তবে ইউরোপের মেয়েরা যুগ যুগ ধরে প্রেমের মারফতে বিয়ে করেছে বলে অনেক কিছু জানে, এবং আর পাঁচজন বিচক্ষণ বান্ধবীদের কাছ থেকে উপদেশও পায়।
এদেশের তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে আমার যোগসূত্র নেই। তবে আমার সবসময়েই মনে হয়েছে আমাদের মেয়েরা বড় অসহায়।
***
সিরিয়স প্রবন্ধ লিখব বলে আমার আদৌ ইচ্ছা ছিল না। আমি প্রণয়, বিবাহ, লাভ ফর লাভ সেক্ ইত্যাদি সম্বন্ধে ফরাসিদের দু-একটি মতামত লিখতে যাচ্ছিলুম মাত্র। এ বাবদে ফরাসিদের অধিকারই যে সবচেয়ে বেশি, সেকথা বিশ্বজন মেনে নিয়েছে। লোকে বলে অবাধ অবৈধ প্রেম নাকি ওই দেশেই সবচেয়ে বেশি। আমি কিছু বলতে নারাজ, তবে একটা কথা জানি। ডিভোর্স বা লগ্নচ্ছেদ ফরাসিরা নেকনজরে দেখে না। পারিবারিক শান্তি ও শিশুদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তারা বড়ই সচেতন। স্বামী-স্ত্রী দুজনাই কিঞ্চিৎ অসংযমী হলে ফরাসি সমাজ সয়ে নেয়, কিন্তু তারা একে অন্যকে ডিভোর্স করতে চাইলে সমাজ অসন্তুষ্ট হয়।
ইউরোপের উন্নত দেশগুলো যে স্থলে গিয়ে পৌঁছেছে আমরাও একদিন সেখানে গিয়ে পৌঁছব, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। (অবশ্য তার অর্থ এ নয় যে, আমি ইউরোপের প্রেম তথা বিবাহ পদ্ধতির নিন্দা করছি। বস্তুত বাইরের অন্য সভ্যতা অন্য ঐতিহ্যের মানুষ হয়ে আমার পক্ষে ইউরোপীয় সভ্যতা বিচার করতে যাওয়াটা খুব যুক্তিসঙ্গত নয়। যারা আমার চেয়ে বহু ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃত সত্য দেখতে পান তারাই বোধহয় অনাসক্তভাবে আপন দেশ ও বিদেশ সম্বন্ধে মতামত প্রকাশ করবার অধিকার ধরেন)। এদেশের ঐতিহ্য তাকে প্রেম বিবাহ প্রভৃতি ব্যাপারে অন্য প্যাটার্ন বানাতে শেখাবে- এই আমার বিশ্বাস।
***
যে ফরাসি যুবতী কয়েকটি তরুণীকে হাসিঠাট্টার ভিতর দিয়ে সদুপদেশ দিচ্ছিলেন তার কথাগুলো শুনে আমি আমোদ অনুভব করছিলুম। তরুণীদের ভাবভঙ্গি-কথাবার্তা থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল তারা যুবতীটিকে প্রেমের ভুবনে রীতিমতো সাকসেসফুল বা বিজয়িনী বলে মনে করছিলেন। তিনি খাচ্ছিলেন কন্যা ও চেসার, অতি ধীরে মন্থরে। অর্থাৎ সামান্য কয়েক ফোঁটা কন্যা পান করে সঙ্গে সঙ্গে অন্য গেলাস থেকে এক ঢোক জল। এই জল কন্যাককে chase করে নিয়ে যায় বলে একে বলে চেসার। যুবতীটি যে পান বাবদে শুধু সমঝদার তাই নয়, আমার মনে হল তিনি এ বাবদে পরিপূর্ণ আত্মকর্তৃত্বও বজায় রাখেন।
লম্বা হোল্ডারে সিগারেট ধরিয়ে ঊর্ধ্বপানে ধুয়োর একসারি চক্কর চালান করে বললেন, লেয়ো ব্লুমের কেতাবখানা মন দিয়ে পড়। বিবাহ সম্বন্ধে তিনি অনেক খাঁটি কথা বলেছেন। রুম একদা ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং তিনি তার বইয়ে বলেন, প্রেম, যৌনজীবন সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ যুবক-যুবতীর বিবাহ সাধারণত তাদের জীবনে দীর্ঘকালব্যাপী দাম্পত্য সুখশান্তি দিতে পারে না। উচিত, উভয় পক্ষেরই এ-সব বিষয়ে কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার পর বিয়ে করা। বলা বাহুল্য, এ বই প্রকাশিত হলে ইংলন্ডের অনেকেই এটাকে শকিং গর্হিত বলে নিন্দা করেছিলেন।
সুন্দরীটি ব্লুমের মূল বক্তব্য প্রাঞ্জল ভাষায় পেশ করে বললেন, দেখ, আমি নিজে বিশ্বাস করি, নারী-পুরুষ দুই যুযুধান শক্তি, একে অন্যের শত্রু
একটি তরুণী কফির ঢোক গিলতে গিয়ে মারাত্মক বিষম খেয়ে বলল, আপনি এ কী কথা বলছেন! কবি দুর্গা এখনও আপনার কথা ভুলতে পারেননি– আপনি তাকে বিদায় দেওয়ার পরও। এখনও তার মুখে ওই এক মন্ত্র : আপনার মতো প্রাণ-মন, সর্বহৃদয়, সর্বস্ব দিয়ে এরকম আত্মহারা হয়ে কেউ কখনও ভালোবাসতে পারেনি।
যুবতী স্মিত হাস্যভরা চোখে তরুণীর দিকে তাকিয়ে বললেন, বেচারি আঁদ্রে! তোমার এখনও অনেক-কিছু শেখবার বাকি আছে। আমি আর্টিস্ট। আমি যা-ই করি না কেন, সেটাকে পরিপূর্ণতার চরমে পৌঁছিয়ে দিয়ে করি। যখনই ভালোবেসেছি, আত্মহারা হয়েই ভালোবেসেছি। কিন্তু, ডার্লিং, ইহুদিও কি তার ব্যবসা আহার নিদ্রা ত্যাগ করে আত্মহারা হয়ে ভালোবাসে না? তাই বলে সে কি তার মুনাফার কথা ভুলে যায়। যে ব্যবসাকে সে আপন প্রিয়ার চেয়েও বেশি ভালোবাসে তাকে সে অকাতরে বিসর্জন দেয় না, যদি দেখে সেটা দেউলে হয়ে যাওয়ার উপক্রম।
তাই বলছিলুম, পুরুষ রমণীর শত্রু। যে কোনও পুরুষ আমাকে আত্মহারা হয়ে ভালোবাসলেও একদিন সে আমাকে অকাতরে বিসর্জন দিতে পারে আমি যে রকম সিয়ো দুর্গাকে দিয়েছিলুম। অবশ্য আমি স্যাডিস্ট নই, তাই তাকে ড্রপ করার সময় যতদূর সম্ভব মোলায়েমভাবে সেটা সম্পাদন করি– তদুপরি বলা তো যায় না, কখন কাকে আবার প্রয়োজন হয়।
আরেকটি তরুণী বলল, কিন্তু দান্তে–?
মাদাম বললেন, ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি– যদিও ওঁর কাব্য আমার প্রেমপত্রে কাজে লেগেছে। ওই ধরনের মানুষ আমি দেখিনি। তবে এইটুকু বলতে পারি, যারা কারও বিরহে বা মৃত্যুতে দীর্ঘদিন ধরে আপসা-আপসি করে সেটা শুধু তাদের আত্মম্ভরিতা। নিজের কাছে স্বীকার করতে চায় না যে, এইবারে তার অন্য ব্যবসা ফাঁদা উচিত। মনস্তত্ত্বে ওদের বলা হয় ম্যাজোকিস্ট নিজেকে নিজে কষ্ট দিয়ে সুখ পায়। ওই যে রকম অনেক সর্বত্যাগী অনাহারে থেকে সুখ পান! তোমার-আমার স্বাস্থ্য আছে, ক্ষুধা আছে, আমরা নর্মে। খাদ্য যখন রয়েছে তখন উপোস করব কোন্ দুঃখে?