সৈয়দদ্বয়ের সামনে তাকে আনা হলে তাঁদের একজন আপন কলম-দান খুলে, চোখে সুরমা (কাজল) লাগাবার শলাকা ঘাতকের হাতে দিলেন। ফররুখসিয়ারকে সবলে চিৎ করে ফেলে অন্ধ করা হল। তবে কোনও কোনও ঐতিহাসিক বলেন, ওই নিষ্ঠুর কর্ম যে করেছিল সে তাঁকে সম্পূর্ণ অন্ধ করেনি সে ভেবেছিল, বলা তো যায় না, হয়তো একদিন তিনি আবার রাজা না হলেও যথেষ্ট শক্তিশালী হবেন, তখন সে মৃত্যুদণ্ড তো এড়াবেই, হয়তোবা বখশিশও পেতে পারে। ফররুকসিয়ারকে নহবতখানায় বন্দি করে রাখা হল। লালকেল্লার আজকের দিনের প্রধান প্রবেশপথ ও দেওয়ান-ই-আম-এর মাঝখানে এটা পড়ে।
ওদিকে কিন্তু দিল্লির অন্য এক মহল্লায় এক ভিন্ন কমেডি শুরু হয়েছে।
সৈয়দদ্বয় অনেক চিন্তা ততোধিক তর্কবিতর্ক আলোচনা করে স্থির করেছেন যে, ফররুখসিয়ারের খুড়ো রফি-উশ-শানের (ইনি আজিম-উশ-শানের পরের ভ্রাতা আওরঙ্গজেবের দৌহিত্র) জ্যেষ্ঠ পুত্র তরুণ মুহম্মদ ইব্রাহিমকে সিংহাসনে বসানো হবে। সেই মর্মে দূত পাঠানো হয়েছে রফি-উশ-শানের হাভেলিতে। সেখানে ইব্রাহিম তাঁর ভাই ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনসহ বাস করেন।
দূতের দল উপস্থিত হওয়ামাত্রই হাভেলিতে উচ্চৈঃস্বরে বামাকণ্ঠের ক্রন্দন রোদন চিৎকার অভিসম্পাত আরম্ভ হল।
কারণটা সরল। কয়েকদিন ধরেই দিল্লি শহর শত রকমের গুজবে ম-ম করছে। ফররুখসিয়ার সিংহাসনচ্যুত হলে হতেও পারেন যদিও অনেকেই প্রাণপণ আশা করছিলেন, অজিত সিং যা-ই করুন, আপন জামাতাকে সিংহাসনচ্যুতি থেকে রক্ষা করবেন নিশ্চয়ই, নইলে তাঁর নিধন অবধারিত ও দিল্লিবাসীদের কাছে যে ব্যক্তি পুত্রকে হত্যা করে তার চেয়েও ঘৃণ্য– যে তার মেয়েকে বিধবা হতে দেয়। কিছুদিন পর ফররুখসিয়ার নিহত হওয়ার পর অজিত সিং রাস্তায় বেরোলেই তার সশস্ত্র পাইক-বরকন্দাজকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা। করে রাস্তার ছোঁড়ারা তাঁর পাল্কির দুই পাশে ছুটতে ছুটতে তারস্বরে ঐক্যতান ধরত, দামাদকুশ, দামাদকুশ জামাতৃহন্তা, জামাতৃহন্তা! পুত্রকে হত্যা করে কেউ এভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন বলে আমার স্মরণে আসছে না।)
ফররুখসিয়ার সিংহাসন হারালে সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের যে কার প্রতি নেক্-নজর–অবশ্য যে-ই রাজা হোন তাঁকে হতে হবে ভ্রাতৃদয়ের হস্তে পুত্তলিকা মাত্র– পড়বে তার কিছু স্থিরতা ছিল না। দূতরা তাই যখন হাভেলির সামনে এসে সুসংবাদ দিল, তারা এসেছে সমারোহ। সহকারে নবীন রাজা মুহম্মদ ইব্রাহিমকে তাঁর অভিষেকের জন্য নিয়ে যেতে, তখন সবাই নিঃসন্দেহে ভাবল এটা একটা আস্ত ধাপ্পা। আসলে আর কেউ বাদশা হয়ে দূত পাঠিয়েছেন ইব্রাহিমকে ছলে বলে পকড় করে নিয়ে গিয়ে হয় হত্যা করতে, নিদেন অন্ধ করে দিতে– যাতে করে পরবর্তী প্রতিদ্বন্দীরা সম্পূর্ণ নির্মূল হয়; এ রেওয়াজ তো রাস্তার ভিখিরি পর্যন্ত জানে, জানবে না শুধু রাজবাড়ির হারেমের মহিলারা! তওবা! তওবা!!
বিরাট বাড়ি। বিস্তর কুঠুরি, চিলেকোঠা। তদুপরি এসব কারবার তো দিল্লি শহরে হামে-হাল লেগেই আছে। তাই দু-চারটে গুপ্তঘর, পালিয়ে যাবার সুড়ঙ্গও যে নেই, এ কথাই বা বলবে কে? হারেম-মহিলারা তড়িঘড়ি ইব্রাহিম ও তার ছোট ভাই রফি উদ্-দৌলাকে কোথায় যে লুকিয়ে ফেললেন তার সন্ধান পেতে আদৌ যদি পাওয়া যায়– লাগবে সময়। ওদিকে দূতদের পই পই করে বলা হয়েছে, তারা যাবে আর আসবে, ছররার মতো দ্রুতবেগে, এবং পথমধ্যে যেন তিলার্ধকাল বিলম্ব না করে। কারণটি অতিশয় স্বপ্রকাশ। দিল্লি শহরের দুগ্ধপোষ্য শিশু পর্যন্ত জানে, একবার যদি খবর রটে যায় এবং সেটা কিছুমাত্র অসম্ভব নয়– যে ফররুখসিয়ার সিংহাসনচ্যুত হয়ে গিয়েছেন এবং সে সিংহাসন তখনও শূন্য তা হলে আওরেঙ্গজেব-বংশের যে কোনও রাজপুত্র দুঃসাহসে ভর করে নিজেকে বাদশা বলে ঘোষণা করে দেবে। সৈয়দ-ভায়েরা বিলক্ষণ জানতেন যে, যদিও আমির-ওমরাহ সোওয়ার-সেপাই তাদের পক্ষে, তবু এ তত্ত্বটি ভুললে বিলকুল চলবে না যে, ফররুখসিয়ার ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় সম্রাট। তার পর আরেকটা কথা। আওরেঙ্গজেবের এক বংশধর যদি অন্য বংশধরকে খেদিয়ে দিয়ে সিংহাসন দখল করেন, তবে জনসাধারণ হয়তো কোনও পক্ষই নেবে না। কিন্তু সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় তো কোনও রাজাদেশে, সিংহাসনে হক্কধারী কোনও রাজপুত্রের হুকুমে বাদশাহ ফররুখসিয়ারকে সিংহাসনচ্যুত করেননি। তারা কে? আসলে সিন্ধু প্রদেশের দুই ভাগ্যান্বেষী। একজন ফররুখসিয়ারের প্রধানমন্ত্রী, অন্যজন প্রধান সেনাপতি। অর্থাৎ তার কর্মচারী এবং তাঁরই নুননেমক খেয়েছেন অন্তত দু-টি বছর ধরে। তাই মনিবকে সিংহাসনচ্যুত করে এঁরা যে অপকর্মটি করলেন এটা নেমকহারামির চূড়ান্ত! দিল্লির জনসাধারণ উজবুক নয়। তারা যদি ক্ষেপে যায় তবে সৈন্য-সামন্ত নিয়েও দিল্লিকে ঠাণ্ডা করা রীতিমতো মুশকিল হবে।
অতএব সৈয়দদের সর্বাপেক্ষা জরুরি প্রয়োজন, তড়িঘড়ি আওরেঙ্গজেবের কোনও সন্তানকে সিংহাসনে বসিয়ে তার কাছ থেকে ফরমান নিয়ে আইনত এবং ঐতিহ্যগত পন্থায় দিল্লির রাজভক্ত প্রজাগণকে মোকাবেলা করা।
কিন্তু দূতরা গুপ্তঘরের সন্ধান পাবে কী করে? বাচ্চাটিকে কেড়ে নিতে চাইলে বেড়ালটা পর্যন্ত মারমুখো হয়ে ওঠে। এরা আবার তুর্কি রমণী– যুগ যুগ ধরে ইয়া তাগড়া তাগড়া মর্দকে কড়ে আঙুলের চতুর্দিকে ঘুরিয়েছে।