বুড়ো-বুড়িকে যেন আশ্রয় দিয়ে রক্ষণ করছে– এর চেয়ে হৃদয়স্পর্শী যেন আর কিছুই। কল্পনা করা যায় না।
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বুড়ি আমাকে গভীর সম্মান-অভিবাদন জানাতে আরম্ভ করছিলেন, কিন্তু বুড়ো একটি শব্দ দিয়েই তার সসম্মান-অভিবাদন কেটে দু-টুকরো করে ফেললেন :
এ তো মরিসের বন্ধু…
সঙ্গে সঙ্গে বুড়ি কাঁপতে লাগলেন, কেঁদে ফেললেন, রুমালখানা হারিয়ে ফেললেন, মুখ রাঙা হয়ে গেল, টকটকে লাল, বুড়োর চেয়েও বেশি লাল… হায়, বুড়ো-বুড়ি! এঁদের সর্ব শিরায় আছে মাত্র একটি ফোঁটা রক্ত, আর সামান্যতম অনুভূতির পরশ লাগলেই সেই ফোঁটাটি মুখে এসে পৌঁছে যায়।
শিগগির, শিগগির চেয়ার নিয়ে এস… বুড়ি তার বাচ্চাটিকে বললেন।
জানালাটা খুলে দাও– বুড়ো তার বাচ্চাটিকে হুকুম দিলেন।
তার পর দুজনাতে আমার দু বাহু ধরে খুট খুট করে হেঁটে নিয়ে চললেন জানালার কাছে। সেটা পুরো খুলে দেওয়া হয়েছে যাতে করে ওঁরা আমাকে আরও ভালো করে দেখতে পান। আমরা এগিয়ে গেলুম আরামকেদারার কাছে। আমি বসলুম তাঁদের দুজনার মাঝখানে চেয়ারে। মেয়ে দুটি আমাদের পিছনে। তার পর আরম্ভ হল সওয়াল :
কী রকম আছে সে? কী করে সে? এখানে আসে না কেন? সুখে আছে তো?…
এটা, ওটা, সেটা–কত শত কথা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
আর আমি? তারা আমার বন্ধুবাবদে যেসব প্রশ্ন শুধোচ্ছিলেন সেগুলোর উত্তর আমার সর্বশ্রেষ্ঠ সাধ্যমতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তো দিলুমই– যেগুলো জানা ছিল; আর যেগুলো জানা ছিল না সেগুলো নির্লজ্জভাবে বানিয়ে বানিয়ে। আর বিশেষভাবে অবশ্যই কিছুতেই স্বীকার করলুম না যে, তার ঘরের জানালাগুলো ঠিকমতো বন্ধ হয় কি না সেটা যে আমি লক্ষ করিনি, কিংবা তার ঘরের দেয়ালের কাগজগুলো কোন রঙের!
তার ঘরের দেয়ালের কাগজগুলো কোন রঙের?… নীল রঙের ঠাকুমা, হালকা নীল– আসমানি রঙের ফুলের মালার ছবি আঁকা।…
–তাই না? বুড়ি একবারে গদগদ। তার পর স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, সোনার চাঁদ ছেলেটি!
বুড়ো সোৎসাহে যোগ দিলেন, সোনার চাঁদ ছেলে।
আর আমি যতক্ষণ কথা বলছিলুম, তারা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে ক্ষণে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাচ্ছিলেন, ক্ষণে সামান্য স্মিতহাস্য করছিলেন, ক্ষণে চোখে চোখে ঠার মারছিলেন, ক্ষণে একে অন্যকে ঠিক ঠিক বুঝতে পারার ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন কিংবা বুড়ো আমার একটু কাছে এসে আমায় বলেন,
আরেকটু জোরে কও… ভালো করে শুনতে পায় না ও।
আর উনিও, আরেকটু চেঁচিয়ে লক্ষ্মীটি!… উনি সবকথা ভালো করে শুনতে পান না…
আমি তখন গলাটা একটু চড়াই; দুজনাই তখন একটুখানি স্মিতহাস্যে আমাকে ধন্যবাদ জানান। আর তাঁদের সেই হালকা ফিকে স্মিতহাস্যভরা দৃষ্টি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে তারা যেন আমার চোখের নিভৃততম গভীরে খুঁজে দেখবার চেষ্টা করেন তাঁদের মরিসের ছবি; আর আমার হৃদয়ও যেন আমার বন্ধুর ছবি তাঁদের চোখে দেখে একেবারে গলে যায়– আবছা-আবছা, ঘোমটা-ঢাকা। ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, যেন অনেক দূরের থেকে, কুয়াশার ভিতর দিয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসছে।
***
হঠাৎ বুড়ো তাঁর আরামকেদারার গভীর থেকে হকচকিয়ে উঠলেন :
আমার কী মনে পড়ল, মামেৎ.. সে বোধহয় এখনও দুপুরের খাবার খায়নি!
আর মামেৎ আর্ত হয়ে শূন্যে তুলে দিয়েছেন হাত দু খানা :
এখনও খায়নি!… হে দয়াময়, হে ভগবান!
আমি ভাবলুম, এখনও বুঝি মরিসের কথাই হচ্ছে; তাই তাঁদের বললুম যে, তাঁদের যাদু মরিস দুপুর হতে না হতেই খানার টেবিলে বসে যায় তার চেয়ে দেরি সে কস্মিনকালেও করে না। কিন্তু না, এবারে উঠেছে আমার কথা। আর আমি যখন স্বীকার করলুম যে আমি তখনও খাইনি, তখন যে ধুন্দুমার আরম্ভ হল সেটা সত্যি দেখবার মতো।
শিগগির শিগগির নিয়ে এস। ছুরি-কাঁটা সব– ও বাচ্চারা! টেবিলটা ঘরের মধ্যিখানে নিয়ে এস। রবারের টেবিলক্লথ, ফুলেল নকশাদার বাসন-প্লেটগুলো! আর অত হাসাহাসি না করলেও আমাদের চলবে, বুঝলে! আর জলদি, জলদি প্লিজ!
আমার মনে কণামাত্র সন্দেহ নেই, তারা জলদি জলদিই করেছিল! তিনখানা পেলেট ভাঙতে যতখানি সময় লাগার কথা তার পূর্বেই টেবিল, খাবার-দাবার, সব তৈরি।
সামান্য একটু ভালো-মন্দ নাশতা বই আর কিছু নয়–আমাকে টেবিলের দিকে নিয়ে যেতে যেতে মামেৎ বললেন। শুধু তোমাকে একলা-একলিই খেতে হবে। আমরা? আমরা সকালবেলাই খেয়ে নিয়েছি।
বেচারা বুড়ো-বুড়ি! যে কোনও সময়েই ওঁদের শুধোও না কেন, ওঁদের সবসময়েই ওই এক উত্তর, তাঁরা সকাল সকালই খেয়ে নিয়েছেন।
মামেতের দেওয়া নাশতা– দুধ, খেজুর আর একখানা আস্ত পাই; ওই দিয়ে কিন্তু মামে আর তার ক্যানারিপাখিগুলোর নিদেন আটদিনের খাওয়া-দাওয়া চলে যায়… তাই ভাবো দিকিনি, আমি একাই তাবৎ মালের শেষ কণাটুকু খেয়ে ফেললুম!… আর টেবিলের চতুর্দিকে সে কী কেলেঙ্কারি! ক্ষুদে দুই নীলাম্বরী একে অন্যকে কনুইয়ের গুতো মেরে ফিসূফিস্ করছিল, আর খাঁচার ভিতরে ক্যানারিগুলোর ভাব, যেন মনে মনে বলছে, দেখেছ! এ কেমন ভদ্রলোক। গোটা পাইটাই খেয়ে ফেলল!
কথাটা সত্যি। আমি প্রায় সমস্তটাই বেখেয়ালে খেয়ে ফেলেছি– কারণ আমি তখন ওই শান্ত শীতল ঘরটার চতুর্দিকে তাকিয়ে দেখছি সেখানে কেমন যেন প্রাচীন দিনের সৌরভ ভাসছিল… বিশেষ করে দুটি ছোট্ট খাট থেকে আমি আমার চোখ কিছুতেই ফেরাতে পারছিলুম না। প্রায় যেন ছোট্ট দুটি শিশুদের দোলনা। আমি কল্পনা করতে লাগলুম সকালে, অতি ভোরে বুড়ো-বুড়ি ঝালর-লাগানো পর্দাঘেরা খাটের গভীরে শুয়ে। ভোর তিনটে বাজল। ওইটেই সব বুড়ো-বুড়ির জেগে ওঠার সময়।