অবশ্য পাঠক বলতে পারেন এ ধরনের ঘটনা সাতিশয় বিরল।
সাতিশয় বিরলই যদি হবে তবে আমাদের কবিগুরু ওই ধরনের উদাহরণই জাতক থেকে। নেবেন কেন?
–বালক কিশোর,
উত্তীয় তাহার নাম, ব্যর্থ প্রেমে মোর
উন্মত্ত অধীর। সে আমার অনুনয়ে
তব চুরি-অপবাদ নিজস্কন্ধে লয়ে
দিয়েছে আপন প্রাণ।
এবং যেন এ কবিতাতেই প্রোপাগান্ডা কর্ম নিঃশেষ হল না বলে কবি বৃদ্ধ বয়সে ওই বিষয় নিয়ে আরও মনোরঞ্জক, আরও চিত্তচাঞ্চল্যকর গীতি নৃত্য-নাট্য শ্যামা রচনা করলেন।
এস্থলে উল্লেখ করা প্রয়োজন বোধ করি যে, আমার যতদূর মনে পড়ছে মূল জাতকে গল্পটি একটু অন্যরকমের। আমার স্মৃতিশক্তি হয়তো আমাকে ঠকাচ্ছে, কিন্তু আমার যেন মনে পড়ছে, উত্তীয়কে কোনওকিছু না বলেই তাকে শ্যামা নগরপালের কাছে পাঠায়। তাকে আগের থেকেই শ্যামা বলে রেখেছিল, কিংবা উত্তীয়েরই হাত দিয়ে চিঠি লিখে তাকে জানায়, পত্রবাহককে শূলে চড়াও; বজ্রসেনকে মুক্তি দাও। এবং বোধহয় ঘুষের টাকাও কিছু ছিল, আর সেটাও উত্তীয় তার আপন ভাণ্ডার থেকেই দিয়েছিল তাবৎ ঘটনার কোনওকিছুই না জেনেশুনেই। আবার মাফ চাইছি, ভুল হতে পারে, শ্যামা বোধহয় উত্তীয়কে বলে তুমি এই চিঠি ও অর্থ– সেটা শ্যামার কিংবা উত্তীয়ের নগরপালকে দিয়ে এলে আমি একান্ত তোমারই হব।
পাঠক স্বপ্নেও ভাববেন না, আমি শ্যামা বা পুষ্পবিলাসিনীর কার্যকলাপ সম্মতির চোখে দেখছি। আধুনিকাঁদের অধঃপাতগমনের অহেতুক অভিযোগ কানে এলে আমার এসব দৃষ্টান্ত মনে আসে, এই মাত্র।
তবে এ নিয়ে ভাববার আছে।
যে কালে মুরুব্বিরা মেয়ের বিয়ে ঠিক করে দিতেন, সে সময় ভিন্ন ভিন্ন পরিবারের মুরুব্বিদের ভিতর ভালো বর পাওয়ার জন্য যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হত না তা নয়। বস্তুত যে কনের সঙ্গে লোভনীয় বরের বিয়ের কথাবার্তা এগিয়ে গেছে তার বিরুদ্ধে নাকি উড়ো চিঠি পর্যন্ত যেত তৃতীয় কন্যাপক্ষ থেকে। আশ্চর্য হবার কিছু নেই। সংগ্রামে আবার নীতি কী! এবং কিছুমাত্র নতুন তত্ত্ব নয় যে, কুরু-পাণ্ডবরা কুরুক্ষেত্র সংগ্রামে যে নীতি অবলম্বন করেছিলেন সে নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু এ যুগে, বিশেষ করে কলকাতা এবং অন্যান্য বড় শহরে অনেক মেয়েকেই বাধ্য হয়ে বরের সন্ধানে বেরুতে হয়। এবং বররাও বেরোন কন্যার সন্ধানে। ফলে বিত্তশালী, রূপবতী বা উচ্চশিক্ষিতা যার যেমন অভিরুচি কনের জন্য ছোকরাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা লেগে যায়, এবং উল্টোটাও হয়। বোধহয় সুলেখক সুবোধ ঘোষের গল্পেই পড়েছি, তিনটি মেয়ে তিনটি ফুলের তোড়া নিয়ে পাল্লা দেয় এক শাসালো বরকে স্টেশনে সি-অফ করতে গিয়ে।
এসব বিয়ে যে দেখামাত্রই দুম্ করে স্থির হয় না সে কথা বলা বাহুল্য। কিঞ্চিৎ পূর্বরাগ, প্রেম বা প্রেমের অভিনয়ের প্রয়োজন হয়। কোনও কোনও স্থলে এটাকে কোর্টশিপও বলা হয়। আমাদের দেশে একদা গান্ধর্ব-বিবাহের প্রচলন ছিল। সে বিবাহ হত বিবাহের পূর্বেকার প্রণয়ের ভিত্তিতে।
কিন্তু এদেশে এখনও প্রণয়ের কোনও কোড় নির্মিত হয়নি, অর্থাৎ যুবক-যুবতীতে কতখানি প্রণয় হওয়ার পর ছেলে কিংবা মেয়ে আশা করতে পারে যে এবারে অন্য পক্ষ তাকে বিয়ে করতে প্রস্তুত, এবং তখন যদি সে হঠাৎ তাকে ত্যাগ করে অন্য কাউকে ভালোবাসতে আরম্ভ করে তবে সমাজে তার নিন্দা হয়। ইউরোপে মোটামুটি দুটো ধাপ আছে। দু-জনাতে প্রণয় হওয়ার ফলে যদি ছেলেটা মেয়েটিকে ফরাসিতে আমি, জর্মনে ফ্রয়েভিন (গার্লফ্রেন্ডের চেয়ে এটাকে ঘনিষ্ঠতর বলে ধরা হয়) বলে উল্লেখ করে তার তখনও মোটামুটি বিয়ের দায়িত্ব আসে না। এটা প্রথম ধাপ। কিন্তু ফরাসিতে ফিয়াসে– জর্মনে ওই একই শব্দ বা ফেরট ব্যবহৃত হয়– পর্যায়ে পৌঁছলে সেটাকে দ্বিতীয় ধাপ বলা হয়। এবং সে সময় যদি যুবক তাকে এনগেজমেন্ট আংটি দেয় (অর্থাৎ মেয়েটি তখন বাগদত্তা হল যদিও অর্থটা কিছু ভিন্ন) তবে সেটা বিয়ের প্রতিশ্রুতি বলেই ধরা হয়। তার পর সে বিয়ে করতে না চাইলে অনেক স্থলে মেয়েটি আদালতে প্রতিজ্ঞা বা চুক্তিভঙ্গের মোকদ্দমা করে খেসারতি চাইতে পারে। সমাজে বদনাম তো হয়ই। মহাভারতে রুক্মিণী বাগদত্তা ছিলেন বলে পরে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বিয়ে করলে শ্রীকৃষ্ণের শত্রুপক্ষ তাঁর নিন্দা করে।
এদেশে প্রণয়ের কোনও স্তরেই বোধহয় এরকম আংটি দেবার রেওয়াজ প্রচলিত হয়নি। তবে প্রণয় ঘনীভূত হওয়ার পর (কতটা ঘনীভূত এবং তার চিহ্ন কী, সেটা বলা কঠিন) যদি কোনও পক্ষ অকারণে রণে ভঙ্গ দেয়, তবে তার যে বদনাম হয় সেটা সুনিশ্চিত। ইউরোপেও যে মেয়ে অকারণে একাধিক প্রণয়ীকে পরপর ত্যাগ করে সে জিট এই বদনামটি পায়।
নিছক প্রেমের জন্য প্রেম বিয়ে করার উদ্দেশ্য কারওরই নেই– এটা বোধহয় এদেশে বিরল। ইউরোপে মোটেই বিরল নয়। ছাত্র, ছাত্রী, মেয়ে কেরানি, ছোকরা অ্যাসিসটেন্টের ভিতর এ-জাতীয় প্রেম আকছারই হয়। এ-জাতীয় প্রণয়ের ফলে যদি কোনও কুমারী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে যায় তবে কোনও কোনও স্থলে সে যুবকের বিরুদ্ধে খেসারতির মোকদ্দমা আনতে পারে। আমি যতদূর জানি, বিয়ে করতে বাধ্য করাতে পারে না–তবে রাশাতে বোধ হয় সন্তানটি অন্তত পিতার নামটা আইনত পায়, অর্থাৎ জারজরূপে ঘৃণার পাত্র হয় না। ইউরোপে যদি যুবা প্রমাণ করতে পারে যে, মেয়েটার একাধিক প্রণয়ী ছিল তবে তাকে বা অন্য কাউকে কোনও খেসারত দিতে হয় না। এক বলশেভিক আমাকে বলেন, এক্ষেত্রে রাশায় সব কজনাকে খেসারতি ভাগাভাগি করে দিতে হয়।