জাহান্নামে যাক বন্ধুত্ব! ঠিক আজকের সকালটাতেই আবহাওয়াটি হয়েছে চমৎকার, কিন্তু বাউণ্ডুলের মতো যত্র-তত্র চর্কিবাজি খাওয়ার মতো আদপেই নয়। একে তো বইছে জোর হাওয়া, তদুপরি রৌদ্রটিও চড়চড়ে কড়া–প্রভাস অঞ্চলের খাঁটি দিন যাকে বলে। আমি ঠিক করে বসেছিলুম, দুটি পাহাড়ের ঢিপির মধ্যিখানে শুয়ে শুয়ে সমস্ত দিনটা কাটিয়ে দেব হুবহু একটি গিরগিটির মতো, সূর্যালোক পান করতে করতে আর পাইনগাছের মর্মরগান শুনতে শুনতে– এমন সময় এল ওই লক্ষ্মীছাড়া চিঠিটা… কিন্তু করা যায় কী কও? মিটা বন্ধ করলুম অভিসম্পাত দিতে দিতে, চাবিটা রেখে দিলুম বেড়ালটার আসা-যাওয়ার ছোট্ট গর্তটার ভিতর। লাঠিটা, পাইপটি ব্যস্, নাবলুম রাস্তায়।
বেলা প্রায় দুটোর সময় পৌঁছলুম এইগুইয়েরে। গা-টা খাঁ খাঁ করছে, সবাই খেত-খামারে। ধুলোয় ঢাকা এলমগাছে ঝিল্লি ঝি ঝি করছে যেন নির্জন খোলামাঠের মধ্যিখানে। অবশ্য সরকারি বাড়িটার সামনের চত্বরে একটা গাধা রোদ পোয়াচ্ছিল বটে, আর গির্জের সামনের ফোয়ারায় একপাল পায়রাও ছিল, কিন্তু অনাথাশ্রমটি দেখিয়ে দেবার মতো কেউই ছিল না। কিন্তু কপাল ভালো, হঠাৎ আমার সামনে যেন পরীর মতো আত্মপ্রকাশ করল এক বুড়ি। ঘরের সামনের এক কোণে উবু হয়ে বসে চরকা কাটছিল। শুধালুম তাকে। আর পরীটিরও ছিল দৈবীশক্তি। কড়ে আঙুলটি তুলে দেখাতে না-দেখাতে তৎক্ষণাৎ চোখের সামনে যেন মন্ত্রবলে আমারই সামনে দাঁড়িয়ে উঠল অনাথাশ্রমটি!… বিরাট, ভারিক্কি, কালো কুঠিবাড়ি। বেশ দেমাকের সঙ্গে তার দেউড়ির উপরের পাঁশুটে লাল রঙের প্রাচীন দিনের ক্রুশ–চতুর্দিকে আবার দু ছত্তর লাতিনও দেখিয়ে দিচ্ছে। ওই বাড়িটার পাশেই দেখতে পেলুম আরেকটি ছোট্ট বাড়ি। ছাইরঙের খড়খড়ি, পিছনে ছোট্ট বাগানটি… তদ্দণ্ডেই চিনে গেলুম, কড়া না নেড়েই ঢুকে পড়লুম।
আমার বাকি জীবন ধরে আমি সেই দীর্ঘ করিডরটি দেখব; মন্দ-মধুর ঠাণ্ডা, শান্ত-প্রশান্ত, দেয়ালগুলো গোলাপি রঙের, খড়খড়ির ভিতর দিয়ে দেখি বাগানটি যেন স্বচ্ছ রৌদ্রালোকে অল্প অল্প কাঁপছে, আর সার্সিগুলোর উপর ফুলপাতায় জড়ানো বেহালার ছবি আঁকা। আমার মনে হল আমি সেদে যুগের প্রাচীন সম্রান্ত দরবারখানায় পৌঁছে গিয়েছি।… করিডরের শেষপ্রান্তে, ডানদিকে, আধ-ভেজানো দরজার ভিতর দিয়ে আসছে দেয়ালঘড়ির টিক-টাক শব্দ, আর একটি শিশু স্কুলের বাচ্চার গলার শব্দে প্রতি শব্দে থেমে থেমে পড়ছে : তখন…সেন্ট…ইরেনে…চিকা…র…করে…বললেন…আমি…প্রভুর…যেন… গম..শস্য… আমাকে…ময়দা…হতে…হয়ে …ওই…সব…পশুদের…দাঁতের…পিষণে…। আমি ধীরে ধীরে মৃদু পদে সেই দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে ভিতরের দিকে তাকালুম।
শান্ত, অর্ধ দিবালোকে, ছোট্ট একটি কামরার ভিতর, গভীর একটা আরাম কেদারার ভিতর ঘুমুচ্ছেন এক অতি বৃদ্ধ। গোলাপি ছোট্ট দুটি গাল, আঙুলের ডগা অবধি সর্বশরীরের চামড়া কোঁচকানো, মুখ খোলা, হাত দুটি দুজানুর উপর পাতা। তাঁর পায়ের কাছে নীল পোশাক পরা ছোট্ট একটি মেয়ে মাথায় নাদের মতো টুপি, অনাথাশ্রমের মেয়েদের পোশাক পরা– সাধ্বী ইরেনের জীবনী পড়ছে– বইখানা আকারে তার চাইতেও বড়। এই অলৌকিক পুরাণপাঠ যেন সমস্ত বাড়িটার ওপর ক্রিয়া চালিয়েছে। বৃদ্ধ ঘুমুচ্ছেন তাঁর আরামকেদারায়, মাছিগুলো ছাতে, ক্যানারি পাখিগুলো এই হোথায় জানালার উপরে তাদের খাঁচায়। প্রকাণ্ড দেয়ালঘড়িটা নাক ডাকাচ্ছে– টি, টাক, টিক্ টা। সমস্ত ঘরটাতে কেউই জেগে নেই–সুন্দুমাত্র খড়খড়ির ভিতর যে একফালি সাদা সোজা আলো এসে পড়েছে তার ভিতর ভর্তি জীবন্ত রশ্মি-কণা– তারা নাচছে তাদের পরমাণু নৃত্যের চক্রাকারের ওয়ালট… এই ঘরজোড়া তন্দ্রালসের মাঝখানে সেই মেয়েটি গম্ভীর কণ্ঠে পড়ে যাচ্ছে : সঙ্গে… সঙ্গে… দুটো… সিংহ… লাফ… দিয়ে… পড়ল… তার… উপর… এবং তাঁকে… উদর… সাৎ.. করে… ফেলল… ঠিক ওই মুহূর্তেই আমি ঘরে ঢুকলুম। স্বয়ং সেন্ট ইরেনের সিংহদুটোও ওই সময়ে সে-ঘরে ঢুকলে এতখানি বিহ্বলতার স্তম্ভন সৃষ্টি করতে পারত না। সে-যেন রীতিমতো নাটকীয় আচমকা আবির্ভাব! বাচ্চাটা ডুকরে উঠল, বিরাট কেতাবখানা পড়ে গেল, ক্যানারিপাখিগুলো জেগে উঠল, দেয়ালঘড়িটা ঢং ঢং করে উঠল, বুড়ো প্রায় লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন– একেবারে হকচকিয়ে গেছেন– আর আমিও কেমন যেন বোকা বনে গিয়ে চৌকাঠে থমকে গিয়ে বেশ একটু জোর গলায় বলে উঠলুম : সুপ্রভাত, সজ্জনগণ! আমি মরিসের বন্ধু!
আহা! আপনারা যদি তখন তাঁকে দেখতে পেতেন– যদি দেখতে পেতেন, বেচারি বুড়োকে দেখতে পেতেন! দুই বাহু প্রসারিত করে আমাকে আলিঙ্গন করতে, আমার হাত দুখানা ধরে ঝাঁকুনি দিতে এগিয়ে এলেন, আর ঘরময় উত্তেজিত হয়ে ছুটোছুটি লাগিয়ে শুধু বলন,
হে দয়াময়, হে দয়াময়!…
তার মুখের সব কোচকানো চামড়া হাসিতে ভরে উঠেছে। আর তোতলাচ্ছেন,
আ মসিয়ো… আ মসিয়ো…
তার পর কামরার শেষ প্রান্তে ডাক দিতে দিতে গেলেন :
মামেৎ!
একটা দরজা খুলে গেল। করিডরে যেন একটা ইঁদুরের পায়ের শব্দ শোনা গেল… ওই যে মামেৎ! ওই একফোঁটা বুড়ি– কী যে সুন্দর দেখাচ্ছিল– মাথায় গিঁট বাঁধানো বনেট, পরনে কারমেলিট নাদের ফিকে বাদামি রঙের পোশাক, হাতে নকশাকাটা রুমাল আমাকে সেই প্রাচীনদিনের কায়দায় অভিনন্দন জানাবার জন্যে…ওঁদের দেখলেই কিন্তু বুকটা দরদে ভরে আসে, দুজনারই চেহারা একই রকমের! বুড়োর মাথার চুল বদলে দিয়ে বুড়ির বনে তাঁর মাথায় পরিয়ে দিলে তাকেও মামেৎ নাম দেওয়া যেত!… শুধু সত্যিকার মামেকে নিশ্চয়ই তাঁর জীবনে চোখের জল ফেলতে হয়েছে অনেক বেশি, আর তার সর্বাঙ্গের চামড়া কুঁকড়ে গিয়েছে আরও বেশি। বুড়োর মতো ওঁরও সঙ্গে অনাথাশ্রমের একটি ছোট্ট মেয়ে, পরনে অন্য মেয়েটার মতোই পোশাক, বুড়ির সঙ্গে সর্বক্ষণ থাকে, কখনও তাঁর সঙ্গ ছাড়ে না– অনাথাশ্রমে আশ্রয়প্রাপ্ত দুটি বাচ্চা মেয়ে এই দুই