আমি মনে মনে সম্পূর্ণ সায় দিলুম। এবং যোগ দিলুম, হয়তো চীন পারবে।
কিন্তু একটা প্র্যাকটিকাল উপদেশ আমি দিই। বিয়ের পূর্বের সর্ব অভিজ্ঞতা যেন বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে হয়। তার প্রথম কারণ তারা প্রবীণতর, পকৃতর। তাদের কাছে শুধু প্রণয় নয়, জীবনের মূল্যবান আরও অনেক-কিছু শেখা যায়। কিন্তু খবরদার আহামুকের মতো ককখনও তাকে বলবে না, তোমার বউকে ডিভোর্স করে আমাকে বিয়ে কর। এক্সপেরিমেন্টের ইঁদুরকে আকাট মূর্খও বিয়ে করে না।
আরেকটা কারণ বললে তোমাদের তরুণ-হৃদয়ে হয়তো একটু বাজবে।
ওই বিবাহিতদেরই দু পয়সা রেস্ত থাকে। বনে-বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে আর স্রেফ হাওয়া খেয়ে খেয়ে জীবনের কোনও অভিজ্ঞতাই সঞ্চয় হয় না। সেটা হয় জনসমাজে। ক্লাব, রেস্তোরাঁ, অপূরা, জুয়োর কাসিনো, রেস্, রিভিয়েরা, সুইজারল্যান্ড ভ্রমণ, এগুলো না করলে, না চষলে কোনও এলেমই হয় না, যেটা তোমার ভবিষ্যৎ স্বামী ও দাম্পত্যজীবনে কাজে লাগবে।
আরেকটা সুবিধে, বলা তো যায় না, তিনি যদি মাত্রা সামলাতে না পেরে তোমাকে বিয়ে করতে চেয়ে বসেন, তুমি তখন অতিশয় ব্রীড়া সহকারে বলতে পারবে, আমি চাইনে যে আপনার স্ত্রীকে ডিভোর্স করে আপনি একটি পরিবার নষ্ট করুন।
এবং শেষ সুবিধে, যেদিন তুমি কেটে পড়তে চাইবে, সেদিন স্বচ্ছন্দে বলতে পারবে, আমারও তো সংসার পাততে হবে, আমারও তো সমাজের প্রটেকশন দরকার, তার পর ব্লাশ করে বলবে, আমিও তো, আমিও তো মা হতে চাই।
কী বলব পাঠক, সে যা অনবদ্য অভিনয় করলেন সেই বিবাহিতা যুবতীটি– আহা যেন ষোল বছরের তরুণীটি, ভাজা মাছটি উন্টে খেতে জানেন না। ধন্য নটরানি প্যারিস, ধন্য তোমার অভিনয়, ধন্য তোমার নব মরালিটি! সাধে কি লোক বার বার বলে, সি প্যারিস অ্যান্ড ডাই। প্যারিস দেখার পর পৃথিবীতে দেখবার মতো আর তো কিছু থাকে না।
তবে আমার অনুরোধ, অন্যান্য বহু বস্তু নির্মাণ করার সময় ফ্রান্সে আইনত যেমন ছাপ মারতে হয়, নট ফর একত্সপোর্ট–বিদেশে চালান নিষিদ্ধ, এই নব মরালিটির উপরও যেন তেমনি ছাপটি সযত্নে মারা হয়।
তবে আমি এটি আমদানি করলুম কেন? বুঝিয়ে বলি। বিদগ্ধা যুবতীটি যা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলেছিলেন আমি তার সহস্রাংশের একাংশও বলিনি। আমি শুধু সেটুকুই বলেছি, যেটুকু আপনার জানা থাকলে যদি কখনও প্যারিসের ওই নব মরালিটিটি এদেশে চোরাবাজার দিয়ে বা স্মাগড় হয়ে চলে আসে তবে যেন তৎক্ষণাৎ সেটি চিনতে পারেন।
চার্লি চ্যাপলিন এই কর্মটি করেছিলেন। অনেকেই তার মিশিয়ে ভেদু ছবি দেখেছেন। চ্যাপলিনের পূর্বেও তার সময়ে ইউরোপের কোনও কোনও দার্শনিক সাড়ম্বর প্রচার করেন, জীবনসংগ্রামে বেঁচে থাকার জন্য মানুষ যেন সর্বাস্ত্র প্রয়োগ করে সর্ব প্রতিদ্বন্দ্বীকে অর দ্য কঁবা–দরকার হলে খতম করে দেয়। সেই হাস্যাস্পদ দর্শনের বেকুব চরম পরিণতি প্রমাণ করার জন্য চ্যাপলিন দেখান কীভাবে একজন লোক একটার পর একটা ধনী প্রাপ্তবয়স্কা রমণীকে বিয়ে করে তাকে সুকৌশলে খুন করে অর্থ সঞ্চয় করতে থাকে। কিন্তু খুনের কৌশলটি ছবিতে দেখাননি।
আমিও বিদগ্ধা প্যারিসিনীর আসল অস্ত্রটির রহস্য সযত্নে গোপন রেখেছি।
বুড়ো-বুড়ি
চিঠি নাকি, বাবাজি আজান?
বিলক্ষণ, মসিয়ো… প্যারিস থেকে এসেছে।
চিঠিখানি যে খুদ প্যারিস থেকে এসেছে তাই নিয়ে সাদা-দিল্ বাবাজি আজানের চিত্তে রীতিমতো দেমাক।… কিন্তু আমার না। কে যেন আমায় বলে দিচ্ছিল, এই যে অ্যা জাহ্ন রুশো সরণির প্যারিসিনী বলা নেই কওয়া নেই, সাত সকালে হঠাৎ আমার টেবিলের উপর এসে অবতীর্ণ হলেন, ইনি আমার পুরো দিনটারই সর্বনাশ করবেন। ঠিক। ভুল করিনি; বিশ্বেস না হয় দেখুন :
আমার একটু উপকার করতে হবে, দোস্ত। তোকে একদিনের তরে তোর ময়দা-কল বন্ধ করে সঙ্গে সঙ্গে এইগুইয়ের যেতে হবে… এইগুইয়ের বড় গগ্রাম, তোর ওখান থেকে পাঁচ ছ কোশ কিছু না, বেড়াতে বেড়াতে পৌঁছে যাবি। পৌঁছে অনাথাশ্রমের খোঁজ নিবি। আশ্রমের ঠিক পরের বাড়িটা একটু নিচু, জানালা-খড়খড়ি ছাই-রঙা, বাড়ির পিছনভাগে একটুখানি বাগান। কড়া না নেড়েই ঢুকে পড়বি– দরজা হামেহাল খোলা থাকে আর ঘরে ঢুকেই আচ্ছা জোরসে চেঁচিয়ে বলবি, সজ্জনদের পেন্নাম জানাই! অমি মরিসের বন্ধু… তখন দেখতে পাবি একমুঠো সাইজের ছোট্ট একজোড়া বুড়ো-বুড়ি, ওহ! সে কী বুড়ো! বুড়ো, তার চেয়েও বুড়ো, আদ্যিকালের বুড়ো-বুড়ি তাদের বিরাট আরামকেদারার গর্ত থেকে তোর দিকে হাত তুলে ধরবেন, আর তুই তখন তাদের আমার হয়ে আলিঙ্গন করবি, চুমো খাবি, তোর সর্বহৃদয় দিয়ে, যেন ওঁরা তোরই। তার পর সবাই মিলে গাল-গল্প আরম্ভ হবে; ওঁনারা সুদু আমার সম্বন্ধেই কথা কইবেন, আর কিছুটি না, সুদু আমার কথা; হাজার হাজার আবোল তাবোল বকে যাবেন, তুই কিন্তু হাসবিনি… হাসবিনি কিন্তু বুঝেছিস?… এরা আমার ঠাকুদ্দা, ঠাকুমা, ওঁদের আগাপাশতলা প্রাণ একমাত্র আমি এবং আমাকে দশ বছর হল দেখেননি… দশ বছর– দীর্ঘকাল! কিন্তু কী করি বল! আমি– প্যারিস আমাকে জাবড়ে ধরে আছে; ওঁদের? ওঁদের আটকে রেখেছে বুড়ো বয়স… এদের যা বয়স, আমাকে দেখবার জন্য রওনা হলে পথিমধ্যে চালানি মালের মতো টুকরো টুকরো হয়ে যাবেন… কিন্তু আমার কপাল ভালো, তুই তো ভাই, হোথায় আছিস, বেরাদর আমার, ময়দাকলের মালিক তোকে আদর-প্যার করে বেচারি বুড়ো-বুড়িরা আনন্দ পাবে, যেন আমারই এ্যাটুখানিকে চুমো-চামা খাচ্ছে.. আমি অনেকবার আমাদের কথা ওঁদের বলেছি, এবং আমাদের গভীর বন্ধুত্ব সম্বন্ধেও, যেটি কি না…