনে, অতিশয় সাবধানে কিংবা স্বাস্থ্যলাভের জন্য সামান্য মদ্যপান করা শাস্ত্রসম্মত কি না? এ বিষয়ে উকৃষ্ট আলোচনার জন্য যতখানি মুসলিম শাস্ত্রজ্ঞান থাকা উচিত আমার সেটি নেই। এবং শাস্ত্র ছাড়া লোকাঁচার, দেশাচার নামক প্রতিষ্ঠান আছে। উভয় বাঙলার এই দুটি আচারে মদ্যপান নিন্দিত। বরঞ্চ পশ্চিম বাংলার কোনও কোনও জায়গায় তাড়ির প্রচলন আছে– পুব বাঙলায় সেটাও নেই, অন্তত আমার চোখে পড়েনি।