তবে কি একনিষ্ঠ প্রেম বলে কিছুই নেই?
কী উৎপাত! কে বলল নেই? নিশ্চয়ই আছে। যখন যাকে ভালোবাসবে তখন তার প্রতি একনিষ্ঠ হবে, আঁদ্রের ভাষায় আত্মহারা হবে। একাধিকজনের সঙ্গেও অক্লেশে একনিষ্ঠ হওয়া যায়। ওই তো আমার এক বন্ধু ছিলেন লিয়োতে। সেখানে মাঝে মাঝে উইক-এন্ড করতে যেতুম। চমৎকার কথাবার্তা বলতে জানেন। বাড়িটিও সুন্দর। প্যারিসে প্রতি বৃহস্পতিবারে আমার ফ্ল্যাটে আসতেন আরেক বন্ধু। উনি বিবাহিত। অন্য সময় সুযোগ। পেতেন না। তা ছাড়া চাকরির উন্নতির জন্য অফিসের এক বৃদ্ধ কর্তার সঙ্গে তাঁর মোটরে মাঝে মাঝে বেরুতে হত। তিনি আবার ভয়ানক ভীতু। যদি কেউ দেখে ফেলে! তাই রাত্রে মোটরে করে শহর থেকে দূরে যেতে হয় তাঁর সঙ্গে। এদের প্রত্যেককে যদি একনিষ্ঠভাবে না ভালোবাসি তবে ওই যে বললুম পুরুষ মাত্রই শত্রু– সে শত্রু ধরে ফেলবে না আমার ভারসেটাইলিটি– বহুমুখী প্রতিভা? শুনেছি, এবং বিশ্বস্তসূত্রেই, যে রসরাজ কবি, যোদ্ধা, ঔপন্যাসিক, শাসনকর্তা দাদৃজিয়ে একসঙ্গে একগণ্ডা সুন্দরীর সঙ্গে একনিষ্ঠ প্রেমের উচ্চাঙ্গ সাধনা করেছেন, তিনি একই সময়ে চারজনকে যে চার সিরিজ প্রেমপত্র লিখেছেন, তার প্রত্যেকটি অতিশয় অরিজিনাল মাধুর্যময় কবিত্বপূর্ণ কোনও সিরিজের সঙ্গে কোনও সিরিজের সাদৃশ্য নেই। প্রত্যেকটি বল্ল আপন সিরিজ পেয়ে ধন্য হয়েছেন।
তার পর আরেক তরুণীর দিকে তাকিয়ে বললেন, সুজান, তুমি এ লাইন ছেড়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেল। পল আর মার্সেল তোমাকে একই সময়ে ভালোবাসত; আর তুমি মাত্র দুটোকে সামলাতে পারলে না? হায়! প্যারিস কোথায় এসে পৌঁছচ্ছে? আর ডার্লিং সুজান, তুমি নাকি জানতেও না, পল্ আর মার্সেল উভয়েরই তখন আরেক প্রস্থ প্রিয়া ছিল!
স্যুজান তাজ্জব মেনে বলল, তাই নাকি। মঁ দিয়ো!
নানেৎ বলল, ডিভাইড অ্যান্ড রুল? দ্বিধা করে সিধা রাখ?
মাদাম বললেন, ও! তা কেন? মেনাজ্ আ ত্রোয় (menage a trois = management by three) যদিও এখন ফ্রান্সে একটু আউট অব ডেট– তবু তিনজনে মিলেমিশে থাকাটা তো ট্রায়েল পেতে পারে, কিন্তু সবসময়েই মনে রাখতে হবে শান্তিভঙ্গ যেন না হয়, নো স্ক্যান্ডাল, প্লিজ! আর ডুয়েল, খুন, আত্মহত্যা এগুলো তো বর্বরতার চরম ভুল বললুম, বর্বরদের ভিতর এসব অপ্রিয় ঘটনা প্রায় কখনওই ঘটে না। এগুলো ঘটলে মনের অশান্তি খানিকটে হয় বটে, কিন্তু তার চেয়ে মারাত্মক বদনাম ছড়ায় ভবিষ্যতের বিয়ের বাজারে। অবশ্য এমন কোনও বদনাম নেই যেটা আস্তে আস্তে মুছে ফেলা যায় না। এবং কোনও কোনও স্থলে একাধিক পুরুষ আকৃষ্ট হয় ফাম্ ফাতা (fatal woman) বিপজ্জনক রমণীর প্রতি।
ইনি তাদেরই একজন কি না সেটা জানবার কৌতূহল আমার পক্ষে স্বাভাবিক।
ইতোমধ্যে তার কন্যা শেষ হয়ে গিয়েছে দেখে গুটিতিনেক তরুণী একসঙ্গে ওয়েটারকে ডাকল। যুবতী রাজ-রাজেশ্বরীর মতো বাঁ হাতখানা দিয়ে যেন বাতাসের একাংশ দু টুকরো করে অসম্মতি জানালেন, বললেন, সুইট অব ইউ, কিন্তু জানো তো আমার সোনার খনিতে এখন ডবল শিফটে কাজ চলছে। দ্বিতীয় শিফটটায় আমি অবশ্য অনেকখানি সাহায্য করি। এমনিতেই আমি একগাদা টাকার কুমিরকে চিনতুম, এখন আমার মারি (স্বামী) প্রতি রাত্রেই দু-একটি নয়া নয়া বাঘ-ভালুক শিকার করছেন আমাকে তাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে।–তোমরা বরঞ্চ শ্যামপেন খাও।
তরুণীদের একাধিকজন আনমনা হয়ে ভাবল, তাদের জীবনে এ সুদিন আসবে কবে?
হঠাৎ যেন বিজয়িনীর একটি গভীর তত্ত্বকথা মনে পড়ল। গম্ভীর হয়ে বললেন, কিন্তু, যাদুরা, একটি কথা মনের ভিতর ভালো করে গেঁথে নিয়ো। ব্লুম এটা বলেননি। সর্বপ্রেমের চরম গতি যখন পতিলাভ তখন সে-পথে নামবার আগে একটি মোক্ষম তত্ত্ব ভুললে চলবে না। ব্লুম বলেছেন, প্রথম ইদিক-উদিক প্রেম এবং ফ্যাকটুস অব্ লাইফ সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার পর, ইংরেজিতে পুরুষের বেলা যাকে বলা হয় বুনো ভুট্টা বপন সেইটে হয়ে গেলে পর বিয়ে করবে। তা হলে একে অন্যের প্রতি সহিষ্ণুতা হবে অনেক বেশি, একে অন্যকে সাহায্য করতে পারবে অনেক বেশি দাম্পত্যজীবন তাই হবে দীর্ঘকালব্যাপী ও মধুর। ব্লুমের উদ্দেশ্য অতিশয় মহৎ এ-বিষয়ে কেউ সন্দেহ করবে না। অমি তো নিশ্চয়ই করব না, কারণ তিনি অতিশয় নীতিবাগীশ
কোরাস উঠল তাবৎ তরুণী কণ্ঠে, কী বললেন, মাদাম?
কণামাত্র বিচলিত না হয়ে মহিলাটি ধীরেসুস্থে আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করে বললেন, কট্টর নীতিবাগীশ, ধর্মভীরু, আচারনিষ্ঠ এবং ছিন্নভিন্ন উদ্দেশ্যহীন ফরাসিসমাজকে নৈতিক দৃঢ়ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ব্যগ্র। তিনি ইহুদি, এবং অনেকেই যেরকম তার ইহুদি-ভ্রাতা ফ্রয়েটকে ভুল বোঝে, এর বেলাও তাই হয়েছে। আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি এবং জানি, তিনি নীতি, মরালিটিতে অতিশয় আস্থাবান। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন, প্রাচীন নীতি পরিবর্তন করে বরং বলব সেটা পরিপূর্ণভাবে কার্যকরী ও কল্যাণময়ী করে সম্পূর্ণতর করে তোলবার জন্য নবীন নীতির প্রয়োজন। তিনি সেইটে প্রবর্তন করতে চান। কিন্তু এই নবীন নীতি প্রবর্তন করতে পারি শুধু আমরা ফরাসিরাই। যেরকম আমরাই সর্বপ্রথম ফরাসিবিদ্রোহ করে সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা প্রবর্তন করি। ইউরোপের অন্যান্য দেশ, এমনকি জর্মনিরও লাগবে এ নীতি গ্রহণ করতে অন্তত একশো বছর। তারা তো এখনও গণতন্ত্রটাই রপ্ত করতে পারেনি। আর যেসব দেশ ধর্ম উৎপাদন করেছে যেমন প্যালেস্টাইন, আরবদেশ, ইন্ডিয়া, এরা এ নীতি কখনও গ্রহণ করতে পারবে না, আর যদি করে তবে তাদের সর্বনাশ হবে।